যুদ্ধ
ফারহানা নীলা
কালিঞ্জা নদীটা বর্ষাকালে ভরা আর বাকী সময় শুকনা খটখটে। নৌকায় পারাপার করতে হয়। ভদ্রঘাট হয়ে বেশ কিছুটা পথ এসে নৌকায় চড়ে আজান। ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে। করোনা নামের কি এক অসুখে ছাঁটাই চলছে। আজান তল্পিতল্পা নিয়ে বাড়ির পথে।
ঘাট পার হয়ে আবার হাঁটা পথ। একটু দূর এগুলেই কয়াবিল গ্রামটা। দু একটা ভ্যান চলে। প্রায় বছর পর আজান গ্রামে এলো।
…. কে? কে এলো? ওযু? জায়নামাজ? তসবিহ? খোদেজা বিবি একাধারে বলে চলে। তবুও আজান নামটা মনে পড়ে না!
খোদেজা বিবির বয়স প্রায় সত্তরের ঘরে। দেখে মনে হয় আরো বেশী। চোখে দেখে না। সারাদিন ঘরের বাইরে বসে বলতে থাকে — কে? কে? কে এলো? কখনো ডুমুর, কদবেল, কখনো ওযু, তসবিহ!
আজানের দাদী খোদেজা বিবি। আজান কোনো কথা না বলে কাপড় নিয়ে ঘাটে যায়। গোসল করে এসে দাদীর সাথে কথা বলবে।
গ্রামে কোনো করোনার ভয় নেই। মাস্ক বা দূরত্ব নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। আজানের মা বাবা নেই। দাদীই সম্বল। এই দাদী ছোটবেলায় কত কি না করেছে আজানের জন্য! এখন দাদী আজানকেই চিনতে পারে না! আজান গোসল শেষে দাদীর কাছে বসে।
…. দাদী গো দাদী! আমি আজান।
…. কে? কে? কে এলো? ওযু, মসজিদ,তসবিহ…. খোদেজা বিবি বলেই চলে।
——-
বাড়িতে এক ফুফু আছে। তিনিই দাদীর দেখাশোনা করেন। ফুফুর কাছে রাত জেগে কত গল্প শুনেছে আজান! ভাত খেয়ে গোরস্তানের দিকে হাঁটে আজান।বাবা আর মা ওখানেই আছে। কবরে জবাফুলের গাছটা ফুলে ভরে আছে।
——
আজান তখন ছোট। বাবা- মা,দাদী,ফুফু… সবার আদরে বড় হয়।গ্রামে গরু চুরির সালিশ বসে। কারা জানি বাবার নাম জড়িয়ে দেয়। সালিশে কথা হয় যত না গরু চুরি নিয়ে, তার বেশী কথা হয় বাবাকে নিয়ে। বাবাকে অকথ্য ভাষায় কথা বলে ওরা। বাবা সেদিন খুব কেঁদেছিল।
খোদেজা বিবির বয়স তখন প্রায় বাইশ। কুচকুচে কালো চেহারা। পাতিলের কালোও বুঝি হার মানে।
বিয়ের কথা চলে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসে,খায় দায়,ফিরে গিয়ে জবাব দিয়ে দেয়।
এর মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। খোদেজা বিবি তখন গ্রামের সব মুক্তির ভরসা হয়ে ওঠে। রাত-বিরেতে একেকজন অথবা দলেবলে খেতে আসে। খোদেজা বিবি ওদের জন্য রেঁধে রাখে।সবাই বুবু ডাকে।
… দরজায় টোকা! বুবু! বুবু! আমি রতন!
খোদেজা দরজার খিল খুলে আস্তে ডাকে— আয়!
—- বুবু রাজাকারের দল মিলিটারিকে সব কয়ে দিছে। আইজ রাতেই পালায় যাও। সেই কথাই কবের আসছি।
— কোনে যাবো? কেন যাবো? কি করিছি?
— অত কথার কাম নেই! আলো ফুটার আগেই চলো আমার সাথ।
বাহিরে দপদপ বুটের আওয়াজ। রতনকে কই লুকাই?
খোদেজা রতনের উপর গোলার ধান ঢেলে দেয়। চারিদিকে ছিটিয়ে আছে ধান। দরজার ওপাশে আওয়াজটা বাড়ছে। খোদেজা দরজা খোলে না। কেউ একজন ধাক্কা দেয় সজোরে। নড়বড়ে দরজাটা….
——
কুচকুচে কালো মেয়েতেও ওদের অরুচি নেই। প্রতিরাতে একেকজন আসে, বোতলের কিসব খায়। খোদেজার চুল গুলো ছিঁড়ে গেছে টানতে টানতে। বুকে, নাভীতে, পিঠে দাঁতের ক্ষত দগদগে। আগে রক্ত দেখলে ভয় পেতো খোদেজা। এখন রোজ রাতে তার শরীরে রক্তের দাগ। চিটচিটে রক্ত জমে থাকে। এখান থেকে পালানোর পথ নেই।খোদেজা গালি দেয়
… হারামির বাচ্চা, কুত্তার…
আরো জোরে চেপে ধরে মুখ ওরা। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কামড়ের ক্ষতগুলোতে পচন শুরু হয়েছে। শরীরে পেটিকোট আর ব্লাউজ ছিল। এখন ওসবও নেই। উদোম বুকে ক্ষতগুলো মানচিত্র আঁকে।
—–
আজানের বাবা এলো পৃথিবীতে। কার ঔরসজাত খোদেজা জানে না। ওখান থেকে একদিন ওরা ফেলে দিয়ে গেলো নদীর ঘাটে। কারা যে বাড়ি নিয়ে গেলো? খোদেজা কিছুই মনে করতে পারে না। আজানের বাপ বড় হয়। বাপের পরিচয় দিতে পারে না। খোদেজা ততদিনে কেমন বোবা হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলে না। এই গ্রামের মানুষ কেউ বাড়ীতে আসে না, একঘরে খোদেজা আর আজানের বাপ। ছেলেটা তাগড়া জোয়ান হয়। বিয়ে হয়। বাবা হয়। বিয়ের সময়ও বাপ নিয়ে কথা ওঠে। মেয়ের বাবা কেন জানি বিয়েটা দেয়! সে নিজেও একজন মুক্তি ছিল।
——
সালিশে বেজন্মা,কুলাঙ্গার কথাগুলো কানে বাজে। সেই রাতেই আজানের বাপ ক্ষেতের পোকা মারার বিষের বোতল পুরোটা ঢেলে দেয় মুখে।তাকে কবর দিতেও গ্রামের মাতবরের নিষেধ ছিল।আজানের মা মাতবরের পা ধরে। এরাই নাকি শান্তি কমিটির লোক ছিল? আজানের মায়ের উপর চোখ পড়ে মাতবরের। ডেকে পাঠায়, বাড়িতে আসে। আজানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েও মুক্তি পায়নি মেয়েটা। একরাতে মাতবরের লোকজন ধরে নিয়ে আসে। তারপর চলে উপর্যুপরি বলৎকার।আজানের মায়ের লাশ পাওয়া যায় ক্ষেতে।
কেমন করে মারা গেলো? আজও কেউ জানেনি?
——
কবর দুটোর পাশে আজান দাঁড়িয়ে। মাগরিবের আজানের শব্দ আসে। নির্দয় পৃথিবীর বুকে এইটুকু শান্তির জায়গা!
আজানের মনে হয় আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ হোক! এবার সে হবে মুক্তি।
যুদ্ধটা তার জারি আছে। হোক আরেকটা যুদ্ধ!
এই যুদ্ধে আজান সব রাজাকার, আলবদর,শান্তি কমিটি আর মেলেটারী মেরে দাদীর পায়ের কাছে জড়ো করবে।
দাদী বলবে… কে? কে? কে এলো? ওযু,তসবিহ, মসজিদ?
আজানের ভেতরে বারুদ বলকায়।
তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২০