মেঘালয়: মেঘের দেশে আমরা ক’দিন

 

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস

এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে

পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস

দুয়ার চেপে ধরে–”

 

মেঘালয়- নামটা শুনলেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই লাইনগুলো সবার আগে মনে পড়তো। ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ের পাতায় প্রথম পরিচিত হই এই শব্দটার সাথে। উত্তরপূর্ব ভারতের এক অন্যতম বৃষ্টিবহুল রাজ্য। ছবিতে দেখতাম, সবুজ পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে, অবশ্য কবির ভাষায়- চরে বেড়াচ্ছে। এক অমলিন সবুজের চাদর ঢেকে রেখেছে আপামর উপত্যকা, বৃষ্টিতে যেন আরও উজ্জ্বল আরও সতেজ হয়ে উঠেছে। সেই থেকেই ভাবতাম একদিন ঠিক পৌঁছে যাবো ওই মেঘের দেশে। বোহেমিয়ান মেজাজে মেঘ-বৃষ্টির সেই গল্পে আমিও সামিল হবো।

 

ক্লাস সিক্সের সেই স্বপ্নটা ২০২৩’এ এসে বাস্তবের মাটি ছুঁলো। বিগত চার পাঁচ মাসের পরিকল্পনা শেষে জানুয়ারির একটা হিমেল সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পৌঁছে গেলাম গৌহাটি। ভোরের ফ্লাইট ছিলো, প্লেনে বসেই সূর্যোদয় দেখলাম। সে এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। টুকটুকে লাল আলোর রোদ গায়ে এসে পড়লো। এয়ারপোর্টে নেমেই ড্রাইভার দাদাকে কল করলাম। গাড়ি বলাই ছিলো, ততক্ষণে চলেও এসেছে। আমাদের প্রথম গন্তব্য কামাখ্যা মন্দির। কামাখ্যা ভারতের ইতিহাসের এক অতি প্রাচীন মন্দির ও একাধারে শক্তিপীঠ। ভোরের আলো ফোটার আগেই পুজোর লাইন পড়ে। পুজো দিতে অনেকটা সময় লাগে ব’লে আগে থেকেই এক পুরোহিতের সাথে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম। তবুও পুজো দিয়ে বেরোতে বেরোতে বেলা হয়ে গেল। খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম শিলংয়ের উদ্দেশ্যে।

গৌহাটিতে সেভাবে ঠাণ্ডাটা বোঝা গেল না। তবে গাড়ি যত শিলংয়ের দিকে এগোচ্ছিলো পাল্লা দিয়ে উষ্ণতার পারদও নিম্নগামী। এখানের রাস্তাঘাট উল্লেখযোগ্যভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি রাস্তার সাথে এইসব রাস্তার বিস্তর ফারাক। ফোর লেনের চওড়া রাস্তা ধ’রে আমরা এগিয়ে চলেছি। পাকদণ্ডী বেয়ে ওঠার পথে রাস্তার ধারে আনারসের পসরা দেখলাম। আনারস এখানের one of the must try fruits. গাড়ি থামিয়ে আমরাও স্বাদের আনন্দে মেতে উঠলাম। এই আনারসের স্বাদ সত্যিই অনবদ্য, চেখে না দেখলে মিস হয়ে যেত। শিলং ঢোকার আগেই পড়লো উমিয়াম লেক। পাহাড়ের কোলে শান্ত, স্নিগ্ধ এক অপার সৌন্দর্যের আধার এই উমিয়াম লেক। আয়তনে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে, কয়েকজন বোটিং করছে দেখলাম। সূর্যাস্তের সময়ও হয়ে এসেছে। গোধূলির আলোয় লেকের জলও সেজে উঠেছে, পেছনের পাহাড়ের কোলে ডুবে যাচ্ছেন দিবাকর। এমন সন্ধ্যা, এই আলো, এই পাহাড়, নৈসর্গ সারাজীবন স্মৃতিতে অক্ষয় থেকে যাবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত।

 

শিলংয়ের ঠাণ্ডা ভোলার নয়। রাতে তো টের পেয়েইছি, সকালে ঘুম থেকে উঠেও আরও একবার তার আভাস পেলাম। রুম হিটার ছাড়া টেকা দায় হতো। কোনোমতে গরম জলে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম। ব্যালকনি থেকে শিলংয়ের বার্ড-আই ভিউ আরও একবার চমকে দিলো। গতকাল রাতে নিচের বাড়িগুলোর টিমটিমে আলোয় যেন জোনাকিদের আসর বসেছিলো। সকালে আবার অন্যরকম সৌন্দর্য। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। পথে পড়লো রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। পাহাড়ের গায়ে ছিমছাম নিপাট সৌন্দর্যের এক ঠিকানা। মনে পড়ে গেল, এখানে বসেই তিনি ‘শেষের কবিতা’ লিখেছিলেন। আমারও ভাবনায় দোলা লাগলো বৈকি।

 

লাইটলুম গ্রান্ড ক্যানিয়ন পৌঁছতে ঘন্টা খানেক লাগলো। গাড়ি থেকে নামতেই যেন বিস্ময়ে আমরা স্থির। সুবিশাল গিরিখাত, শীতেও তার সবুজের লালিত্য চোখে পড়ার মতো। নিচে সুতোর মতো বয়ে চলেছে নদী। প্রকৃতির এই অগাধ ভাণ্ডার বারবার অভিভূত করে, তার সামনে নতজানু হয়ে বসি। জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবগুলো নিমেষেই যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। লাইটলুম থেকে গাড়ি এগিয়ে চললো ডাউকির উদ্দেশ্যে।

 

ডাউকি- স্থানীয় নাম উঙগট(umngot)। পান্না রঙের জল, ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ। তল অব্দি পরিষ্কার দেখা যায়। নদীর এপাশে ভারত, ওপাশে বাংলাদেশের সিলেট। ওখানেও বেশ ভিড় জমেছে দেখলাম। নৌকা চড়ে বসলাম, জলের তল দেখতে দেখতে এগিয়ে যাওয়ার এমন অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। নিচে পাথর, মাছ, জলজ গাছপালা স্পষ্ট দেখা যায় সব। এইবেলা টু ডু লিস্টের আরেকটা এন্ট্রিতে দাগ পড়লো। মনে মনে ভাবলাম, এই ট্রিপে এখনও আরেকটা এন্ট্রি বাকি। জিপ-লাইনিং। এও নিশ্চয় পূরণ হবে, আশা রইলো। ডাউকি ছেড়ে এগিয়ে চললাম মাওলিনঙয়ের দিকে। পৌঁছনোর ঠিক আগেই পথে পেলাম সিঙ্গেল রুট ব্রিজ। রাস্তা থেকে খানিকটা ট্রেক করে নামতে হয়। গাছের শিকড় দিয়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই এই ব্রিজ তৈরি হয়েছে। তার ওপর দিয়ে দিব্যি লোকজন হেঁটে চলেছে। এ যেন চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না!

মাওলিনঙ-এশিয়ার সবথেকে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। এইজন্যেই বোধহয় তাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। যখন পৌঁছলাম, প্রায় সন্ধে। সেভাবে বোঝা না গেলেও, পরিচ্ছন্নতা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। পরের দিন সকালেই অবশ্য এই আন্দাজ সত্যি হয়ে উঠলো। বাড়িঘর থেকে শুরু করে, রাস্তাঘাট, গলিপথ, বাগান, সবকিছুতেই এই নিপাট পরিচ্ছন্নতা। আবর্জনা ফেলার জায়গাগুলোও ভারী সুন্দর ও সৃজনশীল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো, শঙ্কুর মতো দেখতে। এখানে অধিকাংশ লোকই খ্রীষ্টান। একটা চার্চও রয়েছে। গতকাল রাতে ওখানেই ক্যয়র শুনতে গিয়েছিলাম। নিঝুম, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আজকের গন্তব্য চেরাপুঞ্জি। হোমস্টের জানলা থেকে দেখলাম খানিকটা দূরেই মেঘের সমুদ্র। ছোটো ছোটো মেঘ সকালের আকাশের বুকে যেন ঢেউ তুলছে। সত্যিই – Abode of Clouds. মাওলিনঙ থেকে বেরোনোর পথে বাম্বু স্কাই ওয়াকে নামলাম। বাঁশ দিয়ে বানানো স্কাইওয়াক। বেশ সাবধানে পা ফেলতে হয়। রাস্তায় ড্রাইভার দাদার কাছে এই অঞ্চলের আরও কিছু বিশেষত্ব জানতে পারলাম। এখানে সমাজ কিছুটা মাতৃতান্ত্রিক। এখানে মেয়েরা বিয়ে করে বরের বাড়ি যায় না, বরং ছেলেরা বিয়ের পর মেয়ের বাড়িতে থাকে। অধিকাংশ দোকানেই দেখলাম মেয়েরা রয়েছে। পেট্রোলপাম্পেও কর্মচারী হিসেবে মেয়েদের আধিক্য। কিছু কিছু জায়গায় বাড়ির সব সম্পত্তিও বাড়ির ছোটো মেয়েই পায়। মেয়েদের গুরুত্ব দেখে সত্যিই বেশ লাগলো। পৃথিবীব্যাপী সমাজব্যাবস্থাও বোধহয় এভাবেই ব্যালান্স হয়।

 

চেরাপুঞ্জির অন্যতম বিশেষত্ব ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ। পার্কিং পয়েন্ট থেকে আসা যাওয়া নিয়ে পাহাড়ি পথে প্রায় ১০০০০ স্টেপস। প্রায় সাত ঘন্টা লাগলো। গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি এই প্রাকৃতিক দো’তলা ব্রিজ বিশ্বের আর কোথাও নেই। সেইজন্যেই বোধহয় “হেরিটেজ সাইট” তকমা দেওয়া হয়েছে। মেঘালয়ে প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ বারবার অবাক করছে। ডাবল ডেকার থেকে আরও ঘন্টা খানেকের ট্রেক করে পৌঁছালাম ব্লু লাগুন। পাহাড়ের কোলে স্বচ্ছ নীল জলের জলাধার। যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে নিলাম এই শীতল স্পর্শে। চেরাপুঞ্জির আকাশও দেখার মতো। এত নীল আগে কখনও দেখেছি কি না মনে পড়ে না। রাতে হোমস্টেতে ফিরে বনফায়ারের আনন্দে মেতে উঠলাম। দিনভর ট্রেকিংয়ের ধকল আগুনের ওমে ফুরিয়ে এলো।

সকালে যখন উঠলাম, পায়ের ব্যথাটা বুঝতে পারলাম। হাঁটতে চলতেও রীতিমতো সমস্যা হচ্ছে। পা টেনে টেনে হাঁটতে হচ্ছে। কাফ মাসলস’গুলোয় একটা তীব্র যন্ত্রণা।l এখনও অনেকগুলো ট্রেকিং রয়েছে, তবে কালকের মতো ওতো বড় না। পায়ে স্প্রে করে কিছুটা আরাম পেলাম। প্রথম গন্তব্য মাওসমায় কেভ। গুহার ভেতর এভাবে এক্সপ্লোর করার অভিজ্ঞতাও এই প্রথম। কিছু কিছু জায়গায় আলোও নেই। পায়ের নিচে বয়ে যাচ্ছে জল। সব মিলিয়েই এক দারুণ ব্যাপার। মোবাইলের টর্চের আলোয় পুরোটা ঘুরেই বেরিয়ে এলাম। আরিয়া কেভও ভীষণ সুন্দর, তবে এক্ষেত্রে কিছুটা অভ্যস্ত লাগলো।

 

মেঘালয়ের প্রতিটি ঝর্ণাই প্রায় ট্রেক করে কিছুটা গিয়ে দেখা যায়। নোহকালিকাই, এলিফ্যান্ট, ওয়াকাবা পায়ের ব্যথা নিয়ে হেঁটে নামলেও নিরাশ হতে হয়নি। অবশ্য লক্ষ্য করলাম আমাদের মতোই পা টেনে টেনে হাঁটছে আরও কয়েকজন, অনেকে তো একমুখ হাসি নিয়ে প্রশ্নই করে ফেললো – “ডাবল ডেকার গয়ে থ্যে ক্যায়া? ” মনে মনে বেশ মজা লাগছিলো। সেভেন সিস্টার্স ফলসও ভীষণ সুন্দর। পাহাড়ের গায়ে সাতটি জলের ধারা।

শেষদিন চেরাপুঞ্জি থেকে গৌহাটি ফেরার পথে রাস্তায় থামলাম, উদ্দেশ্য – জিপ লাইনিং। দুটো পাহাড়ের মাঝে একটা দড়ির সাহায্যে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় ঝুলতে ঝুলতে যাওয়া। দেখে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক। ২৬০০ ফুট লম্বা, ১২০০ ফুট উঁচু জিপ লাইনিং। জীবনের আরেক দুর্ধর্ষ ও অন্যতম অভিজ্ঞতা। অবশ্য প্রথমে ভয় লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা উধাও হয়ে গিয়েছিলো। দড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের নিচের ছোটো ছোটো বাড়ি, নদীর রেখা – সে এক ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা। নিজেকে পাখি মনে হওয়াটাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। টু ডু লিস্টে আরেকটা দাগ পড়লো বৈকি।

 

একই ট্রিপে একসাথে এতগুলো অভিজ্ঞতা এই প্রথম – ট্রেকিং, জিপ লাইনিং, কেভ এক্সপ্লোরিং, ডাউকিতে নৌকা চালানো, বনফায়ার…। এবার ফিরে আসার পালা। একরাশ ভালোলাগার ঝুলি নিয়ে স্মৃতির আকরে যত্নে তুলে রাখা। আবারও কখনও ঝুলি খুলে বসে স্মৃতির রোমন্থন। এভাবেই জীবন ভালোলাগার উৎসব হয়ে ওঠে, প্রতিটি দিনই তার উদযাপন।

পরের দিন সকালেই কলকাতার ফ্লাইট। আমাদের ঘরে ফেরার গান ইতিমধ্যেই শিলংয়ের রাস্তায় গুনগুন করে উঠলো… কানে কানে কেউ যেন বলে গেল আবারও ফিরে আসার কথা। সাক্ষী থাকলেন অন্তর্যামী।

তারিখঃ জানুয়ারি ১৮, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse