মানসপট

 

চন্দ্রা

“Hope to see you soon Mehjabeen”

ন্দ্রাও স্মিত হেসে বিদায় নিল Dr.Archie Steven এর কাছ থেকে। ডাউনটাউন এর একটা অভিজাত রেঁস্তোরাতে তিনদিন ধরে Biomedical Technology র ওপর বিখ্যাত সব গবেষকদের একটি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল চন্দ্রা মেহজাবিন, পোস্ট ডক ফেলো হিসেবে। আজকের বিষয়টির আয়োজক এবং কিনোট স্পীকার ছিলেন Dr. Archie Steven. মধ্যচল্লিশ, ছ’ফুটের কিছুটা বেশি উচ্চতা,আকর্ষনীয় ও প্রতিভাদীপ্ত দুটো চোখের অধিকারী Dr. Archie Steven এর মধ্যেই উল্লেখযোগ্য কিছু পেটেন্টের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন। নতুন কিছু সম্ভাবনার কথা আজ আলোচনায় উঠে এসেছিল প্রশ্নোত্তর পর্বে। রবীনও এসেছে, কিন্তু ওকে রয়ে যেতে হলো সাংগঠনিক কিছু কাজের জন্য।

রবীনের সাথে পরিচয় পি. এইচ. ডি প্রোগ্রামে, থিসিস প্রপোজালের বিষয়বস্তু নির্বাচনের শুরুর দিকে। একই ইউনিভার্সিটিতে রবীন রোবটিকস রিসার্চে আছে। আই. আই. টি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিউট থেকে ফুল রাইড মেরিট স্কলারশীপে পড়তে এসেছিল। ইউনিভার্সিটি আর ফেরত যেতে দেয়নি। কোনো এক রুপোলি মাহেন্দ্রক্ষণে রবীন আর চন্দ্রার ভবিষ্যত জুড়ে গিয়েছিল একটি বিনিসুতোয়।কাগজে কলমে বা দৃশ্যত: ওরা সংসার জীবন শুরু করেনি ঠিকই কিন্তু বোঝাবুঝির জায়গাটিতে ওরা পৌঁছে গেছে অনেক আগেই।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চন্দ্রা কিছুক্ষণ ক্লান্তিতে চোখ বুজে রইল। মায়ের ফোনের শব্দে সম্বিৎ ফিরল। ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে মার সাথে চন্দ্রার যৌথজীবন শুরু হয় বাবা চলে যাবার পর। ভাবুক স্বভাবের বাবার একটি গুন চন্দ্রার সহজাত। তা হলো, এই খটোমটো বিজ্ঞান বিষয়ের বাইরেও চন্দ্রার লেখালেখির একটা জগত আছে। গতবছর একটি উপন্যাস রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড পেয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মেইন স্ট্রিম লেখকদের মধ্যে দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার একজন লেখকের নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করে নেওয়া খুব সহজ না।

“কী রে সারাদিন কিছু খেয়েছিস? আয় তাড়াতাড়ি একসাথে খাব বলে অপেক্ষা করছি।”

মায়ের এই ডাক খুব কমই উপেক্ষা করতে পারে চন্দ্রা। আজও সব কাজ তো সামলেই নিল। বাড়ি ফেরা যাক। পার্কিং ফী দিয়ে মেইন রোডে উড়িয়ে দিল সাদা নিশান এস ইউ ভি।

                                       

রবীন

বাবা ছাড়া রবীনের তেমন কোনো পিছুটান নেই কলকাতায়। মা’র অন্তর্জলি যাত্রা তো সেই মাধ্যমিকের সময়টাতে। বাবা সারাটা জীবন বিপত্নীক থেকে গেলেন বলে বাহবা যেমন পেয়েছেন, তেমনটা সমালোচিতও হয়েছেন। কোনটা হলে ভালো হতো, রবীন তা হিসেব করেনি কখনও। কিন্তু, বাবা ওকে মায়ের অভাব কখনও অনুভব করতে দেননি, অন্তত: প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন। তবুও, জ্বরের রাতগুলোতে মা ঢুকে পড়তো চোখের জলে। গরমের দুপুরগুলোতে আমের আচার দেওয়ার কাল্পনিক সুগন্ধে ডুবে থাকত রবীন চুপ করে, একান্ত অনুভবে।

বাবাও আই আই টির গোল্ড মেডেলিস্ট। সারাটা জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়িয়েছেন মন দিয়ে। অ্যাডভান্স ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাথে বাবার জুড়ি মেলা ভার। আজ পর্যন্ত ওর যা কিছু অধীত, সব কিছুতেই বাবার একাগ্র প্রচেষ্টা এই বয়সেই ওকে একজন সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী করে তুলেছে। রিসার্চের কাজে ডুবে থাকা এক রকমের অ্যাডিকশন ওর। নেশাটা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে চন্দ্রার কারনে। নিস্তরঙ্গ একাকী জীবনে বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ চন্দ্রা এবং বাবা। ছুটির দিনে বাবার সাথে নানা বিষয়ে গল্পের অপেক্ষা থাকে, তর্ক বিতর্কও জমে যায় বেশুমার।

গতমাসে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল ল্যাব থেকে বের হতে। কাজ শেষে এলিভেটরের স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই মোবাইল বেজে উঠলো। Dr. Archie Steven নাম Caller ID তে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল। ছ’মাস আগে একটি কনফারেন্সে দেখা, তখন একটা আভাস দিয়ে রেখেছিলেন যে একটা breakthrough রিসার্চে রবীনকে দরকার হতে পারে। নিউরোসাইন্সের গুরু বলা হয় Dr. Steven কে। কথা শেষ করে অনেকটা অভিভূত এবং একই সাথে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল ওর।প্রথমত: এমন একজন বিজ্ঞানীর সহযোগী হিসেবে গবেষণায় অংশগ্রহণ করতে পারা সৌভাগ্য, দ্বিতীয়ত: গবেষণার বিষয়বস্তু অভিনব “Mind To Mind Communication”.

The Realm

হরের উপকন্ঠে গড়ে উঠেছে একটি জনপদ। প্রায় পাঁচশো লোকের বসবাস। প্রতিদিনই নতুন অধিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। এই শহরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নিত্য নতুন কর্মসংস্হানের আয়োজন, প্রতিটি বাড়িকে Free Furnishings, স্বল্প খরচে বসবাসের আয়োজন ইত্যাদি কোনোকিছুরই কার্পণ্য নেই নগর অধিকর্তার। ছবির মতো এই শহর যেন এক স্বপ্নরাজ্য। মূল শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে Dr Steven এর গবেষণা কেন্দ্র একটু একটু করে শেষ পর্যায়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। আপাতত: খরগোশের ওপর চলছে নিরীক্ষণ। ওদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে একটি Chip যা পরস্পরের সাথে একটি যোগাযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, এদের ব্যবহারে অনেক স্হিরতা এসেছে, চাঞ্চল্য কমেছে। আরো কিছুদিন এদেরকে পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে মানুষের ওপর রোপন করা হবে এই বিস্ময়কর প্রযুক্তি।

আজ চন্দ্রা আসবে। লেকের পাশে একটা সুন্দর দোতলা বাড়িতে ওদের থাকবার ব্যবস্হা হয়েছে। Dr. Steven এর ইচ্ছে চন্দ্রাও এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করুক। বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রিতে ওরও ঐতিহাসিক অবদান থাকতে পারে। তবে, আপাতত: কিছুদিন থাকতেই আসছে, ভালো লাগলে চন্দ্রা হয়তো এখানে রয়ে যাবে। একটি নতুন উপন্যাসেরও কাজ চলছে। মাঝে মাঝে রবীন গবেষণার বিষয়বস্তুটি নিয়ে যে কিছুটা দ্বিধান্বিত নয় তা অস্বীকার করতে পারবে না, কিন্তু উন্নততর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে আসন্ন সম্ভাবনাকে খারিজ করে দিতেও পারছেনা। কৌতূহলী মন তাই অপেক্ষায় আছে চূড়ান্ত সময়ের জন্য।

দোতলার ব্যালকনিতে এসব সাত পাঁচ ভাবছে যখন, গাড়ির হর্ণের আওয়াজে রবীনের মগ্নতা ভাঙল। সাদা ক্যাপ্রি আর কুসুম কুসুম হলদে রঙা টপস এ চন্দ্রাকে ভারি স্নিগ্ধ লাগছে। বহুদিন পর বাড়ির সব আনাচে কানাচে দেখা হওয়ার কোমল উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। বিছানা বালিশের আদরে মাখামাখি হয়ে চন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে বেলাশেষের হলুদ জবার মতো। রবীন আরও একবার অনুভব করে, চন্দ্রা ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ।

 

অন্তরালের মুহূর্তরা

মকে উঠল রবীন, কতক্ষণ ধরে চন্দ্রা ডেকে চলেছে খেয়ালই করেনি। এক সপ্তাহ হলো রবীনের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে সেই অত্যাশ্চর্য কৃত্রিম ইন্দ্রিয়, যাকে আশ্রয় করে রবীন শুনতে পারে আরেকটি মনের কথা, কখনও একের অধিক। আজ রেঁস্তোরাতে ডিনার করতে এসেছে ও আর চন্দ্রা। পাশের টেবিলে দুজন দম্পত্তি ভালোবেসে গলে গলে পড়ছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই, চোখে চোখে কথা দুজনের। রবীন বুঝতে পারে, এরাও সাথে নিয়ে ঘুরছে সেই একই জিনিস, মনে মনেই এদের কথা চলছে। ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিতে এলো ব্যাজার মুখে। রবীন টের পাচ্ছে ওয়েটারের মনে অশান্তি চলছে, পঁচিশ বছর পর বাবা মার ডিভোর্স। হঠাৎ করে এও শুনলো রবীন, কে যেন তার প্রিয় বন্ধুকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে কেননা, সে প্রেম করছে তারই প্রেমিকার সাথে। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পেলনা। রবীন এতটাই মশগুল ছিল যে, এত কথার মিছিলে চন্দ্রাকে হারিয়েই ফেলেছিল।

“রবীন, আমি জানি তুমি কেন আমার ডাক শুনতে পাওনি, তুমি কী মনে করোনা এভাবে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হতে পারে?”

বাড়ি ফেরার পর কথাটি নিয়ে ভাবছে রবীন। সিদ্ধান্ত নিল, চন্দ্রাকেও এই অভিযাত্রার সঙ্গী করবে। এতে করে, দুজন দুজনের পুরোটা অনুভব করবে। চন্দ্রাকেও আর একাকীত্বে হাতড়ে বেড়াতে হবেনা।আড়াল থাকবেনা কোনোকিছুই। মৃদু ওজর আপত্তি চন্দ্রার ছিলনা তা নয়, কিন্তু জিতে গেল রবীন।

 

মধুচন্দ্রিমা

সপিটাল কেবিনে ঘুম ভাঙল চন্দ্রার। মরফিনের প্রকোপ কাটতে কাটতে চন্দ্রার মনে পড়ল সব। হাতের পাতায় মৃদু চাপ অনুভব করতেই চোখ থেকে ঘুম ঘুম ঘোরটুকু তাড়াতে তাড়াতেই বুঝতে পারল, রবীনের প্রশ্নভরা মুখটা ঝুঁকে আছে তার দিকে।আশ্বস্ত করল রবীনকে, একটু দুর্বলতা ছাড়া তেমন কিছু বোধ করছেনা চন্দ্রা। ভালো বোধ করলে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে যেতে পারবে, রবীন জানাল।

প্রথম ক’দিনের এলোমেলো অনুভূতি কাটাতে একটু সময় লেগেছিল চন্দ্রার। ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরে বের হতে শুরু করল। প্রথম যেদিন চিপ ইমপ্ল্যান্টের ফলাফল হিসেবে অন্যের মন পড়ে নেওয়ার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হলো, সেদিনকার দিনটা পরিষ্কার মনে পড়ে চন্দ্রার। টুকিটাকি কিছু বাজার করে ফেরার পথে কফির পিপাসা পেয়ে গিয়েছিল। কাপে দুধ চিনি মেশাতে মেশাতে পাশের একজনের সাথে চোখ পড়ে গেল। ছেলেটার বয়স আঠেরো উনিশ হবে। সদ্য কলেজ শুরু করেছে সম্ভবত। ছেলেটার মন জুড়ে ভবিষ্যতের ভাবনা। চন্দ্রা ভাবল, তাহলে ছেলেটিও এই রিসার্চের অন্তর্ভুক্ত। এই গবেষণায় অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক হলেও আর্থিক অনুদানের বিষয়টি নি:সন্দেহে একটি ভূমিকা রাখছে।

ঘরে ফিরে চন্দ্রা রাতের খাবার তৈরি করতে করতে রবীনকে জানাল আজকের দুর্লভ অভিজ্ঞতা। ক’টা দিন চন্দ্রার কাছে এটা বেশ খেলা খেলা মনে হয়েছে। ইচ্ছে করলেই মনের খবর জেনে ফেলা। মন্দ কী? রবীনও পাল্টাপাল্টি চন্দ্রার সাথে খেলছে এ নিয়ে, চমক লাগিয়ে দিচ্ছে প্রায়ই।

 

নয় নয় এ মধুর খেলা

জ চন্দ্রা ফিরে যাচ্ছে বিচলিত মন নিয়ে, কিছুটা আতংকিতও বলা যেতে পারে। গবেষণার খবর গোপন রাখার চেষ্টায় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া সত্বেও কোনো না কোনোভাবে তা ছড়িয়ে গেছে শহরের আনাচে কানাচে। বায়োলজিকাল অস্ত্রসামগ্রীর পরবর্তী প্রজন্ম মানসিক অস্ত্র তৈরীর কাজে এই গবেষণার লব্ধ ফল কাজে লাগানো হবে। আন্তর্জাতিক গুপ্তচর বৃত্তিতে এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার রাখবে বলে Dr. Steven এই গবেষণার লক্ষ্যে পৌঁছোতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

শহরের বিভিন্ন স্হানীয় খবরের কাগজগুলোতে গুচ্ছ গুচ্ছ দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ পেয়েছে। সহিংসতা বেড়ে গেছে ঘরে বাইরে সর্বস্তরে। একান্তই নিজস্ব বলে আর কিছু থাকছে না। পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটছে দ্রুতগতিতে – সম্পর্কের উত্তাপ কমছে, অস্হিরতা ঢুকে পড়ছে।

রবীন রোবটিক্স সায়েন্সে জড়িয়ে গেছে প্রবলভাবে।চন্দ্রার ফিরে যাবার কথা মেনে নিতে পারেনি। ওর মনের প্রতিটি ভাঁজ এসে আছড়ে পড়েছে চন্দ্রার প্রত্যেক নিউরনে। যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে চন্দ্রা। কিন্তু, সিদ্ধান্ত থেকে এক সুতো পরিমানও সরাতে পারেনি চন্দ্রাকে। আসবার আগের দিন ল্যাবের ক্লিনিকে গিয়েছিল, শরীরের ভেতরের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে। চন্দ্রা চায় না এই ধ্বংসযজ্ঞে নিজেকে সামিল করতে। কিছুটা মনের আড়াল থাকা সত্যিই খুব জরুরী। নিজস্ব কিছু কথা একান্ত আপনারই থাকুক। মনপাখি যদি নীলাম্বরী আকাশে রোদে মেঘে তার ডানাই না মেলতে পারল, তাহলে মানুষজন্মই বা কেন?

 

তারিখঃ জুলাই ৮, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse