যাত্রার সেকাল এবং একাল, বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য
জয়শ্রী গাঙ্গুলি
বহু শতক ধরে চলে আসা গ্রাম বাংলার শৈল্পিক বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল যাত্রা । বিগত শতাব্দীর সত্তর আশির দশকে বা তারও আগে ইন্টারনেট দুনিয়া যখন প্রভাব ফেলেনি মানুষের জীবনে অথবা তারও আগের সময়ে টেলিভিশনের প্রবেশ ঘটেনি বাঙালির জীবনে, মানুষের অবসর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল যাত্রাপালা।
গ্রামে গ্রামে বাঙালির উৎসব দুর্গাপুজোটা পেরিয়ে গেলেই হিমেল ছোঁয়া যখন বাতাসে লাগত — অথবা শীতের কুয়াশা ঝরে পড়ত পেকে যাওয়া ধানশীষের আগায়, বারোয়ারী মণ্ডপগুলোতে অথবা গ্রামেগঞ্জেও ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটির প্যাণ্ডেল করে শুরু হয়ে যেত যাত্রাপালার উৎসব। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে শুরু করে ছোট ছোট শিশুরাও মায়ের আঁচলের তলা থেকে বড় বড় চোখে জমকালো পোশাক পরা রাজা রাজড়ার কাহিনী, বিভিন্ন পৌরাণিক পালা, ঐতিহাসিক পালায় যাত্রাভিনয় দেখত। তাতে শহুরে চাকচিক্য হয়ত থাকত না বা সূক্ষ্ম শিল্পকলার ছোঁয়া সবসময় থাকত না, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের আবেগ মিশে যেত আনন্দের সাথে। এই যাত্রা বা যাত্রাপালাই বাংলার নিজস্ব সম্পদ।
বেশ কয়েক শতাব্দী আগেও এই যাত্রা ছিল দেবদেবীদের নিয়ে শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার ভক্তিমূলক গানগুলি ক্রমে আসরে উঠে এলো এবং শোভাযাত্রার ‘ শোভা’ বাদ দিয়ে ক্রমশঃ ‘যাত্রা’র রূপ নিল। শ্রীগৌরাঙ্গের আগে পর্যন্ত এই যাত্রা শুধু গানের মালাই ছিল এবং অলিখিত ছিল অর্থাৎ মুখে মুখে গাওয়া হতো। যতদূর জানা যায়, শ্রীগৌরাঙ্গ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে যে যাত্রাভিনয় করেছিলেন তাতেই প্রথম অল্পস্বল্প গদ্যকথা দিয়ে গানের মালা গাঁথা হয় এবং পালার আকার নেয়,সেগুলিই ছিল প্রথম লিখিত যাত্রাপালা। এরপর থেকে কৃষ্ণযাত্রা ,রামযাত্রা ,চৈতণ্যমঙ্গল ,শিবযাত্রা প্রভৃতি গীতিনাট্য যাত্রার রূপে এল ।
প্রায় একশো বছরেরও বেশি আগে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ মতিলাল রায় প্রথম সার্থক যাত্রাপালা রচনা করেন। তিনিই যাত্রাশিল্পকে গীতিনাট্য থেকে গীতাভিনয়ে নিয়ে যান। মতিলাল রায় আদিরসকে বর্জন করে আনলেন ভক্তিরস । তাঁর যাত্রাপালায় গানের সংখ্যা বেশি থাকত, দীর্ঘ সংলাপ থাকত, নানারকম উপমা ,অনুপ্রাস ও পাণ্ডিত্যের বাহুল্য ছিল। এইসময়, যাত্রাগানের আসরগুলিতে পৌরাণিক পালাই বেশি অভিনীত হত। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে এইসব যাত্রাপালার উপস্থাপন বিষয়ও পরিবর্তিত হতে থাকে। তাতে যেমন স্হান পেতে থাকে সামাজিক ও ঐতিহাসিক সমস্ত কাহিনী, সেরকমই জায়গা করে নেয় দেশাত্মবোধক অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় সম্বলিত কাহিনীগুলি।
একেবারে আদি থেকে আজ অব্দি এই মূল্যবান শিল্পমাধ্যমটির সুসম্পূর্ণ ইতিহাস পাওয়াটা খুবই কঠিন। শোনা যায় কেঁদুলী গ্রামের এক ব্রাহ্মণ শিশুরাম অধিকারী যাত্রার নবপ্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর উত্তরসাধক রূপে শ্রীদাম, সুবল, পরমানন্দ এবং আরো কয়েকজন যাত্রার পুনরুজ্জীবনে ব্রতী ছিলেন।
শখের যাত্রা — একসময় কলকাতায় শৌখিন লোকেদের বিনোদনের জন্য ‘ শখের যাত্রা ‘ নাম নিয়ে এক নতুন দল গঠিত হয়। এই শখের যাত্রার আদি কোথায় সঠিকভাবে তা জানা যায় না। শোনা যায়, কলকাতার বৌবাজারের জনৈক ধনাঢ্য ব্যাক্তি রাধারমনই এর প্রবর্তক ।আড়িয়াদহে শখের যাত্রার দল গঠিত হয় ১৮২২ সালে।
বরানগরের শখের যাত্রাদলের সমকালে কলকাতার ভবানীপুরের বেলতলার শিবঠাকুরের বিদ্যাসুন্দর যাত্রাপালার উল্লেখ পাওয়া যায়। গোপালচন্দ্র দাস যিনি সারা বাংলায় গোপাল উড়ে নামে খ্যাত ছিলেন তিনিও প্রথমে শখের যাত্রার দল গঠন করেন।
সেকালে যাত্রার আসরে আরেকজনের আবির্ভাব ঘটেছিল — তিনি হলেন মদন মাষ্টার। তিনিও প্রথমে শখের যাত্রার দল গড়েন।
তাঁর ‘ দক্ষযজ্ঞ’ পালার একটি গান হল
‘ তাই ভাবি গো মনে,বিনা নিমণ্ত্রনে,
কেমন করে যজ্ঞে যাই বলো না
তোমরা সবে যাবে সমাদর পাবে,
আমি গেলে পিতা কথাও ক’বে না ‘।
১৮৬৭ সালে বাগবাজারে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্র,ধর্মদাস সুর, রাধামাধব কর প্রভৃতি নাট্যরসিকরা মিলিত হয়ে একটি শখের যাত্রার দল গঠন করেন। মাইকেলের ‘ শর্মিষ্ঠা ‘ নাটক অনুষ্ঠিত হয় এবং যাত্রার উপযোগী গান রচনা করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
সেকালে শখের যাত্রার দল হিসেবে আর একটি দল খুব নাম করেছিল। সেই দলটির নাম ছিল অভয় দাসের দল। সে হল বাংলা সন ১৩০৬ সালের কথা। এ সময় হরিপদ চট্টোপাধ্যায় দলে এসে যোগ দিলেন এবং তাঁর যাত্রাপালা ‘ দাতাকর্ণ ‘ অভিনয়ের জন্য প্রদান করেন। ‘ রুক্সাঙ্গদ রাজার হরিবাসর ‘ ,’ প্রহ্লাদচরিত ‘, ‘ শুকদেবচরিত’ প্রভৃতি কয়েকটি জনপ্রিয় পালা তাঁরই লেখা। সেকালের যাত্রার যে পরিবেশন পদ্ধতি তার পরিবর্তন দেখা যায় ১৩১১ সাল থেকে। হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ই এই পরিবর্তন আনেন। পুরোনো পদ্ধতিতে যাত্রা শুরু হবার আগে ‘ আখড়াই বন্দী ‘ হতো। এতে অল্প বয়সের ছেলেরা মেয়ে সেজে এসে আসরে নেচে নেচে গান গেয়ে প্রথমে আসর জমাতো। এই নৃত্য বর্জিত হলো পরে। এছাড়াও সে সময় আসরে চার থেকে দশজনের একটি দল,পাগড়ি,চোগা চাপকান পরা, পাজামা পরা উকিল বেশধারী একদল গায়ক অভিনেতা, অভিনয় চলাকালীন মাঝে মাঝে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে ‘ উক্তিগীত’ গেয়ে যেত। এই প্রথাটিও বর্জিত হলো । এর পরিবর্তে এল একজন গায়ক বা গায়িকার চরিত্র । এই চরিত্রটি পালার মাঝখানে এসে গান গেয়ে যেত। এই চরিত্রকে বলা হতো বিবেক।
বাংলা ১৩১২সাল থেকে ‘ পদ্মিনী ‘ পালায় থিয়েট্রিক্যাল সুরের প্রয়োগ দেখা যায়।হরিপদ চট্টোপাধ্যায় এক নতুন স্বাদ এনে দেন দর্শকদের সামনে।
থিয়েট্রিক্যাল যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন নারায়ণ চন্দ্র দত্ত। নারায়ণ মাষ্টারমশাই নামে ইনি সুপরিচিত ছিলেন। ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন এই নারায়ণ মাষ্টারমশাই। সেসময়ের কর্ণেট বাদক গোপালবাবু এবং ক্ল্যারিওনেট বাদক ভূষণবাবুর বেশ নাম ছিল। এর আগে যাত্রাপালায় কর্ণেট ও ক্ল্যারিওনেট বাজানো হতো না।বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করা হতো বেহালা, তানপুরা, হারমোনিয়াম,ঢোল, বাঁয়া , তবলা এবং মন্দিরাও বাজানো হতো ।
যাত্রায় সেসময়ের আর এক গুরুত্বপূর্ণ নাম ছিল ‘ গোপাল উড়ে। এই গোপাল উড়ের নাম বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।কটকের কাছে জাজপুর এঁর জন্মস্থান। ইনি প্রথম জীবনে কলকাতায় মনোহারি জিনিস ফেরি করে বেড়াতেন। পরবর্তীকালে যাত্রায় যোগ দেন। দেখতে অতি সুপুরুষ এবং সুকণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পীকে অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে অসুবিধা হয়নি। কথিত আছে, তাঁর মুখশ্রী এতোই কমনীয় ছিল যে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করলে তাঁকে আর পুরুষ বলে চেনা যেত না। সে যুগের পালাকার হিসেবে লোকনাথ দাসের কথাও উঠে আসে। কলকাতার বেনেপুকুর অঞ্চলের বাসিন্দা এই লোকনাথ দাস সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। কলকাতা শহরে দুগো ঘোড়েলের যাত্রাদল একসময় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে। এই দলে দুই সুকণ্ঠী গায়ক লোকনাথ দাস ও কালীনাথ হালদার ছিল দলের প্রাণস্বরূপ । এদের দলের তিনটি পালা ‘ নল দময়ন্তী ‘,’ কলঙ্ক ভঞ্জন’, এবং ‘ শ্রীমন্তের মশান’ একসময় খুব জনপ্রিয় হয়।
খ্রীষ্টিয় অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যাত্রার কদর বাড়তে থাকে। কিন্তু ঠিক কবে থেকে মহিলা শিল্পীরা যাত্রাভিনয়ে এলেন তার সঠিকভাবে জানা যায় না। ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করত । শুধুমাত্র বাংলাতেই নয়, সেকালের ইংরেজদের শখের থিয়েটারেও ছেলেরাও মেয়ে সেজে অভিনয় করত।
যাত্রাদলের অভিনেতা,বাদক ও নাট্যকার; থিয়েট্রিক্যাল ভাবধারা আসার আগে পালার সময় আসরে বসতেন দুজন ওস্তাদ। একজন ছন্দের গতির শাসক ( মৃদঙ্গ,বাঁয়া , তবলা ও ঢোলবাদক ) আর একজন সুরের রেশ ধরে রাখতেন বেহালার ঝংকার ও সুরের মূর্ছনায়। এভাবে যাত্রা শুরু হত আখড়াই বন্দী দিয়ে তারপর হত ‘ মঙ্গলাচরণ’ অর্থাৎ বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা।
যাত্রায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত প্রম্পটারের। এই প্রম্পটার আসরের আড়ালথেকে অনুচ্চ স্বরে ডায়লগ বলে যেত যাতে অভিনেতারা ডায়লগ ভুলে না যায়।
প্রায় আশি পঁচাশি বছর আগে কলকাতার ছাতুবাবুর বাজারে যাদব বাঁড়ুজ্জের দল থেকে তিনটি যাত্রাদলের উদ্ভব হয়। ১. শ্রীচরণ ভাণ্ডারীর নামে হয় শ্রীচরণ ভাণ্ডারীর দল ,২. যামিনী ভাণ্ডারীর দল ৩, এই তৃতীয় দলটি তৈরি করেন শ্রীচরণ ভাণ্ডারীর এক পুত্র।
এই সময় গিরীশ চাটুজ্জের দলও খুব নাম করেছিল।
একটি কথা খুবই প্রাসঙ্গিক এখানে,এ সময়ের যাত্রা অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে শিল্পী বলা হয়, সেসময় ( ৬০/ ৭০) বছর আগে যাত্রাপালার অভিনেতা অভিনেত্রীকে বলা হতো ‘ আসামী ‘। সেসময় এই শিল্পমাধ্যমের এতো সমাদর ছিল না। এই দলগুলি তখন গোরুর গাড়িতে চড়ে,টিনের বাক্সে সাজপোশাক ভ’রে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আসর করত। অনেক কষ্টের জীবনের মধ্যে দিয়ে চলতে হতো তাদের। মূলত: গ্রামের মানুষেরাই যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাঁশের মাথায় সরা বসিয়ে রেড়ির তেল দিয়ে মোটা করে পলতে দেয়া হতো। ওই আলোতেই আসর বসত। খড়ি আর আলতা মেখে শিল্পীরা সাজতো।
একালের কয়েকটি বিখ্যাত যাত্রাদলের নাম; সত্যম্বর অপেরা, ভাণ্ডারী অপেরা, নট্ট কোম্পানি, নিউ রয়েল বিনাপানি ,মাধবী নট্ট কোম্পানি, শ্রীকৃষ্ণ অপেরা, মঞ্জরী অপেরা, অগ্রগামী, বীনাপানি নাট্য কোম্পানি, আর্য অপেরা, ভারতী অপেরা ইত্যাদি।
দীর্ঘ আটশো বছর ধরে যাত্রাপালার যে উন্নতি হয়েছে তা অবশ্যই গৌরবের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শতকের বেশ কিছু প্রসিদ্ধ পালাকারের নাম উল্লেখযোগ্য
যেমন, ব্রজেন্দ্র কুমার দে, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়,সঞ্জীবন দাস, অরুণ রায়, নরেশ চক্রবর্তী, নারায়ণ দত্ত,নির্মল মুখোপাধ্যায়,সত্যপ্রকাশ দত্ত।
যাত্রাগান বাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য। গ্রামবাংলার আপামর জনসাধারণের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়ার এরকম শিল্পমাধ্যম আর একটিও নেই। সমাজের ছবি, সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সমাজের সমকালীন পরিস্হিতি, ঐতিহাসিক কাহিনী, ভক্তিমূলক কাহিনী, পৌরাণিক পালা — মানুষের আবেগের প্রকাশ এই শিল্পমাধ্যমটির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। বাংলার এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে লালন করা শিল্পানুরাগী প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য ।
তথ্যঋণ : ’বাংলার যাত্রানাটক’ — ব্রজেন্দ্র কুমার দে
‘ যাত্রাগানের ইতিবৃত্ত’— বীরেশ্বর ব্যানার্জী
আন্তর্জাল
তারিখঃ এপ্রিল ১৩, ২০২৩