রেলের গল্প
নিখিল কুমার চক্রবর্তী
১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল (বাংলার ১২৬০ সালের ১লা বৈশাখ) শনিবারের দুপুর বেলা। ভ্যাপসা গরমে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই গরমেই বোম্বের বোরিবন্দর স্টেশন নানারকমভাবে সেজে উঠেছে। কী নেই সেই সাজে! ফুলমালা তো আছেই, আছে অসংখ্য ব্রিটিশ পতাকার আন্দোলন, আছে স্টেশনের লোকজনের বিভিন্ন রঙের পোশাকের মিশ্রণ। ঘড়ির কাঁটা যখন তিনটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট, তখনই বোম্বের প্রতিরক্ষা দপ্তরের সদর অফিস থেকে একুশ বার তোপধ্বনির সাথে অভিনন্দিত হলো ভারতবর্ষের এক ঐতিহাসিক সময়ের সূচনা। ভারতের মাটিতে প্রথম চলতে শুরু করল যাত্রীবাহী বাষ্প-শকট বা রেলগাড়ি। সেই সময়টাতে “গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে” বা GIPR এর লোকজনদের নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসৎ ছিল না। তারাই যে ভারতে যাত্রীবাহী রেল চালানোর ভগীরথ। এমন দিনে তাদের ব্যস্ততা চরমে থাকাই তো স্বাভাবিক! চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত এবং অভিজাত মানুষ। স্টেশনের কাছে যাদের আসার উপায় নেই ট্রেন চলার অনেক আগে থেকে তারা দূরের যে কোন উঁচু জায়গা বেছে নিয়ে অপেক্ষা করে আছে মাহেন্দ্রক্ষণের। তাদের সবার বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়েই ছুটল যাত্রীবাহী ট্রেন। বাইকুল্লা, সায়ত্তন এবং বান্দুপ অতিক্রম করে ট্রেন চলল থানের দিকে। ভারতে সেই প্রথম। বোরিবন্দর থেকে থানে পর্যন্ত একুশ মাইল বা চৌত্রিশ কিলোমিটার পথে ছুটেছিল সে গাড়ি। চোদ্দ টি কামরাতে মোট চারশ জন নিমন্ত্রিত যাত্রী নিয়ে শুরু হল সেই সফর। কে ছিলেন না সেই সফরে! সেই সময়কার বোম্বের গভর্ণর মি. ফকল্যান্ডেরও যাওয়ার কথা ছিল। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিশেষ কাজে তিনি মহাবালেশ্বর চলে যাওয়ায় ভারতীয় রেলের প্রথম সফরে সাক্ষী হিসাবে থাকতে পারেননি। তবে ছিলেন লেডি ফকল্যান্ড। ছিলেন বোম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকগন এবং বোম্বে তথা ভারতের অন্যান্য অনেক অভিজাত ব্যক্তি। প্রশ্ন জাগে, একুশ বার তোপধ্বনি কেন? হয়ত একুশ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবে প্রথম ট্রেন, তাই তোপধ্বনিও একুশ বার। থানে পৌঁছানোর পর সমস্ত যাত্রীদের সেখানে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। একের পর এক অস্থায়ী তাঁবুর সারি থানেতে। আভিজাত্যের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল সেই সব তাঁবু। সেখানেই রাত্রে থাকার এবং যথেচ্ছ আহার ও পানীয়ের বন্দোবস্ত করা হয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলে আমোদ – প্রমোদ। পরদিন ১৭ এপ্রিল ট্রেনটি আবার ফিরতি পথে বোম্বে ফিরে এল। ভারতে প্রথম ট্রেন যাত্রার বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। মোট তিনটি লোকোমোটিভ ইঞ্জিন একুশ মাইলের এই পথে ট্রেনটিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল – সিন্ধ, সুলতান এবং সাহেব। এক ঘণ্টা পনের মিনিট সময় লেগেছিল এই দূরত্ব অতিক্রম করতে। ভারতে প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন চলা নিয়ে ১৮ এপ্রিল “বম্বে টাইমস্ এন্ড জার্নাল অব কমার্স” (বর্তমানের “টাইমস্ অব ইন্ডিয়া”) লিখল, ” On saturday last, the 16 th instant, the railway between Bombay and Thane was opened with all the pomp and ceremony. Soon after two o’clock, the awning and shed began to be filled with all beauty, rank and fashion of Bombay.”
ভারতে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হওয়ার ১৬ মাস পরে ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট যাত্রীবাহী ট্রেন চলেছিল এই বাংলায়। হাওড়া থেকে হুগলীর মধ্যে। ট্রেন নিয়ে সাধারণ মানুষের সেই সময় বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। এমন ধারণাও পোষণ করা হতো যে, ইঞ্জিনের মধ্যে এক বিশালাকার দৈত্যকে বেঁধে রেখে তার লেজে আগুন দিয়ে দেওয়া হয়। সে রাগে প্রচণ্ড গর্জন করে ছুটতে থাকে তখন। গ্রামবাসীরা ইঞ্জিনে সিঁদুর পরিয়ে দিত, লাইনে নৈবেদ্য রেখে দিত, ট্টেন চলার সময় দু হাত তুলে হরিবোল ধ্বনি দিত। বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরের এক বৃদ্ধকে নিয়ে এক মজার গল্প প্রচলিত আছে।
ঐ সময়ে বর্ধমানের কাছে হাটগোবিন্দপুর গ্রামে এক অশীতিপর বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি আটটা-ন’টা পর্যন্ত রাস্তার ধারে তাঁর বাড়ির দাওয়াতে বসে থাকতেন। গ্রামের সবাই তাঁকে খুব ভক্তি, শ্রদ্ধা করত। একদিন সকালে একজন যুবক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে প্রণাম করতে এলে তিনি যুবকটিকে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করেন। যুবকটি জানায় সে কলকাতা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর সেই যুবক কলকাতা থেকে ফেরার পথে আবার তাঁকে প্রণাম করতে যায়। যুবকটিকে দেখে বৃদ্ধ তাঁর নাম জানতে চান। যুবকটি নাম বললে, তিনি বলেন, “তুমি যে সকালে কলিকাতায় যাইতেছ বলিলে, কলিকাতায় কি যাও নাই?” যুবকটি জানায় যে সকালে কলকাতায় গিয়ে এখন ফিরে আসছে। বৃদ্ধ বলেন, “কলিকাতা এখান থেকে তিন দিনের পথ, তুমি সকালে কলিকাতায় গিয়া সন্ধ্যায় কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিলে কী প্রকারে? ব্যাপারটা কী?” তখন যুবকটি কলের গাড়ি লোহার লাইনের ওপর দিয়ে কিভাবে দৌড়ায় তাও সে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করে এবং জানায় যে সে কলের গাড়িতে চড়েই কলকাতা গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। সে আরও জানায় বর্ধমান থেকে কলকাতা পর্যন্ত কলের গাড়ির জন্য লোহার লাইন পাতা হয়েছে। সেই লাইনের ওপর দিয়েই গাড়ি দৌড়য়। শুনে বৃদ্ধ সহাস্যে বলেন,” আমি গ্রাম সম্পর্কে ঠাকুরদা বলিয়া কি আমার সঙ্গে তামাসা করিতেছ? আমরা ঘরে মশারি খাটাইবার জন্য একটি লোহার পেরেক খুঁজিয়া পাই না, আর গাড়ি চালাইবার জন্য বর্ধমান থেকে কলিকাতা পর্যন্ত লোহার পাটি পাতা হইয়াছে। এত লোহা পাবে কোথায়?” তিনদিনের কলকাতা যাওয়ার রাস্তা যুবকটি এত তাড়াতাড়ি গিয়ে ফিরে আসবে তা তিনি কল্পনা করতে পারেন নি।
নানা আজগুবি ধারণা লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এইসময়। গাড়িতে উঠলে কানে তুলো দিয়ে না বসলে আওয়াজে কালা হয়ে যেতে হবে, বুকে শক্ত করে কাপড় বেঁধে না রাখলে হওয়ার ধাক্কায় বুক ফেটে যাবে এইরকম অনেক ধারণার বশবর্তী শুধু নিরক্ষর গ্রামবাসীরাই ছিলেন না, শহরের অনেক শিক্ষিত অভিজাত মানুষও এমন ধারণা পোষণ করতেন।
এ তো গেল, রেল চালু হওয়ার সময়কার কথা। এবারে একটা ঘটনার কথা বলি। ছাড়ার সময়ের ১৫ মিনিট আগেই ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। এর জন্য কিন্তু কেউ তিরস্কৃত হননি, বরং স্টেশনের ডেপুটি সুপার অভিনন্দিত হয়েছিলেন। কেন? সে কথাই বলব।
১৯৮৪ সালের ২ রা ডিসেম্বরের মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে সবে। ভোর আগত প্রায়। ভূপাল স্টেশনের অন ডিউটি ডেপুটি স্টেশন সুপারিন্টেন্ডেন্ট গোলাম দস্তাগীর রাত দশটায় ডিউটিতে এসে অফিসে বসে কাগজপত্রে মনোযোগ দিয়েছিলেন। প্লাটফর্মে গোরখপুর – মুম্বাই এক্সপ্রেস এসে দাঁড়াতে অফিসের বাইরে এলেন। আর তখনই যেন প্রমাদ গুনলেন। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। এত চোখ জ্বালা করছে কেন? এত দমবন্ধ ভাব কেন? লক্ষ্য করলেন ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররাও চোখ কচলাচ্ছে, হাঁফাচ্ছে। কন্ট্রোল মারফৎ খবরটা জানালেন সেন্ট্রাল রেলের হেড অফিসে। ভূপাল অভিমুখে কোনো ট্রেন যেন এখন না আসে। এরপর তাঁর মাথায় এলো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদের কথা। সর্বনাশ! এত যাত্রীর কী অবস্থা হবে? কেবিনকে সিগন্যাল সবুজ করার নির্দেশ দিয়ে ছুটে গেলেন ড্রাইভারের কাছে। ড্রাইভার অবাক! তখনও যে পনের মিনিট বাকি! নিজে দায়িত্ব নিয়ে ড্রাইভারের লগবুকে লিখে দিলেন পনের মিনিট আগে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ। হাজারের ওপর যাত্রীর প্রাণ আগে বাঁচুক, তারপরে না হয় নিয়ম কানুন দেখা যাবে। ট্রেন যখন প্লাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে তখনও কি তিনি আশ্বস্ত হতে পারলেন? না। ইতিমধ্যে ভূপাল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার সহ তেইশ জন রেলকর্মী যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে তাও তখন তিনি জানেন না। ট্রেনের যাত্রীদের বাঁচানোর পর গোলামবাবু কিন্তু স্টেশন সংলগ্ন নিজের কোয়ার্টারে চলে যাননি। প্লাটফর্মের অন্যান্য অসুস্থদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স আনানো, তাদের হাসপাতালে পাঠানো, অন্যান্য স্টেশনের সাথে যোগযোগ রাখার কাজ করে গেছেন। এরপরে সকালে যখন নিজেরও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি কোয়ার্টারে ফিরলেন তখন তাঁর এক পুত্র মারা গেছে। আরেক পুত্রের শরীরে ভীষণরকম সংক্রমণ। বাকি জীবনটা গোলামবাবুকে হাসপাতাল আর ওষুধ নিয়েই কাটাতে হয়েছিল। ২০০৩ সালে নিঃশব্দেই চলে গিয়েছিলেন ভারতীয় রেলের এই সাধারণ (অসাধারণ নয় কেন?) কর্মীটি। তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা হয়েছিল,
Suffering from diseases caused as a direct result of exposure to MIC (Methyl Isocyanate) gas.
হ্যাঁ, ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর, যে ভোররাত্রে ইউনিয়ন কারবাইড কারখানা, ভূপালের স্টোরেজ ট্যাঙ্ক থেকে যে Methyl Isocyanate গ্যাস লিক হয়ে ৩৭৮৭ জনের তৎক্ষনাৎ প্রাণহানি ঘটায় সেই ভোররাত্রেই গোলাম দস্তাগীরের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন হাজারখানেক মানুষ। এই গ্যাস দুর্ঘটনা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৬০০০০০ লোক এই গ্যাসে আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে প্রায় ১৫০০০ জনের মৃত্যু হয়। কত মানুষের জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা বা অন্ধত্ব নিয়ে অনেক মানুষ জীবন্মৃত হয়ে দিন কাটিয়েছেন। এত বিপর্যয় বা হতাশজনক ঘটনার মাঝে আলোকবর্তিকার মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে গোলাম দস্তাগীরের নাম।
তারিখঃ এপ্রিল ২৩, ২০২৪