বৃত্ত

ক্যানসাস সিটি থেকে বেশ খানিকটা দূরে এই কলেজ টাউন ক্যানসাস-ম্যানহাটান । এটাকে আবার লিটল্ অ্যাপেলও বলা হয় । চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা এলাকাটা, লোকসংখ্যাও খুব একটা বেশি না । ডিসেম্বরের এই সময়টা ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়ে। তবে রাতে শুতে যাওয়ার আগে এটা অনুমান করা বেশ কঠিন যে পরের  সকাল’টা বরফের চাদরে মুড়ি দিয়ে থাকবে নাকি রোদ্দুরের ছটায় তার আলসেমি ভাঙবে।

কান্ট্রি ক্লাব রেস্টুরেন্টটা এরই মধ্যে সেজে উঠেছে উডেন স্নো-ফ্লেক্স, রেড হলি বেরিস্, আর বিভিন্ন রকম অর্কিডে। থ্যাংকস গিভিং পেরিয়েছে কিছুদিন আগেই, তবে ক্রিস্টমাসের জন্য এখনও হাতে কিছুটা সময় আছে । শরীরটা কিছুদিন হল ভালো যাচ্ছে না ব্রত’র । কিছুতেই ঘুম হচ্ছে না, সারারাত এপাশ ওপাশ করে অনেকটা দেরীতে ঘুমটা এলেও ভোর রাতে হঠাৎই ভেঙে যাচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। টেবিলে রাখা চকলেট কফিটা প্রায় শেষের দিকে, শেষ চুমুকটা দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। ব্যাংকের থেকে অ্যাকাউন্ট আপডেট এর মেসেজ, টাকা’টা ক্রেডিটেড। আরও কিছুটা উদাসীন হল ওর চোখ গুলো। গ্লাসডোরের বাইরে অন্ধকার নামছে, পার্কিং স্লটেও গাড়ির সংখ্যা কমছে। এভাবেই কি জীবনের অধ্যায় গুলোও একটা একটা করে কমে আসে, চাপা পড়ে যায় অতলে! উত্তর কলকাতার অলিগলি, দুপুরের চিলেকোঠা, ময়দানের বিকেল, প্রিন্সেপের সূর্যাস্ত, বাড়ি ফেরার ট্রামলাইন, চায়ের ঠেক, বাড়ির নোনা ধরা দেওয়াল গুলো আর কেমিস্ট্রি টিউশন’র মেঘলা! ব্রতর চোখের কোণ গুলোতে কান্ট্রি ক্লাবের ডিম আলোর প্রতিফলনটা স্পষ্ট, এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে নামবে। বাইরে তখন স্নো-ফল শুরু হল ।

হিলক্রেস্ট রোডের গায়ে বরফ জমতে শুরু করেছে, বরফ সরানোর কাজ শুরু হয়ে যাবে আর একটু পরেই । কান্ট্রি ক্লাব থেকে আজ সোজা বাড়ি ফিরেছে ব্রত, অন্যদিন টার্টল ক্রীকের লেকটাতে কিছুটা সময় কাটিয়ে বেশ রাত করেই ফেরে। এই পাঁচটা বছরের কত মনখারাপই তো  ফেলে এসেছে ওখানে । অবশ্য শুধু তাই না, স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ওর চাকরিটা যেদিন কনফার্ম হল, রিসার্চ পেপারটা যেদিন ছাপা হল, সেইসব আলোর দিনের আনন্দ গুলোও ভাগ করেছে ওই লেকের পাড়ে বসেই । অবশ্য উপায়ই বা কি ছিল, এই ইঁদুর দৌড়ের জীবনে বন্ধু বলতে তো এখানে সেরকম কেউ হয়নি । রূপাঞ্জন ছিল কিছুদিন তবে সেও এখন ওয়াশিংটনে, চাইলেই দেখা করা যায় না । যা কথা হয় ওই ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়ে গুলোর সাথেই। এই একটা ব্যাপার যদিও বেশ ভালো লাগে ওর, কত দেশের লোকজন এই ছোট্ট শহরটায় এসে রয়েছে, তাদের সংস্কৃতি, খাওয়াদাওয়া, উৎসব এ যেন এক বিশাল বৈচিত্র। তবে কারোর কাছেই মন খুলে যেন বুকের ভেতর জমে থাকা কথা গুলো বলা যায়না, কে জানে ওরা বুঝবে কি না, বা ও’ই হয়তো বোঝাতে পারবে না। মা মারা যাওয়ার পরে একদিন ও  নিজেই মানিকতলার বাড়িটা ছেড়ে, ভালোবাসার শহরটা ছেড়ে, চেনা মুখ গুলোকে ছেড়ে এই দেশটাতে চলে এসেছিল দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে । আরও বড় হতে হবে, আরও স্বপ্ন বুনতে হবে,  রিসার্চটা সফল হতেই হবে । আর এইসবের জন্য লাগবে ফোকাস আরও বেশি ফোকাস। তাই হয়তো সব পিছুটান ভুলে পড়াশুনা, রিসার্চ, পার্টটাইমের কাজ নিয়েই মেতে উঠলো । এইসবের ব্যস্ততার মাঝে মেঘলার সাথে সম্পর্কটাও কখন যেন রঙ হারিয়ে ফিকে হয়ে উঠেছিল কিছু বুঝে উঠবার আগেই । সেদিন হয়তো ওর এই বোধটা ছিল না, যা কিছু ও ভুলতে চেয়েছে, ফেলে রেখে এসেছে এক পৃথিবী দূরে, সেই সবটুকুই একে একে  ফিরে আসবে কোনো এক নিঃসঙ্গ দিনে।

ব্যাংকের মেসেজটা আসার পর থেকেই খুব অস্থির হয়ে উঠেছে  ব্রত, ড্রাইভ করার সময়ও বার বার খেই হারাচ্ছিলো। কলকাতার বুকে ওই বাড়িটাই বোধহয় ওই শহরে ওর অদৃশ্য উপস্থিতিটা ধরে রেখেছিলো । আজ তা’ও বিক্রি হয়ে গেল। এতটা নিঃসঙ্গ আগে কখনো লাগেনি। স্বপ্নপূরণের সব প্রাপ্তিটুকু নিয়েও আজ যেন বড় নিঃস্ব লাগছে ওর । হয়তো চেষ্টা করলে ও ফিরতে পারতো, বাড়িটা ধরে রাখতে পারতো, হয়তো! আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ব্রত’র, ইচ্ছে করছে সবকিছু ফেলে ফিরে যেতে, নতুন ভাবে কলকাতায় গিয়ে  কিছু শুরু করতে। ইচ্ছে করছে আবার কলেজস্কয়ারে গিয়ে আড্ডা মারতে, ইডেনে একটা ম্যাচ দেখতে। ইচ্ছে করছে আবার কাকভেজা সারা বিকেল ভিক্টোরিয়ার সামনে মেঘলা’র জন্য অপেক্ষা করতে । ইচ্ছে করছে…

রাত নামছে। ব্লু মন্ট এভিনিউর যে’কটা জানালা তে এখনও আলো আছে, সেগুলোও  নিভে আসবে একে একে । তারপর রাত যখন আরও গভীর, ওই সামনের  এপার্টমেন্টের কোনো একটা রুমে একটা আস্ত কলকাতা জেগে উঠবে । একটা হলুদ ট্যাক্সি, ট্রাম লাইন, কফি হাউস…

* * * * * * * * *

-একটা চা ।

বলেই ব্যাগটা সামনের বেঞ্চিটাতে রাখলো দীপ। ঘড়িতে সকাল ন’টা। এবার হয়তো শশধর বাবু এসে পড়বেন। যদিও ইচ্ছে করেই ও কিছুটা আগে চলে এসেছে, পাছে দেরী হলে এই ঘরটাও হাতছাড়া হয়। কাল যে দুটো ঘর দেখেছিলো সেগুলো অবশ্য ও নিজেই ছেড়েছে। কলকাতা শহরে বাড়ির যা ভাড়া, পকেটের কথাও তো ভাবতে হয়। ওই এসে পড়েছেন শশধর বাবু । দীপ এগিয়ে গেল ।

ঘর না বলে রুম বলাই ভালো। দেওয়ালের মাঝে মাঝে রঙ উঠে গেছে, খসে পড়ছে পাপড়ি। তবুও এই রুমটাতে তাও থাকা যায় বাকি গুলোর অবস্থা আরও সঙীন । বাথরুমটা বাইরে বেরিয়ে। তবে মাস ছয়েকের বেশি থাকা যাবে না, তারপরই এখানে প্রোমোটিং এর কাজ শুরু হবে । যাইহোক ভাড়াটা অনেক কম, এই ছ’মাসের মধ্যে  গুছিয়ে নিতে পারবে দীপ, তা ও জানে। আর তা ছাড়া স্কলারশিপটা   কনফার্ম হয়ে গেলে তো আর তো কয়েকটা দিন, তারপর স্বপ্নের উড়ান । নতুন দেশ, নতুন শহর, নতুন সবকিছুই। অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের টাকার থেকে কিছুটা তখন বাড়িতেও  পাঠাতে পারবে । বাবাকে আর রোজ দোকানে বসতে  হবে না, মায়ের ট্রিটমেন্ট এর জন্য সবসময় জ্যেঠুদের কাছে হাত পাততে হবে না, বোনেরও পড়াশুনাটাও চালিয়ে যেতে পারবে । আপাতত এই সস্তার রুমটাই ওর জন্য পারফেক্ট ।

সব কাজ সেরে খাওয়া দাওয়া শেষ হতে বিকেল হয়ে গেল ।পড়ন্ত রোদ্দুর এসে মিশেছে জানালার  গরাদে। জানালার আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালো দীপ, এখান থেকে মোড়ের মাথা’টা দেখা যায়। কত গাড়ি, কত মানুষ, কত শব্দ তোলপাড় করে চলেছে। ভারী ভালো লাগে ওর এই শহরটা । কাজে অকাজে এরই মধ্যে বহুবার যাতায়াতও হয়ে গেছে, আর এবার তো বেশ কিছুদিন থাকা । জানালার পাল্লাটা ভালো করে দেখলো, কাঠের গায়েও সেই এক শব্দগুলো। আজ সারা ঘর ঝাড়পোছ করতে গিয়ে এই একই লেখা ও সারা রুম জুড়ে খুঁজে পেয়েছে । দরজার হাতল, দেওয়ালের কোণ, বইয়ের তাক, ভাঙা তক্তা, আর এখন এই জানালার পাল্লা, সব জায়গায় চিহ্ন ছেড়ে গেছে । হাতের লেখাটা কোথাও বেশ কাঁপা কাঁপা, কোথাও পরিণত । “ব্রত – দ্য ড্রিম মেকার “।

* * * * * * * *

শীত ফুরিয়ে আসছে, কচিপাতা উঠছে ডালে ডালে, বসন্ত আসন্ন। প্রতিদিন স্বপ্নের ভাঙা গড়ার খেলা গুলো পেরিয়েও শহরটা কিন্তু দিব্যি আছে, ময়দানের আড্ডা গুলো আছে, নিউ মার্কেটের দর কষাকষি আছে, ক্রিস্টমাসের পার্কস্ট্রিট আছে, ভালোবাসার বইপাড়া আছে, ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছেরা যেমন আছে তেমনই আছে ফিরে আসার পিছুটান। আজ না হয় কাল ফিরে তো  আসতেই  হয়, ফিরে তো  আসতেই  হবে, এ শহর যে রূপকথার, এ শহর যে  পিছুডাকে ।

তারিখঃ জানুয়ারি ১০, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse