মন ভাসির টানে

 

মানুষ নামের মদে আমার বড় তৃষ্ণা। আকন্ঠ পান করে আমি নেশা করেছি। তারপর নেশা গেছে কিন্তু খোয়ারি কাটে না। তখন গড়াগড়ি যাই ধুলায়। তবু শক্তি পাই নে। অসহায় হয়ে বলি, আমার মুক্তি কোথায়? আমার আলোর মুক্তি, অশেষের মুক্তি? তখন আমি পেয়েছি অকূল নীলাম্বুধির ডাক। স্বপ্নে দেখেছি তার দূর দিগন্তছোঁয়া আকাশের হাতছানি। তার ফেনিলোচ্ছল অট্টহাসে কেঁপেছে সেই ঘেরাটোপ। ভেঙে পড়েছে তার করাঘাতে। তাই চলেছি বাইরে।” -কালকূট

কখনও মানুষের টানে, কখনও প্রকৃতির মায়ায়, কখনও বা ফেনিল সমুদ্রের হাতছানিতে, আমার, ঘরের বন্ধন কেটে বেরিয়ে পড়া। কাছে-দূরে, পর্বতে-সমুদ্রে, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়েও মন টেনে নেয় সেইসব মানুষদের সান্নিধ্য, যারা জীবন নদীর জোয়ার-ভাঁটায় অবিরাম ভেসে চলেছে। মানুষের জীবনের জটিলতা ভাবায় বই কি? এই ভাবনাই আমার যাপন, আমার আশ্রয়। ভ্রমণের অভিপ্রায়ে বেরিয়ে এমন মানবজীবনের ছোট ছোট ঘটনার সামিল হতে পারাও তো আরও এক অভিজ্ঞতা। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলির এক ছোট্ট মালা গাঁথার প্রচেষ্টায় আমার এই নিবেদন।

সেবারে, গরমের ছুটিতে কালকা মেলে চেপে, চলেছি কালকা। ইচ্ছে আছে, টয় ট্রেনে সিমলা পৌঁছনোর। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়ার পরে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে, রাত্রের খাওয়ার সেরে নিলাম। আমার সিটের উল্টোদিকে বসেছিলেন বাবা,মা ও তাদের ছোট একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স হয়ত বছর সাত আটেকের মত ছিল। লম্বা চুলগুলি টেনে বেঁধে মাথার পিছনে একটি বেনী করা। ভারী ফুটফুটে চেহারা মেয়েটির। কিন্তু দেখে আশ্চর্য হচ্ছিলাম, পরিবারের সবাই কেমন এক বিষণ্ণতার ভারে যেন ক্লান্ত। বাবা, মায়ের মুখ থমথমে। বাচ্চাটি ক্ষনিকের জন্য উৎফুল্ল হওয়ার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু আবার পর মুহূর্তেই কাঁচের জানলার বাইরে, চলমান বহির্জগতে, কোথায় যেন তার মন হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন সফরে আমার ঘুম হয় না একেবারেই। ঘোরার মোটামুটি একটা প্ল্যান বানিয়েই রেখেছিলাম। সেগুলোই মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। ছিটকুলে আবহাওয়া ভালো থাকলে, একদিন থাকা যায় কিনা কিংবা রোটাং পাসে যাওয়ার পারমিট পাব কিনা ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে সারারাত জেগে কাটানোর পর, ভোরবেলায় চোখটা মনে হয় একটু লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ, ট্রেনের ব্রেক কষার আওয়াজে ঘুমটা গেল ভেঙে। চোখ মেলতেই দেখি, বাচ্চা মেয়েটি মিডল বার্থে শুয়ে, আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার সঙ্গে হাসি বিনিময় করতে, শুরু হল গল্প। তার নিতান্ত বোরিং ট্রেন সফরে, তার কথা শোনানোর মত বন্ধু সে যেন কাউকে পেলো। সেই যে শুরু হল, ট্রেন কালকা স্টেশন পৌঁছনো পর্যন্ত, খাওয়া ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে সে গল্প আর থামলো না। কত যে তার প্রশ্ন! উত্তর একটা দিতেই হবে তার মত করে, নাহলে নিস্তার নেই। বাতানুকূল কোচের একঘেয়ে ট্রেন জার্নি তার সঙ্গতে ভালোই জমে উঠেছিল। তার নানা গল্পের মাঝে কয়েকটা গোপন কথাও সে বাবা মায়ের কান বাঁচিয়ে আমাকে বলে ফেলেছিল। কুলু,মানালি ঘুরিয়ে তাকে সিমলার একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে রেখে আসা হবে। তার বাবা এবং মা আইনী বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। বাবা মায়ের সঙ্গে এই হয়ত তার শেষ একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া। তখনই তার, মাঝেমধ্যেই, মনে মনে হারিয়ে যাওয়ার কারণটা বুঝলাম। ছোট মানুষ, এত গম্ভীর বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতেও পারছে না আবার ভুলে থাকতেও পারছে না। ট্রেন থেকে নেমে বিদায় নেওয়ার সময় আমার কানে কানে সে একটি কথা বলে গিয়েছিল,”আমি বড় হয়ে ঠিক, বাবা আর মাকে একসঙ্গে বিয়ে করব,তাহলে আমরা একসঙ্গে তিনজন থাকতে পারব। তুমি কিন্তু এই সিক্রেটটা কাউকে বলে দিও না!” কিচ্ছু বলতে পারিনি সেদিন সেই কথার উত্তরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানিয়েছিলাম। এই অলীক আশা নিয়েই যদি ও খুশী থাকে তবে থাক না, কি দরকার ওর রূপকথার জগৎ থেকে ওকে জোর করে সরিয়ে আনার? আসন্ন হিমাচল ভ্রমণের আনন্দটুকু সেদিন যেন নিমেষে বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল। জীবনে কতরকমভাবেই না অসহায় অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হয় মানুষকে। বাচ্চাটি,তার মা,বাবা প্রত্যেকেই পরিস্থিতির শিকার। রাত্রে ঘরের আলো নিভে গেলে, অন্ধকারে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে, মনে পড়ে সেই বাচ্চাটির কথা। ও কি এখনও হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে, মা বাবাকে বিয়ে করে একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন সযত্নে লালন করছে? জানি না, কার উদ্দেশ্যে হাতদুটি জড়ো করে, মনে মনে ওর হয়ে প্রার্থনা করি,

“স্বপন যদি মধুর এমন,

হোক না মিছে কল্পনা

জাগিও না আমায়, জাগিও না।”

একবার, পুজোর ছুটিতে গিয়েছিলাম চারধাম যাত্রায়। কেদারনাথ মন্দির দর্শন করে ফিরছি। বেলা প্রায় দেড়টা। কোন সেই সকালবেলায় দুটি পরোটা খেয়ে হাঁটা শুরু করেছিলাম। মাঝে নুন-চিনি-লেবুর শরবত ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি। আর যেন পা চলছিল না কোনোভাবেই। একটা অস্থায়ী খাওয়ার হোটেলে ঢুকে দেখলাম সেখানে উনুনে ভাত রান্না হচ্ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অতএব, কোণের একটা চেয়ার টেবিল দেখে বসে পড়লাম। খিদের সময় কাঠের জ্বালানীতে তৈরি, গরম ভাতের সুবাস এক স্বর্গীয় অনুভুতি এনে দেয়। মনে নানা চিন্তা-ভাবনার আনাগোনা। গালে হাত দিয়ে বসে, সামনের খাড়া পাহাড়ের কোলে বয়ে যাওয়া মন্দাকিনীর দিকে তাকিয়ে ভাবনার জাল বিস্তার করছি। ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল, একটা শোরগোলের আওয়াজে। হইহই করে সাদা শাড়ি পরিহিত আটজন বয়স্ক মহিলা ওই হোটেলে এসে উপস্থিত হলেন। আমি তো খুঁজি, মানুষের গল্প। তাই আলাপ করার তাগিদে ওঁদের ভিড়ে মিশে গেলাম। কথায় কথায় জানলাম,কেউ কারোর সম্পর্কে জা হন, তো কেউ ননদ বা কেউ বোন এইরকম। প্রত্যেকেরই প্রায় ষাটের ওপরে বয়স। সাংসারিক সমস্ত দায়দায়িত্ব কর্তব্য সেরে তাঁরা নিজেরাই দল বেঁধে ভারতভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। মহারাষ্ট্রের অজ গ্রামের আটজন ষাটোর্ধ্ব মহিলা নিজেদের ইচ্ছের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছেন, এমন ভাবনাই জীবনে নতুন উদ্যম দেয়। তাঁদের কাছে আজকের দিনের অতি প্রয়োজনীয় মোবাইল ফোনটিও নেই। যেন সবটুকু মোহমায়া কাটিয়ে, প্রকৃতির অনিশ্চয়তার মধ্যে পরম নিশ্চিন্তের সঙ্গে নিজেদের সমর্পণ করেছেন। বিদায়বেলায় তাঁদের একটিই অনুরোধ ছিল, তাঁদের একসঙ্গে একটি ছবি তুলে দিতে হবে ও সেই ছবিটি তাঁদের নাতনীর ইমেইলে পাঠিয়ে দিতে হবে। তথাস্তু জানিয়ে তাঁদের সে মনস্কামনা আমি পূর্ণ করেছিলাম। একটা ছোট্ট ডায়েরি বের করে দিয়েছিলেন ওঁদের মধ্যে একজন, যেখানে একটি নামের ফোন নম্বরের পাশে, একটি ইমেইল আইডিও ছিল। যাঁর ইমেইলে পাঠাতে বললেন, তাঁর নামটি শুধু বলে দিয়েছিলেন, কারণ কেউই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন না। এইরকমই এক কেরালার দলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সারাহানের ভীমাকালী মন্দিরে। সেই দল আবার বিদেশেও ঘুরে এসেছেন। ওই দলে, সবথেকে বয়স্ক মহিলার বয়স ছিল আশির ওপরে। জীবন তো সত্যিই কোনো পরিস্থিতিতেই থেমে থাকে না। আমরা শুধু থেমে যাওয়ার ভয় পেয়েই জীবন কাটিয়ে দিই। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু সদিচ্ছা আর সাহসটুকুই প্রয়োজন সেটি ভুলে যাই। ওঁরা, সারাজীবন, সংসারের সকলের মন জুগিয়ে, গাধার খাটুনি খেটে দিন অতিবাহিত করেছেন। আজ যখন সংসারে ছেলেমেয়ে সবাই যে যার মত করে প্রতিষ্ঠিত, তখন এঁরা এঁদের হারিয়ে যাওয়া সময়কে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন, কারোর বাধা আর কানেই তোলেননি। ওঁদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে রবি ঠাকুরের সেই গানখানি মনে পড়ছিল,

“চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন

রাখবে নীচে

এত বল নাই রে তোমার,

সইবে না সেই টান”

মানুষের মন বড় বিচিত্র বস্তু। ক্ষণে ক্ষণে তার প্রকৃতি বদল হয়। ঋতু পরিবর্তনের মত কখনও সেখানে গুমোট গরম, কখনও ঝড়ের তাণ্ডব, কখনও ঝমঝমিয়ে বর্ষা, কখনও বা বসন্তের হাওয়া। কাজের সূত্রে একবার পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে দিন কুড়ি থাকতে হয়েছিল। ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা খাওয়ার হোটেল কিছু ছিল না। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল গ্রামের এক গন্যমান্য ব্যক্তির বাগানবাড়িতে। সেখানে আমার দেখাশোনা করার জন্য ‘বারু’ নামের এক বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন। উনিই আমার জন্য রান্না করে দিতেন। সঙ্গে নিয়ে আসতেন ছোট্ট একটি মেয়েকে। সেই মেয়েটি ছিল বারুর প্রাণ। চোখে হারাতেন যেন মেয়েটিকে। প্রথম কয়েকদিন কাজের ব্যস্ততায় এঁদের দেখলেও আলাপ করার সুযোগ হয়নি। কাজের সূত্রে গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিচয় হতে থাকে। সেখান থেকে জানতে পারি, বারুর মেয়েকে, তার মা রাগ করে দু ঘা মেরেছিল, সেই রাগে বারু তার স্ত্রীকে গালে আঘাত করে ও বেকায়দায় লেগে তার স্ত্রী তৎক্ষণাৎ মারা যায়। ঘটনা যে সময়ের, সেইসময়ে ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর থানায় পৌঁছত না, সেকারণে সে আজও জেলের বাইরে। একই মানুষ দুটি বিভিন্ন স্বত্ত্বায় দুটি বিভিন্ন রূপে অবস্থান করছে। স্নেহপ্রবণ এক পিতা কিভাবে হন্তারক এক স্বামী হতে পারে এ বড় বিচিত্র জিজ্ঞাসা। পরে বারুর সঙ্গে পরিচয় হয়ে, লোকটির মত সহজ,সরল,স্নেহপ্রবণ এক মানুষ ছাড়া আর কিচ্ছু দেখতে পাইনি। ক্ষণিকের রাগ মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলিয়ে হিংস্র জানোয়ারে পরিণত করতে পারে। তবে সেই ঘটনার পর থেকে সে নাকি জীবনে আর কখনও রাগ দেখায়নি। মেয়েকে বুকে ধরে মানুষ করেছে। এখন মেয়ের মেয়েকেও একইভাবে আগলে রেখে বড় করে তুলছে। মনের গহীন, গভীর খাদে কি ভাবনার বসবাস, তা যদি আমরা নিজেও জানতে পারতাম। কি জানি, আজ সে নিজেও হয়ত অনুতাপের দীর্ঘশ্বাসে জর্জরিত! দিন শেষে, পরিশ্রান্ত শরীরে যখন ঘুমের ভারে তার চোখের পাতা বুজে আসে, তখন মনে মনে সেও হয়ত বলে,

“যদি পাপমনে করি অবিচার

কাহারো ’পরে,

আমার বিচার তুমি করো

তব আপন করে।”

ভালোবাসা এক অবলা প্রাণীও বোঝে। আন্তরিকতার উষ্ণ পরশ, মনের মলিনতা ও শরীরের ক্লান্তিকে সরিয়ে মনকে দেবাসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে। ঘাটশিলায় প্রথম যেবারে যাই, তখন ঐ অঞ্চলে, নিরাপত্তার কারণে, পর্যটকদের যাতায়াত অনেক কম ছিল। আর মে মাসের ওই গরমে তো যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, সেবারই প্রথম রাজ্যের বাইরে পা রাখা। ওই সময়ে রোদের তাপ থাকে তীব্র এবং সকাল দশটার পরে ঘরের বাইরে বেরোনো দায় হয়ে পড়ে। ঘাটশিলায় পৌঁছে একজন অটোচালককে ঠিক করা হয়েছিল স্থানীয় দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। বিকেলের দিকে ঘাটশিলা থেকে একটু দূরে ধারাগিরি নামে একটি ঝর্ণা দেখতে বেরিয়েছিলাম। অবশ্য ঝর্ণা বলতে যা বোঝায়, এটি তার কাছে নেহাতই শিশু। আর গরমের সময়, জল প্রায় ছিলই না। একটি সরু ধারা ওপর থেকে নিচে এসে মিশছিল, হাঁটু দৈর্ঘ্যের একটি ছোট জলাধারের সঙ্গে। ওই সময়ে পর্যটকের ভিড় না থাকার কারণে ঝর্ণায় যাওয়ার পথটি ছিল ঝোপ জঙ্গলে পরিপূর্ণ। স্থানীয় একটি বাচ্চা ছেলে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঝর্ণাটি ছিল গাছ গাছালির ছায়ায় আলো আঁধারীতে। ঝর্ণার সামনে একটা বড় পাথরের ওপর বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল বাকি পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে, আর আমি ও সেই ঝর্ণা মুখোমুখি বসে, সেই শান্তির ঘুমে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে তার পাহারায় বসে রয়েছি। কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম খেয়াল ছিল না। সম্বিৎ ফিরল বাচ্চা ছেলেটির ডাকে। অনেকক্ষন সে বাড়ির বাইরে এসেছে, এবারে সে ফিরতে চায়। ছোট্ট ছেলে, আমার কোমরের সমান উচ্চতা তার। ফেরার পথে কিছু বকশিশ দিতে, সে যে কি ভীষণ খুশী হল। বারবার নোটটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, আর আমার মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে। ফেরার পথে, সে আমার হাত ধরে তার বাড়ি নিয়ে গেল। কি সুন্দর মাটির বাড়ি। বাড়ির দেওয়ালে রং দিয়ে নকশা আঁকা। আর তার মধ্যে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো বসিয়ে কারুকাজ করা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে, দেখা গেল নিকোনো উঠোন। ভেতর বারান্দায় খেজুরপাতার চাটাই পেতে সে আমায় বসতে দিয়ে তার মাকে ডাকতে গেল। তার মায়ের সঙ্গে, দু চার কথা হওয়ার পরে, উনি বাড়ির ভেতরে গেলেন,আর সঙ্গে আনলেন এক গ্লাস শরবত। নুন,চিনি লেবুর শরবত তো আমি রোজই খাই কিন্তু এত মিষ্টি আর ঠান্ডা শরবত আমি আজ পর্যন্ত খাইনি। কোথাও একটা পড়েছিলাম, একই মশলা দিয়ে তো সকলেই রান্না করে, তাহলে স্বাদে এমন হেরফের হয় কেন? উত্তর ছিল, ভালোবাসার স্পর্শই খাওয়ারের স্বাদকে অমৃত বানিয়ে দেয়। সেই একগ্লাস শরবত আমাকে সেই পরশ দিয়েছিল, যাতে প্রবল গ্রীষ্মের দাবদাহে কিছুক্ষনের জন্যও জুড়িয়ে নেওয়া যায়। আমার চেনা শহুরে পরিবেশ ছেড়ে আমি কোনোদিন ওখানে দীর্ঘস্থায়ী বসবাস গড়ে তুলতে পারব না ঠিকই, কিন্তু ওই যে ক্ষনিকের ওই আপ্যায়ন তাই আমায় নিত্যদিনের ঘটে চলা সামাজিক কলুষতাকে ভুলতে সাহায্য করবে। ওঁদের থেকে বিদায় নেওয়ার সময়, কবি হেলাল হাফিজের লেখা, বিখ্যাত একটি কবিতার দুটি লাইন মনে এলো,

“কেউ বলেনি,ক্লান্ত পথিক,

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে

জিরিয়ে নিও…”

জীবনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতার অমৃত কলস, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে এই আশা রাখি। মনে ভাবি, ভারতের পথে প্রান্তরে নিছক বেদুইনের মত পিছুটানহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়ে, মানুষের জটিল মনস্তত্বের মানচিত্রে পথ করে নিয়ে, একদিন ঠিক পৌঁছে যাব অমৃত কলসের পূর্ণতায়। কিন্তু পূর্ণতা কি এক অলীক কল্পনা নয়? শূন্য মন নিয়ে নিশিদিন আমরা ছুটে চলি কিসের যেন এক প্রত্যাশায়। কিছুতেই যেন সাধ মেটে না। মনের এই অস্থির অবস্থার কথা মনে করে, তাই তো কবি বলেছেন, “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই নে।” সুতরাং সে অন্বেষণ বজায় রেখে আবারও কবির কথা ধার করেই বলি,

“পথ দিয়ে কে যায় গো চলে

ডাক দিয়ে সে যায়।

আমার ঘরে থাকাই দায়।।”

তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সা’দ জগলুল আববাস
সা’দ জগলুল আববাস
1 year ago

ক’টি ঘটনাযোগে রচিত চমৎকার একটি ভ্রমণ কাহিনী পড়লাম।

সুকন্যা
সুকন্যা
1 year ago

অনেক ধন্যবাদ জানবেন দাদা

Chanchal bag
Chanchal bag
1 year ago

অপূর্ব উপলব্ধি

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse