মেরুদণ্ডহীন
দেবব্রত সরকার
১, তৃণার কথা:
নাসিংহোম পৌঁছেই মেজাজটা খিচড়ে গেল তৃণার। একদল হিজড়ে ঝামেলা জুড়েছে রিসেপশনের সামনে। সিকিউরিটি কোথায়? এখন ডিউটি বদলের সময়, বারবার বলা হয়েছে, এইসময় যেন মেনগেট খালি না থাকে, আজ সিকিউরিটি সুপারভাইজারকে ডেকে ভালো করে কড়কে দিতে হবে।
তৃণা প্রথমে ভেবেছিল ঝামেলাটা বোধহয় কোন রোগীর বাড়ির লোকেদের সাথে। অনেক সময় হয়। দূরের কোন রোগীর বাচ্চা হলে, ওদের নেটওয়ার্কের বাইরের, যেখানে নিজেরা গিয়ে বাচ্চা নাচিয়ে সুবিধা করতে পারে না, সেখানে পেশেণ্ট পার্টির সাথে কথা বলে একটা রফা করে নেয়। কোথা থেকে ওরা খবর পায় তৃণার জানা নেই। ওদের নেটওয়ার্ক ভীষণ ভালো। যদিও নাসিংহোমর মালিক ডাক্তার বোস নাসিংহোমর ভিতর এসব মোটেও পছন্দ করেন না।
রিসেপশনে ঢুকতে গিয়ে কিছু শব্দ কানে গেল তৃণার, ওদের বক্তব্য, এই নাসিংহোম থেকে ওদেরকে সঠিক তথ্য দেওয়া হচ্ছেনা। ওদের কাছে খবর আছে এখানে যত বাচ্চা হচ্ছে সব খবর ওরা পাচ্ছে না। ভিড়ের থেকে কেউ একটা আওয়াজ দিল – এটা ওদের পেটে মারার চক্রান্ত। সব তথ্য ওদের চাই। না হলে হিজড়ে বসিয়ে দেবে নাসিংহোমে।
তৃণা জানে ব্যাপারটা কতটা খারাপ, সবসময় হিজড়ে বসে আছে দেখলে রোগীই আসা কমে যাবে। ডাক্তার বোস আসার আগে এদের কে এখান থেকে সরাতে হবে। দলটা বেশ ভারি, সবার সাথে কথা বলে লাভ নেই, ওতে কেউ কারো কথা ঠিক করে শুনতে পায় না। এদের মধ্যে লিডার কে আছে দেখে আলাদা করে কথা বলতে হবে।
এমনিতেই আজ নাসিংহোম পৌঁছাতে দেরি হয়েছে তৃণার। গতরাতে ওর জায়গায় পরের নার্স আসেনি। হঠাৎ একটা জরুরি অপারেশন পড়ে গিয়েছিল। জল ভাঙা নিয়ে গত সন্ধ্যেতে ভর্তি হয়েছিল আট নম্বরের বউটা; সাইত্রিশ সপ্তাহের পোয়াতি, পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল বউটার। ডাক্তার বোস সাধরনত সিজার করেন না। পেটের ভিতর মায়ের নাড়িতে জড়িয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটা। অপারেশন না করলে বাচ্চা আর মা দুইই মারা যেতে পারত। খুব জোর বেঁচে গেছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে।
নামে অপারেশন করেন ডাক্তার কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব সাহায্য নার্সদেরই করতে হয়। ওটি সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে বারোটা। বাবা নিতে এসেছিল। বাড়ি বদলানোর পর থেকে একটু রাত হলেই বাবা নিতে আসে।
গতরাতে তিনজন ওদের পিছু নিয়েছিল। মুখ ঢাকা ছিল ছেলে গুলোর। একজনের হাঁটা দেখে তৃণা বুঝেছে ওটা সমীর। সমীর কী করে এই ঠিকানার খোঁজ পেল? তার নতুন বাড়ি, নতুন চাকরীর কথা কারও জানার নয়!
মানুষ কত তাড়াতাড়ি রঙ বদলায়। সাথের ছেলে দুটো নির্ঘাত গুলে আর বগলা। ওর সাগরেদ। ওদেরকে দেখলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে তৃণার। ওরা পারেনা এমন কাজ নেই। এদের সাথেও মানুষের বন্ধুত্ব হয়! বাবা সাথে ছিল বলে হয়ত ওরা কাছে ঘেঁষেনি। কিন্তু ভরসা নেই। ওরা পারেনা এমন কাজ নেই।
আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে বেশ দেরীতে বাবার চিৎকারে। এল্যার্ম দিতে ভুল গিয়েছিল তৃণা। যত বয়স হচ্ছে লোকটার বাচ্চাদের মত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দাদার অমন হওয়ার পর থেকে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আগে যার সকাল বিকেল পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মেরে; দাবা না খেললে চলত না, সেই এখন লজ্জায় সবার থেকে পালিয়ে বেড়ায়? বাবার মনে হয় এইসবের জন্যে মা’ই দায়ী। যত আক্রোশ মায়ের ওপর। যা মুখে আসে তাই বলে। কানে আঙুল দিতে হয়। ইদানীং মাকে কিছু বললে সেও মুখ চালায়। চুপকরে থাকলে দেখেছে সবাই পেয়ে বসে। মা যে কী করে সহ্য করে?
সমীরের ঘটনাটা বাড়ির কেউ এখনও জানে না, জানলে আরেক কাণ্ড হবে! নিজেকেই শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে। কী দেখে সমীরকে ভালবেসেছিল সে!
সমীরের নাম মনে আসায় মুখটা তিতো হয়ে গেল। কিছু কিছু দিন এমন আছে যে পারিপার্শ্বিক সবকিছুই বলে দেয় আজ দিনটা খারাপ যাবে, কোন কিছুই যেন নিজের আয়ত্তে থাকে না। আজ সকাল থেকে একের পর এক চলছে।
এই চাকরীটা নতুন। আগেরটা বদলাতে বাধ্য হয়েছে তৃণা। এখানে সে নামেই নার্স। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতে হয়। আজ আবার রিসেপশনের মেয়েটা আসবে না।
হিজড়ে গুলো রিসেপশনেই ওকে ঘিরে ধরেছে কি আবদার ওদেরকে নাসিংহোমর পেশেন্ট রেজিস্টার দেখাতে হবে। সিকিউরিটি যতই বোঝায় তারা দেখাতে পারেনা, কার কথা কে শোনে।
অনুরোধ করল তৃণা – “কোনও একজন কথা বলুন, এভাবে সবাই কথা বললে কিছু বোঝা যাচ্ছে না”।
শুনতে কেউ রাজি নয়।তৃণা বোঝানোর চেষ্টা করে – আমরা এখান থেকে এভাবে এসব তথ্য দিতে পারিনা।
হিজড়ে গুলো তুই তুকারি শুরু করে দিয়েছে – দিবি না মানে। মাগনা চাইছি?
- সবকিছুর একটা নিয়ম আছে।
ওদেরই একজন জোরকরে গাল টিপে দিল তৃণার, তারপর অদ্ভুত হাতের মুদ্রা করে তৃণাকেই বলল – খুব মিষ্টি দেখতে, দেনা সুন্দরী, অমন করিস কেন?
গালটা টসটস করছে তৃণার, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। এরা গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে ওস্তাদ। এই ফাঁদে পা দিলেই কাপড় চোপড় উঠিয়ে এমন করবে লজ্জার শেষ থাকবে না। আস্তে জবাব দিল তৃণা – রেজিস্টার আমাদের কাছে থাকে না।
এবার বেশ রাগের সাথেই আর একজন বলল – থাকেনা মানে? ছেনাল মারাচ্ছিস।বের কর নাহলে ঢুকিয়ে বের করে নেব।
- কি উল্টোপাল্টা বলছেন? মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না?
অন্যপাশে ওদেরই আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল, লম্বা, পুরুষালি চেহারায় কিন্তু একটা মেয়েলি ভাব আছে সেই বলল – আমরা ছেলে না মেয়ে নিজেরাই জানি না, কীভাবে কথা বলে শিখিয়ে দে?
খিলখিল করে হেসে উঠল বাকি হিজড়ে গুলো – আরে মনা দারুণ দিলি তো।
মনা নামের হিজড়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞা ঝরে পড়ল তৃণার মুখ থেকে।
সিকিউরিটিরা সরানোর চেষ্টা করছে ভিড়টা। হিজড়েদের সাথে তাদের হাতাহাতি বেঁধে গেছে।
মনার কথা শোনার পর থেকে রাগ চড়ছে তৃণারও, সে তাচ্ছিল্যের স্বরে সিকিউরিটিকে জানাল – ঘাড় ধরে বের করে দিন। মেরুদণ্ডহীন যত্তসব।
“মুখ সামলে কথা বলবি” – বলে চিৎকার করে ঘুষি চালালো মনা বলে হিজড়েটা ।
সিকিউরিটিরা ধরে ফেলায় ঘুষিটা ফসকে গেল; জায়গা মত লাগলে নাক মুখ ফেটে যেতে পারত তৃণার। সিকিউরিটির হাতের মধ্যেই চিৎকার করছে সে – আমরা হিজড়ে হতে পারি, তোদের মত গিরগিটি নই।
******************
২, সমীরের কথা:
আসর জমে উঠেছে। মদের। পার্টি দিচ্ছে সমীর। সাথে দুই সাগরেদ। গুলের নাম কী করে গুলে হল; সেটা গুলে নিজেও জানে না। যারা গুলের সাথে মেশে তারাই জানে গুলে কী জিনিস। একবার পেটে মাল পড়লে গুলে হয়ে যায় কামানের গোলা। আর নেশাটা যদি কারও ঘাড় ভেঙে হয়! কথাই নেই। মাল খাওয়ার পর গুলের মাথা খুব চলে; হাতের নিশানাও। আজ গুলের একটা কাজ আছে; করতেই হবে না হলে প্রেস্টিজ গ্যামাক্সিন।
চেষ্টা চালাচ্ছে গত দুদিন ধরে। সুবিধা করতে পারেনি। একবার পাখি ফাঁদে পা দিয়েও ফসকে গেছে। গত পরশু তৃনাকে ডাক্তার বোস নাসিংহোমের গাড়িতে ছেড়ে গেছেন। গতকাল ফিরেছে দেরিতে। মাঝরাত পার করে হিটলারটা সাথে ছিল। শুভ কাজে দেরী ভালো না। আজ এসপার ওসপার কিছু একটা করতেই হবে। বড্ড বেড়েছে মাগীটা। আজ যদি ওর হিটলার বাপও সাথে থাকে গুলে তাকেও রেয়াত করবে না।
তৃণার সাথে সম্পর্ক জানার পর থেকে সমীরের মায়ের আপত্তি ছিল – ধিঙ্গি মেয়ে নার্সের কাজ করে? সংসার করবে? অনেকবার মন কষাকষি হয়েছে মা ছেলের।
সমীরের সাফ জবাব – পাপানদার বউও একই কাজ করে, তুমি বল ওর মত বউ হয়না। তাহলে তৃণার কাজে আপত্তি কোথায়?
- যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে তর্ক করবি না।
- তুমিও শুনে রাখো তৃণার বিরুদ্ধে কোন কথা আমিও শুনব না।
রেগে কাই হয়ে যেতেন রেবতী – এত বড় কথা, এখনও বিয়ে হয়নি তাতেই এত। বিয়ে হলে আমার কী দশা হবে গো?
রেবতী জোর করে কিছু বলতে পারতেন না সমীরের টাকাতেই সংসার চলে। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ত সমরের ওপর – তখনই বলেছিলাম পুরুষ মানুষের রাশ আলগা হলে চলে না। কিছু বলা তোমার ধাতে নেই। যত জ্বালা আমার। লাই দিয়ে ওকে তুমি মাথায় তুলেছ।
উল্টে সমরই বলতেন – মেয়েটারই কপাল খারাপ, তোমার ছেলের মত জানোয়ারের পাল্লায় পড়েছে, দেখ যদি মানুষ হয়।
- কী বললে আমি ছেলে মানুষ করতে পারিনি? কী সর্বনেশে মেয়েরে বাবা এখনও এ বাড়িতে আসতে পারিনি এর মধ্যেই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে! দেখব ও মেয়ে কী করে এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায়।
রেবতীর অবস্থা দেখে হাসবেন না কাঁদবেন বুঝে উঠতে পারতেন না সমর।
সেই সমীরই এখন পালটে গেছে, তৃণার থেকে ওর দাদার খবরটা শোনার পর থেকেই। তৃণা কথা গুলো না বললেও পারত। কিন্তু লুকিয়ে কী লাভ! একদিন সবাই জানত। অন্যের মুখে শোনার থেকে নিজেই বলে দেওয়া ভালো। তাছাড়া ভালবাসলে একটা বিশ্বাসের জন্ম হয়, তাতে ভরসা থাকে।সমীরকে ভরসা করেছিল তৃণা।
সম্পর্কটা কেটে গেছে শুনে ভারতের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল রেবতী – আমি জানতাম ও মেয়ে ভালো হতে পারে না।
সমীর শুধু ভাবছিল এতদিন ধরে কেউ তাকে স্বপ্ন দেখিয়ে পিছন থেকে ছুরি মেরেছে।
মানিয়েও নিচ্ছিল সমীর আর তৃণা দুজনেই নিজেদের মত করে। বেশ কিছুদিন দেখা যাচ্ছিল না তৃণাকে। কদিন আগে মাল খেতে গিয়ে তৃণাদের বাড়ি বদলাবার খবর বগলাই এনেছে। তখনই পোকাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে গুলে।
গুলে জানে তৃণা ওকে মোটেও পছন্দ করে না। এনিয়ে অনেক বার কথা কাটাকাটি হয়েছে তৃণা আর সমীরের।
তৃনা বলত – এই লাফাঙ্গা গুলো তোমার বন্ধু? সারাদিন মেয়েদের টিজ করে বেড়ায়। মদের গন্ধে কাছে দাঁড়ানো যায় না। শুনেছি ড্রাগও নেয়।
- কাজের জন্য খাতির রাখতে হয়।
- কী এমন কাজ? এদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়?
- যা বোঝ না তা নিয়ে তর্ক করো কেন?
গুলে সব জানে, গায়ে মাখে না। যারা অন্যের ঘাড় মটকে নেশা করে তাদের এসব গায়ে মাখতেও নেই। মাল খাওয়াটা গুলে বগলার কাছে রোজনামচা দাঁত মাজা স্নান সারার মতো।
এদেরকে হাতে রাখতে মাল খাওয়ায় সমীরই। ফ্রিতে আসে সমীরের কোম্পানির থেকে। সমীরের ভাষায় – ইনসেন্টিভ।
তৃণা বলত – ইনসেন্টিভ বলে মদের বোতল দেবে?
- যাদের যা নিয়ম।
- তুমি নেবে না বলবে টাকা দিতে।
সমীর জানে সব কথা সবার সাথে বলা যায় না। ইনসেন্টিভ না ছাই। বিনা আবগারি শুল্কের বেআইনি মাল। সরকারী রেকর্ডে নেই। সমীরই দেখভাল করে সব। মালিক মুখ বন্ধ রাখতে সপ্তাহান্তে বোতল ধরিয়ে দেয়। যত বেশী মাল কাটাতি হয় তত বেশী ইনসেন্টিভ।
গুলে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে বলে – ঘুষ।
প্রসঙ্গ পালটায় সমীর – আমার পুরিয়ার কী হল? কড়া ডোজের বলেছিলাম। গেল বারের মত ন্যাতানে গছিয়ো না।
এই কারণেই গুলে আর বগলার মত বন্ধু তার। সমীরেরও লাভ আছে নির্ঝঞ্ঝাটে সময় মত পুরিয়া জোটে। এ ধান্ধা নতুন। বিক্রিবাটা কম কিন্তু কামাই অনেক বেশী।
আর গুলেও জানে তৃণার মত মেয়ের সাথে সমীরের সম্পর্ক থাকলে দুদিকেই লস। তাই প্রতিশোধ নেওয়ার এমন সুযোগ কাছে পেয়ে টোপ ফেলতে দেরী করে না – মালটা বিট্রে করেই বাড়ি বদলে সতী সাজল। এর মধ্যে নতুন মালও জুটিয়ে ফেলেছে। দেখিসনি সেদিন তার গাড়িতে বসে কী লটঘট করছিল। মনে হচ্ছিল মুখে এ্যসিড মেরে শেষ করে দি। গুরুর সাথে মামদোবাজি। এমনি ছেড়ে দিবি? কী রে তুই? ছক্কা না অন্য কিছু?
- জ্ঞান দিবিনেতো, কেলিয়ে দেব।
- যাঃ শালাঃ কে লেঙ্গি মারে আর কোথায় গরম ছাড়ে? তোর মাল অন্যে মস্তি মারছে আর তুই বসে ছেঁড়? বলে হাতে নোংরা ইঙ্গিত করল গুলে।
অন্য সময় তৃণাকে নিয়ে এমন কিছু বললে হয়ত জিভ ছিঁড়ে নিত সমীর, এই প্রথম কিছু বলল না। বোধহয় ভালোবাসা যখন দিক হারায় তখন কোন অনুভূতি থাকে না।
******************
৩, মণীষের কথা:
চাকরিতে আজ প্রথম দিন। অনেক কষ্টে পাওয়া কাজটা। একটা মোবাইল কোম্পানিতে রিকভারি এজেন্টের কাজ। থার্ড পার্টির পে-রোলে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গের লোক চাই। ওয়ার্কিং ইন্টাররভিউ। মণীষের রেজাল্ট দেখে বেশী প্রশ্ন করেনি। জানতে চেয়েছে– টার্গেট বেসড জব, প্রয়োজনে টাফ হতে হবে পারবে?
- সুযোগ দিয়ে দেখতে পারেন নিরাশ হবেন না।
- উই লাইক দিজ কনফিডেন্স। আমরা এক্সপিরিয়েন্সড ছাড়া নিই না। তোমার রেজাল্ট ভালো বলে একটা সুযোগ দিচ্ছি।
চাকরিটার খুব দরকার ছিল মনীষের। যদিও পেমেণ্ট বেশি দেবে না। একার চলে যাবে। এভাবে আর ভালোও লাগছে না। প্রতিদিনই জবরদস্তি বাচ্চা নাচানোর দলের সাথে যেতে হয়। না গেলে গালিগালাজ, অত্যাচার। ওরা ছাড়তেই চায় না, বলে – তুই তো পড়াশুনো জানিস, গুছিয়ে কথা বলিস, তুই সাথে থাকলে মাল্লু বেশি মেলে।কমিশন বাড়িয়ে দেব?
কমিশন! তার বদলে লোকের মুখ থেকে যে সব গালিগালাজ শুনতে হয়? সে পড়াশুনো জানে তাহলে তার আলাদা পরিচয় কেন থাকবে না? নিজের ইচ্ছাতে কি মানুষ তৃতীয় লিঙ্গের হয়?
মনীষ প্রথম যখন বুঝল সে অন্য সবার মত নয়, খুব খারাপ লাগত, নিজের বাড়ির লোক জনই উল্টোপাল্টা বলত, নিজের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। কেউ বুঝতেই চাইতনা, এমনও হতে পারে। চেনা কারো মুখোমুখি হতে বাজে লাগত। এখনও লাগে, লোকে এমন ভাব করে যেন এলিয়েন দেখছে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত মনীষের। কেউ বুঝতে চায়না, যে এটা যেকারো সাথেই হতে পারে, ক্রোমোজোমের হেরফেরে……।
এখন আর পিছনে ফিরে তাকানোর নেই। যারা বুঝতে চায়না তাদের পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ? নিজের জন্মের ওপর কি মানুষের নিজের হাত থাকে?
এখানে নিজের নামটাও পর্যন্ত কেউ বলতে চায়না। এখানে আসার পর থেকে ও এদের মনা ডার্লিং। একজন আবার ওকে তার চ্যালা বানিয়েছে। এলাইনে নাকি তারিক্কি করতে গেলে গুরু ধরে নাড়া বাধতে হয়। নাড়া বাঁধা মানে কি? দল বেঁধে গিয়ে বাচ্চা নাচানো? গালিগালাজ করা? এরই নাম যদি তারিক্কি করা হয়, তবে তার আর দরকার নেই মণীষের। যদি একটু বাড়ির সাহায্য পেত, হয়ত জীবনটাই বদলে যেত। বাবাই মেনে নিতে পারল না। যে বাবা এত ভালোবাসত সে এইভাবে মুখ ফেরাতে পারে কি করে?
সকালে নার্সিংহোমে চিল্লামিল্লি বেশি হয়ে গেছে। ডাক্তারটা ভালো ছিল নাহলে থানা পুলিশ করে ছাড়ত। এরপর থেকে এমন কাজে যেতে বললে মুখের ওপর না করে দেবে।
দুপুরেও বেশ চাপ গেছে। নতুন চাকরি ইন্ডাক্সন ট্রেনিং ছিল, কীভাবে কাজ করতে হবে, কাদের সাথে কাজ করতে হবে তারই সাতকাহন। ভর সন্ধে বেলা কতকগুলো নাম ঠিকানা ধরিয়ে দিল, অফিসের ভাষায় লিড দেওয়া।
নতুন যারা মোবাইল পোষ্টপেড নাম্বার নিচ্ছে তাদের ঠিকানা যাচাই এর কাজ। বকেয়া পাওনা আদায়ের কাজ শুরু করার আগে বিভিন্ন কাস্টমারের বিহেভিয়ারের সাথে পরিচিত হওয়া।
আগামীকাল গেলেও চলত। আজকের মতো অফিস শেষ। বাসায় যেতেও মন চাইছে না। এখন সন্ধ্যেটা খারাপ কাটে ওর। কত আর এদিক সেদিক ঘুরতে ভালো লাগে। আস্তানায় ফিরলে দেখা যায় হয় বাকিরা মাল খেয়ে পড়ে আছে, না হলে খিস্তি খেউড়ের প্রতিযোগিতা চলছে। নিজেদের বখরা নিয়ে ঝগড়া ঝাঁটি।
ঘরে ফেরার আগে কয়েকটা ঠিকানা যাচাই করলে হত। প্রথম নামটাতে চোখ আটকে গেল। নামটা খুব চেনা। মহীতোষ সেন। ও যে ঠিকানাটা জানে আর এখানে যে ঠিকানা আছে দুটোই আলাদা। একই নামে দুইজন একই শহরে থাকতেই পারে।
অফিসের বাইরে এসে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল মণীষ। বাইক চালাতে চালাতে মনে হল, ছোট একটা ভুল হয়ে গেল। আজ ট্রেনিংয়ে বলেছিল, কাস্টমার ইজ আওয়ার গড। নতুন উপভোক্তা মানে নতুন সম্পর্কের বন্ধন। তোমাদের কাজ কোম্পানী আর উপভোক্তার মাঝে জনসংযোগের। যেন কোম্পানি সম্পর্কে উপভোক্তার মনে কোনও খারাপ ধারনা না তৈরি হয়। প্রথমেই কারো সাথে দেখা করার আগে ফোনে কথা বলে, সময় চেয়ে, অনুমতি দিলে তবেই যাওয়া উচিত। সেটাই শিষ্টতা। রওনা দেওয়ার পর কথা গুলো খেয়াল হল মণীষের। বাইক চালানো থামাল না রাস্তাতেই ফোন করে নিলে হবে। নির্দিষ্ট দূরত্ব আসার পর জিপিএসে এর আগে রাস্তা দেখাচ্ছে না।
কাছের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই জানালো – আরও অনেকটা ভিতরে যেতে হবে।
এত ভিতরে কেউ বাড়ি বানায়? ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি হবে বোধহয়, কেয়ার অফে কারো নাম নেই। দোকানদার যে ভাবে বলেছেন তাতে সামনের বাঁক পেরিয়ে অনেকটা যেতে হবে। এদিকে বাড়িঘর কম। চারিদিকে ঝোপঝাড়। বাঁক পেরোনোর আগেই লোডশেডিং হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার। বাইক থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল মণীষ। আগে এগোনোর থেকে, ভদ্রলোক বাড়িতে আছেন কিনা জেনে এগানো ভালো। ফোন লাগাল মণীষ। রিং হচ্ছে। মণীষ হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠের তীব্র চীৎকার ভেসে এলো – এ নম্বরেরও খোঁজ পেয়ে গেছ? আমাকে না মারলে কি তোমার শান্তি নেই। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ কোথাকার। বলেছিনা আমার সাথে কোনও সম্পর্ক রাখবে না।
পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে তার, ফোন কেটে দিল মণীষ। তখনই কানে গেল শব্দটা, পাশের ঝোপের ভিতর কেউ সর্বশক্তি দিয়ে গোঙাচ্ছে। মেয়ের আওয়াজ। মুখে কিছু বাঁধা। পাশ থেকে কেউ চাপা গলায় বলছে – ঢ্যামনা দেরী করছিস কেন ঢোকা নাহলে নালি কেটে দেব।
মুহূর্তে হাত পা শক্ত হয়ে গেল মনীষের। বুঝে নিতে দেরি হল না ঝোপের আড়ালে কী হতে চলেছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য সব সময় বাইকের সাথে একটা শক্ত লাঠি বেঁধে রাখে সে, খুলে নিয়ে নিঃশব্দে ঝোপের ভিতর ঢুকল মণীষ।
অন্ধকারটা এখন একটু চোখ সয়ে গেছে। মেয়েটাকে মাটিতে ফেলে একজন ওপরে চেপে বসেছে পাশে আরও দুজন আছে। মেয়েটা সর্বশক্তি দিয়ে আটকাবার চেষ্টা করছে। নিঃশব্দে আরও একজন যে ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই। মাঝের লোকটার মাথা লক্ষ্য করে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করল মণীষ।
******************
৪, শেষের কথা:
মণীষের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর পুলিশের সঠিক সময়ে তৎপরতার জোরে ধরা পড়েছে তিন অপরাধী। সবাই মাল খেয়ে টাল ছিল। সমীরের মাথা বাজেভাবে ফেটেছে। গুলের দুপায়ের মাঝখানে মনীষের এমন লাথি লেগেছে বোধহয় কোনদিনও সে বাবা হতে পারবেনা। মোবাইলের টর্চ অনেক সাহায্য করেছে। বগলা পালিয়ে যাচ্ছিল, মণীষ তাকেও আঘাত করেছে লাঠি দিয়ে, ধস্তাধস্তির সময় বগলার হাতের ভোজালির কোপে মণীষের অনেকটা হাত কেটে গেছে। বেশ কয়েকটা সেলাই পড়েছে।
তৃণার মেডিকেল করানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন না করালেও চলত। পুলিশের কেস বানানোর জন্য দরকার ছিল। ডাক্তার বোসকে খবর দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি খবর পেয়েই অনেক সাহায্য করেছেন। ওপর মহলে ওনার হাতযশ কাজে এসেছে।
এখন ভোর পাঁচটা। মণীষেরা এখনও থানাতে। তৃণা, ওর বাবা, মা আর মণীষ। কাগজ পত্রের কাজ শেষ। সই সাবুদ চলছে।
ওসি শ্যামল দত্তরায় থানাতে ছিলেন না। ফোনে কেসের গভীরতা শুনেই চলে এসেছেন। ব্রেকিং নিউজ হওয়ার মত কেস। মিডিয়াকে সেই ভাবে সামলাতে হবে। একটা প্রমোশন বাকি। সিনিয়র কেউ চলে এলে মিডিয়ার সব ফোকাস ওদিকেই চলে যাবে। নাম কেনার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে!
এসেই জড়িয়ে ধরলেন মণীষকে – তুমি কী করেছো নিজেও জান না। ড্রাগ পাচারের কেসে তিনজনকেই আমরা খুঁজছিলাম। সাথে আবার এ্যটেম টু রেপ। এমন কেস দেব এজীবনে আর বাইরে আসতে হবে না। তুমি খুব সাহস দেখিয়েছ। আমি চেষ্টা করব যদি তোমার জন্য কিছু করা যায়।
পাশ থেকে তৃণার বাবা মহীতোষ বলে উঠলেন – আমার একমাত্র ছেলে।
মণীষ দাঁতে দাঁত চিপে বলে উঠল – এক জন নপুংসক মেরুদণ্ডহীন কে নিজের ছেলে বলতে এবার লজ্জা করবে না?
মহীতোষ মাথা নিচু করলেন। পূর্বদিক ফরসা হচ্ছে, ভোরের আলোতে বোঝা গেল না কে সত্যিকারের মেরুদণ্ডহীন।
******************
তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১