শাপলায় দেখি তোমার মুখ

চোখ দুটো খোলা। হাতের মুঠোয় কিছু খড়বিচালি ধরা। হা করা মুখে মাছি ভনভন করছে। শেষ মুহুর্তে বুকভরে শ্বাস নিতেই কি চাইছিলেন জয়ন্তী পিসি ? মধ্য এপ্রিলের শেষ বিকেলে, লাশটা পড়ে আছে পারিবারিক মন্দিরের সামনের উঠোনে। দীর্ঘদিনের পোষা কুকুরটা ঠাঁই বসে আছে লাশটা পাহাড়া দিয়ে। শেয়াল কিংবা শকুন কাছে ভিড়তে দেয়নি একমুহূর্তের জন্যও। আমাদের দেখে কুকুরটা উঠে গিয়ে একটু দূরে সামনের দু’পায়ের উপর মাথা রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জয়ন্তী পিসির নিথর দেহটার দিকে।

বড়ুয়া পাড়ায় লুকিয়ে ছিলাম তিনদিন তিনরাত। জয়ন্তী পিসির সায়ানাইড খেয়ে আত্মহননের খবর শুনেছি ওখানে। গিয়েছিলাম সাময়িক আশ্রয়ের সন্ধানে। পথে রাজাকারদের তান্ডবে আর ফিরতে পারিনি সময় মতো। যখন ফিরলাম তখন সব শেষ। বুড়ো-বুড়িদের আগেই পার করে দিয়েছি। কথা ছিল পরেরদিন ভোরে এসে অন্যদের নিয়ে যাবো। শুনশান বাড়িটা পড়ে আছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। বিকেলের শেষ আলোটুকু নিঃশেষ হওয়ার আগে পিসির লাশটা মাটিচাপা দিতে হবে। শানুকাকা পাড়ার কয়েকজন যুবককে খুঁজে আনলেন,যারা লুকিয়ে ছিল ঝোপে জঙ্গলে। নিঃশব্দে সবাই মিলে একটা গর্ত খুঁড়ল। লাশ গর্তে নামানোর আগে খেয়াল হলো, পিসির অনামিকায় একটা সোনার আংটি। শানুকাকা বললেন,আংটিটা খুলে নে টুনু, স্মৃতি হয়ে বুকে আগুন জ্বালাক। আমি খুলতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আঙ্গুলটাই ছিঁড়ে চলে আসতে চাইছিল।

এইটুকু বলার পর টুনুদা চুপ করলেন। স্বাধীনতার এতবছর পেরিয়ে গেল, এখনও সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরে এই পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্যদের।

কি হয়েছিল পুতুলদি,বেলাদি,রেনুদি’র। তাঁরা কিভাবে বেঁচে ফিরলেন ? মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস শুনতে বসা বালক বালিকা দলের উৎসুক প্রশ্ন। টুনুদা দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে, কান্না দমিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।

কি হবে ওসব জেনে ? দেখতে পারছিস না আমরা আসলে কি পেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়ে ? তারচে চল শহীদমিনার সাজাই। কাল ভোরে ফুল আর অশ্রুতে স্মরণ করি জয়ন্তী পিসি সহ সকল নাম বিস্মৃত শহীদদের।

নাছোড়বান্দা ছেলেমেয়েদের চাপে টুনুদা মুখ খুললেন।

লাশ মুখাগ্নি করারও ধর্মীয় নিয়ম পালন হয়নি। ব্রাহ্মণ নেই, যে মন্ত্র বলবে। তাই মন্ত্র হলো চাপা স্বরে “জয় বাংলা”। তারপর শুরু হলো আমাদের অজানার পথে পাড়ি দেওয়া। পার্শ্ববর্তী বড়ুয়া পাড়া হয়ে ফটিকছড়ির দুর্গম অঞ্চল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছুলাম ভারতের সাবরুম অঞ্চলে। নানুপুর,খিরাম,ধুরুং লেলাং কতো অজানা অচেনা গুরপথ পাড়ি দিয়েছি মনে নেই । শুধু মনে আছে, এক বিশাল জনস্রোত নীরবে অশ্রু মুছে মাতৃভূমি ছেড়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধা মাকে আর কাঁধে বইতে না পেরে ছেলে হাহাকার করছে। মা শান্তনা দিয়ে বলছেন, “যা পালিয়ে যা,বেঁচে থাক,আমার জন্য ভাবিস না, আমি এখানে দেশের মাটিতেই মরতে চাই। তোরা যুদ্ধে যা বাবা। ” পথে পথে সাধারণ কৃষক জনতা খাদ্য পানীয় নিয়ে সহায়তা করছেন। আবার রাতের আঁধারে সুযোগ বুঝে রাজাকারের দল হামলে পড়ছে এই নিরস্ত্র মানুষের নীরব মিছিলে। রামগড় আসার পর দেখলাম এক বৃদ্ধার দুই কান রক্তে রক্তে ভেজা, সাদা কাপড় লালে লাল হয়ে আছে। রাজাকাররা তার কানের সোনার দুল খোলার সময়ও দেয়নি, টান মেরে ছিনিয়ে নিয়েছে। বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো কোনো বনেদি ঘরের দাপুটে কতৃ ছিলেন হয়তো।

ছোটছোট টিলার আড়ালে মশারী, শাড়ি,কাঁথা যা ছিল সব দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তাবু বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতীয় সেনা ও সদ্য গঠিত মুক্তিসেনার দল শরনার্থীদের দেখাশোনা করছেন। তখনও সেখানে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আসেনি। আমরা কয়েক পরিবার মিলে কোনরকমে খিচুড়ি খেয়ে বেঁচে আছি। কতগুলো পাহাড়ি প্রাকৃতিক কুয়া আমাদের খাবার জলের উৎস। ইতিমধ্যেই কলেরা সহ নানারকম ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে শরনার্থী শিবিরে। রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে পালিয়ে আসা অসহায় মানুষ মরতে লাগলো, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতায় আরও অসহায় ভাবে। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন একদল মুক্তিযোদ্ধা আমার বোনদের নিয়ে এলো সাবরুমে আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে।

তারপর ? সবাই নড়েচড়ে বসলাম দিদিদের ফিরে আসার কাহিনী শুনতে। টুনুদা আবার শুরু করলেন।

মুক্তিযুদ্ধ আসলে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। অমানুষের সংসারেও যে কিছু মানুষ বসবাস করেন তা মুক্তিযুদ্ধ না হলে বুঝতে পারতাম না। যে রাজাকার আমার বোনদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল গণিমতের মাল হিসাবে, তারই স্ত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ির সহায়তায় আমার বোনদের রাতের আঁধারে পার করে দেন সীমান্ত। তাদের মুখে সেই বীভৎস দিন রাতের বর্ণনা  শুনে আমরা যখন স্তব্ধ, তখন আমার ছোট ভাই নীলু আর তার বন্ধু, পাশের বাড়ির তপন ঘর ছাড়লো। ওরা তখন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ। কি আগুন বুকে নিয়ে ওরা ছুটে গিয়েছিল যুদ্ধে, তা তোদের বুঝিয়ে বলতে পারবনা। আমিও যেতাম,পারলামনা। বুড়ো মা-বাবা আর বোনদের কার কাছে নিরাপদে রেখে যাই ? ওরা কথা রেখেছিল। যাবার আগে চিরকুটে লিখে গিয়েছিল, “দেশ স্বাধীন হলে যদি বেঁচে থাকি তবেই ফিরবো, তার আগে নয়।”

যুদ্ধের বিস্মৃত ইতিহাস শুনতে শুনতে দুটি কিশোর হৃদয় বুকের ভেতর সে আগুনের তাপ নিয়ে ফিরে গেল এক গোপন শপথ দীক্ষা নিয়ে। যুদ্ধ শেষে নীলুদা আর তপনদা একদিন গিয়েছিল ঐ রাজাকারদের একজনকে মারতে। কিন্তু হারামীটা পালিয়ে ছিলো, তাই অসমাপ্ত রয়ে গেছে প্রতিশোধ নেওয়া। প্রজন্মান্তরে প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দুই কিশোর।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্টের পর এলোমেলো হয়ে গেল বাংলাদেশ। চারিদিকে অরাজকতা। অস্থিরতায় কেটে গেল অনেকগুলো বছর। সেই পুরনো শকুনিরা খামছে ধরেছে লাল-সবুজের পতাকা। রাজাকারের সরদার দেশের মন্ত্রী। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে পুলিশ প্রোটকলে দাপিয়ে বেড়ায় টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ! পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো দেশে এরকম ঘটেছে কি-না সন্দেহ। বুকের ভেতর ধিকিধিকি আগুন নিয়ে বেড়ে উঠা সেই কিশোর দ্বয় ভুলেনি তাদের প্রতিজ্ঞা।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কিশোরেরা তখন যুবক। স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী ঠেকাতে বিরেধীদলের প্রস্তুতিও কিছুটা সশস্ত্র। বোমা বানানো,গুলি ছোঁড়া তখন ডালভাত। সদ্য যুবক দ্বয় আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক।

জয়ন্তী পিসির হন্তারক চিহ্নিত। সেই নরপশুটা সরকারি মদদপুষ্ট গ্রাম সরকার প্রধান। গ্রামের বাজারে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। রাতে জুয়ার ঠেক বসায়। মাতাল হয়ে গালাগালি করতে করতে বাড়ি ফেরে আর বউ পিটায়। সব নখদর্পনে খবর রাখে যুবক দ্বয়, আর অপেক্ষায় থাকে সুযোগের। দুবার সুযোগের কাছাকাছি চলেও গিয়েছিল, কিন্তু শেয়ালটা দল-বল নিয়ে চলে, তাই পিছিয়ে আসতে হয়।

নভেম্বরের এক অন্ধকার কুয়াশা ঢাকা রাতে শেয়ালটাকে ফলো করতে করতে বাজারের অদূরে শাপলা পুকুরের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে যুবক দ্বয়। সেদিন খুব ফুর্তিতে ছিল লম্পটটা। নেশার ঘোরে একাই ফিরছিল বাড়ি। সাথে নেই চেলা চামুণ্ডা।

রাত গভীর। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। বাদুরগুলো উড়ছে, দেখা যায় ছায়াছায়া। রাতজাগা পাখি আর শেয়ালের ডাকাডাকি পরিবেশটাকে কেমন গা ছমছমে করে তুলেছে। মাতালটা, জাতে মাতাল তালে ঠিক। শাপলা পুকুরের পাড়ে খেজুর গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে গেল। কুকুরের মতো বাতাসে গন্ধ শুঁকে মাতাল কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো, “আবে কোন হালা বাইনচোদ ” যুবকদের একজন মিলিটারি কায়দায় বললো, হল্ট !

ম্যাজিকের মতো হারামীটা ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে। প্রায় বিশ মিনিট জলের ঝাপটা শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ। শাপলার লতাগুলো হয়তো শত্রু চিনেছে এত বছর পর। আবার ঝিঁঝিরা ডেকে উঠলো। যুবকদের মনে হলো এবার ঝিঁঝিরা সেই বিখ্যাত গানের সুরে সুর মিলিয়ে গাইছে, ” জয় বাংলা, বাংলার জয়। হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়। “

তারিখঃ জানুয়ারি ১০, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse