লাল শার্টের বয়স
মোহাম্মদ কাজী মামুন
আমার ছবি দেখে সে পছন্দ করে, আমি ব্যাপারটা উপভোগ করি – আমার প্রতি একটা মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে, আমার কি ভাল না লেগে পারে? তারপর সে আবার তরুণী। সে অবশ্য ফেসবুকে আমার পোস্ট পড়ে ভাল লেগেছে বলে রিকোয়েস্ট পাঠানোর কথা বলে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি, আমার তরুণ বয়সের চোখ ধাঁধানো ড্যাশিং ছবিটাই কাজ করেছে অন্তরালে। কারণ এমনটা তো আগেও হয়েছে, যখন প্রোফাইল পিকচার পাল্টিয়েছি, পালটে এই ছবিটা দিয়েছি, তখনই নতুন কিছু তরুণীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়েছি। কিন্তু সেইসব তরুণীর মোহ আস্তে আস্তে মিইয়ে গেছে। শুধু গেল না এই তরুণীটির। সে লেগে রইল জোঁকের মত। কারণে অকারণে আমায় নক করে। অনেক গুরুত্বহীন অনুল্লেখ্য আর নিতান্ত সাদামাটা, সাধারণ কথা সে বলে। আমি তার জন্য ছবিটাও পাল্টাতে পারি না আর।
একদিন সে আমার অফিসে আসতে চায়, আমি নির্ঘুম রাত কাটাই। আমি তো তাকে ডেকে আনিনি, সেইজন্যই ছুঁড়ে ফেলে দিতেও ভয়, না জানি আবার ব্যাকফায়ার করে! যদি আমার ডাকেই সে আসতো, তাহলে ফেরার রাস্তাও আমার জানা থাকতো। আমি অনেক ভাবি, নিজের কোনো দোষ খুঁজে পাই না। হ্যাঁ, আমি উপভোগ করতাম কিন্তু তার জন্য এই শাস্তি আমার পাওনা?
আমি নিজেকে বাঁচাতে একটি বুদ্ধির আশ্রয় নিই। তাকে বলি, চলুন একটি পার্কে দেখা করি। সেন্ট্রাল পার্কটা দিনের মধ্যভাগে খুব ফাঁকা থাকে। তাকে আসতে বলি। অফিস থেকে বের হয়ে যেতে হবে আমায়। একটি অজুহাত, অজুহাত মনের ইচ্ছার বাইরে। দিন রাত তার সন্ধান করতে লাগলাম আর নিজের উপরই চটে উঠলাম। কেন, কেন এই যন্ত্রণা সেধে সেধে নিয়েছি! তবে এই অনুভূতির পুরোটা শুধু যন্ত্রণা নয়, একপ্রকার ভয়ও মিশে আছে। কেন জানি বুক খুব দুরুদুরু করেছিল সে ক’টা দিন। যেদিন দিন তারিখ ঠিক হয়েছে, তার দুদিন আগ থেকে আমি খাওয়াদাওয়া কমিয়ে ফেললাম, চুল কাটালাম ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের স্টাইলে, অর্ধেক ন্যাড়া করে।
সেই দিনটার কথা বেশ ভাল মনে আছে। খুব ভোরে উঠলাম, তবে উঠলাম না বলে উত্তেজনায় ঘুম হলো না বলাই শ্রেয়। সাতসকালে ওঠা আমার কোনোকালেই হয়নি, সাধুপুরুষদের নিয়মের বেড়াজালে জীবনভরই জড়াতে চেয়েছি, কিন্তু পেরে উঠিনি। হালকা শীত শীত করছিল, সারা শরীরে কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি! কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু বাথরুমে যাওয়ারও তাড়া ছিলো। সেরে নিয়ে এসে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ব বিছানায় – এই ভেবে আমি মোটা কাঁথাটা এক ঝটকায় তুলে নিলাম। প্রক্ষালনপর্ব সেরে কী মনে করে বিছানায় না ফিরে একটু বারান্দায় দাঁড়ালাম। দেখলাম গোলাপ গাছটা গ্রিল বেয়ে বেয়ে ছাতের দিকে যাচ্ছে, অথচ গায়ে ফুল বা কলির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এই গাছের মনে হয় পথ চলাতেই আনন্দ! অনেকদিন গাছটিকে দেখিনি, ভোরে ঘুমিয়ে থাকি যে! দরজাটা ভেজিয়ে ছাদে উঠে গেলাম, সেও অনেক দিন পরেই। অনেক উঁচু থেকে শহরটির গায়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ব্যায়াম শুরু করলাম। এক একটা বুক-ডনে আমার সারা শরীর দুলতে লাগল মাঝ দরিয়ার নায়ের মতো। ছাদের ধাতব পিঠে হাতকে শক্তভাবে স্থাপন করাই হয়ে দাঁড়ালো বড় চ্যালেঞ্জের, ছুলে গেল হাতের তলার নরম মাংস। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু কী এক জেদ চেপে বসেছিল, একশো পার না করে মাঠ ছেড়ে দিলাম না।
ঘামে-ধুলোয়-গন্ধে ড্রেনের পোকার চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হচ্ছিল নিজেকে, তাই ইচ্ছেমত পানি ঢাললাম শরীরে, তবে প্রতিদিনকার মত গরম পানিতে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা পানি মিশিয়ে কুসুম কুসুম উষ্ণতায় আনতে ভুলে যাওয়ায় শরীর থেকে ধোঁয়া উঠছিল আমার। পশমি তোয়ালে জড়িয়ে যখন আলমারিটার কাছে এসে দাঁড়ালাম তখনো টপটপ করে পানি ঝরছিল শরীর বেয়ে আর আগের থেকেও শীত শীত করছিল আমার! আলমারির দুটো কাঠের দরজা, একদিকের ঘরে গোটা সাতেক হ্যাঙ্গার যার মধ্যে দুটি ছাড়া সবগুলোতে রঙবেরঙের কোট ঝোলানো ছিল। আর অন্য ঘরে তক্তা দিয়ে আলাদা করা তিনটি খুপরি, যেখানে অন্য সব কাপড়চোপড় থরে থরে সাজানো রয়েছে। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি ঘরগুলোতে, চেনা দৃশ্য হঠাৎ অচেনা ঠেকে আমার কাছে!
জামা কাপড়ের মধ্যে তুলনামূলক অধিক পুরোনোগুলো বেশি নীচে, এমনকি এক যুগ আগের শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবিও আছে ওখানে। আমার একটা বদ অভ্যাস আছে যা নিয়ে আমার আশে-পাশের লোকজন বিব্রত, বিরক্ত ও ইদানীং সন্ত্রস্ত – আমি জিনিসপত্র খালি জমাই, একটা জামা যে ব্যাগে করে ঘরে নিয়ে আসি, সেই কাগজের ব্যাগটিও আমার কাছে অতীব মূল্যবান! এমনি কত জিনিস যে জমিয়ে রেখেছি, কেউ যদি আমায় জিজ্ঞাসা করে – কী কাজ ওসবের, আমার কাছে কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আমার তো শুধু এটাই মনে হয়েছে যে ওগুলোর মধ্যে কিছু একটা আছে যা ফেলে দেওয়া চলে না। একই কারণে সুতো উঠে যাওয়া বহুবর্ষী শার্ট বা পাঞ্জাবিটা ঘরছাড়া করতে আমার বাধে।
সেদিন কেন জানি না পুরনো জামাকাপড়গুলি টেনে টেনে বের করতে লাগলাম। এমন ভাঁজ পড়েছে সেগুলোয়! একটা লাল শার্ট ছিল, বন্ধুরা বলতো নায়কের মতো লাগতো আমায়। বয়স এক যুগ না হলেও অর্ধযুগ তো হবেই।ফেসবুক লাইকের রেকর্ড করেছিল এই লাল শার্ট গায়ে চাপানো ছবিটা।সেটা যদিও তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পাওয়া গেল না। আমার জামাকাপড়গুলি অনেকদিন পর পর পরা হয়। সেই ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় মামা রাশিয়া থেকে একটা সোয়েটার নিয়ে এসেছিল, সেটিও তো দেখতে পাচ্ছি বহাল তবিয়তেই, তাহলে? লাল শার্টের শোকটা এক সময় বিরক্তির বেশ ধরলো। কেন একটি পোশাক নিয়ে ভাবতে হবে? কী অপরাধ আমার? ওকে না বলে দিলেই হতো। অফিস পর্যন্ত এসে কেলেংকারি করবে – এ নেহাতই আমার দুর্বল মস্তিষ্কের চিন্তা।
এই সময়গুলোতে কেমন এক জেদ চেপে বসে আমার মধ্যে, যেন কোনো এক অজানা গ্রহ থেকে কেউ আমায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, ভেংচি কাটছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম অফিস থেকে পার্কে যাওয়ার আগে যমুনার বিশাল শপিং কমপ্লেক্সে দম নিয়ে আসবো। লাল শার্ট খুঁজতে এসেছিলাম, ঠিক আগেরটির মতোই চাই আমার। মস্ত এই মার্কেটে এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। যে’রকম শার্ট মনের মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম, সে’রকম ছিল না এখানে। তবে লাল শার্ট ছিল আরো অনেক, অন্য অন্য রকম। সেগুলোকে ডিঙিয়ে কোনো এক অমোঘ নির্দেশে আমি হাঁটতে লাগলাম সুসজ্জিত আলোকোজ্জ্বল দোকানগুলিতে। একটির পর আর একটিতে। দোকানগুলিতে কেমন নির্লিপ্তি। মানুষ আসছে, যাচ্ছে। কোনো জোরাজুরি নেই, শোরগোল নেই। যে কেনার কিনবে, যখন সময় হবে তখন। অত বলা কওয়ার কী আছে!
একটি খয়েরি শার্ট চোখে লেগে গেলে অবশেষে তাকে নিয়ে ড্রেসিং রুমের দিকে পা চালালাম। দেখি আয়নার ওপারে দাঁড়ানো একটি ছোকরা, চেনাই যাচ্ছে না। খুশি হওয়ার পরিবর্তে কোনো এক অজানা ব্যথায় মনটা ছেয়ে গেল। ট্রায়াল রুমের দরজায় টোকা পড়তেই ধ্যান ভাঙলো, আরো কেউ সিরিয়ালে আছেন। বাইরে বেরিয়ে কাউন্টারে বসা ম্যাডামকে যখন শার্টটা দিলাম প্যাক করার জন্য সে যেন প্রথম হোঁচট খেলো। পরে আমার দিকে চোখ যেতেই হেসে দিল। এরপর আমি তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। যথেষ্ট হয়েছে, আর এক সেকেন্ডও দেরী করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আমার বিলম্ব দেখে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য অফিসমুখী হতে পারে। কে জানে, ইতিমধ্যে অফিস পৌঁছে গিয়েছে কিনা! টেনশন হতে থাকে আমার, এস্কেলটরের এক ধাপ থেকে আর এক ধাপে নামতে গিয়ে টাইটা দুলে ওঠে ভীষণ, কড়া হলুদ একটি টাই পরেছিলাম আজ। খেয়াল করলাম বেশি ঝুলে গেছে, খানিকটা শর্ট করতে হবে। নট-টা নতুন করে বাঁধতে শুরু করি চলতে চলতে, বা বলা ভাল দৌড়োতে দৌড়োতে।
শপিং কমপ্লেক্সটা পার্কের কাছেই – রিকশার দূরত্ব। বাইরে এসে সোজা হাঁটতে শুরু করলাম আমি। রিকশায় উঠে জ্যামের ভেতর বসে থাকার মানে হয় না, এর চেয়ে ভেতরের অলি-গলি হেঁটে আগে পৌঁছনো যাবে। বেশ একটা অস্থির অবস্থা হবে অবশ্য এজন্য। বিকেল শুরুর আগের এই সময়টা – এখনো রোদ সরে যায়নি আর রয়েছে শহুরে ধুলো-ধোঁয়া। ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করে দিয়েছে কপাল, শার্টের হাতার নীচেও ভিজে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে স্পটে পৌঁছানোর আগেই সে ছুটতে শুরু করবে একেবেঁকে। পার ভেঙে পথ করে নিতে নিতে প্লাবিত করে যাবে সদ্য কেনা শার্টসহ সব কিছু। তবে চিন্তা নেই, মার্কেট থেকেই একটা পকেট পারফিউম কিনে রেখেছি বুদ্ধি করে। উপরে লেখা ‘ফর ম্যান ওনলি’, রোনালডো’র ছবি আঁটা। ঘামের সাথে সাথে পথের সব গন্ধের জন্য সমুচিত জবাব হবে এটি।
আর মাত্র চল্লিশ গজ হবে, ঐ তো রাস্তার ধারে পার্কের গেটটা ছোট মত দেখা যাচ্ছে। ভাল করে দেখতে চশমাটা চোখে দিতে গেলাম কিন্তু খেয়াল হল এটি সানগ্লাস, ডাক্তার নির্দেশিত চশমার পরিবর্তে এটি নিয়েই বের হয়েছি। ইদানীং কেমন যেন ঘোলা ঘোলা দেখি সবকিছু, খুব বেশি বইয়ের দিকে তাকাই বলে? নাকি কম্পিউটার স্ক্রিনই আসল ভিলেন যার দিকে দিন প্রতি দশ ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে আমায় বাধ্য করা হয়? “আমার সব খেয়ো গো মাটি, শুধু চোখ দুটি… “। অ্যান্ড্রু কিশোরের সেই গানটা মাথায় ছিল কিনা জানি না কিন্তু আর কোনো সময় এত তড়িঘড়ি করে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া হয়নি। ডাক্তার যখন চোখ পরীক্ষা করতে করতে ‘এই সমস্যাগুলো তো আরো বেশি বয়সেই হয়, আপনার আগেই এল কেন, সেটাই প্রশ্ন’ – এই কথাগুলো বলছিল, আমি সেই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে নতুন পাওয়ারে চশমাটা করতে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন কোনো এক অজানা কারণে উৎকণ্ঠার পরিবর্তে আমার মধ্যে শান্তির সুবাতাস বইছিল!
হঠাৎ একটা রিকশা আমার প্রায় গা ঘেঁষে চলে যেতেই ধ্যান ভাঙে আমার। চলে যাওয়া রিকশাটার দিকে চোখ চলে যায়। ওর গোলাকার চাকাগুলোতে নতুন রংয়ের কড়া গন্ধ। টায়ারকে ঘিরে যে রুপালি জাল তা এই পড়ন্ত বিকেলের রোদে ঝাঁ চকচক করছিল। সেখানে যেন অচেনা নাচের আসর বসেছে। উপরে হাতলের সাথে ঝোলা বেল থেকে যে টুংটাং শব্দ হচ্ছিল তার সাথে এক অদ্ভুত তাল লয় জুড়ে দিয়ে এক দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য অচেতন ঘূর্ণি সেখানে। মাথাটা গুলিয়ে গেলে সানগ্লাসটা খুলে বুকে ঝুলিয়ে রাখি আমি। যখন পার্কে প্রবেশ করবো, তখন পরে নিলেই হবে, খুব বেশিক্ষণ থাকা হবে না আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে। একটা ছুতো খুঁজে যেভাবেই হোক বেরিয়ে পড়তে হবে। ঐ সময়টুকু সানগ্লাসের চোখেই দেখার কাজটা চালানো যাবে।
খালি চোখে হাঁটতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। চশমা যে এত উপকারী জিনিস, আগে বুঝিনি। আমি হাঁটি রাস্তা দিয়ে। যখন প্রায় ঘেঁষে একটি রিকশা যায় তখন মনে হয় মাথার উপর তার ঘর্ষণ টের পাই। এই বুঝি আঘাত করে গেল, শরীরটাকে বেঁকিয়ে ড্রেনে ফেলতে বাকি থাকে। রাস্তাগুলি এত সরু আর ভর্তি! প্রায়ই আমি রিকশার সামান্য শব্দে সচকিত হয়ে উঠি, কুর্নিশ করে পিছিয়ে যাই। আগেভাগেই তাকে জায়গা করে দিই। পৌরুষ বিদ্রোহ করে উঠে। একটা রাস্তায় কেন আমি দাঁপিয়ে হাটতে পারবো না! টেকনিক বদল করতে হবে। আমি না, রিকশা আমায় কুর্নিশ করবে! হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা গাড়ি ইউটার্ন নিতে যাবে, তাকে বিন্দুমাত্র সমীহ না দেখিয়ে তার আগেই পা বাড়াই আমি। একটা ঝড়ের গতিতে এসে সে আমায় প্রায় ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেল। চারদিক অন্ধকার হয়ে এল, একটা ধোঁয়া ধুলোর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। গরম বাতাস চারদিকে। রাস্তায় কেউ কেউ বলল, এমন করে কেউ পথ চলে? আর একটু হলেই তো গেছিলেন। এরপর তলিয়ে দেখতে কিছুক্ষণ পর পর চোখ বুজি। দৃশ্যটা কল্পনা করি আর সারা দেহ শক্ত হয়ে যায় আমার। যেন গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলা হয়েছে আমায়! যদি সত্যি সত্যি লেগে যেত? কী হতো তখন? আরো ভাল করে বুঝতে, আবার চোখ বুজি আমি।
ছোটোখাটো পার্কমত নার্সারির গেটটি খুলে যখন আমি ঢুকি তখন বিকেল শুয়ে পড়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এখনো কয়েক মিনিট আছে। তাই জিরিয়ে নিতে একটি বেঞ্চ খুঁজি আমি কাছে-ধারে। খুব চটপট কিছু কাজ করে নিতে হবে। পকেটে হাত বুলিয়ে রুমাল ও পারফিউমটা জায়গামতো আছে কিনা চেক করতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটি লম্বা ছায়া আমার সামনের দূর্বাঘাসগুলোকে সম্পূর্ণ ঢেকে দিল। চোখ তোলার আগেই কানে পৌঁছলো, ‘আপনিই মোরসালিন মারুফ?’
সে হাসছিল, তার চোখের কোণের কুঞ্চিত রেখাগুলোসহ। গোলাপি সালোয়ার কামিজ শরীরের ভাঁজকে ঠেলে বিকেলের পড়ন্ত আলোর সাথে মিতালী করতে মরিয়া। আমার গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরচ্ছিল না, কোনো মতে মাথাটুকু নাড়াতে পেরেছিলাম।
‘আপনাকে কেমন যেন দুর্বল দেখাচ্ছে। শরীরটা ভাল নেই?’
যেন ধপ করে জ্বলে উঠলো পৌরুষ, গা ঝাড়া দিয়ে বললাম, ‘কই না তো, সেরকম কিছু না। জ্যামে পড়ে গেলাম তাই।স্যরি!’
‘আপনার না সেই লাল শার্টটা পরে আসার কথা ছিল?’ হাঁটতে শুরু করার সময় দুজনের মাঝখানে যে সামান্য দূরত্ব ছিল, ইতিমধ্যে তা কমে আসছিল।
‘হ্যাঁ, কিন্তু শার্টটা খুঁজে পেলাম না।’ শার্টের বেদনাটা আবার মাথাচড়া দিয়ে উঠলো।
পার্কের মাঝে একটি সুন্দর লেক আছে, আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। গোলাপ ঝাড়ের কাছের একটি কাঠের বেঞ্চের দিকে ইশারা করল সে। ‘ভাল হয়েছে, শার্টটার অনেক বয়স হয়েছে। ঐ শার্টের ছবিটাতে আপনাকে কলেজ পড়ুয়া ছেলে মনে হয়।’
পার্কের বেঞ্চগুলো সাধারণত খুব নোংরা থাকে, আর ভাঙ্গাচোরা। যদিও এটি তার যৌবন ধরে রেখেছিল, আমরা নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে বসলাম। চতুর্দিকে মাথা উঁচু করে ফুটে থাকা ফুলে পাতায় ছয়লাপ গোলাপ ঝাড়টি দেখতে দেখতে বললাম, ‘আর এখন? ’
সে এবার হেসে ওঠে। অনেকক্ষণ ধরে তার মুখ-চোখ-শরীর হেসে চলে, সামলানোর একটুও চেষ্টা না করে। ‘আপনি এখন বড় হয়েছেন, সামনে আরও বড় হবেন। ছোট থেকে বড় হওয়াই তো মানুষের নিয়তি।’
বিকেল তার অন্তিম সময় পার করছে। পাখিরা অস্থির হয়ে উঠেছে। সে তার হাত আলতো বাড়িয়ে দিতে চাইলে আমি হাতটি ধরি। আমার মধ্যে ভয় ছিল না তখন, বিরক্তি বা হতাশা – তাও না, এমনকি কোনো না কোনো অনুভূতি, সেও বিদায় নিয়েছিল শুধু একটি জিনিসই ছিল আমার, সে হল নিয়তি।
আমার লাল শার্টটির মৃত্যু ঘটেছিল অনেক আগে, অথচ তাকে বাঁচিয়ে রাখছিলাম ধুঁকে ধুঁকে। এখন ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন নিয়মিত মেনে চলি। একটি সুস্থ-সফল জীবনের জন্য লাল রংয়ের ছিটেফোঁটা থেকেও দূরে থাকি আমি।
তারিখঃ এপ্রিল ৮, ২০২২