মিরর ইমেজ

পাকদন্ডী বেয়ে বেয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলছে।রিয়ার ভিউ মিররে ঘন ঘন চোখ রাখছে অভ্র। নীলাকাশ আর সবুজ বনবীথিকে বিলি কেটে কেটে ওপরে উঠে যাচ্ছে সে।পাহাড়ের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে।মাইলের পর মাইল পাইন বন, সাইপ্রেস ট্রী, উইপিং উইলোর বুনো গন্ধ, পাহাড়ি বাতাসের শন শন শব্দ, পাতা ঝরার আওয়াজ, তার মাঝে ছোট ছোট ঝোরার ছপাৎ ছপাৎ …এক নৈ:স্বর্গিক সম্মোহন ক্রমশ অবশ করে দিচ্ছে অভ্রকে। কখনও কখনও একপাশে পাথরের এবড়ো থেবড়ো দেয়াল আর অন্যপাশে ঢালু খাদ। টার্নিং পয়েন্টগুলোর কাছাকাছি বিপদসংকেতের সাইন ঝুলানো।ড্রাইভিং হুইলের পেছনে যথেষ্ঠ সাবধানতার প্যাঁচ কষে কষে অভ্র বাঁক গুনে চলেছে। পাহাড় ও সমতলের সবটুকু বিশালতাকেও তুচ্ছ করে কী যেন এক অন্তহীন শূন্যতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে অভ্র মাঝে মাঝে। গেরুয়া বিকেলের আলো গাঢ় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। জি পি এস এ দেখাচ্ছে আর দশ মাইলের মধ্যেই ওর রিসোর্ট।

ওজার্ক মাউন্টেনের কাছাকাছি এই পাহাড়ের নাম মাউন্ট ম্যাগাজিন। গাড়ি পার্ক করে ফ্রন্ট অফিসে পেপারওয়ার্ক শেষে চাবি নিয়ে দরজা খুলল অভ্র।দুই রুমের লগ কেবিন।বেডরুম এবং ডাইনিং ড্রইং স্পেস। ছোট্ট ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আয়োজন। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে টানটান নরম বিছানা টানছিল প্রবলভাবে।কিছুক্ষণ খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয় সে, একটা সিগারেট ধরায়।অপরূপ এক হিরন্ময় নিস্তব্ধতা… নির্জন বাঁকে বাঁকে ঘুম নেমে এসেছে অথচ, যত রাত বাড়ছে পাহাড় যেন ততই জেগে উঠছে।ঘরে ফিরে বিছানায় পিঠ ঠেকানো মাত্রই নক আউট হয়ে গেল অভ্র।

সকালে ঘুম ভেঙেই মনে পড়লো রাতে এলোমেলো ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু কিছুই তেমন করে মনে পড়লনা।মোবাইলে তিনটে মিস কল দোলার, আর একটা আননোন নম্বর থেকে এসেছিল কিছুক্ষণ আগেই।ফোন ইচ্ছে করেই মিউট করে রেখেছে অভ্র।শুধু দোলাকেই কল ব্যাক করবে সে।পৌঁছানোর সংবাদ জানিয়ে দিয়ে কদিনের জন্য অরণ্যে হারাবে অভ্র।দোলা, অভ্রর জীবনসঙ্গিনী।ওর সাথে কিছু পারষ্পরিক সমঝোতা গড়ে নিয়েছে অভ্র।বছরে একবার কী দুবার ওরা নিজেদের মতো করে সময় কাটাবে। ফোনে রিডায়াল চেপে সংক্ষিপ্ত কথা সেরে নিল অভ্র। গরম জলে স্নানশেষে একেবারে ঝরঝরে শরীর তরতাজা মন।শেভ করে অডিকোলন ছড়িয়ে নিল। লাউঞ্জে ব্রেকফাস্ট শেষে জিজ্ঞেস করে নেবে আশেপাশে কোথায় যাওয়া যায় আজকে।

স্ক্র্যাম্বেল্ড এগ, টোস্ট শেষ করে কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসেই মন আরো ভালো হয়ে গেল।শ্যাওলা সবুজ থেকে শুরু করে ঘনশ্যাম সবুজে উপচে পড়ছে অরণ্য ।তার ভেতরে ভেতরে রডোডেনড্রনের বাহারী গুল্ম যেন আকাশগঙ্গার মতন ভেসে ভেসে যাচ্ছে।পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে এক অনিবার্য হাতছানি আর রোমাঞ্চ।একারণেই বছরে একবার পাহাড় এবং একবার সমুদ্রে অভ্রর আসা চাই।সিদ্ধান্ত নিল আজ পায়ে হেঁটেই ঘুরবে।ব্যাকস্যাকে ম্যাপ, ক্যামেরা, আর ক্যানিস্টারে জল ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

মাউন্ট ম্যাগাজিন রিসোর্ট যে উচ্চতায়,তার থেকেও ওপরে হাঁটতে হাঁটতে উঠে এলো অভ্র।মেঘের রেণুতে রোদের মাখামাখি – কখনও বেগুনি কখনও কমলা আলো টুপটাপ ঝরে পড়ছে । সারি সারি ইউক্যালিপটাস যেন আরেকটু হলেই আকাশের গায়ে আঁচড় কাটবে। সানগ্লাসটা কপালের ওপর তুলতেই লক্ষ্য করল, ঢালু একটা খাদ নীচে নেমে গেছে।সরু সিঁথির মত একটা রাস্তা আর সুদূর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে এসেছে ক্ষীন জলের ধারার ছোট্ট ঝোড়া।একটু জিরিয়ে নিতে মন চাইল।সাবধানে নামতে নামতেই হঠাৎ চোখে পড়ল কেউ একজন বসে আছে খাদের ধার ঘেষে। কিন্তু কী অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার।সে লোকটিও অভ্রর মতো একদম একই রকম একটা পুলওভার পরে আছে।এমনকি রংটাও এক। পায়ের আওয়াজ পেয়েও সে একবার ফিরেও দেখল না।এসব ভাবতে ভাবতেই যখন সে একেবারে লোকটার কাছাকাছি লোকটা তখনই পেছন ফিরে তাকালো। গা ছমছমে এক নৈ:শব্দ আর দুচোখে অবিশ্বাস্য অপলক বিস্ময় অভ্রর দুচোখে।এ যে অবিকল অভ্রর মতো দেখতে। গায়ের রং, উচ্চতা, সব সব কিছু। এমনকি ডান চিবুকের তিলটাও।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে অভ্র জিজ্ঞেস করল –
“কে আপনি?”
লোকটার দৃষ্টির অতলান্ত গভীরতা যেন স্পর্শ করল অভ্রর অস্তিত্বের অন্তস্হল।

“বোসো অভ্র, আমি তোমার নির্জনতার সঙ্গী হবো বলে অপেক্ষা করে আছি বহুদিন”

অভ্রর চোখের মনিদুটো অস্হির হয়ে উঠছে।বুঝতে পারছে, এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।অভ্র অলৌকিক ঘটনাতে একেবারেই বিশ্বাসী না কিন্তু, যা ঘটে যাচ্ছে তাকে কী বলা যেতে পারে?ফিরে যেতে চাচ্ছে কিন্তু, কিছুতেই উল্টোপথে হাঁটতে পারছেনা।পা দুটো জমে যাচ্ছে ক্রমশ:।

হঠাৎ মনে হলো, অভ্র যেন এক পরিচিত জনপদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।চারিদিকে লোকালয়ের চিহ্ন।সেলুলয়েডের পর্দায় যেন ভেসে উঠছে আজ অব্দি অভ্রর যাপিত জীবনের চলচিত্র ।প্রিয় অপ্রিয় মানুষের মুখ গিজগিজ করছে।রতন,বিটু, পিন্টুর সাথে। জমানো গাঁজার আড্ডার সেই জায়গাটা।বারেক চাচার চায়ের দোকান।মোড়ের জিকু দর্জির দোকানে হ্যাঙারে সাজানো সদ্য বানানো সালোয়ার কামিজ। এই মুহূর্তে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে মজুমদার কাকার বাড়ির সামনে। টলমল পায়ে গোঙানির মত আওয়াজ করে লোকটাকে ফিসফিস করে বলল –

“কী চাও তুমি?”

লোকটার বুক থেকে বেরিয়ে এল এক দীর্ঘশ্বাস। বলল,

“কিছু চাইনা তো… তোমার ফেলে আসা কয়েকটা পাপের কথা বলি চলো।তুমিও তো পালিয়ে পালিয়ে ক্লান্ত।”

অভ্র প্রাণপণে দৌড়তে চেষ্টা করতেই কোত্থেকে একটা জার্মান শেপার্ড লেজ দোলাতে দোলাতে এসে জিহ্বা বের করে সামনে এসে বসে পড়ল।

“জুডো!!!”

সেই লোকটার কন্ঠে তীব্র তিরষ্কার ঝরে পড়লো …
“চিনেছ তাহলে?”

অভ্র তখন ক্লাস টুয়েলভ। রকবাজদের সাথে দিন কাটে ফূর্তিতে। নানারকম নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে রাতদিন। গভীর রাতে দেয়াল টপকে জানালা গলে যখন ঘরে ফেরে, মজুমদার কাকার পোষ্য জুডো তখন প্রতিদিন অর্ধেক পাড়াকে তারস্বরে ডেকে ডেকে যেন দেখিয়ে দিতে চাইত, দেখ দেখ, বখে যাওয়া অভ্র চোরের মতো ঘরে ফিরছে।এরকম একটা দিনে তাড়াহুড়ো করে পাঁচিল পেরোতে গিয়ে অভ্র পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছিল। তিনমাস পর অসহনীয় যন্ত্রণা এবং প্লাস্টার থেকে বেরিয়ে এসে ও সোজা খুন করেছিল জুডোকে।পুরো একবোতল পেস্টিসাইড লুকিয়ে ওর খাওয়ার সাথে মিশিয়ে রেখেছিল। বিপত্নীক নি:সন্তান মজুমদার কাকার জুডো ছাড়া কেউ ছিল না। দিনের পর দিন নি:সঙ্গতার সাথে সমঝোতা না করতে পেরে ঘুমের মধ্যে ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকে মৃত মজুমদার কাকাকে দরজা ভেঙে উদ্ধার করেছিল বাড়ির কাজের লোকজন। নাহ্, অভ্রর তাতে কোনো চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি। হয়নি কোনোই দু:খবোধ।সবকিছুই আগের মত চলেছিল। কাকপক্ষীও ও কথা জানতে পারেনি।
অভ্র যেন নিজের বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ শুনতে পাচ্ছে। জুডোর দুচোখে একটা নরম আলো অথচ কী তীব্র উত্তাপে পুড়িয়ে দিচ্ছে অভ্রকে!! হাত বাড়িয়ে ওকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতেই ও দৌড়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখ দুটো জ্বলছে, লবনাক্ত স্বাদে ঠোঁট জিভ বিষাক্ত মনে হচ্ছে। ক্রুঢ় হাসি হেসে সেই লোকটা জানতে চাইল,

“কষ্ট হচ্ছে?”

অভ্র মুখ লুকিয়ে ফেলতে চাইল দু’হাঁটুর মাঝখানে। আর, ঠিক তখুনি … পেছন থেকে অভ্রর কাঁধে ঠান্ডা আঙুলের ছোঁয়া।

“কে? “ চমকে ওঠে অভ্র।

চেনা কন্ঠের খিলখিল হাসিতে চরাচর যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।গোলাপ আতরের সুগন্ধ অভ্রকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই দিনগুলোতো। পাশে এসে বসেছে নন্দা। নন্দা…বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপুটে সুন্দরী।অভ্রর তখন থার্ড ইয়ার।রাজনৈতিক ঝুট ঝামেলার এক গোলাগুলির ঘটনায় মধুর ক্যান্টিনে পরিচয়।এর পর থেকে ক্যাম্পাসে সবার মুখে মুখে অভ্র নন্দা।দৈনন্দিন সকল কাজের সাথে নন্দা ছায়ার মতো জড়িয়ে থেকেছে অভ্রের সাথে।ওর বাড়িতে নন্দার তখন অবাধ যাতায়াত।বেহিসাবী মুহূর্তেরা ডানা মেলেছে একান্তে নিভৃতে। প্রশ্রয়ে ভেসে গেছে দুজন ।তেমনি এক প্রজাপতি প্রহরের হিসেব চুকিয়ে আসতে হয়েছিল নন্দাকে। সঠিক করে বলতে গেলে বলতে হবে,অভ্র বাধ্য করেছিল নন্দাকে। দুজনের শেষ দেখা গলি ঘুপচির এক অখ্যাত ক্লিনিকের লাউঞ্জে।যখন রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে নন্দা. সে সময় অভ্র সকল দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে পালাচ্ছে।কথা ছিল, দিন পনের পর দেখা হবে ওদের প্রিয় জায়গায়। কথা ছিল, একটু গুছিয়ে উঠলেই নন্দাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসবে।কিন্তু ওপরে ওঠার সিঁড়িটিও ওই সময়েই যেন সামনে চলে এলো। দোলা, অ্যামেরিকা… এক সাজানো ভবিষ্যত। ইউনিভার্সিটিতে ফিরে উন্মাদের মতো খুঁজেছে নন্দা অভ্রকে।অভ্র ততদিনে উড়াল পাখি।বহুদিন পর কারো কাছে শুনেছিল নন্দা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল।মেন্টাল রিহ্যাব থেকে কোনোদিনও ফিরতে পারেনি।অভ্র ভীষণরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ম্যানহ্যাটনের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে গোছানোর আয়েশি কারুকাজে।

নন্দা কখন যেন ঘনিষ্ট হয়ে বসেছে অভ্রর খুব কাছে। আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দিতেই বেজে উঁঠল ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার-

“Fly me to the moon
Let me play among the stars
Let me see what spring is like
On a Jupiter and Mars.”

সূর্যমুখি ফুলের হলদে আলোয় মাখামাখি নন্দা ঝিনুক ঝিনুক পায়ের পাতা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে খাদের ধার ঘেষে।নিজেকে হঠাৎ পাখির পালকের মতো হালকা লাগছে অভ্রর। চোখ বুঁজে আসছে ধীরে ধীরে। আর চারদিকে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য সাদা প্রজাপতি। আর শেষবারের মত অভ্র দেখে নিল সেই লোকটাকে.— ছাইরঙা পুলওভার আর ডান চিবুকের ঐ তিলটা।

তারিখঃ জানুয়ারি ১০, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse