রাক্ষসজাতি

 

ওরা আমাকে ঘিরে বসে আছে। নাচছে, গাইছে, মজা করছে। সবকিছুতেই আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আসলে আমিই এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। আমাকে ঘিরে আগামীকাল উৎসব হবে। উৎসব যেভাবে সম্পন্ন হবে সেটা যদিও শুনতে বেশ কঠিন লাগবে কিন্তু বিষয়টা আমার বেশ ভালোই  লাগছে। যদিও অন্য একটা কারণে আমার মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কিন্তু ওদের মজা  আর আনন্দতে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছি না বলে ওদের সঙ্গে আমিও সঙ্গত দিয়ে চলেছি। লোকগুলো কিন্তু বেশ মজার। আমাকে একতলা একটা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মধ্যে থাকতে দিয়েছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। সত্যি কথা বলতে কি আমি এখানে এসে অবধি বৃষ্টির বিরাম দেখছি না। যদিও আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে আগামীকাল যদি এরকম বৃষ্টি হয় তাহলে রগড়টাই না মাটি হয়ে যায়। ওরা অবশ্য আশ্বস্ত করছিল যে বৃষ্টি নিয়ে ওদের কোনো চিন্তা নেই। এখানে সারাবছরই বৃষ্টি পড়ে। ছাদটা মনে হয় তেমন মজবুত নয়। ফুটো আছে।  আমার মাথায় ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। ওরা মনে হয় পাত্তা দিচ্ছে না। পাত্তা দেওয়ার অবশ্য সত্যিই কোনো কারণ নেই। আর তো শুধু আজকের রাতটা। কালকে যে লোকটা মরে যাবে তার আগের রাতটা বৃষ্টিতে ভিজলে কী আর হবে! ওরা  আমাকে  আগামীকাল ঠিক সকাল দশটা সাঁইত্রিশ মিনিটে ফাঁসিতে ঝোলাবে। ওদের মনে হয়েছে ওটাই সবচেয়ে ভালো সময়। আমাকে কাল ফাঁসিতে  ঝোলাবে এটা আমার কাছে চিন্তার বিষয় নয়। আমার চিন্তার বিষয় হলো আমার শরীর জুড়ে বেড়ে উঠছে অনেকগুলো কালশিটে দাগ। না না ওরা কেউ আমাকে শারীরিক আঘাত করেনি। আমি কোথাও পড়ে গিয়েও আঘাত পাইনি। আচমকাই যেন সমস্ত শরীর জুড়ে সরীসৃপের মত গজিয়ে উঠছে এই দাগগুলো। বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বেগের। এতগুলো মানুষ আনন্দ করছে এই ফাঁসিটা ঘিরে। ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে গলায় শুধু দড়ির দাগটুকুই থাকা ভালো। এইরকম বিশ্রী কালশিটে দাগগুলো মৃতদেহটাকে তো কদাকার বানিয়ে দেবে।

 

ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মত কোনো অপরাধ কিন্তু আমার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়নি। একটা নির্জন করাতকলের ধারে চারটে লোক আট টুকরো হয়ে পড়েছিল। লম্বালম্বি চেরাই করা।  আর তার পাশেই পড়েছিলাম আমি। অক্ষত। কিন্তু আমার সারা শরীরে হত্যাকারীর কোনো চিহ্ন ছিল না। আমার পোশাকে কোনো রক্তের দাগ ছিল না। জামাটা ছিল সম্পূর্ণ সাদা। ওরা আমাকে ওখান থেকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। তারপরে কী একটা অদ্ভুত ধরনের বিচারসভা বসিয়ে আমাকে শাস্তি শোনানো হলো। অবশ্য ঠিক শাস্তি না। বিচারপতি বললেন “তুমি সৌভাগ্যবান। এই ফুর্তি গ্রাম কোনো ব্যক্তিকে  কোনো অপরাধের জন্যই শাস্তি দেয় না।  এই গ্রাম শুধু মজা দেখতে ভালোবাসে। ভালোবাসে ফুর্তি করতে।  তোমাকে নিয়ে ফুর্তি করা হবে শুধু।” বিচারসভাটা  অদ্ভুত বললাম এই কারণে যে বিচারসভা বলতে যা বোঝায় যেমন পক্ষে এবং বিপক্ষে সওয়াল জবাব অথবা একতরফাই দোষী সাব্যস্ত করা। সেসব কিছুই  হলো না। সওয়াল এবং জবাব যেটা নিয়ে হচ্ছিল সেটা হলো আমাকে নিয়ে কীভাবে চূড়ান্ত ফুর্তি করা  যায়। একজন সওয়াল করছিল করাতকলে ঢুকিয়ে আধাআধি ফেড়ে দেওয়ার। সেদিন ওই চারটে লোককে যেভাবে মারা হয়েছিল। আরেকজন সওয়াল করছিল ফাঁসি দেওয়ার পক্ষে। অবশেষে ফাঁসি দেওয়াই সাব্যস্ত হলো। আমার অবশ্য মোটের ওপরে বিষয়টা বেশ মজারই লাগছিল!

 

ফুর্তি গ্রাম। এমন কোনো জায়গা যে পৃথিবীতে আছে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমি আসলে একজন ভবঘুরে মানুষ। আমার কোথাও সাকিন নেই। ঘুরতে ঘুরতে কেউ খেতে দিলে যা পাই তাই খাই। আর না পেলে খাই না। সেদিন আমি ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলাম এই গ্রামের প্রান্তে ওই করাতকলের পাশে। আমি দেখতে পেলাম চারটে লোক বসে বসে মদের বোতলে চুমুক দিয়ে নেশা করছে। আর ওদের সামনে একটি মেয়ে।  হাত – পা বাঁধা এবং বিবস্ত্র। আমি ওই দৃশ্য দেখে ওখানে থেমে গেলাম। লোকগুলো আমাকে দেখে একটুও ভয় পেল না। এমনকি বিরক্তও হলো না। ওদের মধ্যে একজন বললো “বিদেশি মনে হচ্ছে? ফুর্তির ভাগ কিন্তু পাবে না। তবে দর্শক হিসেবে থাকতে পারো!” আমিও উল্লসিত হয়ে বললাম “তা ফুর্তিটা কীরকম হবে? মানে কী কী দেখার আছে তাই জিজ্ঞাসা  করছি!” আরেকটা লোক অনেকটা মদ একসঙ্গে গলায় ঢেলে বললো “তুমি তো দেখছি বেশ সমঝদার লোক হে। বসে  যাও দোস্ত বসে যাও। ভালো দর্শক পেলে তবেই না খেলা জমে।” আরেকজন মাংসের একটা বড়সড় টুকরো মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বললো “এখন এই মাংস খেয়ে ওয়ার্মআপ করছি।  এরপরে চারজন মিলে ওই মেয়েটাকে খাবো। খাওয়া মানে বুঝলে তো?” বলে আমার  দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। তারপরে বললো “তাতেও  যদি মনে হয় ফুর্তি কম হচ্ছে তখন এই বোতলগুলো কাজে লাগাবো!” বলেই চারজন মিলে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলো। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। দেখলাম মলিন বিকেলের আকাশে এসে জড়ো হচ্ছে আঁকাবাঁকা কালো মেঘ। হয়তো এখুনি বৃষ্টি নামবে। চার নম্বর জন একটু কাত হয়ে বসে বললো “আর এক্কেবারে শেষে ওই মেয়েটাকে করাতকলে ধরে গাছের মত চেরাই করে দেব।” লোকগুলো অশ্লীল ভঙ্গিতে দুলে দুলে হাসছিলো। আমি ওদের ফুর্তি দেখছিলাম। ঠিক তখনই একটা – দুটো বৃষ্টির ফোঁটা আমার মাথায়, গায়ে, হাতের তালুতে এসে পড়লো। তারপরে আমার আর কিছু মনে নেই। আমি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম? আমার স্মৃতি যখন  কাজ করতে শুরু করে আমি নিজেকে দেখলাম করাতকলের ঘরটার ভেতরে। মাথার ওপরে ম্যাটম্যাটে হলুদ একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে। করাতকলের চাকাটা বিশ্রী একটা আওয়াজ করে ঘুরে চলেছে।  তার নীচে গাছের মত চেরা হয়ে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে চার দুগুণে আটটা মানুষের টুকরো। ঠাহর করে দেখলাম ওই চারটে লোক। কিন্তু মেয়েটা! মেয়েটা কোত্থাও নেই। না মৃত না জ্যান্ত। আমি ওখানেই বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে গ্রামের লোকেরা ওদেরকে খুঁজতে এসে আমাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে ধরে নিয়ে গেল।

 

“ওই মেয়েটা একটা ঢলানি মেয়েছেলে ছিল। কী করেছিল জানো?” আমি জানি না তাই দুই দিকে মাথা নাড়ালাম। লোকটা  বললো “এখানে একটা পাড়া আছে। ফুর্তিফার্তার জায়গা। সেখানে সব বেবুশ্যেরা থাকে। আমরা নখরা করে নাম দিয়েছি সতী পাড়া। লোকেরা ওখানে ফুর্তি করার জন্য যায়। মদ আর মেয়েছেলে নিয়ে মস্তি করে। একটা পুরুষমানুষের জীবনে যে কত জ্বালা তা তো বোঝো। সারাদিন পরিশ্রম। তার পরে ঘরের মেয়েছেলেদেরকে শাসনে রাখা। সন্ধ্যের সময় সতী পাড়ার মুখে তাই ভিড় জমতে থাকে।” লোকটার মুখ দেখে মনে  হচ্ছিল যেন কথা বলছে না স্তোত্র পাঠ করছে। “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো।” আমি সায় দিলাম “তা ওই মহিলা মানে মেয়েছেলেটা  কি লোকেদের ফুর্তি করতে বাধা দিচ্ছিল?” লোকটা একটু ভাবলো। তারপরে বললো “মেয়েছেলেটা কোন  দেশ থেকে এসেছিল কে জানে! এসে উঠেছিল সতী পাড়ায়। প্রথমদিকে কিছু তো বোঝা যায় নি। সতী পাড়ায় মেয়েছেলে বাড়লে ক্ষতি তো কিছু নেই। বরং লাভ। তাছাড়া দেখতে বেশ চিকনচাকন। লোকেরা আনন্দিতই ছিল। কিন্তু পরে বুঝতে পারলো কী ভুল ওরা করেছে!” লোকটা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যেন একটু থামলো। তারপরে আবার বললো “কিন্তু ওই মেয়েছেলেকে তো কেউ ছুঁতেই পারছিল না। ধরতে গেলেই যেন বাতাসে মিলিয়ে  যায়। শেষে একদিন একজন ধরলো। কিন্তু পরের দিন ভোরবেলায় তাকে পাওয়া গেল গ্রামের শেষে একটা পুকুর পাড়ে। মৃত। কোনো এক আতঙ্কে চোখগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।” আমি তাল মেলালাম ‘কী সর্বনাশ! মেয়ে নাকি পিশাচ!” লোকটা এবারে আর উত্তেজিত হলো না “সমস্যাটা সেখানে ছিল না। সবাই ভাবলো বেশি নেশা করে হার্ট ফেল করে মরেছে। কিন্তু বাধলো অন্য জায়গায়। সতী পাড়ার মেয়েছেলেগুলো ফুর্তিতে সাথ দিতে অস্বীকার করলো। ওরা ওই বজ্জাত মেয়েছেলেটার কাছে পড়াশোনা শিখছে। ওরা এটাও বললো যে সতী পাড়াতে আর প্রকাশ্যে নেশা করা চলবে না!” সবাই চলে গেলেও এই লোকটা রয়ে গিয়েছিল। আজকে রাতের জন্য আমার পাহারাদার। এখানকার লোকগুলোর ঘটে কী বুদ্ধি! আমি মনে মনে হাসছিলাম। যদি  আমিই ওই চারটে মুসকো লোককে করাতকলে ধরে ফেড়ে দিতে পারি তাহলে এই একটা শীর্ণ বুড়ো আমাকে আটকাতে পারবে! আসলে ওরা মনে হয় ভেবেছিল আমি পালাবো না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম “সেইজন্যই কি ওই মেয়েটাকে নিয়ে অমন ফুর্তির বিধান হয়েছিল?” লোকটা বললো “না না। সতী পাড়ার মেয়েছেলেরা বারোয়ারী মাল। ওদের নিয়ে কেউ কিছু বিধান দেয় না। ওটা ফ্রি ফুর্তির জায়গা। ওই চারজন লোক ওই মেয়েছেলেটাকে একা পেয়ে পাকড়াও করে ফেলেছিল। কিন্তু ওরা জানতো যে মেয়েছেলেটা বিপজ্জ্বনক। তাই কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে চুপচাপ করাতকলে ফেলে জবাই করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দেখলে তো তার কী পরিণাম হলো?” আমি বললাম “শুধুই জবাই? আর কিছু না?” লোকটা বললো “ওই আর কি। তার আগে হয়তো মেয়েটার সঙ্গে একটু রঙ্গ রসিকতা করতো।” আমি বললাম “কিন্তু তার জায়গায় নিজেরাই জবাই হয়ে গেল! কী নিষ্ঠুর নিয়তি! আচ্ছা তুমিও কি ভাবো আমিই ওই চারটে লোককে মেরেছি?” লোকটা বললো ‘না না। ওদেরকে মেরেছে কোনো রাক্ষস। যে ওই মেয়েছেলেটার কথা শোনে। তুমি তো জ্যান্ত লোক। এ কাজ তোমার মতো দুবলা লোকের কম্ম না।

সকালবেলায় ঘুম ভাঙলো তখনও আকাশে জামের মত রঙ লেগে আছে। চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা জল ঢেলে স্নান করলাম। পরিষ্কার জামা কাপড় বার করে পরে নিলাম। যেকোনো সভ্য দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে দণ্ডের দিন জেলখানার কর্তৃপক্ষই এসব ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু এদের কাছে এসব আশা করা বৃথা। অবশ্য এটাকে এরা দণ্ড বলছেও না। ওদের কাছে আমি একজন শিল্পী যে নিজের কষ্ট দেখিয়ে অন্যদেরকে আনন্দ দেবে। তবে শিল্পীর সম্মানটুকুও দেওয়া উচিৎ ছিল! আস্তে আস্তে লাল  সূর্যের গায়ে সোনার রঙ লাগতে শুরু করলো। তখনই লোকগুলো ফিরে এল। ওরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে বধ্যভূমিতে। অবশ্য এটাকে বধ্যভূমি বলা মনে হয় ঠিক হলো না। সার্কাসের মাঠ বললেই  সঠিক হয়। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম “দর্শক সংখ্যা কীরকম হবে? বাড়ির সব মহিলারা সুন্দর সেজেগুজে মজা নিতে আসবেন ফুর্তির আসরে?” বাহারি দর্শক থাকলে একজন শিল্পীর খেলা দেখাতে বেশি ভালো লাগে। লোকগুলো আমার কথা শুনে খুব হাসলো “তুমি মাইরি হেব্বি মজার লোক। ঘরের মেয়েছেলেরা রাজ্যের পুরুষের সঙ্গে একজায়গায় ফুর্তি করবে?” আমি সমর্থনের সুরে বললাম “তা ঠিক। মা জননীরা ঘরের কোণেই আলো করে থাকবেন না হয়।” ওরা আবারও প্রতিবাদ করলো “না হে ফুর্তি গ্রামে ফুর্তি সবাই করে। শুধু ধরণটা আলাদা। আজ কারও বাড়িতে রান্না হবে না। আজ সারা গ্রামের রান্না একসাথে হবে। আর গ্রামের সমস্ত মেয়েছেলেরা মিলে সেই রান্না করবে একটা ঘেরা জায়গায়।” কালকের সেই পাহারাদার লোকটা বললো “এই কথাটাই আমি বোঝাচ্ছিলাম ওকে। আত্মপুরুষদের সেবা করাই হলো ভদ্রবাড়ির মেয়েছেলেদের ফুর্তি।” ওরা বুঝে গেছে আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে হবে না তাই বেশ গল্পগুজব করতে করতেই এগোচ্ছিলাম। কিন্তু তালভঙ্গ হয়ে গেল একটা কথায়। ওদের মধ্যে একজন বললো “ওখানে পৌঁছে দেখবে তোমার জন্য একটা মারাত্মক চমক অপেক্ষা করছে।” চমকটা কী তা আমি জানি না কিন্তু অনুমান করতে পারছি। মনের মধ্যে যেন রাশি রাশি কালো মেঘ এসে ঢুকে গেল। অথচ আকাশ আজ নীলে নীল। মেঘের কোনো চিহ্ন নেই।

 

একটা স্টেডিয়াম মতো গোল ঘেরা জায়গায় ওরা নিয়ে এলো আমাকে। তবে সিমেন্টের গ্যালারি নেই। প্রাকৃতিকভাবে অনেক গাছ দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা। ফাঁসির মঞ্চটা একটু ঢিবি মত একটা উঁচু জায়গায়। ব্যবস্থাটা বেশ ভালো। অনেকে দেখতে পাবে। যদিও দর্শক খুব বেশি নেই। আমি জিজ্ঞাসা করাতে ওরা বললো যে মূল আনন্দটা শুধু কিছু ভাগ্যবানই দেখতে পায়। তারাই হলো ফুর্তি গ্রামের মাথা। ফাঁসি হয়ে গেলে গোটা গ্রামের সবাই মৃতদেহ নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে।  আমাকে ওরা ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গেল। আর তখনই বুঝতে পারলাম আমার আশঙ্কাটাই সত্যি হয়েছে।  মঞ্চে একটি গাছের দুটি পাশাপাশি ডালে দুইটি দড়ি ঝোলানো আছে। আমার পাশেই ওই মেয়েটাকেও  আনা হয়েছে। একসাথে ফাঁসি হবে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো “তোর খেলা তাহলে শেষ হলো রাক্ষস?” আমি বললাম “মৃত্যু শেষ নয়। মৃত্যু তে শুরু হয়। মৃত্যু একটা বিপ্লব। মৃত্যু একটা প্রতিবাদ।” মেয়েটা হেসে উঠলো “কে আমার বিপ্লবী এলেন রে! কালশিটে দাগ গুনেছিলি? কটা?” আমি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলাম “সাঁইত্রিশটা।” মেয়েটা বললো “এতগুলো! কী নিষ্ঠুর রে তুই! এইজন্য আমি বলি রাক্ষস!” ইতিমধ্যে আমাদের মাথা গলিয়ে দড়িটা গলায় আলতোভাবে রাখা হয়েছে। একটু পরেই টান পড়বে আর ফাঁসি হয়ে যাবে। মেয়েটার কথা শুনে আমার খুব রাগ হয়ে গেল “রাক্ষস আমি না তুই? এ যুগের শূর্পণখা! সেদিন ওই চারটে লোককে কে মেরেছিল? আমি?” মেয়েটা জবাব দিল “কিন্তু সেদিনও কি তোর শরীরে চারটে কালশিটে দাগ ছিল। ছিল না? তুই তো আগেই মেরে রাখিস। আমি  আর কে?” এমন অদ্ভুত যুক্তি শুনে আবারও রাগ হয়ে গেল। তবে কথাটা সত্যি। সেদিন সত্যিই আমার শরীরে চারটে কালশিটে দাগ পড়েছিল। তবুও আমি প্রতিবাদ করলাম “কালশিটে দাগ কোনো ভবিষ্যৎ বানী না রে মুখ্যু! প্রত্যেকটি আসন্ন মৃত্যু আমাকে ব্যথা দেয়। তাই তখন শরীর জুড়ে বাড়তে থাকে কালশিটে দাগ। কিন্তু তুই তো নিজের হাতে মারিস ওদেরকে।” এবারে মেয়েটা প্রতিবাদ করলো “আমি একটা রোগা দুর্বল মেয়ে। আমি কী করে কাউকে মারতে পারবো? তুই কী বলতে চাইছিস সেদিন অমন চারটে জোয়ান ছেলেকে আমি ওইভাবে মেরেছি? আমার তো হাত-পা বাঁধা ছিল দড়ি দিয়ে! আর আজ? এই যে সাঁইত্রিশটা লোক গাছে গাছে দড়ি বাঁধা হয়ে ঝুলছে। এদেরকেও আমি মেরেছি? আমি তো তোর সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছি।” আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম “কী বাজে কথা বলছিস? ঝুলছে? সাঁইত্রিশটা লোক? স্বপ্ন দেখছিস? ঝুলবো তো শুধু আমরা দুজন! এক্ষুনি আমাদের দড়িতে টান পড়বে আর আমরা ঝুলে  থাকবো!” মেয়েটা বললো “স্বপ্ন তো তুই দেখিস? তোর স্বপ্নের মধ্যেই তুই ওই চারটে আর আজ  সাঁইত্রিশটা লোককে মেরে রেখেছিস। আর ফাঁসি? দড়ি কোথায় যে ফাঁসি হবে?’ এই মেয়েটা আফ্রিকার ব্ল্যাক ম্যাজিক জানে নির্ঘাত। সত্যিই দড়িটা উধাও। সামনে আর আশেপাশে তাকিয়ে আরও দেখলাম এই কদিন ধরে ফুর্তি করা লোকগুলো। সেই বিচারক। সেই পাহারাদার। সবাই একেকটা গাছের ডাল ধরে ফাঁসিতে ঝুলছে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো “বিশ্বাস কর এত লোক মরে যাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে না। প্রত্যেকটা মৃত্যু আমাকেও ব্যথা দেয়। আমি এদের মারিনি।” আমি বললাম “আমি জানি তুই এদের মারিসনি। আমিও এদের মারিনি। সেইদিন ওই চারটে লোককেও আমরা মারিনি।” মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা  করলো “তাহলে এদেরকে এভাবে মারলো কে?” আমি বললাম “ছায়া। এরা বুঝতে পারেনি রাতের অন্ধকারে সতীপাড়ার ছায়ারা লম্বা হচ্ছিল আস্তে আস্তে। ফুর্তি গ্রামে আপাততঃ আর ফুর্তি করার মতো কেউ নেই।”

 

লাল মোরামের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা। মেয়েটা বললো “এবারেও আমরা জিততে পারলাম না। এবারেও আমাদের মরা হলো না। জিতে গেল সতীপাড়ার ছায়ারা।” আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “এবারেও আমার প্রতিবাদ জানানো হলো না। দেখি আবার কোথায় গিয়ে সুযোগ পাই।” মেয়েটা বললো “যেখানে খুশী যা। কিন্তু আমার পেছনে আসবি না। আমি এবারে শান্তিতে থাকতে চাই। তুই এলেই গাদা গাদা লোক মারিস!” আমি রেগে গেলাম “কে কার পেছনে এসেছিল রে? আমি মনের আনন্দে ফাঁসির মঞ্চে আসছিলাম। বাগড়াটা কে দিল?” মেয়েটাও এবারে রেগে গেল “আমি এসেছিলাম? সেদিন ওই করাতকলে কে এসেছিল? তুই এসেছিলি রাক্ষস।” আমিও প্রতিবাদ করে উঠলাম “আমি না রাক্ষস তুই। মনে রাখিস শুধু অন্ধকারে কিন্তু ছায়ারা লম্বা হয় না। অন্ধকারের মধ্যে আলো এলে  তখনই ছায়ারা বাড়তে থাকে। সতীপাড়ায় আলো কে নিয়ে এসেছিল? আমি না তুই?” আমরা দুজনেই  জানি এই বিবাদের শেষ নেই। তবুও বিবাদ চলতেই থাকে। যেমন শেষ নেই এই পথ চলার। লাল রাস্তার ধারে কী একধরনের থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। বর্ষা আসছে। আকাশ জুড়ে কালো কালো  মেঘগুলো জড়ো হচ্ছে। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া। কালো মেঘের গায়ে সার বেঁধে উড়ে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখিরা। আমরাও কিন্তু একটা সুন্দর পৃথিবী চাইছিলাম। ঠিক এইরকম শান্ত নিটোল একটা পৃথিবী। যেখানে কোনো অসম্মানের সতী পাড়া থাকবে না। যেখানে অন্যের যন্ত্রণা দেখে কেউ মজা লুটবে না।  যেখানে আমার গায়ে এরকম কালশিটে দাগ পড়বে না। যেখানে এই মেয়েটিকে কেউ টেনে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করবে না। যেখানে এই মেয়েটি শেখাবে কী করে মাটির গায়ে আঁচড় কেটে ফসল ফলানো যায়। আবার সেই মাটির গায়েই আঁচড় কেটে কিভাবে আঁকা যায় সুন্দর সুন্দর ছবি। আমরা আমাদের কোনো নাম বললাম না।  আমরা নিজেদেরকে রাক্ষস বলেই ডাকি। সত্যিই আমাদের কোনো নাম নেই।

তারিখঃ এপ্রিল ৮, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mithu
Mithu
3 years ago

মায়াবী রূপকথায় বাস্তবের স্বপ্ন… খুব ভালো লাগলো। মুরাকামি মনে পড়লো।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse