শেকড়

 

লেকটাকে ভীষণ আপন মনে হয় কথার । সুখ, দুঃখের সাথী মনে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই লেকের পাড়ে বসে থাকে কথা । আজো কথা লেকের পাড়ে বসে আছে। আজ ওর স্পেশাল একটা দিন । ওর চব্বিশতম জন্মদিন।প্রায় সাড়ে পাঁচ ফিট লম্বা, ধবধবে ফর্সা, কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া কালো চুল, মিষ্টি একটা মুখের মেয়ে, কথা।চোখ দুটো মায়া মায়া। তবে মনে হয় চোখে যেন একটা বিষণ্নতার ছায়া লেগেই আছে ।রক্তের সম্পর্কে কেউ কখনো কথাকে জন্মদিনে উইশ করে না। মা ছাড়া আসলে কথার কেউ নেই পৃথিবীতে।মাও উইশ করতে ভুলে যায়।

মা তার বিশাল নামকরা ব্যক্তি। আমেরিকার নামজাদা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং কৃতী গবেষক।তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে আগে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। কথা ওর মায়ের ফোনে একটা কল দেয়। মেয়েহওয়ার জন্য কথা এইটুকু সুযোগ পায়, যে সরাসরি ওর মাকে কল দিতে পারে।

তিনবার রিং হতেই ওর মা কলটা ধরলেন। খুব মিষ্টি কণ্ঠে বললো, “হ্যাঁ, বল ডিয়ার কী বলবে?

কথা বলে “আমি একটু তোমার সাথে দেখা করতে চাই। আমার কিছু কথা ছিল। সময় হবে তোমার?”

ওর মা বলেন, “কাল সন্ধ্যায় ফ্রি আছি। চলে এসো, ডিনার করবে আমার সাথে। চাইলে রাতে থেকে যেতেও পারো।“

কথা বলে, “ঠিক আছে, কাল তাহলে আসছি। তবে আমি তোমার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই। তোমার বয়ফ্রেন্ড যেন না থাকে।“

পরের দিন সন্ধ্যায় কথা ওর মায়ের বিলাসবহুল এপারমেন্টে যায়। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দেয় আঙ্গুরি ।

আঙ্গুরি কথাকে জড়িয়ে ধরে। “বলে, কেমন আছো তুমি? কতোদিন পর এলে! কতোদিন পর দেখলাম তোমাকে।“;

আঙ্গুরি ওর মায়ের বাসায় থাকে। মায়ের সাহায্যকারী। কথার জন্মের পর বাংলাদেশ থেকে ওর মা আঙ্গুরিকে এনেছিলেন। তারপর থেকে আঙ্গুরি থেকে গেছে। আঙ্গুরির কাছে কথা ছয় বছর বয়স পর্যন্ত ছিল। পরে হোস্টেলে ওর মা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এর কাছেই কথা বাংলা বলতে, অল্প পড়তে, অল্প লিখতেও শিখেছে।কথার মনে হয়, এই আঙ্গুরিই একমাত্র ব্যক্তি যে ওকে ভালোবাসে।আঙ্গুরি বলে, “তোমার মা স্টাড়ি রুমে আছে। তুমি ওখানে চলে যাও। কাল তোমার জন্মদিন ছিল, তাই কেক বানিয়েছি।তোমার পছন্দের টমেটো দিয়ে মুরগির মাংস আর পরোটা বানাচ্ছি। না খেয়ে আবার চলে যেও না।“

কথা ওর মায়ের স্টাডিরুমে যায়। দেখে, ওর মায়ের সাথে মায়ের বয়ফ্রেন্ডও আছে। এই লোকটাকে কথার সহ্য হয় না। ওর মায়ের কথায় ওঠে আর বসে। মায়ের চামচাগিরি করে বলে কথার মনে হয়। তাই ব্যক্তিত্বহীন লাগে। আবার মায়ের সামনে কথাকে বাবাগিরি দেখাতে চায়। এটা বেশি বিরক্তিকর। কথা যেতেই, লোকটা হেসে

বলে, “ইয়াং লেডি কেমন আছো?”; কথা মাথা নেড়ে বিরক্তি লুকিয়ে বললো, “ভালো।“

“তাহলে, তোমরা মা-মেয়ে কথা বলো। আমি এবার চলে যাই।“

কথা মায়ের দিকে তাকায়। কতো বয়স মায়ের! চুয়ান্ন পঞ্চান্ন হবে। কিন্তু মা এখনো বেশ সুন্দরী। ডায়েট, ইয়োগা সব মেনে নিজেকে খুব সুন্দর রেখেছে।কথা মায়ের কাছে বসে। কফি নিয়ে ওর মা বলেন, “তারপর বল কেমন আছো? কী করছো?”

কথা বলে, “সব ঠিকঠাক। নিজের কাজ নিয়ে ভালো আছি।“

ওর মা জিজ্ঞাসা করেন, ”তুমি এখনো একা আছো?একজন বয়ফ্রেন্ড বা স্পেশাল কোনো বন্ধু কি তোমার আছে কেউ?”

কথা মাথা নেড়ে বলে “না নেই।“

ওর মা আবার বলেন, “ তোমার বয়স তো চব্বিশ হলো। এখনো তুমি একা কেন ?

তুমি কি ছেলেদের সাথে মিশতে পছন্দ করো না? মানে তুমি কি অন্যরকম?”

কথা বলে, “আমি অন্যরকম নই। তবে তোমার মতোও নই। তেমন হতেও চাই না। তুমি পুরুষদের ব্যবহার করো। তাই জীবনে নতুন নতুন পুরুষ এনেছ । তোমার চেহারা, স্ট্যাটাস আর ব্যক্তিত্বের কাছে পুরুষরাও ধরা দিয়েছে। আমার জীবনে কোনো একজন পুরুষ চাই যে আমাকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসবে। আমিও বাসবো। এমন কাউকে এখনো পাইনি।“

কথার মা বলেন, “তার মানে বলতে চাচ্ছ, আমি খারাপ!”

“না,খারাপ কেন হতে যাবে। তুমি তোমার মতো, আমি আমার মতো। দুইজন দুই রকম। এবার যে কারণে এসেছি তা সোজাসুজি বলি? আমি জানতে চাই, আমার বাবা কে? তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ, নিশ্চয়ই জানবে আমার বাবা কে? কোনো ফিলিংস থেকে জানতে চাচ্ছি না। আমি শুধু আমার শেকড়টা জানতে চাচ্ছি। তুমি যা বলবে আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত।তাই আশা করি সত্য বলবে ।“

ওর মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলে, “আমি আসলেই জানি না, তোমার বাবা কে?”

আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, “ তুমি আমার মতো চঞ্চল বা অস্থির নও। তুমি শান্ত স্বভাবের। তাই খুব মন দিয়ে আগে আমার সব কথা শোনো, তারপর যা বলার বলবে, করবে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রেমে পড়েছিলাম। যার প্রেমে পড়েছিলাম, সে অন্য একজনকে ভালোবাসতো। আমি জানতাম, কিন্তু তার থেকে বের হতে পারতাম না। সেও আমাকে ধরে থাকতো সেকেন্ড অপশনের মতো। বার বার ধাক্কা খেয়েছি। অনেক কেঁদেছি। একসময় শক্ত হয়েছি। ভেবেছি, পুরুষকে আর ভালোবাসবো না। পুরুষ জীবনেএলে আসবে, যদি একটুও ভালোবাসে, ভালোবাসা নিব। তবে ভালোবাসবো না।

পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলাম। জীবনে যেখানে যেতে চেয়েছিলাম, পেরেছি। সফলতা পেয়েছি, টাকা, সম্মান সব পেয়েছি! আমি মা, বাবার একমাত্র সন্তান তা তুমি জানো। মা মারা যাওয়ার পর আমার মনে হলো বাবাও এক সময় চলে যাবে, আমার আপন কেউ থাকবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, মা হবো। কিন্তু বিয়ে করে কোনো পুরুষের সাথে জড়াতে ভালো লাগলো না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে স্পার্ম ব্যাংক থেকে তোমাকে গ্রহণ করি । সিঙ্গেল মা হই।

সিঙ্গেল মা হই জন্য আত্মীয় স্বজনরা এটাকে ভালো ভাবে নেয় না। তাদের সাথেও তাই যোগাযোগ কমে যায়। আমি তোমাকে জন্ম তো দিলাম, কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হতো। তাই তোমাকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে কখনোই পারিনি। আর সেভাবে কাছে নিয়ে আদর করা, মুখে তুলে খাওয়ানো এগুলো আমার মধ্যে ছিল না। মনে হয়, আমার মনটা মরে গিয়েছিল। কিন্তু তোমার প্রতি আমি অন্য সব দায়িত্বই পালন করেছি যথাসাধ্য।

তুমি আস্তে আস্তে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছ। আমি কিছুই বলিনি। ভেবেছি, তুমি যেভাবে ভালো থাকতে

চাও থাকো।“

কথা বলে, “তোমার আর সব প্রজেক্টের মতো আমাকেও একটা প্রজেক্ট ভেবে নিয়েছ। এই তো! আমি যে মানুষ, আমার জন্য মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ যে দরকার তা একবারও ভাবোনি।

কোথা থেকে আমাকে নিয়েছ ? সেই ঠিকানা কি আছে?”

একটু চুপ করে থেকে আবার কথা বলে, “আমি আমার শেকড়কে জানতে চাই মম।“

ডিনারের সময় হয়ে যায়। সেই রাতে কথা ওর মায়ের কাছে থেকে যায়।

সকালবেলা ও বের হবার সময় ওর মা ডেকে বলেন, “আমি তোমাকে মায়ের পরিপূর্ণ ভালোবাসা দিতে পারি নাই। কিন্তু আমার সম্পত্তি, টাকাপয়সা সবই তোমার। তোমার টাকা ইনকামের কথা ভাবতে হবে না। নিজের যা ভালো লাগে করো। আনন্দে থাকো। আর একটা কথা ছেলেদের কাছে ভালোবাসা আশা করো না। ছেলেরা ভালোবাসতে জানে না। বা জানলেও মেয়েরা

যেমনভাবে চায় তেমন করে বাসে না।“

তারপর হাতে একটা খাম দিয়ে বলেন, “এখানে সেই হাসপাতালের ঠিকানা আর সব তথ্য আছে যেখান থেকে তোমাকে গ্রহণ করেছিলাম। যদি খুঁজতে যেতে চাও যাও। তবে তেমন কিছু আশা করো না।“

মাস চারেক পরে, মায়ের দেয়া খামের ঠিকানা মতো কলকাতার একটা নামী হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কথা। কথার বন্ধু সৌম্য কথাকে অনেকটা সাহায্য করেছে। সৌম্য কলকাতার এক রাজনৈতিক নেতার ছেলে। আমেরিকাতেই থাকে, সেখানেই কথার সাথে পরিচয়, বন্ধুত্ব। সৌম্যও সাথে এসেছে৷ সৌম্য না থাকলে কথার হয়তো অচেনা দেশে সমস্যাই হতো।

কথা হাসপাতাল থেকে ওর বায়লোজিক্যাল বাবার নাম পায়। অনেক কষ্টে সৌম্য ঠিকানাও জোগাড় করে দেয়। ডাক্তার বোধিসত্ত্ব! ওর বায়লোজিক্যাল বাবা। যখন উনি স্পার্ম ডোনেট করেছিলেন। তখন উনি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলকাতায় সৌম্যের এক কাজিন , মিমি আর সৌম্যকে নিয়ে কথা ডাক্তার বোধিসত্ত্বের ঠিকানায় যায়। ওনার খোঁজে ।

পুরাতন একটা পাঁচতালা বাড়ির সামনে এসে ওদের ট্যাক্সি দাঁড়ায়। কথা ভয়ে ভয়ে দোতালায় উঠে কলিং বেলে চাপ দেয়।

ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা এসে দরজা খোলেন। কথা জিজ্ঞাসা করে, “ ডক্টর বোধিসত্ত্ব এখানে থাকেন?” আমি একটু ওনার সাথে দেখা করতে চাই।“

;

ভদ্রমহিলা বলেন, “না থাকেন না।“

কথা বলে, “কিন্তু আমি ওনার এই ঠিকানাই পেয়েছি। দেখুন আমি আমেরিকা থেকে এসেছি, ওনার সাথে একবার দেখা করতে চাই । প্লিজ যদি হেল্প করতে পারেন তবে ভালো হতো।“

ভদ্রমহিলা ভ্রূ কুঁচকে কথাকে ভালো করে দেখে, বলেন, “ভেতরে এসো।“

কথারা বাসার ভেতরে এসে বসে।ভদ্রমহিলা বলেন, “বোধি আমার ভাই। ও তো কলকাতায় থাকে না। তোমার কী দরকার?”

কথা মনে মনে ভাবে এই মহিলা ওর পিসি। যদি রক্তের টান বলে কিছু থাকে তাহলে এই মহিলার ওর প্রতি একটু হলেও টান হওয়া উচিত। মুখে বলে, “ওনার ঠিকানাটা দিন প্লিজ। ওনাকে আমার খুব দরকার। “

ভদ্রমহিলা ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর দার্জিলিংএর একটা ঠিকানা দেন। বলেন, “ও ওখানে থাকে বলে জানি। কিন্তু ও কারো সাথেই যোগাযোগ করে না। তাই অন্য কোথাও চলে যেতেও পারে।“

কথা ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসার উপক্রম করতেই ভদ্রমহিলা ওকে বলেন, “আমি কি তোমাকে আগে কখনো দেখেছি? তোমাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।“

কথা বলে, “ না দেখেন নাই আগে।“

কথা সৌম্যকে সাথে নিয়ে দার্জিলিংএর পাশে একটা গ্রাম লেপচা জগৎ এ এসেছে। এখানে ভালো হোটেল নেই।স্থানীয় মানুষেরা তাদের বাড়িতেই কয়েকটা ঘর পর্যটকদের থাকার জন্য ভাড়া দেয়। টাকার বিনিময়ে খাওয়া দাওয়া। তারাই রান্না করে দেয় । এমন একটা বাড়িতে উঠেছে কথারা।

এই গ্রামের পাশেই একটা মিশনারি হাসপাতাল আছে। সেখানেই ডাঃ বোধিসত্ত্ব চিকিৎসক হিসেবে আছেন বলে কথা জেনেছে। কথা প্রথমদিন বিকেলেই হাসপাতালের কাছে যায়। আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ও খোঁজ নিয়ে জেনেছে ডাঃ বোধিসত্ত্ব বিকেলে হাঁটতে বের হন। একটু পর কথা দেখে, অনেক লম্বা ফর্সা একজন এক ভদ্রলোক ছাই রঙের পুলোভার কালো জিন্স আর কেডস্পরে হাঁটতে বের হয়েছেন। বয়স পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন হবে।

কথার কেন জানি মনে হলো, ইনিই ডাঃ বোধিসত্ত্ব।

কথা এগিয়ে যায়, “ হ্যালো” বলে।ভদ্রলোকও হ্যালো বলে তাকান। কথা হেসে বলে, “ আমি কথা, এখানে ঘুরতে এসেছি। আপনি?”

ভদ্রলোক বলেন, “আমি ডক্টর বোধিসত্ত্ব। এই হাসপাতালের চিকিৎসক।“

কথা বলে, “আমি কি আপনার সাথে একটু হাঁটতে পারি?”

ডক্টর একটু হেসে বলেন, “ঠিক আছে, আসতে পারো।“

সেদিন কথা টুকটাক অনেক গল্পই করে।পরের দিন কথা আবার আসে। ডক্টর আর কথা গল্প করতে করতে বেশ অনেক দূর একসাথে হাঁটে।তৃতীয় দিন ভোরে ডক্টর , কথা আর সৌম্য সূর্য উদয় দেখতে যায়। লেপচা জগৎ থেকে খুব সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কথা মুগ্ধ হয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্যে।পরের দিন বিকেলে কথা হাসপাতালের কাছে এসে একটু গাছের আড়ালে লুকিতে থাকে। ও দেখে ডক্টর হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কথার যেন মনে হয়, হয়তো উনি কথাকেই খুঁজছেন।

ও সামনে আসে, বলে, “চলুন ডক্টর, আজ একটু কোথাও বসে চা আর মোমো খাই।“

ডক্টর বলেন, “আমি বাইরের খাবার খাই না। তুমি খাও।“ কথা একটু জেদ মেশানো আব্দার করে বলে, “না, চলুন। আমি যদি আপনার মেয়ে হতাম তাহলে আমি জেদ করলে আপনি যেতেন না!”

ডক্টর হেসে বলেন “আচ্ছা চলো।“

ওরা একটা খোলা রেস্টুরেন্টে বসে চা আর মোমোর অর্ডার দেয়।

কথা বলে, “ জানেন ডক্টর, আপনার চোখদুটো খুব সুন্দর। মায়ায় ভরা৷ চোখটা যেন অর্ধেক খুলে মায়াভরে সবকিছু দেখেন।“

একটু হেসে বলে, “আমার চোখও নাকি এমন।আমার অনেক বন্ধুরাই বলে।“

ডক্টর খুব জোরে হেসে বলেন, “আমার চোখ কেমন তা আমি কখনো ভাবি নাই। তবে তুমি যে বর্ণনা দিলে তাতে মনে হলো, তোমার চোখ ঠিক এমন মায়ায় ভরা। একটু যেন বিষণ্নতাও আছে তাতে।“

মোমো আর চা এসে যায়। ওরা খেতে খেতে গল্প করতে থাকে। কথা বলে,

“দেখুন ডক্টর, আশপাশের গাছগুলো। একটা গাছ একটা গাছের কতো আপন! যেন ছোট গাছগুলো বড় গাছের স্নেহ মমতায় বড় হচ্ছে। আমার মনে হয় ওরা বাবা, মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজনে মিলে মিশে থকে। দেখুন ওদের সবার শেকড় এক জায়গায়। ওদের আমার অনেক সুখী মনে হয়।মানুষও আগে এভাবে থাকতো। আত্মীয় স্বজন নিয়ে মিলেমিশে সুখে দুঃখে এক সাথে থেকেছে।আর এখন মানুষ দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছে। কাকা, মামা, পিসি, মাসি, ভাইবোন কেউ কাছাকাছি থাকে না। কিছু মানুষ একেবারেই একা, নিঃসঙ্গ। তাদের কেউ নেই। কোন শেকড় নেই।“

কথার চোখে জল আসে। ডক্টর একটু হকচকিয়ে যান। তারপর কথার মাথায় স্নেহের হাত রাখেন। কথা মনে মনে বলে, বাবা, আমার মাথায় আরেকটু হাত রাখো বাবা। আমি সেই ছোট থেকে আমার মাথায় তোমার স্নেহের হাত চেয়েছি। আমি কাঁদলে ভেবেছি, বাবা তুমি আমার চোখ মুছিয়ে দিবে। আমি যুগযুগ ধরে তোমার স্নেহ চেয়েছি।“

সন্ধ্যা হয়ে আসে। ওরা গন্তব্যের দিকে রওনা হয়। কথা বলে, “ কাল আমি চলে যাবো। সকাল আটটায় বের হবো। দার্জিলিং থেকে কলকাতা হয়ে আমেরিকা চলে যাবো। আর হয়তো আপনার সাথে দেখা হবে না!”

সকালে কথা ট্যাক্সিতে উঠে বসে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে ডক্টর আসছেন।কথা ট্যাক্সি থেকে নামে। হাসিমুখে বলে, “আরে আপনি!”

ডক্টর বলেন, “এমনিতেই এলাম। কেন জানি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। জানো, মায়ায় কখনো জড়াতে চাই নাই। তাই বিয়ে করি নাই, বাচ্চাও নাই। ডাক্তারি আর গাছপালা প্রকৃতির সুন্দর্য নিয়ে একা থাকতেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু এই কদিনে তোমার প্রতি কেন জানি না ভীষণ মায়া হলো। আজ প্রথম মনে হলো, তোমার মতো একটা মেয়ে থাকলে বেশ হতো।“

কথা চুপ করে থাকে। ওর চোখ ছলছল করছে।

ডক্টর আবার বলেন, “তাই এলাম তোমাকে চলে যাবার আগে একবার দেখতে। শোন, তোমার যদি এখানে আবার আসতে ইচ্ছা করে তুমি এসো। এই নাও আমার ফোন নাম্বার। মন চাইলে ফোন দিও।“

কথা মাথা নেড়ে বলে, “ঠিক আছে।“

ট্যাক্সি চলতে শুরু করে। পাহাড়ি রাস্তা, ট্যাক্সি ঘুরেঘুরে চলতে থাকে।যতোক্ষণ দেখা যায় কথা পিছনে তাকিয়ে ওর বায়লোজিক্যাল বাবাকে দেখতে থাকে। কথা আবার নিজেই ভাবে, এটা কী ভুল হলো ? চলে যেতে যেতে বাবার আদলের সবটুকু যেন তুলে নেয় কথা চোখের পাতায়।

তারিখঃ জানুয়ারি ১৭, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Alok Mandol
Alok Mandol
2 years ago

অপুর্ব লেখনী

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse