শুধু প্রেমের কারনে

(১)

বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উপর, দক্ষিনেশ্বরের দিক থেকে এয়ারপোর্টগামী লেনে পড়ে ছিল যুবকের মৃতদেহটি।খবর পেয়েই বরাহনগর থানার পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করে। পাশেই পড়েছিল তার ব্যাবহৃত বিধ্বস্ত বাইক এবং মোবাইল ফোনটি।পুলিশের ধারনা,  “এটি একটি নিছক দূর্ঘটনা। ‘হিট অ্যান্ড রান’ কেইস।”

যুবকটি মৃত্যুর আগে তার মোবাইল ফোন থেকে লাস্ট কল করেছিল প্রিয়াঙ্কার কাছে। অজ্ঞাতনামা কেউ একজন মৃতের ফোন থেকেই কল করেন প্রিয়াঙ্কাকে। রাত সোয়া দশটার দিকে একটি ফোনকল যায় প্রিয়াঙ্কার মোবাইলে। প্রিয়াঙ্কাকে বলা হয়, “এই ছেলেটি মারা গিয়েছে। বরাহনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ওর মৃতদেহ রাখা আছে।” খবরটি শুনেই দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যায় প্রিয়াঙ্কা।

 

প্রাথমিক ভাবে ‘নিছক দুর্ঘটনা’ মনে হলেও ময়নাতদন্তে বোঝা গেল গুলি করে যুবকটিকে খুন করা হয়েছে। ছেলেটির কাঁধে একটি ক্ষত রয়েছে। যা বুলেটের ক্ষতচিহ্ন বলে ধারনা করা হয়। ময়নাতদন্তে বলা হয় গুলিটি খুব ‘ক্লোজ রেঞ্জ’  থেকেই করা হয়েছিল।সম্ভবত মৃত্যুর কারন দূর্ঘটনা হিসেবে সাজানোর জন্যই গুলি করার পরে বা আগে তাকে বাইক সমেতই গাড়ি দিয়ে ধাক্কা মারা হয়েছিল। সুরতহাল রিপোর্টে মৃতদেহ এবং বাইকের থ্যাতলানো অংশে গাড়ির সাথে সংঘর্ষের সুস্পষ্ট ছাপ ছিল।

 

মৃতদেহ উদ্ধারের পরপরই খুনের তদন্ত শুরু করে বরাহনগর থানার পুলিশ। ২০১১ সালের জুলাই মাসের ১২ তারিখে এভাবেই খুন হয়েছিলেন বেলঘরিয়া দেশপ্রিয়-নগর জাগ্রতপল্লির বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার জুনিয়র মৃধা। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র ছাব্বিশ বছর। বাবা সমরেশ মৃধা খুব সখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘জুনিয়র মৃধা’। মেধাবী পুত্রকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। জুনিয়রের মা মনে করেন, তার সন্তান শুধু মেধাবীই ছিল না। ছিল অত্যন্ত ভদ্র ও সজ্জন। বিনা অপরাধে, শুধু প্রেমের কারনে তাকে প্রাণ হারাতে হল।সেই সময় এই খুনের ঘটনাটি বেশ তোলপাড় তুলেছিল রাজ্য জুড়ে।

জুনিয়র মৃধার ফোন কলের সূত্র ধরেই তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা নামে এক তরুনী গৃহবধুর যোগাযোগের সূত্রটি সামনে চলে আসে। জুনিয়রের পরিবার থেকে বলা হল, ঘটনার দিন দুপুরে ফোনে প্রিয়াঙ্কার ডাক পেয়েই জুনিয়র বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। অচিরেই কলকাতা মোহনবাগানের সুপরিচিত প্রাক্তন ফুটবল কর্মকর্তা বলরাম চৌধুরী ও তার পরিবার ‘জুনিয়র মৃধা খুন’ মামলায় জড়িয়ে পড়লেন। বলরামের পুত্রবধূ প্রিয়াঙ্কা’র দিকেই সন্দেহের আঙ্গুল তুললেন জুনিয়রের পরিবার।তারা দাবি করলেন জুনিয়রের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার প্রেম ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রিয়তম ছেলের খুনে প্রিয়াঙ্কা-সহ অন্য অনেকেরই হাত আছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করলেন পরিবার।

 

(২)

২০০৮ সালে ফেইসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল জুনিয়র মৃধা এবং প্রিয়াঙ্কা চৌধুরীর। নিজেকে একজন মডেল হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল প্রিয়াঙ্কা।’ফেইসবুক ফ্রেন্ড’ হিসেবে তারা প্রতিদিনই নানা বিষয়ে অনলাইনে চ্যাট করত।এভাবে খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারা সামনাসামনি প্রথম দেখা করেছিল জিমে গিয়ে। জিমে একসঙ্গে ব্যায়াম করতে করতে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গভীর থেকে গভীরতর হয়। শুরু হয় দু’জনের একসাথে ঘোরাঘুরি। খাওয়া-দাওয়া। মন দেয়া-নেয়া।

 

ক্রমে জুনিয়রের পরিবারের সাথেও প্রিয়াঙ্কার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। জুনিয়রের বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন প্রিয়াঙ্কা।প্রিয়াঙ্কার রূপ ও মিষ্টি স্বভাবে মুগ্ধ হয়েছিল বাড়ির সবাই।এই জুটির প্রেমকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে, পারিবারিকভাবে নিজেদের মধ্যে বিয়ের আলোচনাও শুরু করেছিলেন তারা।

একরাতে, টেলিভিশনে একটি ‘রিয়ালিটি শো’ দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল জুনিয়রের। অনুষ্ঠানটি ছিল বিবাহিতা নারীদের নিয়ে তৈরি। প্রতিযোগীতামূলক ওই শোয়ে প্রিয়াঙ্কার অংশগ্রহণে হতভম্ব হয়ে যান মৃধা পরিবার। নিজের প্রেমিকাকে শাঁখা-পলা-সিঁদুর পরা বিবাহিতা রমনীর সাজে দেখে চমকে যান জুনিয়র।

 

পরিচয়ের প্রায় দেড়-দু’বছরের মাথায় জুনিয়র প্রথম জানতে পারল, প্রিয়াঙ্কা বিবাহিত। বিয়ে প্রসঙ্গটি গোপন করায় জুনিয়র ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার মনোমালিন্য শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রিয়াঙ্কা অসঙ্গতিপূর্ণ এবং খাপছাড়া কিছু উত্তর দিয়েছিল।

 

কিন্তু তারপরও ‘জুনিয়র-প্রিয়াঙ্কা’ প্রেমের সম্পর্কটি অব্যাহত থাকে। মনক্ষুন্ন হলেও জুনিয়র প্রেমিকা প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে সরে আসতে পারেনি। কারন প্রিয়াঙ্কা জুনিয়রকে স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের তিক্ততার কথা জানিয়েছিল। সে জয়দীপ চৌধুরীকে ডিভোর্স করে জুনিয়রকে বিয়ে করবে, এভাবেই সমঝোতা হয়েছিল দু’জনের মধ্যে। তাই আগের মতই দু’জনের মেলামেশা চলতে থাকে। যদিও তার মিথ্যাচারের কারনে জুনিয়রের বাবা-মায়ের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা হারিয়ে ছিল প্রিয়াঙ্কা।তাতে সম্পর্কটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, টিকে ছিল।

 

সেদিন অথাৎ জুলাইয়ের বারো তারিখ দুপুরে অফিস থেকে ফিরে, না খেয়ে, খুব তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে যাচ্ছিল জুনিয়র। পেছন থেকে ওর মা খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করছিলেন। ছেলে দুপুরবেলায় না খেয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে দেখে মন খারাপ করেছিলেন মা।জুনিয়র মা’র রাগ কমানোর জন্য বলেছিল, “মা, আমি প্রিয়াঙ্কার সাথে ওর বাড়িতে দেখা করেই ফিরে আসছি। বাড়িতে এসেই খাবো।” ঐদিন সে প্রিয়াঙ্কার বাড়িতে ঠিকই গিয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজেও তার প্রমাণও মিলেছে।

 

(৩)

জুনিয়রের মৃত্যুতে প্রিয়াঙ্কার ভূমিকা নিয়ে প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল মৃধা পরিবারের।খুনের আটদিনের মাথায় সিআইডি মামলার তদন্তভার নিয়েছিল। কিন্তু তদন্ত চলাকালে পরপর চার জন তদন্তকারীকে অন্যত্র বদলি করে দেয়ায়, ‘প্রিয়াঙ্কার শ্বশুর প্রভাব খাটিয়ে তদন্তের গতি রুদ্ধ করছেন’, এমন অভিযোগ উঠল জুনিয়রের পরিবার থেকে।

 

দীর্ঘদিন ধরে খুনের মোটিভ ও খুনিকে সনাক্তকরনের জন্য তদন্ত করছিল সিআইডি। প্রিয়াঙ্কা-সহ চৌধুরী পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন গোয়েন্দারা। কিন্তু বছর দু’য়েক কেটে গেলেও কাউকেই গ্রেফতার করতে পারছিল না পুলিশ। একপর্যায়ে তদন্ত থমকে গেলে মৃধা পরিবার হতাশ হয়ে পড়লেন। জুনিয়রের বাবা ‘সিআইডি’ তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে ‘সিবিআই’ তদন্তের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলেন। সিবিআইকে তদন্তভার দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও চিঠি লিখলেন তিনি।

অবশেষে ২০১৯ সালের জুন মাসে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে ‘জুনিয়র মৃধা খুন’ মামলার তদন্তভার পায় সিবিআই। তখন সিআইডিকে কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

সিবিআই তদন্তভার নেওয়ার পরপরই মামলাটিতে গতি ফিরে আসে। সিবিআইয়ের হাতে উঠে আসে নানা তথ্যসূত্র। মামলার ফাঁকফোকরগুলো খুঁজে বের করে, ছেড়াখোড়া, সন্দেহজনক তথ্যউপাত্তগুলো জড় করে, জোড়া দিয়ে, মামলার একটি কাঠামো তৈরি করে সিবিআই।

শুরু থেকেই সিবিআইয়ের নজর ছিল প্রিয়াঙ্কার শ্বশুরবাড়ির দিকে। কিন্তু জোড়ালো প্রমাণ ছাড়া অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করার হাইকোর্টের নির্দেশের কারনে সতর্কতার সাথেই এগুতে হচ্ছিল তদন্তকারীদের।

 

প্রিয়াঙ্কার এক নিকটাত্মীয়া স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিবিআইকে কিছু তথ্য জানাতে এগিয়ে আসেন। সিবিআইয়ের হাতে বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে দেন তিনি। এক পার্টিতে প্রিয়াঙ্কা তার এই নিকটাত্মীয়ার সঙ্গে জুনিয়কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। জুনিয়র-প্রিয়াঙ্কার প্রেমের সম্পর্ক, তাদের বিয়ের পরিকল্পনা, প্রিয়াঙ্কা-জুনিয়রের ব্যাপারে তার শ্বশুরবাড়ির প্রতিক্রিয়া সবকিছুরই প্রমান তদন্তকারীরা পেয়েছিলেন ওই তরুণীর দেয়া তথ্য-উপাত্তে।

 

এইসব তথ্য-উপাত্তের জের ধরেই তদন্তকারীরা প্রিয়াঙ্কা-সহ চৌধুরী পরিবারকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তদন্তে প্রিয়াঙ্কার সাথে প্রতীক শর্মা নামে টলিউডের এক প্রযোজকের নামও উঠে এলো। অবশেষে তাদের পলিগ্রাফ টেস্টেরও অনুমতি দিল আদালত। তদন্তে প্রতীক জানায়, “প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকেই আমি জুনিয়রের খুনের খবরটি শুনি। এই মর্মান্তিক খবরটি শুনে আমি তাকে শান্তনা দিয়েছিলাম।”

“শুধু জুনিয়রের সঙ্গেই নয়, প্রতীকের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে প্রিয়াঙ্কার। সম্ভবত সেই ত্রিকোণ প্রেমের জটিলতার কারনেই খুন হয়েছে আমার ছেলে।” এমনটাই দাবি করলেন জুনিয়রের বাবা। জুনিয়রের মৃত্যুর পর তার ফোনকল রেকর্ডে দেখা যায়, খুনের দিনও প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে প্রায় একুশ বার ফোনে কথা হয়েছিল জুনিয়রের। তদন্তে প্রিয়াঙ্কার কল-রেকর্ডও বের হয়ে আসে। জুনিয়র খুনের রাতে প্রায় দুইশ বার প্রতীক-প্রিয়াঙ্কার মধ্যে ফোনালাপ হয়েছিল।

 

(৪)

এসব তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করেই ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সল্টলেক সিবিআই দফতর ‘সিজিও কমপ্লেক্স’ এ সমন পাঠিয়ে ডাকা হয় প্রিয়াঙ্কাকে। সাত ঘণ্টা জেরার পর ‘সিবিআই স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ’ প্রিয়াঙ্কাকে গ্রেফতার করে। প্রথমে বরাহনগর থানার পুলিশ, সিআইডি, সবশেষে সিবিআই তদন্তভার নেয়ার দশ বছর পর জুনিয়র খুনের ‘কোল্ড কেইস’টি আলোর মুখ দেখে। হঠাৎ করেই সংবাদ-শিরোনামে উঠে আসেন প্রিয়াঙ্কা।

 

গ্রেফতারকৃত প্রিয়াঙ্কাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জেরা করেন তদন্তকমিশন। জেরার জবাবে প্রিয়াঙ্কা প্রচুর মিথ্যের আশ্রয় নিলেও তদন্তে জুনিয়রের সাথে সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে প্রিয়াঙ্কার একাধিক সম্পর্ক এবং একাধিক টালিউড পরিচালক, প্রযোজকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার প্রমান আসে পুলিশের হাতে।

 

পাশাপাশি জুনিয়রের জীবনের শেষকয়েক ঘণ্টার হদিস পাওয়ার জন্যও তৎপর হয়ে ওঠে তদন্তকমিটি। তদন্তকারীদের ধারণা, অমিমাংশিত প্রশ্নগুলোর উত্তর মিললেই এই খুনের জটিল রহস্যের জট খুলে যাবে।

 

তদন্তকারীরা বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে কাজ শুরু করেন।যেমন, জুনিয়রকে সল্টলেকে ডাকার কারন, এই পরিকল্পনায় প্রিয়াঙ্কার সাথে কে ছিল,  প্রিয়াঙ্কা কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, কেন নিজে জুনিয়রের সাথে দেখা করেনি, সর্বশেষ ফোনকলে প্রিয়াঙ্কা-জুনিয়রের সংলাপ, শেষ ফোনকলের কতক্ষণ পরে জুনিয়র গুলিবিদ্ধ হন, শেষমুহূর্তে কার সঙ্গে জুনিয়রকে দেখা গিয়েছিল, জুনিয়র গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর প্রিয়াঙ্কা কাকে ফোন করেছিল, কী কথা হয়েছিল, সেদিন পার্টিতে যাওয়ার আগে স্বামীর সঙ্গে কাকে নিয়ে ঝগড়া হয় প্রিয়াঙ্কার?

 

সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে প্রিয়াঙ্কার ড্রাইভার জানিয়েছে, ঘটনার দিন প্রিয়াঙ্কা স্বামীর সাথে একটা পারিবারিক পার্টিতে যাচ্ছিলেন। গাড়িতে অনেকগুলো ফোনকল আসছিল প্রিয়াঙ্কার কাছে। তখন তাকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে শোনা যায়। পথে গাড়ি থামিয়ে একজনের সঙ্গে দেখাও করেন তিনি। দুজনের কথা কাটাকাটি হয়। পরে প্রিয়াঙ্কা গাড়ি বদল করেন। ফোনে কার সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার কথা হচ্ছিল, গাড়ি বদলের কারন এবং সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির খোঁজে নেমেছে সিবিআই।

 

“সেই পার্টিতে বেশ দেরী করেই এসেছিল প্রিয়াঙ্কা। তাকে খুব বিষন্ন লাগছিল। জুনিয়রের সঙ্গে সম্পর্কের কারনে স্বামীর সঙ্গে তার অশান্তি চলছিল।” প্রিয়াঙ্কার প্রাক্তন জা নিরাজিতা চৌধুরী এই কথা জানিয়েছিলেন তদন্তকারীদের।

তদন্তকারীদের অনুমান, ভাড়াটে খুনির হাতেই খুন হয়েছিলেন জুনিয়র। তবে কে খুনিকে ভাড়া করেছিল, খুনের সময় প্রিয়াঙ্কা ঘটনাস্থলে ছিল কি না, কী ধরনের পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছিল, ব্যাবহৃত পিস্তলটি কার কাছে, কোথায় আছে, প্রশ্নগুলোর সদুত্তর মেলেনি প্রিয়াঙ্কার জবানবন্দীতে। সামান্য কিছু তথ্য জানানো ছাড়া প্রিয়াঙ্কা কোন বিষয়েই মুখ খোলেনি। শ্বশুরবাড়ি সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো সে এড়িয়ে গিয়েছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর মিললেই খুনের নীলনকশা জানা এবং রহস্যভেদ সহজ হবে।

 

(৫)

প্রিয়াঙ্কার শ্বশুর প্রিয়াঙ্কাকে গ্রেপ্তারের পর মিডিয়াকে বলেন, “পুরো ঘটনাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১১ সালের খুনের ঘটনা ২০২১ সালে নতুন করে তদন্ত হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। খুনের সাথে সম্পৃক্ততার কোন প্রমান ছাড়াই প্রিয়াঙ্কাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওকে আদালতে পেশ করা হলে আমরা জামিনের আবেদন জানাব।” প্রিয়াঙ্কার আইনজীবী অয়ন চক্রবর্তী বলেছেন, “আমার মক্কেল এই খুনের সাথে  জড়িত নন। তিনি কেবল তদন্তে সহযোগিতা করছিলেন।”

 

অন্যদিকে মৃধা পরিবারের পক্ষ হয়ে মামলাটি লড়ছেন জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তার মতে, “দেরিতে হলেও জুনিয়রের পরিবার সুবিচার পাওয়ার পথে একধাপ এগিয়ে গেলেন!”

 

ত্রিকোণ প্রেম, মিডিয়ায় কাজ করা নিয়ে জুনিয়রের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার তীব্র মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল। তদন্তকারীদের ধারণা, মনোমালিন্যপূর্ণ পরকীয়া থেকে বেরিয়ে আসতেই জুনিয়রকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। তবে খুনের নেপথ্যে প্রিয়াঙ্কা-সহ প্রভাবশালী আরও তিনজন জড়িত বলে মনে করা হচ্ছে।

 

ঘটনার দিন প্রিয়াঙ্কা জুনিয়রকে তাদের সল্টলেকের বাড়িতে ডাকলেও, পরে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু জুনিয়রের পীড়াপীড়িতে অন্যত্র দেখা করবে বলে জানায় প্রিয়াঙ্কা। সেইমত রাত আটটা-সাড়ে আটটার দিকে সল্টলেক পিএনবির কাছ দিয়ে জুনিয়রকে মোটরবাইকে যেতে দেখা যায়। কিন্তু জুনিয়র নির্দিষ্ট জায়গা সল্টলেক ৯ নম্বর ট্যাংকের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও দেখতে পায় প্রিয়াঙ্কা নিজে সেখানে না এসে অন্য একজনকে পাঠিয়েছে।

 

রাস্তার একাধিক সিসিটিভি ফুটেজে জুনিয়রকে ঐপথে যেতে দেখা গেলেও তাকে ফিরতে দেখা যায়নি। সিসিটিভির আরেকটি ফুটেজে রাত পৌণে ন’টার দিকে ৯ নম্বর ট্যাংকের কাছে জুনিয়রের বাইকে এক যুবককে বসে থাকতে দেখা যায়। বিষয়টি সিআইডি এবং বিধাননগর ট্রাফিক বিভাগ সিবিআইকে নিশ্চিত করেছে। প্রশ্ন হল, কে সেই যুবক? সে’ই কী ভাড়াটে খুনি?

 

রাত ন’টা একুশে জুনিয়র প্রিয়াঙ্কাকে কল করলে, অনেকক্ষণ কথা হয় দু’জনের। রাত সাড়ে ন’টার দিকে জুনিয়র প্রিয়াঙ্কাকে শেষবার একটি ম্যাসেজ পাঠায়, তাতে লেখা ছিল,

 

“জয়দীপ যেহেতু বাড়িতে নেই, আমার সঙ্গে দেখা করতে পারতে”!

 

মূলত রাত সাড়ে ন’টার দিকেই খুন হয় জুনিয়র মৃধা।

 

প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে ঐ লাস্ট ম্যাসেজটির আর কোন উত্তর আসেনি।বরং রাত সাড়ে ন’টার পর, জুনিয়র খুন হওয়ার আগের ও পরের সব এসএমএসই ডিলিট করা হয় প্রিয়াঙ্কার ফোন থেকে। যদিও ফরেন্সিক ল্যাব থেকে উদ্ধার হয়েছে ডিলিট হওয়া এসএমএসগুলো। উদ্ধারকৃত এসএমএস এবং রেকর্ডকৃত ফোনকলের ভিত্তিতেই প্রিয়াঙ্কা এবং তার প্রযোজক বন্ধুকে জেরা করেছে সিবিআই।

 

৬)

সিবিআইয়ের হেফাজতে প্রিয়াঙ্কাকে দফায় দফায়, লাগাতার জেরা করা হয়। ইতোমধ্যে প্রিয়াঙ্কাকে সিবিআই দফতরে জুনিয়রের বাবা-মা’র মুখোমুখি বসিয়েও জেরা করা হয়েছে। মৃধা দম্পতির সামনেও খুনের মামলায় তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রিয়াঙ্কা। বলেছেন, “আমাকে ফাঁসি দিন, মেরে ফেলুন, যা ইচ্ছা করুন। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না। আমি আগে যা বলেছি, এখনও তাই বলছি, পরেও তা-ই বলব। আমি জুনিয়রকে ভালোবাসতাম। ওকে খুন করিনি। এর বেশি কিছু আমি জানি না।”

 

জুনিয়রের বাবার অভিমত হল, “ভয়ে মুখ খুলছে না প্রিয়াঙ্কা। তাই বেশিরভাগ প্রশ্নই এড়িয়ে যাচ্ছে। ‘মনে নেই’ বলে পাশ কাটাচ্ছে।” গত দশ বছরে ছেলের খুনের কিনারা করতে প্রচন্ড দৌড়ঝাঁপ করেছে পরিবারটি। তদন্তের নামে প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে। খুনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণও নষ্ট হয়েছে সময়ক্ষেপনে। আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ সঙ্গে ছিলেন বলেই তারা দীর্ঘ লড়াইটি লড়তে পেরেছেন। শেষ-পর্যন্ত লড়েও যাবেন। জয়ন্তনারায়ণবাবু জানিয়েছেন, সমরেশবাবুর আইনজীবী হিসেবে তিনি প্রিয়াঙ্কার আগাম জামিনের ঘোর বিরোধিতা করবেন।

 

সিবিআই দফতরে প্রিয়াঙ্কার মুখামুখি বসে জুনিয়রের মায়ের মনেও নানা ভাবান্তর হচ্ছিল। এই ধূর্ত, বিষাক্ত কালনাগিনীর প্রেমে মজেই তার সহজ-সরল ছেলেটি প্রাণ হারিয়েছে।অথচ তাদের পুরো পরিবার প্রিয়াঙ্কার রূপে, মিষ্টি কথায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ঘরের মেয়ের মতই ভালোবেসে ছিলেন। অথচ সে’ই তার কলিজায় ছোবল দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। অশ্রুশিক্ত নয়নে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, “যে তার সন্তানের জীবন হরণ করেছে, তার প্রতি কোনও অনুকম্পা নয়। সংশিষ্ট দোষীর উপযুক্ত শাস্তিই তাদের একমাত্র কাম্য!

 

জুনিয়র খুন হওয়ার তিনমাস আগে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে তার শেষ-দেখা হয়েছিল। ওর সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার আর কোন ইচ্ছেও হয়নি তার। যেদিন বাড়িতে জুনিয়রের মৃতদেহ এলো, সেদিন প্রিয়াঙ্কাও এসেছিল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “জুনিয়র, বাবা, তুই চলে গেলি, আমায় দেখার যে আর কেউ রইল না বাবা!” সে আগ বারিয়ে এসে বলেছিল, “আমি দেখব তোমায়। প্রত্যেকটা খবর তোমায় দেবো। কে খুন করেছে, কে কে আছে খুনের সাথে, সবকিছু বলব তোমাকে।” কিন্তু সেই শেষ! তারপর আর সে কখনও, কোনরকম যোগাযোগই করেনি।

 

এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন সন্তান-হারা মা। বলেছিলেন, “আমার ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটিকে মেরে ফেললে? পয়সাওয়ালা প্রেমিক ধরেছ, তাই সম্পর্ক রাখবে না বলে মেরে ফেলবে? তুমি যতই বড়লোক, যতই প্রভাবশালী হও, আমার ছেলেকে খুন করার শাস্তি তুমি পাবেই পাবে! তোমার শাস্তি হলেই আমার জুনিয়রের আত্মা শান্তিতে ঘুমাবে!”

 

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত)

 

তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ আরও অন্যান্য ভারতীয় বাংলা-পত্রিকা থেকে সংগৃহিত।

তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse