রাতের অতিথি
মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী
জিতু যখন ফোন করে জানায় এই শহরে কোথায় যেন ও আটকে পড়েছে, আজ রাতটা এবাড়িতে কাটাবে তখন থেকেই ধীরেনের মনে কেমন একটা কালো ছায়া পড়েছে যেন। অথচ কত মাস দেখা হয়নি ছেলের সাথে, এতে ওর আনন্দিত হওয়ারই কথা তবু কেন যেন পুরোপুরি খুশি হতে পারছে না।
বৃষ্টিটা শুরু হল বিকেল থেকে, ঝির ঝিরে বৃষ্টি একটানা চলেছে।এসময় রাস্তা খুব তাড়াতাড়ি শুনশান হয়ে যায়। বনলতা তাড়া দিলেন,” কী রে যা, রুটিটা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি, বৃষ্টি বাদলার দিন, বন্ধ হয়ে যাবে দোকান।” ধীরেন তবুও ওঠার কোনো লক্ষণ দেখায় না। একটু অবাক হন বনলতা, একটামাত্র মা মরা ছেলে এতদিন পর আসছে, তবু কেন যে সে এরকম নির্বিকার আছে ঠিক বুঝতে পারছেন না। একটু বেশিই চুপ করে আছে যেন।
“কী হলো?”প্রশ্ন করেন বনলতা।
ধীরেন কোন উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে গ্রিল খুলে বেরিয়ে যায়, বলে,”তালা টা দিয়ে দাও আসছি আমি।”
বনলতা তালা দিয়ে এসে ঘরে বসেন, টিভিটা চলছে তবে বিশেষ কিছু দেখছেন না, এলোমেলো ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ভাবনা, ভাসা ভাসা ছবি মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ছে প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছেন। ধীরেনেরও দেখতে দেখতে পঁয়ত্রিশ বছর।ঝড়খালি না কোথায় যেন ধীরেনের গ্রামের বাড়ি, পঁয়ত্রিশ বছর আগে যখন শ্বশুরমশাই ওকে বাড়িতে এনেছিলেন তখন ওর বয়স বছর পনের-ষোলো হবে। ভদ্র স্বভাবের সৎ, পরিশ্রমী ছেলে। প্রথমে তাকে বৌদিমণি বলে ডাকতো, বনলতার পছন্দ হয়নি, বলেছিল, ” বৌমণি বলবি, বৌদিমণি নয়”। বাড়ির সবার ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে একসময় এ বাড়ির অপরিহার্য একজন হয়ে উঠেছে।
বছর পাঁচেক হলো উনি চলে গেলেন হঠাৎ করে। একমাত্র মেয়ে বেঙ্গালুরুতে, জামাই ওখানকার আইটি সেক্টরের বড় চাকুরে। এখানে বনলতা একাই থাকেন ভরসা ঐ ধীরেন। এমনকি মেয়ে টুপু রোজই একবার করে ফোনে খোঁজ খবর নেয় বটে তবে সেও অনেকটা নিশ্চিন্ত যে ধীরুকাকা আছে তার মায়ের দেখাশোনা করার জন্য। ধীরেন যখন এ বাড়িতে আসে টুপু তখন দু-বছরের, আগলে রাখতে রাখতে, বেশ একটা সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে। টিউশন পড়া শেষ হওয়ার আগেই টিচারের বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করত ধীরেন, কোনদিন দেরী হলে রাগ করত টুপু, ধীরেন হাসিমুখে উপভোগ করত তার সেই ছেলেমানুষি রাগ।
রুটির দোকানে বড় একটা আসেনা ধীরেন গ্রামের ছেলে, তার রাতে ভাত খাবারই অভ্যাস, এত বছর শহরে থেকেও সে অভ্যাস তার বদলাবার প্রয়োজন হয়নি। প্রথম প্রথম গিন্নী মা বলতেন “আহা, ছোট ছেলে, ভাতের অভ্যাস, সকালে দুটি চাল বেশী নিও বৌমা”। বৌমণিও তার সে অভ্যাস বজায় রেখেছেন এখনো পর্যন্ত। সকালে যে মেয়েটি রান্না করে দিয়ে যায় সে একেবারে ভাত করে রাখে। রাতে ধীরেন একাই ভাত খায়, বৌমণি বেশিরভাগ দিনই ওটস, কর্ণফ্লেক্স, দুধ খেয়ে নেন। আজ তাকে দিয়ে মুরগির মাংস রাঁধিয়ে রেখেছেন বৌমণি জিতু আসবে বলে। তার জন্যই রুটি নিয়ে যাওয়া, সে আবার রাতে ভাত খায় না।
রুটির দোকানে এই বর্ষায়ও বেশ ভিড়, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে ধীরেন। পুরনো কথা মনের মধ্যে ভিড় করে… পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেলো এ বাড়িতে, মাঝখানে জীবনে কত কিছুইনা পরিবর্তন হলো…আরতির সঙ্গে বিয়ে, জিতুর আসা, অসময়ে আরতির চলে যাওয়া সবই পর পর ছবির মত যেন ভেসে উঠছে চোখে। গ্রাম থেকে মায়ের চিঠি পেয়ে বাড়ি গিয়ে দেখে বিয়ে ঠিক হয়েছে, বিনা আপত্তিতে বিয়ে করেছিল, পছন্দ হয়েছিল খুব আরতির ঢলঢলে লাবণ্যময় মুখ, কালো চোখের হাসির ঝিলিক। আগে মাসের পর মাস ছুটি না নেওয়া ধীরেন প্রতি মাসেই কয়েকটি দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যেত ওই চোখের টানে। যথাসময়ে জিতু এল আরতির কোলে কিন্তু তারপর থেকেই আরতি অসুস্থ হয়ে পড়ল, ডাক্তার বলেছিল জিতু হওয়ার সময় কিছু ইনফেকশন হয়েছিল, ধীরেন সবটা বুঝতে পারেনি ভালো তবে বিছানা ছেড়ে উঠে ছেলেকে আদর করার সুখ ভোগ করা তার হয়নি, আট মাসের জিতুকে ফেলে পাড়ি দিতে হল না ফেরার দেশে। বাড়ি যাওয়ার আকর্ষণ হারালো ধীরেন। ওর বৌদি মা-হারা ছেলেটাকে আপন করে নিয়েছিলো তাই বাড়ির সঙ্গে ওর দূরত্বটা বেড়েই গেল। একটু বড় হতে জিতুকে এখানেই নিয়ে এসেছিল ধীরেন কিন্তু এখানে তার মন টিকলো না আর বাড়িতে তার জেঠিমারও। বড় ভালোবাসতো বৌদি তার মা মারা ছেলেটাকে তাই আবার গ্রামের বাড়িতেই রেখে আসতে হলো। সেভাবে আদর বা শাসন কোনটাই সে করে উঠতে পারেনি জিতুকে, তবে বাড়িতে আদরের অভাব ছিল না সেই কারণে ছোট থেকেই একটু বেয়ারা ধরনের জেদি হয়ে উঠেছিল সে। যদিও তার জেঠিমা হাসিমুখেই সব মেনে নিত ভাবতো বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। ধীরেন জানে না কতটা কী ঠিক হয়েছে। তার গতিবিধি চালচলন সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও কেমন একটু সন্দেহজনক লাগে তার। পড়াশোনা খুব বেশিদূর করেনি কিন্তু পোশাক-আশাকের চাকচিক্য আছে। কী করে জানতে চাইলেও পরিষ্কার করে কিছু বলে না অথচ উপার্জন খুব কম নয় এটা বুঝতে পারে। সেই কারণে একটু চিন্তায় থাকে সে। এর আগে মাঝে মধ্যে দেখা করে গেছে এ বাড়িতে তবে রাতে থাকেনি কখনো। আজ হঠাৎ করে জানালো রাতে থাকবে এখানে। বৌমণির বয়স হয়েছে শরীর খুব একটা ভালো নয় রাতে আবার গোলমাল না কিছু হয়! একটা আশঙ্কার কাঁটা কেন বারবার মনে বিঁধছে।
রুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে তখন প্রায় ন’টা জিতু এখনো আসেনি, ওকে দেখে বনলতা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “রুটিগুলো ক্যাসেরোলে রেখে দে, গরম থাকবে আর একটা ফোন করে দেখ কখন আসবে, এত রাত হচ্ছে কেন?”
ধীরেন জবাব দেয়,” আসবে বলেছে তো, এখনই ফোন করার কী আছে? আর খানিকটা দেখি।”
বনলতা একটু অবাক হলেও কিছু বললেন না ।ধীরেন কেবলই ঘড়ির দিকে তাকায় আর একটা অস্থিরতায় যেন ছটফট করে, তার মনটা কেন এত কু গাইছে বুঝতে পারছে না। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ হয়। প্রত্যাশিতভাবেই গ্রিলের বাইরে দেখা যায় জিতু অর্থাৎ জিতেনকে, ধীরেন এর ছেলে। ধীরে ধীরে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় ভেতরে আসে জিতু, বনলতাকে প্রণাম করে বসে সোফায়। বেশ ভালো সাজপোশাক, খুব মার্জিত ব্যবহার। ধীরেনের মনটা একটু হালকা হতে থাকে তাহলে হয়তো তার ভাবনাটা অমূলকই ছিল। অনেকদিন পর বাপ-ছেলে একসাথে খেতে বসে বনলতা তার খই দুধ নিয়ে ঘরে চলে আসেন। ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে টুক-টাক কথা হয় বাবা ছেলেতে। বনলতা শুতে গেলে বাইরের বারান্দায় এসে বসে জিতু, বাবা ঘরে মশারি খাটিয়ে ডাকে ছেলেকে। জিতু শুয়ে পড়লে ধীরেন মশারিটা গুঁজে দিতে যায়, তখনই বোমাটা ফাটায় জিতু…” আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে রাতে দরজাটা খুলে দিও”
বজ্রাহতের মত চমকে তাকায় ধীরেন,” কী বলছিস?”
“ঠিকই বলছি, কী হবে বুড়ির এত সম্পত্তি? প্রাণে তো আর মারছিনা”
ধীরেন প্রথমটা স্তম্ভিত হলেও সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বলে,” এক্ষুণি তোর বন্ধুদের ফোন করে বারণ কর নয়তো আমি পুলিশে ফোন করবো”
“তুমি কিছুই করতে পারবে না” নিরুত্তাপ জবাব জিতেনের। বিমূঢ় ধীরেনের গলাটা শুকিয়ে আসে, বুঝতে পারে না কী করবে। সত্যিই তো ছেলের সাথে গায়ের জোরে কী সে পারবে? দিশেহারা হয়ে পুতুলের মতো বসে থাকে।এত বড় সর্বনাশ হবে এ বাড়ির, ঠেকাতে পারবে না সে! এটা ভাবতে আরও কষ্ট হচ্ছে তারই ছেলের হাতে হবে এই সর্বনাশ। শেষ চেষ্টা করে দেখে। বলে, রাতে এবাড়ির অতিথি হয়ে সত্যি সত্যি রাতের অতিথি হয়ে এলি জিতু? এ লজ্জা আমি রখবো কোথায় আর তাছাড়া পুলিশ কী ছেড়ে দেব আমাদের? আমি পারবো না বেইমানি করতে।”
এসব কথায় জিতুর কোন পরিবর্তন হয়না, পাশ ফিরে শোয় সে, বলে, “এখন শুয়ে পড়ো”। এমন সময় পাশের ঘর থেকে কেমন একটা গোঙানির আওয়াজ আসে, দৌড়ে যায় ধীরেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছন পিছন আসে জিতু পাছে বাবা বাড়ির মালকিনকে সবটা বলে দেয়। দরজা ভেজিয়েই রাখেন বনলতা, ঘরে ঢুকে ধীরেন দেখে অসম্ভব যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন বৌমণি, চোখ যেন বেরিয়ে আসছে, ঘামছেন প্রচন্ড, বুকের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। ধীরেন ছুটে যায় টেলিফোনের কাছে। অ্যাম্বুলেন্স’র নাম্বার সব সময় কাছাকাছি রাখা থাকে, ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সে। মিনিট কুড়ির মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসেও যায়। হঠাৎ কী হয়ে যায় বোঝেনা জিতু, নিজেই পাঁজাকোলা করে বনলতাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে, বাবাকে বলে, ঠিক করে তালা লাগাও।”
সারারাত এমার্জেন্সি তে বসে থাকে তারা। দৌড়াদৌড়ি করে ওষুধ স্যালাইনের বোতল অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজনে এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া সমস্তই জিতু করে। অপলক তাকিয়ে দেখে ধীরেন আর মনে মনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম রেখে দেয়। অনেক বড় পাথর আজ তার বুক থেকে নেমে গেল কত বড় ক্ষতিই না হয়ে যেত এ বাড়ির তারই হাত ধরে, ভগবান খুব বাঁচিয়েছেন।
পরদিন বনলতা চোখ খুলে দেখেন বেডের পাশে দাঁড়িয়ে ধীরেন আর জিতু। টুপুকে নিয়ে সম্পূর্ণা ছিলেন বনলতা, কখনো ছেলের অভাববোধ করেননি। তবুও গতকাল রাতের ঘটনা ধীরে ধীরে মনে করে আর জিতুকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখের কোলটা ভিজে উঠলো , ক্লান্তিতে আবার চোখ বুজলেন তিনি। জিতুও দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সেখানে, ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে, হয়তো লজ্জায়। বুঝতে পারছে না তার মত একটা বখে যাওয়া ছেলের বিবেক কেন জেগে উঠছে! নাকি যে মায়ের মুখটাও মনে করতে পারে না আজ এই বনলতার মধ্যে তাকে দেখতে পাচ্ছে!
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে তার পিঠে হাত রাখে ধীরেন। বৌমণির ঘরে নয়, মনের ঘরে রাতের অতিথি হয়ে এসেছে তার ছেলে, চুরি করেছে তাঁর ভরসা, স্নেহ। আজ অনেক দিন পর আরতিকে বড় মনে পড়ছে ধীরেনের, দূর থেকেই হয়তো তার দু’চোখও স্নেহ বর্ষণ করছে… অজান্তেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ধীরেন।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১