মার্জার মেঘদূত কথা
চিরন্তন ভট্টাচার্য
বৃষ্টি স্নাত একটি সুন্দর সন্ধ্যা তাই না মি: অলোকেশ?”
অলোকেশ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলো না। অথচ কথাটা খুব পরিষ্কার শুনতে পেলো। নারী কণ্ঠ। বৃষ্টিটা অনেকক্ষণ ধরে একটানা হয়েই চলেছে। ঠিক কতক্ষণ ধরে হচ্ছে তারই যেন আর হিসাব থাকছে না। অনেকদিন তীব্র দাবদাহের পরে আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি। আহা এমন দিনেই তো মেঘ কে ডেকে বলতে হয় ‘যাও মেঘ তারে গিয়ে বলো এই তৃষিত হৃদয় একবার তার দেখা পাওয়ার তরে বুভুক্ষু হয়ে আছে।’ অলোকেশের এমন প্রিয়ার সংখ্যা অবশ্য প্রভূত যাদের জন্য ওর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর সেই বিরহের গান সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মাঝ রাত এমনকি কখনো ভোর রাত অবধি চলতে থাকে। সেসব বিরহের কথা বলার জন্য অবশ্য মেঘকে আর দূত করতে হয় না। ইথার তরঙ্গ অন্তর্জাল ভেদ করে প্রিয়াদের কানে কানে পৌঁছে দেয় সেইসব বাণী। কিন্তু এখন কে বললো কথাটা! বৃষ্টির মধ্যে মোহনপুরার রাজাদের পরিত্যক্ত প্রাসাদ বাড়ির বারান্দায় আর তো দ্বিতীয় কোনো মানুষ উপস্থিত নেই। কাছে পিঠে প্রাণী বলতে বেশ সুন্দরী দেখতে একটা বেড়াল। বেড়ালটা কথা বললো? বলতেই পারে। কিন্তু ও বুঝতে পারলো কিভাবে! এরপরেই ওর মনে হলো এর রিপ্লাই দেওয়া যাক। দেখা যাক বেড়ালটা ঠিক সমভাবেই বুঝতে পারে কি না! তাই ও বেড়ালটার দিকে ঘুরে বললো ‘হ্যাঁ। অনেকদিন পরে বৃষ্টি নামলো তাই আরও ভালো লাগছে। আমি কি তোমার নাম জানতে পারি!’
‘নিশ্চয়ই। আমার নাম লাবণ্য। সুন্দর না নামটা?’
‘হ্যাঁ। খুব সুন্দর নাম। কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কী করে?’
‘নাম জানা আর আশ্চর্য কী? তুমি এই এলাকারই তো বাসিন্দা।’
‘হ্যাঁ। আমি এই এলাকারই বাসিন্দা। তুমি কি এই বাড়িতেই থাকো? মানে এই রাজপ্রাসাদে?’
‘এটাকে আর রাজপ্রাসাদ তো বলা যায় না। ভূতের বাড়ি বলতে পারো!’
অলোকেশ হেসে উঠলো। উল্টো প্রতিক্রিয়ায় বেড়ালটা হাসলো কি না সেটা দেখার জন্য তাকালো। তখনই সেই বেড়াল বা লাবণ্য কথা বলে উঠলো ‘তোমার হাসির উত্তরে আমারও হাসা উচিৎ ছিলো। সেটাই সৌজন্য। কিন্তু আমি পারলাম না। কারণ বেড়াল হাসতে পারে না। সমস্ত প্রাণীকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষই হাসতে পারে।’
‘তুমি যদি বেড়াল হয়ে মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারো তাহলে হাসতেও পারবে।’
‘তুমি তোমার সুপিরিওরিটিতে ভুগছো মিস্টার। আমি যে তোমার ভাষায় কথা বলছি এমনটা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় না। হয়তো তুমিই আমার ভাষায় কথা বলছো!’
‘তাহলে তো তোমাকেই সুপিরিয়র বানালাম। বোঝাতে চাইলাম তুমি মানুষের ভাষা রপ্ত করতে পেরেছো। কিন্তু আমি তোমার ভাষা পারিনি।’
‘ওটা সুপিরিয়রিটি নয় মি: অলোকেশ। মানুষ মনে করে তারাই গোটা পৃথিবীতে সুপিরিয়র। অন্যরা তাকে অনুসরণ করবে। আর তুমি সেই সিস্টেমের অঙ্গ। তাই তুমি নিশ্চিত যে আমিই তোমার ভাষায় কথা বলছি।’
‘কিন্তু আমি যে আমার ভাষায় কথা বলছি সেটা তো নিশ্চিত।’
‘আপেক্ষিকতা বলে যখন দুটো বস্তু সমান বেগে একই দিকে দৌড়ায় তখন তাদের পরস্পরের কাছে গতিবেগ শূন্য। যেহেতু আমরা দুজনেই ভাষাটা বুঝতে পারছি তাই আমরা দুজনেই ভাবছি যে আমরা নিজের নিজের ভাষায় কথা বলছি এবং অন্যজন আমাকে অনুকরন করছে।’
‘বৃষ্টিটা কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই পড়ছে তাই না!’ অলোকেশ কথাটা ঘোরাবার জন্য বললো। আসলে বেশ ভালোই লাগছে বেড়াল অথবা লাবণ্যর সঙ্গে কথা বলে। এমন একটা জায়গায় বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত বোর হতো। পকেট থেকে মোবাইল বার করে অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে এক্টিভ থাকাই যেতো। কিন্তু সেও আর কতক্ষণ! এমনিই এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় ঈশাদের মত অনেকেই পার্টি করছে নিজেদের মধ্যে। এখন ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য কেউ এক্টিভ থাকবে বলেও মনে হয় না। তাই এইভাবে সময়টা পার করতে নিতান্ত মন্দ লাগছে না! বেড়ালটা বললো ‘হ্যাঁ। অনেকদিন পরে এরকম একটানা বৃষ্টি পড়ছে। তুমি এরকম দিনে ছাতা নিয়ে বেরোওনি? না কি মেঘের দিকে চেয়ে আরেকটা মেঘদূতম লিখবে বলে বেরিয়েছো?’
‘তা লিখতে পারলে মন্দ হতো না! “আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং বপ্রক্রীড়াপরিঢতগজপ্রেক্ষনিং দদর্শ …”
‘এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। মেসেজবক্সে ঢুকে টাইপ করে সেন্ড। মেঘের ধার কে আর ধারে!’
‘তা ঠিক। সেটা হতে পারে সাধারণক্ষেত্রে। কিন্তু আজও মনে যদি সত্যিই বিরহ জাগে। যদি কারোকে একবার স্পর্শ করার জন্য আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। যদি কারোর জন্য বলতে না পারা কথাগুলো চোখের কোনা বেয়ে নোনা স্বাদ হয়ে ঝরে পড়ে তখন সেই মেঘই ভরসা! এমনটা হতেই পারে যে রোজ দুই বেলা তার সঙ্গে তোমার অনেক কথা হচ্ছে। ঝগড়া হচ্ছে। হাসি হচ্ছে। বার্তা আদানপ্রদান হচ্ছে প্রচুর। তারপরেও হঠাৎ কখনো টেলিফোনে নিশ্বাসের শব্দগুলো কোনো এক প্রাচীন ঘুলঘুলিতে আটকে যায়। তখনই সেই মেঘের দরকার পড়ে – ”মেঘালোকে ভবতী সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তিচেতঃ।’’
আজকে এই বৃষ্টির মধ্যে না বেরোলেই তো ভালো হতো, অলোকেশ ভাবছিলো। ও নিজেও ভালো করে জানে এই যে ঈশা একটু আগে ওকে দামী হুইস্কির বোতল হাতে নিজের ছবি দিয়ে মেসেজ পাঠালো ‘উইশ ইউ কুড জয়েন আস?’ ঈশার বর আজকে নেই। ওদের তিন বন্ধু তাই ওর বাড়িতে দেখা করে সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি সহযোগে বর্ষার সন্ধ্যা কাটাবে। এই ডাক কি আন্তরিক ছিলো? ও তো বেরিয়েও পড়েছিলো যাবে বলে। যদি সত্যি চলে যেতো তাহলে কি ঈশা ওকে সাদরে গ্রহণ করতে পারতো? না কি নিজেদের বন্ধুদের আসরে হঠাৎ হাজির হওয়া এক উপদ্রব হিসেবে ভাবতো? আপাততঃ অবশ্য যাওয়াটা হলো না। আর এতক্ষণ পরে ওখানে হাজির হওয়ার কোনো মানেও নেই। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে এই বেড়ালটার সঙ্গেই গল্প করা যাক। অবশ্য ঘরে থাকলেও হতো। কোনো একটা পর্ন সাইটে ঢুকে বর্ষার সন্ধ্যায় উষ্ণতার অনুভব আনা যেতে পারতো।
‘কোনো আফসোস? তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা খেদ আছে!’
‘যাচ্ছিলাম এক বন্ধুর বাড়ি। বর্ষার সন্ধ্যায় সিঙ্গেল মল্ট। আহা! আটকে গেলাম।’
‘আহা! তা বন্ধু না বান্ধবী!’
‘বন্ধু। তবে মেয়ে। ওরা তিনজন বন্ধু মিলে পার্টি করছে। তিনজনেই মেয়ে। বাকি দুজনের সঙ্গে অবশ্য আমার স্রেফ হাই হ্যালোর সম্পর্ক।’
‘আচ্ছা। তুমি নিশ্চিত যে ওরা তোমাকে ডাকছিলো? আগে কখনো গেছো ওই আসরে?’
‘না যাইনি। অনেকবার বলেছে কিন্তু কোনোবারই গিয়ে পৌঁছতে পারিনি।’
‘সামনাসামনি কখনো দেখা হয়েছে তোমাদের?’
‘হ্যাঁ। হয়েছে কয়েকবার। তবে ওর বাড়িতে কখনো যাইনি। বাইরে কফি শপে। বইয়ের দোকানে। দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। এই পর্যন্ত…’
‘তুমি কি নিশ্চিত যে ঈশা তোমাকে সামনাসামনি পেয়ে ঠিক ততটাই খুশী হয়েছে যতটা তোমাকে ভার্চ্যুয়ালী পেয়ে খুশী হয়?’
বেড়ালের প্রশ্নটা কিন্তু অমোঘ। এদিকটা কখনো তো ভেবে দেখেনি অলোকেশ। ঈশা আছে, স্বপ্না আছে, দেবকী আছে, সাথী আছে, রুথ র্যন্ডলার আছে … আরও কতজন। তার মধ্যে ঈশার সঙ্গেই শুধু সামনাসামনি দেখা হয়েছে। আজকে এই বিজন সন্ধেবেলা। এই বৃষ্টি। এই নির্জন রাস্তা। একটা বেড়ালের সঙ্গে গল্প। অদ্ভুত অপরিসীম নিঃসঙ্গতা। সত্যিই যদি ঈশা চাইতো তাহলে তো নিশ্চিত কল করতো। জানতে চাইতো। কষ্টগুলো কোথায় যে আটকে যায়!
“তেনার্হিত্বং ত্বমি
বিধিবশ্যাৎদুরবন্ধুর্গোতঅহং।
যাঞ্চা মোঘা বয়ম্ অধিগুনে নাধমে লব্ধকামা”
মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতম। হে মেঘ আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি আমার বিরহ তুমি প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দাও। তুমি গুণবান তাই তোমার কাছে আমার এই প্রার্থনা। যদি বিফল হই তাও ভালো। অধমের কাছে প্রার্থনা করে সফল হয়েও তা ভালো হয় না। কিন্তু প্রিয়া? কার কাছে পাঠাবে বার্তা? ঈশা? কিন্তু সেকি সত্যিই শুনতে চায়? আজ এই বাহান্ন বছর বয়সে এসে, একটা বিজন বৃষ্টির সন্ধ্যায়, একটা আধভাঙা দালানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, মেঘদূত আক্রান্ত অলোকেশ চ্যাটার্জী নামের একটা লোক একটা বেড়ালের প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো মেঘ আছে, বার্তাও আছে, কিন্তু ডেসটিনেশনটা জানা নেই।
‘যদি তোমার দুঃখটা হুইস্কির জন্য হয় তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’ সেই লাবণ্য নামের বেড়ালটা এবারে বললো।
‘কিভাবে?’
‘আমার কাছে আছে একটা। সিলড বোতল। চিন্তা নেই। গ্লেনফিডিচ। সিঙ্গেল মল্ট।’
‘বেড়াল হুইস্কি খায় এটা জানতাম না!’
‘পরেও জানবে না। তুমি এত বোকা কেন? খায় না বলেই তো তোমাকে দিচ্ছে!’
‘তাহলে জোগাড় করলে কেন?’
‘নিজের ইচ্ছেয় তো করিনি। হয়তো কারোর রাগ বা ঝগড়া কিছু হয়েছিলো। ফেলে গেছে। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছি।’
‘কোনো বেড়াল যে এত গোছানো হয় তা জানতাম না!’
‘তোমরা মানুষরা ভাবো তোমরাই সব জানো। এমন অনেককিছুই আছে যা তোমরা জানো না!’
‘তা না হয় হলো। কিন্তু একা একা! যত দামী মদই হোক না কেন। নিজেকে তো পেঁচি মাতাল মনে হবে! ওই আড্ডাটা চাই। না হলে গল্পগুলো তৈরি হবে কিভাবে?’
‘আমি তো মেঘ নই। আমি গুণবান নই। আমি লাবণ্য। আমি কিভাবে তোমার বার্তা পৌঁছে দেব? আর তুমি নিজেও জানো না কোথায় পৌঁছে দিতে হবে! যে ছবি তোমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে সেটা সত্যি কি না তাও তুমি জানো না!’
মেঘদূতম কাব্যে বিরহী যক্ষের একটা ঠিকানা জানা ছিলো যেখানে বার্তা পৌঁছে দেওয়া যাবে। কেউ একজন অপেক্ষা করে বসেছিলো বার্তা পাবার জন্য। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে তো কোনো ঠিকানা নেই। ঠিক নেই কী? আছে তো। কিন্তু সেটা হয়তো একতরফা। এটাও হয়তো খেলা। কথা বলার সময় মনে হবে যেন তোমারই অপেক্ষায় অথচ সেখানে পৌঁছে গেলে দেখা যাবে কেউ কোনো অপেক্ষাতেই ছিলো না। বা আরও খারাপ। দেখা যাবে সে হয়তো বিরক্তই হয়েছে। ঈশা একদিন ওকে বলেছিলো ‘আমার তো প্রত্যেকটা অপেক্ষাই তোমার জন্য। তোমার লেখা। তোমার কবিতা। তোমার গল্প বলার স্টাইল। আমাকে একটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। যা আমি আর কারোর থেকে পাই না।’ কিন্তু সেইগুলো কি সত্যি? না কি নিছকই কথার কথা। বেড়ালটা এইসময় জিজ্ঞাসা করলো ‘তোমার কি মনে আফসোস হচ্ছে? ঈশার বাড়ি যেতে পারলে না বলে?’
‘তা তো একটু হলামই। এমন একটা বাদল সন্ধ্যা। গ্লাসের মধ্যে পানীয়। উষ্ণ মন। আর মাথার মধ্যে সেই কবেকার মেঘদূত।’
‘কিন্তু তুমি কি জেনেছ ওদেরও এই একই ইচ্ছে আছে কি না? হয়তো ওরা আজ গল্প করবে নিজেদের কাহিনী নিয়ে। যা অনেকদিন আগে হয়ে গেছে। যা এখন হচ্ছে। হয়তো সেই গল্পে তুমিও আছো। এমনও হতে পারে যে সেই গল্পের তুমি ওদের আকাঙ্ক্ষার মানুষ নও বরং ঈশা তোমাকে স্রেফ কনসিডার করে!’
‘হতে তো কত কিছুই পারে। সম্ভাবনার সব সময়েই দুটি দিক। যদি আমরা শুধু উল্টোদিকটাই ভাবতে থাকি তাহলে তো আর মানুষই খুঁজে পাবো না অ্যাসোসিয়েশনের জন্য।’
‘তুমি কি নিশ্চিত যে তুমিই মানুষ আর আমি বেড়াল?’
‘তোমার প্রশ্নগুলো মাঝে মাঝে খুব হাস্যকর। মানুষের দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে আমি একজন মানুষ আর তুমি একটা বেড়াল।’
‘একটা এবং একজন! যাকগে সে বিতর্ক বাদ দাও। আমি মানুষের তৈরি করা সংজ্ঞা অনুসারেই বলছি আমিই আসলে একজন মানুষ আর তুমি একটা বেড়াল – এটা যে সত্যি নয় তা তুমি নিশ্চিত?’
‘আমার তো তাই মনে হয়।’
‘ভুলও তো হতে পারে। একটা বেড়ালের সঙ্গে তুমি গল্প করছো সারা সন্ধ্যা। বৃষ্টি কখন থেমে গেছে। তুমি তো ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারতে যেখানে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছিলে। থেমে গেলে কেন? তোমার মনে হচ্ছিলো বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু সত্যি তো হচ্ছিলো না। আসলে মি: অলোকেশ পৃথিবীতে এমন কতকগুলো পয়েন্ট আছে যেখানে মানুষ তার নিজের আইডেন্টিটি হারিয়ে ফেলে। তুমি কি নিশ্চিত তুমি ঠিক সেই পয়েন্টেই এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নেই?’
ল্যাবিরিন্থ অর্থাৎ গোলকধাঁধা। কথাটা শোনা। কিন্তু আজকে ঠিক এই একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অলোকেশের মনে হলো ও যেন বর্হেসের জাদু পৃথিবীর আলেফের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে মহাবিশ্ব আর মহাকাল সব থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই লাবণ্য নামের সেই বেড়াল যেন একটা ম্যাজিক খেলার মত বলে উঠলো
“সেদিন কি জগতের যতেক প্রবাসী
জোড়হস্তে মেঘ – পানে শূন্যে তুলি মাথা
গেয়েছিলে সমস্বরে বিরহের গাথা
ফিরি প্রিয়গৃহে – পানে? বন্ধনবিহীন
নবমেঘপক্ষ – পরে করিয়া আসীন
পাঠাতে চাহিয়াছিলো প্রেমের বারতা।”
অলোকেশ ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললো ‘আমি চিনেছি তোমাকে। তুমি বেড়াল নও।’
‘তুমি কি করে এতটা নিশ্চিত হলে?’
‘সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে আরেকটু বাকি আছে। তুমি আরেকবার বলো তোমার ওই লাইনগুলো – যেগুলো তোমার খুব ফেভারিট। বলো, বলো …’
“পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।”
‘বলো। তুমি বলো …’
“আজ শুধু করি নিবেদন –
আমি চিত্রাঙ্গদা আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।।”
‘আমিও কোনোদিন ঈশার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছতে পারিনি। বারবার তুমি কোনো এক কুহক তৈরি করে আটকে দাও। প্রত্যেকবার তোমার মার্জার রূপ। তবুও আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে তুমি বেড়াল নও’
‘কিভাবে?’
‘কেন না প্রবাদ বলে বেড়াল কাউকে মনে রাখে না। অথচ এই ঘটনাটা শুধু আজকের নয়। দিনের পর দিন এটা হয়ে চলেছে। আমি জানি না ঠিক কত দিন! হয়তো কয়েক হাজার বছর। আমি যেতে চাইলেই তুমি ইন্দ্রজাল তৈরি করে আমাকে আটকে দাও। অথচ নিজে একটা বেড়ালের রূপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকো অনেক দূরে। এটা কি একটা খেলা? অথবা আমিই মেঘের মাধ্যমে খবর পাঠাই তোমাকে? তুমিই কি আমার সেই প্রিয়া? এটা কি একটা ল্যাবিরিন্থ? না কি এটাই কি সেই পয়েন্ট যার নাম আলেফ? আমি সত্যিই জানি না!’
তারিখঃ জুলাই ১৯, ২০২৩
চমৎকার একটি অতীন্দ্রিয় গল্প।
অনেক অনেক ধন্যবাদ। এমন মন্তব্য উৎসাহ যোগায়
চিরন্তনবাবু, আপনি আমার প্রিয় সাহিত্যিক। কবিতা ও গদ্য – এই দুই মাধ্যমেই আপনার অনায়াস গতায়াত ও মেধার তূরীয় প্রতিফলন যারপরনাই বিস্মিত করে। আপনার লেখা একাধারে আপনার বিপুলায়তন পড়াশোনার চিহ্ন বহন করে চলে, তারই সাথে বিশুদ্ধ মৌলিকত্বর ঘ্রাণ ম ম করতে থাকে। বিষয় নির্বাচন থেকেই শুরু হয় উড়াল, যা শেষপর্যন্ত পাঠককে নিয়ে যায় এই গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে অন্য কোথাও। সনাতনী সাহিত্যের দিকপালদের দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েও, নিজস্ব সৃষ্টিকে স্বাতন্ত্র্য দেওয়ার এই স্টাইল প্রমাণ করে দেয় চিরন্তন ভট্টাচার্য নিজেই নিজের বিশেষণ।
এই গল্পেও মহাকবি কালিদাস ও তাঁর অমর সৃষ্টির সাথে বহের্সের রচনারীতির মেলবন্ধন ঘটানোর কাঠামোয় গল্পের আত্মায় স্বীয় বৈশিষ্ট্য প্রোথিত করে রাখার রাজকীয়তা এক ধ্রুপদী জঁর নির্মাণ করে তোলে।
আরও একটি কথা না বলে পারছি না, এই লেখা আপনার এক অনন্য সাহিত্যকৃতি হয়ে রইল।
মন্তব্য যে একটা শিল্প হতে পারে তা আপনার মন্তব্য পড়ে বোঝা যায়। আমি তো মুগ্ধ হয়ে শুধু আপনার মন্তব্য পড়ে গেলাম। এই লেখাটা নিয়ে আমার একটা ভয় ছিলো। আপনার কথায় বুঝতে পারলাম উতরে গেছি। সত্যি বলছি অনুপ্রাণিত হলাম গভীরভাবে
আপনার গল্পে বরাবরের মত একটা ভিন্নতা আছে। অদ্ভুত এক আবহ তৈরি করে রাখেন আপনি। যে আবহে আটকে থাকি শেষ পর্যন্ত।
এমন সুন্দর মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করলো। খুবই ভালো লাগলো
আপনার লেখাগুলো বরাবরের মত ব্যতিক্রমী।