লঙ্গরখানা
নবমী দাস
করোনা তার প্রথম থাবা বসিয়েছে কলকাতার বুকে। অফিস কাচারি, কলকারখানার কলকব্জায় জং ধরার উপক্রম, খেটে খাওয়া মানুষের হাড়গোড়ও বিকল প্রায় তবুও করোনা বাবাজী তার খেল দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি। তিনি স্বমহিমায় চড়ে আছেন মানুষের মাথায়। তাকে যে টেনে হিঁচড়ে কেউ নামাবে তার সাধ্যি কার আছে! গরম পড়লে করোনা বাবাজী পালাবেন শুনে সক্কলে গরমের জন্য হাপিত্যেশ করলো বটে কিন্তু যে কদু সেই লাউ! বরং গরমে করোনা বাবাজীবন নতুন উদ্যমে শুরু করলেন হামলা পর্ব। তা সে যাক, বাঙালি কবে কোন রোগভোগকে তোয়াক্কা করেছে যে করোনাকে করবে। তাও আবার চিনে আমদানি! তুড়ি মেরে মাস্কবিহীন জীবনযাপন। শহরে তখন খবরের চ্যানেলে দাগিয়ে দিচ্ছে কলকাতার একেকটা টুকরোর রেড জোন। রেড জোনে কড়া সর্তকীকরণ। যার মানার সে মানছে আর যার না মানার সে বাঁশের বেড়া টপকে আরামসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কয়েকমাস পরেই পৌরসভা নির্বাচন। কাউন্সিলরগণ তখন দুহাতে দান করছেন। একেকটা জ্যান্ত দয়ার সাগর আকাশ থেকে টুপ করে খসে পড়ল যেন।
বিশুবাবুর বেশ ট্যাঁকের জোর ছিল কিন্তু আগেরবারের নির্বাচনের টিকিট তিনি পাননি। রাগ হয়েছিল সাবেক এবং বর্তমান কাউন্সিলারের প্রতি কিন্তু চেষ্টা তিনি ছাড়েননি। তক্কে তক্কে ছিলেন, লকডাউনে মাইক দিয়ে প্রচার করিয়ে দিলেন “কাল থেকে বিশুর কয়লার দোকানের সামনের লঙ্গরখানা খোলা হচ্ছে। যে সব গরীব দুঃখী ভাইবোনেদের খাওয়া হচ্ছে না তাদের সাদর আমন্ত্রণ জানানো হলো। লঙ্গরখানা খোলা থাকবে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা। আপনাদের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার এই পূণ্য কাজটি আপনাদেরই ঘরের ছেলে কাজের ছেলে বিশ্বনাথ ঘরামী করছেন। সকলে হাসি মুখে দুটি ভাত ডাল মুখে দিলে তিনি ধন্য হবেন।” খুবই খেলো কথা বলে প্রচার করলেও বস্তির লোকেদের খিদের কষ্টটা বুঝি কমলো। দীর্ঘ তেরো দিন সকাল থেকে বিকেল অব্ধি বিশুর কয়লার দোকানের সামনে নোংরা পলিথিন পেপারে বসে চলল কাঙালি ভোজন। কেউ কেউ ধন্যি ধন্যি করল, কেউ কেউ ফিসফিস করে বললে, “পাপের টাকায় কাঙালি ভোজন করালে কি পাপ কমে বাপু!”
আগত পৌরসভা নির্বাচনী। টিকিট বিশুবাবু এবার হাতছাড়া করেননি। কোনো দল টল না একেবারে নির্দলে দাঁড়িয়ে পড়লেন ‘মই’ নিয়ে। মুহুর্মুহু প্রচার হলো, “আগত পৌরসভার নির্বাচনীতে কয়লা বিশু ওরফে বিশ্বনাথ ঘরামীকে বিপুল ভোটে জয়ী করুন। করোনাকালে আপনাদের মুখে যে ভাত তুলে দিয়েছে তাকে আজীবন আপনাদের মুখে অন্ন জোগানোর জন্য কেবল ‘মই’ চিহ্নে ভোট দিন।” নির্বাচনের দিন সদলবলে বুথের বাইরে থেকে করজোড়ে সকলের কাছে ভোট প্রার্থনা করলেন।
গণনার আগের দিন পর্যন্ত বিশুবাবু বুক ফুলিয়ে হাঁটলেন বটে তবে গণনার দিন রাতের বেলা বিপক্ষীয় দলের ছেলেদের কাছে চোখ-মুখ ফুলিয়ে অন্ধকারে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলাকাবাসীর উদ্দ্যেশে গালি বর্ষণ করে লাল তরল গলায় ঢেলে কয়লা বিশু কাঁচা কয়লায় গোডাউনে ঘুমিয়ে পড়লেন। কীসের যেন চিৎকারে ঘুম চটকে গেল। শাটারে মৃদু ধাক্কার আওয়াজ! ভয়ে শিউরে উঠলেন বিশুবাবু। একবার চোখের পাশে ফোলাটাতে হাত বুলিয়ে আহ্ করে উঠলেন ব্যথায়। রাগে দিশেহারা হয়ে হাতের কাছে কয়লাটানা বেলচাটা টেনে নিয়ে বললেন, “কে?” মৃদু অথচ কান্নাভরা গলায় জবাব এল, “দরজাটা খোলো বাবা, শুনলাম ওরা তোকে মেরেছে?” বিশুবাবু হাতের বেলচা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “এ্যাই বুড়ি, কেন এসেছিস এখানে? লোকে আমার মুখে থু থু ছেটাচ্ছে, তাই দেখতে? যা শাটার তুলবো না, যা দূর হয়ে যা! এসেছিস কেন এখানে, যত সব হাড় হাভাতে।” বাইরের শীর্ণ মহিলাটির কান্নাটি এবার গলা ফুটে বেরোলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন, “বাবা আমি যে তোর মা, তোকে লোকে গালমন্দ করছে, মারছে, এ কি আমার সহ্য হয় বাবা! একবারটি দরজা খোল বাবা, এতটা পথ হেঁটে এলাম বাবা তোকে একবার দেখবার জন্য।” বিশুবাবু ভেতর থেকে বেলচাটা তুলে শাটারে ছুঁড়ে মারলেন। বললেন, ” বুড়ি তুই যাবি এবার?” মহিলাটি শীর্ণকায়া তুলে চলে যেতে যেতে কয়লার দোকানের দিকে একবার চাইলেন, তারপর ছেঁড়াখোড়া কাপড়খানি গায়ে বেশ করে জড়িয়ে নিয়ে, লাঠি ঠুকে স্টেশনের দিকে চললেন। পথচলতি কে একজন জিজ্ঞেস করলে, “কয়লাবিশুর মা না?” বুড়ি থেমে মুখ তুলে তাকালেন, ম্লান হাসলেন একবার। পথচারী বললো, “শেষ ট্রেনে ভিক্ষে একটু বেশি পাওয়া যায় মাসি, তাড়াতাড়ি যাও।” বুড়ি জোরে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।ঠকঠক করে লাঠি ঠুকে তিন রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে গেলেন আস্তে আস্তে।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২