শেহেরজাদ মূল গল্প : হারুকি মুরাকামি 

 

প্রতিবার সঙ্গম শেষে সে হাবারাকে একটি করে অদ্ভুত ও আকর্ষক গল্প বলতো। ঠিক “One Thousand and One Nights.” এ শেহেরজাদ যেমন করে রাজাকে গল্প শোনাতো। কিন্তু, পার্থক্য হলো, গল্প শেষে পরদিন সকালে  রাজার যেমন শেহেরজাদের মাথা কাটা নিয়ে এক পরিকল্পনা ছিল, হাবারার তা ছিল না। অবশ্য, সকাল পর্যন্ত সেও হাবারার সাথে রাত কাটায়নি কোনোদিন। সঙ্গম শেষে প্রতিবার গল্প বলার অধ্যায়টি কেন এসেছিল, এ নিয়ে হাবারা ভেবেছে অনেক। হতে পারে, অন্তরঙ্গ সহবাসের পরবর্তী সুখটুকু সে অলস বিছানায় গুটিশুটি হয়ে তার সঙ্গীর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পছন্দ করতো। হতে পারে, প্রবল দ্বৈরথের পর হাবারাকে ক্ষণিক আনন্দ দিতে চাইতো। কেন না, হাবারার প্রতিদিন কাটতো চারদেয়ালের ভেতরে, এছাড়া হাবারার আর কোনো বিনোদন ছিল না।

হাবারার মনে হতো, এ আর এক শেহেরজাদ। যদিও, কখনই এ নামে তাকে সে সম্বোধন করেনি। তার ছোট্ট ডায়েরির দিনলিপিতে বল পেনে লিখে রাখতো “আজ শেহেরজাদ এসেছিল”। সংক্ষিপ্ত আকারে সাংকেতিক অক্ষরে লিখতো সেদিনের ঘটনাবহুল মুহূর্তগুলো। গল্পগুলো সত্যি, না আংশিক সত্যি, নাকি সম্পূর্ণই মন গড়া তা সে কখনই জানতে পারেনি। শুধু বুঝতে পারতো শেহেরজাদের গল্পের আখ্যানে হাবারা এক শিশুর মতো জড়িয়ে পড়তো বাস্তবতা এবং অনুমানের মাঝামাঝি এক অপার্থিব জগতে। আর কীই বা ফারাক পড়তো গল্পের সত্যতা কতটুকু এ নিয়ে ভেবে। যাই হোক না কেন, শেহেরজাদের এক অসামান্য প্রতিভা ছিল গল্পকথনে। যে ধরনেরই গল্প হোক না কেন, তার কণ্ঠের প্রক্ষেপণ, আবহ, আবেগ এবং সময় সব মিলিয়ে এক উত্তেজনা তৈরি করতো নিমেষেই। হাবারা ভুলে যেতো তার বাস্তব প্রেক্ষিত যা তাকে ঘিরে রয়েছে। যেন একটা ব্ল্যাকবোর্ড ভিজে কাপড় দিয়ে এমন করে মুছে দেয়া হয়েছে, যেখানে কোনো শঙ্কা নেই, নেই কোনো অপ্রীতিকর স্মৃতির ঝড় ঝাপটা। জীবনের এই সময়টুকুতে হাবারা এর চেয়ে বেশী কিছু চায়নি।

শেহেরজাদের বয়স ছিল পয়ত্রিশ, হাবারার থেকে চার বছরের বড়। পুরোদস্তুর হাউসওয়াইফ এবং দুই বাচ্চার মা। রেজিস্টার্ড নার্স হলেও সে নিয়মিত কাজ করতো না। মাঝে মধ্যে তার ডাক আসতো। স্বামী সাধারন চাকুরে। হাবারা যেখানে থাকতো তার থেকে পচিশ মিনিট দূরেই ছিল শেহেরজাদের বাড়ি। এইটুকুই তথ্য শেহেরজাদ হাবারাকে জানিয়েছিল স্বেচ্ছায়। হাবারা এই তথ্যর সত্যত্য নিয়ে কখনও ভাবেনি বা যাচাই করবার চেষ্টাও করেনি। “এর থেকে বেশি তোমার জানবার দরকার নেই, আছে কি?” শেহেরজাদ জিজ্ঞেস করেছিল হাবারাকে। হাবারার নামটিও কখনই শেহেরজাদ উচ্চারণ করেনি, যেন সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়েছিল।

“A Thousand and One Nights” এ শেহেরজাদের যে রূপ বর্ণনা রয়েছে বাস্তবিক ভাবে এই শেহেরজাদের কোনো সাদৃশ্য ছিল না তার সাথে। ইতোমধ্যেই সে তার মধ্যবয়সি পথে হাঁটতে শুরু করেছে, মুটিয়েও গেছে খানিকটা, চোখের কোণে বেশ অনেকটুকুই জ্যামিতিক রেখা যুক্ত হয়েছে জালের মতো। বেশভূষা এবং প্রসাধন  বেপরোয়া নয় মোটেও। হঠাৎ করে কেউ শেহেরজাদকে দেখে হয়তো কোনো প্রশংসাও ছুঁড়ে দেবে না। এমনটি নয় যে সে আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু অযত্নের ছাপ রয়েছে অনেকটাই। অনেকের মধ্যে হয়তো তার উপস্থিতি বিশেষভাবে কারো নজরেই পড়বেই না। কিন্তু, এটা নিশ্চিত যে, আজ থেকে দশ বছর আগেও সে অনেকের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম ছিল। সেই অধ্যায়ের যবনিকা পাত হয়েছে অযত্নে অনবধানে যার পুনরুদ্ঘাটনের সম্ভবনাও হয়তো মৃত।

শেহেরজাদ হাবারার কাছে আসতো সপ্তাহে দু’বার এবং উইকএন্ডে কখনোই না। ঐ দু’দিন সে তার পরিবারের সাথে সময় কাটাতো নিঃসন্দেহে। হাবারার কাছে আসবার একঘণ্টা আগে সে সাধারনতঃ ফোনে জানিয়ে দিতো। আসবার পথে একটি পুরোনো মডেলের নীল মাজদার হ্যাচব্যাক ভরে কিছু বাজার সদাই করতো হাবারার জন্য। গাড়ি পার্ক করে, নিজ হাতেই বাজারগুলো নিয়ে দরজার কাছে এসে ডোরবেল বাজাতো। হাবারা পিপহোল দিয়ে দেখে নিতো শেহেরজাদকে। নিশ্চিত হয়ে তবেই দরজার তালা খুলে দিতো। শেহেরজাদ বাড়িতে ঢুকেই রান্নাঘরে চলে যেতো। রেফ্রিজেটরে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতো সবকিছু এবং পরের সপ্তাহে কী কী লাগবে তার একটি তালিকা বানিয়ে নিতো। এই কাজগুলো যখন করতো তখন শেহেরজাদ থাকতো নিশ্চুপ। সে এই কাজগুলো সেরে নিতো অভ্যস্ত ছন্দে। সব সারা হলে তারা দুজন নিঃশব্দে হেঁটে আসতো শোবার ঘরে। যেন কোনো দুর্বিনীত স্রোতের ধারা দু’জনকে ভাসিয়ে নিয়ে আসতো এক অব্যর্থ লক্ষ্যের দিকে। ধীরে ধীরে নিজেকে অনাবৃত করতো শেহেরজাদ। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়তো সেই ব্যকুল দ্বৈরথে। তার গতি প্রকৃতি ছিল তীব্র, অনিবার্য। অধিকাংশ সময়েই শেহেরজাদ থাকতো নীরব। যেন, কোনো assignment নির্ভুল ভাবে, কোনো ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় মোটেও। হাবারার তখন মনে পড়ে যেতো, শেহেরজাদ একজন রেজিস্টার্ড নার্স।

সঙ্গমত্তোর মুহূর্তগুলো কাটতো গল্পে ও কথায়। বলতে গেলে শেহেরজাদই একাধারে কথা বলতো আর হাবারা শুনে যেতো একনিষ্ঠ শ্রোতার মতো। কখনও হয়তো ছোট ছোট প্রশ্ন করতো, তার উত্তরগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত। ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজবার সাথে সাথেই শেহেরজাদ গল্প শেষ করতো। ঠিক ঐ সময়টিতেই হয়তো গল্প তার শীর্ষবিন্দু্তে পৌঁছেছে, কিন্তু শেহেরজাদের তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতো, কারণ বাড়ি পৌঁছেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। হাবারা তাকে দরজা খুলে দিতো, তারপর জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে শেহেরজাদের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকতো যতক্ষন পর্যন্ত না নীল গাড়িটি দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে যায়। এর পর হাবারার আবার নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ সময়ে শুরু হতো। নিজের খাবার তৈরী করা তার জন্য খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না, একসময় বাবুর্চি হিসেবে সে কাজ করেছে বলে বিষয়টি ভালোই জানতো। খাওয়া শেষ করে এক কাপ কফি বানিয়ে হয় ডি.ভি.ডি নয়তো বই পড়েই সে বাকি সময় কাটাতো। একটু জটিল বই পড়তে পছন্দ করতো, যে বইগুলো একবার পড়ে আত্মস্থ করা সম্ভব না, একের অধিক পাঠের দাবী রেখে যায়। এ ছাড়া তেমন কিছু তার করার ছিল না। কাউকে ফোনে যোগাযোগ করার ছিল না, বাড়িতে কম্পিউটার বা কোনো খবরের কাগজের সরবরাহও ছিল না। টেলিভিশন দেখতে পছন্দ করতো না হাবারা (অবশ্য তার একটা কারণও ছিল)। ঘরের বাইরে না বেরোবার নির্দেশ ছিল। কোনো কারণে যদি শেহেরজাদের আসা বন্ধ হয়ে যেতো, তাহলে এই একাকী অন্তরীণ জীবন অন্তহীন হতো বৈকি। হাবারা ভাবে, এমনটা ঘটলে সে কি এই মরুভূমি দ্বীপে আটকে থাকতো? নাকি, হাবারা নিজেই একটি মরুভূমি দ্বীপ! প্রকৃতপক্ষে, একাকী জীবন হাবারা বরাবরই ভালোবেসে এসেছে। শেহেরজাদের এই অতর্কিত প্রস্থান তাকে অপেক্ষা করতে শিখিয়েছে, আরও একটি দিনের জন্য, অসমাপ্ত এক গল্পের অধীর প্রতীক্ষার সমাপ্তিতে।

*****

“কোনো এক জন্মে আমি ল্যাম্প্রে ঈল হয়ে জন্মেছিলাম” – আদুরে অলস বিছানায় শুয়ে শেহেরজাদ একদিন বলেছিল। হাবারার জানা ছিল না “ল্যাম্প্রে ঈল” কোন প্রজাতির মাছ। সে কারণে কোনো উত্তর ছিল না তার।

“তুমি জানো, ল্যাম্প্রে ঈল ট্রাউট মাছ খেয়ে ফেলে ? এদের চোয়াল নেই, এখানেই এরা ঈল থেকে আলাদা”

“ঈলের চোয়াল থাকে?” হাবারার কণ্ঠে বিস্ময়।

“সে কী? তুমি কখনই লক্ষ্য করোনি? শেহেরজাদ তার থেকেও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

সেই প্রথম হাবারা জেনেছিল ল্যাম্প্রে ঈল আর ট্রাউট শিকারের গল্প।

“এদের চোয়াল বা দাঁত কোনোটাই নেই। জলের ওপর এরা আগাছার মতো ভেসে থাকে, সাঁতরে বেড়ায় এবং ট্রাউটের খোঁজে থাকে। যখনই কোনো ট্রাউট এদের পরিসীমার মধ্যে ধরা পড়ে, এরা এদের নিষ্কাশক দিয়ে টেনে নেয় মুখের মধ্যে এবং জড়িয়ে রাখে এই নিষ্কাশক দিয়ে। যতক্ষন পর্যন্ত ট্রাউটের পেটের মধ্যে একটা ছিদ্র না হয়, ততই জোরদার হয়ে ওঠে এই বাঁধন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত নিষ্পেষিত না হয়, কুরে কুরে মেরে ফেলতে থাকে“ শেহেরজাদ বলেছিল।

“কখনও আকুইরিয়ামে গিয়ে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবে, দেখতে পারবে।“

“আমি কখনোই ট্রাউট হতে চাই না” হাবারা বলেছিল শেহেরজাদকে।

হাবারা যেন অনেকটা স্বগোক্তির মতো বললো, “আমি ট্রাউট হতে পছন্দ করতাম না”

“রোমানরা ল্যাম্প্রে ঈলের চাষ করতো পুকুরে। বেয়াড়া ক্রীতদাসদের পুকুরে ছুড়ে ফেলা হতো এবং ল্যাম্প্রে ঈল ওদেরকে জীবন্ত খেয়ে ফেলতো।“শেহেরজাদের কথায় হাবারা ভাবছিল, “রোমান ক্রীতদাস হওয়াও সুখকর ছিল না।“

শেহেরজাদ বলেছিল, ক্লাস ট্রিপে একবার acqarium এ গিয়ে ল্যাম্প্রে ঈল সম্পর্কে সে জানতে পারে। তারপর ওদের জীবন চক্র পড়েই শেহেরজাদের মনে হয়, আগের জন্মে নিশ্চয়ই সে এই জীবনযাপন করেছিল। মনে পড়তো, জলের নীচে পাথরের টুকরো ঘিরে আগাছার মতো সে ঝুলে আছে আর অপেক্ষা ওপরে ভেসে যাওয়া একটা মোটাসোটা ট্রাউটের দিকে।

“তোমার কী মনে পড়ে তুমি ট্রাউট খেয়েছিলে ?” হাবারা জিজ্ঞেস করে শেহেরজাদকে।

ছোট্ট করে শেহেরজাদ উত্তর দেয়, “না, তা মনে পড়ছে না”

“যাক, বাঁচা গেল। কিন্তু, তোমার শুধু এতটুকুই মনে পড়ে? ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছ নদী বা পুকুরে? “

“পূর্বজন্মের কথা কিন্তু এতটুকুই মনে পড়ে। অনেকটা এরকম যে তুমি এক বিশাল এক দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ আর তাতে রয়েছে ছোট্ট এক ছিদ্র। তুমি তাতে চোখ রেখেছ। তোমার সামনে ঝলসে উঠেছে এক আলোর সমুদ্র। তুমি নিজেকে আবিষ্কার করেছ অন্য এক পৃথিবীতে। তোমার কখনও এমনটা হয়নি? “

শেহেরজাদের প্রশ্নের উত্তরে হাবারা বলেছিল, কখনোই তার এরকম মনে হয়নি। বস্তুতপক্ষে তার দুহাতে পাতায় বর্তমানের ভিড় এতটাই যে, পূর্বজন্মের অস্তিত্ব সে একেবারেই অনুভব করেনা।

“জানো, লেকে জলের ভেতরটা খুব অলীক এবং পরাবাস্তব। ছোট বড় নানারকম পাথরের গা ঘেষে আমি ভেসে যেতাম আর লক্ষ্য করতাম বড় বড় মাছ আমায় পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। একবার একটা কালো বিশালাকার কচ্ছপকে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল, ‘স্টার ওয়ার’ এ শ্ত্রুপক্ষের একটা জাহাজ ঢুকে পড়েছে কোনো অশুভ উদ্দেশ্যে।

“তুমি এখনও ওসব দেখতে পাও” হাবারার কণ্ঠে বিস্ময়।

“একদম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার” – শেহেরজাদের কণ্ঠে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস ছিল।

হাবারা জানতে চেয়েছিল, ল্যাম্প্রে ঈলের চিন্তাধারা কেমন?

“ল্যাম্প্রেদের ভাবনা ওদের মতো। জলের পৃথিবীতে ওদের বসবাস। যেমন ধরো, আমরা যখন মায়ের গর্ভে থাকি, আমরা কিন্তু আমাদের মতো করে ভাবি, কিন্তু আমরা প্রকাশ করতে পারি না।

শেহেরজাদের হেঁয়ালিতে হাবারা ক্রমশঃই খেই হারিয়ে ফেলছিলো, “তার মানে তোমার সেটিও মনে পড়ে?

“নিশ্চয়ই, কোনো একদিন আমি তোমাকে সেই গল্পও শোনাবো।

সেদিন শেহেরজাদ চলে যাবার পর হাবারা তার ডায়েরীতে ছোট্ট করে লিখে রেখেছিল, “শেহেরজাদ, ল্যাম্প্রে, পূর্বজন্ম” । অসাবধানে এই ডায়েরী যদি কেউ পড়েও ফেলে, তারা কিছু বুঝতেই পারবে না। এ বিষয়ে অনেকটাই নিঃসন্দিহান ছিল সে।

হাবারার সাথে শেহেরজাদের পরিচয় চার মাস আগে। টোকিওর উত্তরে একটি প্রাদেশিক শহর থেকে হাবারা সরাসরি এই বাড়িতে আসে “Support Liaison” হিসেবে। শর্ত ছিল, হাবারা বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না। শেহেরজাদ হাবারার যা কিছু দরকার নিয়ে আসবে। সে যখন আসতো, তখন কিছু বই, পত্রিকা, সিডি, যা কিছু হাবারার পছন্দ সেগুলোও নিয়ে আসতো।

*****

শেহেরজাদ এবং হাবারার যৌন সম্পর্ক হয়তো বাধ্যতামূলক ছিল না কিন্তু তারা মন প্রাণ উজাড় করে এই মুহূর্তগুলো  উপভোগ করতো এটাও বলা যায় না। শেহেরজাদ সতর্ক থাকতো অতন্দ্র প্রহরীর মতো, যেন সে একজন সুচারু প্রশিক্ষক, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র তার কাছেই থাকা উচিত। কেননা, ছাত্রের অতিরিক্ত উত্তেজনা বিপত্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে, হাবারা হলফ করে বলতে পারে, মিলনোম্মুখ শেহেরজাদকে সে আনন্দ দিতে পেরেছিল। হাবারা আবেগ বিবর্জিত একজন মানুষ নয়, কিংবা খাঁচায় বন্দী এক হিংস্র পশুও নয়, যে যৌনতাকে শুধুমাত্রই শারীরিক চাহিদার জন্য ব্যবহার করবে। খুব সম্ভবত: শেহেরজাদ যৌনতাকে তার অন্যান্য প্রাত্যহিক দায়িত্বের একটিই ধরে নিয়েছিল, এবং ওর ব্যক্তিগত সীমারেখায় তার কতটুকু প্রভাব ফেলেছিল, তা হাবারার অজানা।

আরও কিছু কিছু বিষয়েও হাবারার একই পর্যবেক্ষণ ছিল। শেহেরজাদের অনুভূতি এবং আবেগ বরাবরই অধরা ছিল। ত্রিশোর্ধ্ব রমনীদের মতোই ছিল তার বেশবাস। যদিও এ ব্যাপারে হাবারার অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। অবশ্য, মাঝে মাঝে শেহেরজাদ যে রঙিন, জাঁকজমক সিল্ক পরে আসতো না, তা নয়। কিন্তু, এই অনিয়মিত পরিবর্তনের কী হেতু হতে পারে, তা অস্পষ্ট। সঙ্গম এবং শেহেরজাদের গল্প এই দুটোর সম্পৃক্ততা এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, যে প্রবল সঙ্গম সুখের পর গল্পবলা আগে শুরু হয়েছিল, না গল্পের পর পরই এই দ্বৈরথের শুরু— এই ধাঁধা হাবারাকে বিভ্রান্ত করে তুলতো,।

হাবারার পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে এক অলস সময়ে শেহেরজাদ শুনিয়েছিল অভিনব এক গল্প। এক সময় এক অদ্ভুত নেশায় পেয়েছিল তাকে। যখন কোনো বাড়ির বাসিন্দারা বেরিয়ে যেত,

সে ঢুকে পড়তো অচেনা সেই বাড়িতে ।

“নিস্তব্ধতা আমাকে খুব টানতো। মনে হতো, পৃথিবীর এক শুদ্ধ শান্তির সাক্ষী হয়েছি আমি। যখন আমি মেঝের ওপর স্থির হয়ে বসতাম ঠিক তখনই মনে পড়ে যেত পূর্বজীবনের ল্যাম্প্রে ঈল এর স্মৃতি। মনে হতো, আমি যেন অতলান্ত জলের গভীরে একখণ্ড পাথরকে আঁকড়ে ধরে চুপটি করে বসে আছি। রং বেরঙের জলজ আগাছারা আমার চারপাশ ঘিরে রয়েছে আর ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব সব মাছ। একটি আলো ঝলমলে দিনে , সূর্যের কিরণ তীরের মতো বিঁধেছে জলের শরীর। আমার মন চিন্তামুক্ত, ভাবনাহীন। শুধুমাত্র ল্যাম্প্রে ঈল আমায় কিছুটা ধোঁয়াশা করেছে কিন্তু এ ছাড়া আর সব আদি ও অকৃত্তিম। সে এক অনাবিল অনুভব।

শেহেরজাদ প্রথম যেবার অবৈধভাবে প্রবেশ করেছিল একটি বাড়িতে, তখন সে জুনিয়র হাই তে পড়ে। তখন তার দুরন্ত কৈশোর। একটি ছেলেকে ভালোবেসেছিল ভীষণরকম। সুদর্শন বলতে যা বোঝায়, ছেলেটি তা ছিল না। নির্মেদ দীর্ঘদেহী সেই ছেলেটি ফুটবল খেলতো। কিন্তু সে ভালোবাসতো অন্য একটি মেয়েকে। এত তীব্র সেই ভালোবাসা যে, শেহেরজাদের সেখানে কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এতটাই প্রকট ছিল এই খারাপ লাগা, মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হয়ে যেত, এতটাই কষ্ট পেতো, মনে হতো যে কোনো মুহূর্তে বমি হয়ে যাবে। কিন্তু, এই ভালোবাসা যে স্বীকৃতি পাওয়ার নয়, তা সে খুব ভালোভাবেই ততদিনে বুঝে গিয়েছিল। উন্মাদের মতোই সে একটা কিছু করতে চেয়েছিল।

 

একদিন শেহেরজাদ স্কুল পালিয়ে সেই ছেলের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। সে ওদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিল তার আগেই, ওর মা একটা স্কুলে জাপানিজ ভাষা শেখায়, বাবা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত, এবং বোন হাই স্কুল জুনিয়র। তার মানে, ওদের বাড়িটি প্রায় সারাদিনই  শূন্য থাকে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িটির সামনের দরজা তালাবন্ধ ছিল। মাদুরের নিচে চাবি খুঁজছিল শেহেরজাদ, এবং পেয়েও গিয়েছিল। এরকম একটা শান্ত ও নিরাপদ লোকালয়ে প্রায় সবাই বেরোনোর আগে মাদুরের নিচে চাবি রেখেই যায়। তবুও সাবধানি শেহেরজাদ ডোর বেল বাজিয়েছিল নিশ্চিত হবার জন্য, যে বাড়িটি আসলেই জনমানব শূন্য।  সামনের রাস্তায় কেউ ওকে লক্ষ্য করছে কিনা সেটা দেখে নিয়ে ঝটপট তালা খুলে ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে। ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে, একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে নিজের জুতোজোড়া ঢুকিয়ে নিয়ে, পা টিপে টিপে দোতলায় ছেলেটির শোবার ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল।

 

 

বিছানাটি পরিপাটি করে গোছানো। বইয়ের তাকের ওপর একটা ছোট্ট স্টেরিও, পাশে কিছু সি ডি। দেয়ালে বার্সিলোনা ফুটবল দলের একটি ছবি, এবং ব্যানার। অন্য কোনো ছবি বা পোষ্টার নেই। ঘিয়ে রঙা একটি দেয়াল, জানালায় সাদা পর্দা। ছিমছাম ঘর, যেখানে যে জিনিস থাকা উচিত তার কোনো অন্যথা নেই, কোনো বই বা কাপড় এদিকে সেদিকে বা মেঝের ওপর পড়ে নেই। এই বাড়ির বাসিন্দারা যে সুক্ষ্মচিন্তার অধিকারী তার প্রতিফলন ফুটে উঠেছে প্রতিটি কোণে। একটু অগোছাল হলেই নজরে পড়ে যাবে কারো না কারো। এই ভেবে শেহেরজাদ একটু শংকিত হয়ে পড়ল আবার একই সাথে ঘরের পারিপাট্য এবং সারল্য তাকে অভিভূত করল — কেন না ছেলেটিও এমনটাই, পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।

 

শেহেরজাদ কিছুক্ষণের জন্য ডেস্কের চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। প্রতিদিন, ও এই চেয়ারে বসে পড়ালেখা করে ভাবতেই মন কেমন চনমন করে উঠল। পেন্সিল, ইরেজার, স্টেপলার, রুলার, কাঁচি  এক এক করে সব হাতে তুলে বুক ভরে গন্ধ নিল, ঠোঁটে ছোঁয়ালো। শুধুমাত্র ওর বলেই, এই সব জাগতিক জিনিসগুলোকে  কী ভীষণ উজ্জ্বল মনে হয়েছিল সেদিন। ডেস্কের ড্রয়ার দুটো ভাগ ভাগ করা এবং একটা করে ট্রে দু’ভাগেই পাতা আছে। ওতে ছোটখাটো বিভিন্ন রকমের জিনিস আর সুভ্যেনির রাখা আছে। দ্বিতীয় ড্রয়ারে ক্লাসের খাতা , তৃতীয় ড্রয়ারে পুরোনো কাগজপত্র, পরীক্ষার খাতায় ঠাসা। শেহেরজাদ আসলে ব্যক্তিগত কিছু খুঁজছিলো, যেমন ডায়েরি অথবা চিঠি। কিন্তু এসব তো ছিলই না, একটা ছবি পর্যন্তও পায়নি। সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে ফুটবল অথবা স্কুলের সাথে জড়িত। এ ছাড়া কি অন্য কোনো জীবন নেই ওর? নাকি খুব সন্তর্পনে লুকিয়ে রাখা আছে ওসব , যাতে করে সহজে কেউ তার খোঁজ না পায় ! হাতের লেখার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে এক অশান্তিতে ছেয়ে  গেল শেহেরজাদের মন। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঝের ওপর শান্ত হয়ে বসে ওপরে ছাতের দিকে তাকালো। এক অনন্ত নি:স্তব্ধতা তাকে পরম শান্তি দিয়েছিল। সে আবার ফিরে গিয়েছিল ল্যাম্প্রেদের জগতে।

 

তার মানে, “তুমি ওর ঘরে ঢুকে ওর মেঝেতে বসে পড়েছিলে, এইটুকুই তো? ” বিস্ময়াভূত হাবারা প্রশ্ন করেছিল শেহেরজাদকে।

 

“না, শুধু তাই কি ? না আরো আছে। আমি ওর ব্যবহার্য জিনিস, যা প্রতিদিন ওর শরীরের খুব কাছাকাছি থাকে এমন একটা কিছু নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।  একটা পেন্সিল চুরি করেছিলাম ওর ডেস্ক থেকে, যা সম্ভবত ও প্রতিদিন ব্যবহার করে। আসলে সেদিন আমি ‘প্রেম চোর’ হয়েছিলাম। এই আর কী !”

হাবরার মনে হলো, ‘প্রেম চোর’ যেন কোনো এক নির্বাক ছবির নাম।

 

“এরপর, আমার চিহ্ন হিসেবে কিছু একটা রেখে আসতে চেয়েছিলাম, যা আমার উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে থাকবে, প্রমান করবে যে এখানে এক বিনিময় সংঘটিত হয়েছিল, নিছক চুরি নয়। কিন্তু, বুঝতে পারছিলাম না কী রেখে আসব। আমার ব্যাকপ্যাক ঘাঁটলাম, পকেট হাতড়ালাম কিন্তু যথাযথ কিছুই খুঁজে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, আমার একটা ট্যাম্পন রেখে আসবো। অবশ্যই অব্যবহৃত এবং একটা প্লাস্টিকে মোড়ানো।  নিচের ড্রয়ারে একদম পেছনের দিকে ওটা গুছিয়ে রাখলাম। এতটাই নিজস্ব একটা কিছু ওর এখানে রেখে গেলাম, এটা ভাবতেই এক ধরণের শিহরন জেগেছিল। ”

 

হাবারা ভাবছিল, “পেন্সিলের বিনিময়ে ট্যাম্পন!” তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আজ ডায়েরিতে কী লিখে রাখবে? “প্রেমচোর , পেন্সিল, ট্যাম্পন? যদি কখনো এই ডায়েরি পড়ে, তাহলে তারা এই তিনটে শব্দ থেকে কী বুঝবে ? ”

 

“ওর বাড়িতে আমি পনেরো মিনিটের মতো ছিলাম। এর চেয়ে বেশি সময় আমার পক্ষে থাকা সম্ভব ছিল না। কোনো বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঢূকবার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। সেজন্য একটু ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে কেউ একজন ফিরে আসবে। তাই, বের হয়ে নিশ্চিত হয়েই স্কুলের পথে রওনা দিয়েছিলাম, সাথে ছিল ওর সেই মূল্যবান পেন্সিল।“

 

গল্প গল্প করতে শেহেরজাদ ফিরে গিয়েছিল সেই দিনগুলিতে, যেন দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছে সব যা ঘটেছিল সেইদিন।

 

“ওই সপ্তাহটা আমার জীবনের সবচাইতে সুখের ছিল,” দীর্ঘ বিরতীর পর শেহেরজাদ বলেছিল। “আমার নোটবুকে ওর পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতাম, চুমু খেতাম, আমার গালে চেপে ধরে বসে থাকতাম। লিখতে লিখতে ধীরে ধীরে পেন্সিলটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম, যখন আর একটু ছোট হয়ে যাবে, তখন আর একবার ওর বাড়িতে যাবো। পেন্সিল হোল্ডারে অনেকগুলো পেন্সিল ছিল, যদি আর একটা নিয়ে আসি, বুঝতেই পারবে না। আমার ট্যাম্পনটা, যে খুব যত্ন করে ওর ড্রয়ারে গুছিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, নিশ্চয়ই এখনও নজরে পড়েনি। দারুণ লাগতো ভাবতে, যে আমার উপস্থিতি কখনও অনুভব করেনি, তারই জীবনের এক অংশকে আমার সঙ্গে রেখে চলেছি দিন রাত।

 

ঠিক দশদিন বাদে শেহেরজাদ আবার ফিরে যায় সেই বাড়িতে। সময় সকাল এগারোটা। আগের দিনের মতোই মাদুরের নিচ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে সরাসরি ওর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। ঘরটা আগের মতই ঝকঝকে পরিষ্কার, সবকিছুই নিয়মমাফিক সাজানো গোছানো। প্রথমেই, সে একটা পেন্সিল নিয়ে ব্যাকপ্যাকে রেখে দেয়। তারপর দু’হাত জড়ো করে খুব আরামে ওর বিছানায় শুয়ে থাকে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, এই বিছানাতেই প্রতি রাতে ছেলেটি ঘুমায়। একসময় মনে হয়েছিল, ওর শ্বাস প্রশ্বাস খুব দ্রুত হয়ে আসছে, নিজের হ্রদস্পন্দন যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে এবং ফুসফুসে পর্যাপ্ত হাওয়া ঢুকতে পারছে না, হাড়ের মতো শক্ত হয়ে আসছে। ঝট করে উঠে পড়েছিল বিছানা থেকে। প্রথম দিনের মতো মেঝেতে সোজা হয়ে বসে তাকিয়ে ছিল সিলিং এর দিকে, আর ভাবছিল এখনও ওর বিছানায় শোবার জন্য তৈরী হয়ে ওঠেনি মন।

 

এবার শেহেরজাদ আধঘণ্টা থেকেছিল বাড়িটিতে। একটা নোটবুক বের করে সোসেকি নাটসুমের লেখা “কোকোরো” উপন্যাসের বুক রিভিউ পড়ছিলো। গ্রীষ্মকালীন পাঠ হিসেবে ক্লাসের সবাইকে বইটি পড়তে দেয়া হয়েছিল। সেহেরজাদকে গোটা গোটা হরফে ছবির মতো হাতের লেখা মুগ্ধ করেছিল। সে ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্রছাত্রীদের অন্যতম।

 

চেস্ট অব ড্রয়ারে থরে থরে সাজানো মোজা, টি শার্ট, ফুটবল জার্সি,প্যান্ট—সব সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা। ওর মা’ প্রতিদিন হয়তো ওর জন্যে এই কাজগুলো করে দেয়, এই ভেবে একটু হিংসেও হয়েছিল। শেহেরজাদ একটু ঝুঁকে ড্রয়ারের কাপড়গুলো থেকে ওর গায়ের গন্ধ নেয়। একটা ছাই রঙা টি শার্ট বের করে বারবার গভীরভাবে শ্বাস নেয়। কাপড়্গুলো সদ্য ধোঁয়া বলে লন্ড্রি ডিটারজেন্টের গন্ধ ছাড়া আর কিছ পায়নি। ট্যাম্পনটা ঠিক যেখানে রেখে গিয়েছিল, সেখানেই ছিলো। ভাবছিল, ট্যাম্পনটা ওর মায়ের নজরে এলে ওর মা কী মনে করতে পারে? ওর কাছে কী জানতে চাইবে, এটা কার? কিংবা এটা কোত্থেকে এল, ডেস্কের ড্রয়ারেই বা কেন? না কী, এই গূঢ রহস্যের কিছুই জানতে চাইবে না। এসব ভেবেছিল বটে, কিন্তু ট্যাম্পনটা ওখান থেকে সরিয়ে নেয়নি শেষমেশ। কেন না, একমাত্র চিহ্ন হিসেবেই ট্যাম্পনটাই রেখে আসতে হয়েছিল।

শেহেরজাদ তার দ্বিতীয় সফরকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য সেবার রেখে গিয়েছিল তিনটে চুলের গোছা। আগের দিন রাতে সে এগুলোকে প্লাস্টিকের মোড়কে পুরে এনভেলপে ভরে নিয়ে এসেছিল সেদিন। অঙ্ক বইয়ের মধ্যে এনভেলপটা রেখে ভাবছিল, কেউ বুঝতেও পারবে না এগুলো কার। যদি ডি.এন. এ টেস্ট করা হয়, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। তবে,এটা যে কোনো মেয়ের তা বোঝা যাচ্ছে, কারণ চুলগুলো ছিল রেশমি কালো, খুব একটা বড়ও নয়, ছোটও নয়।

 

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে স্কুলে দুপুরের ক্লাসগুলোতে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে শেহেরজাদের মনে হতে থাকে, ছেলেটিকে সে অনেকটুকুই কাছে পেয়েছে। হতে পারে, শেহেরজাদ দশদিনের মধ্যে আবার ফিরে গিয়েছিল বা যায়নি, কিন্তু এটা যে একটা নেশার মতো, সে নিজেই তা স্বীকার করেছিল।

 

গল্পটা যখনই শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে, তখনই ঘড়িতে বিকেল চারটে বত্রিশ। শেহেরজাদের যাবার সময়। তড়িঘড়ি করে চুল আঁচড়ে, একে একে কাপড় পরে নীলরঙা গাড়িতে করে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।

 

হাবারাকে একাকীত্বে ভাসিয়ে দিয়ে শেহেরজাদ চলে যাবার পর, হাবারা ভাবছিল এই গল্পের শেষ কীভাবে হয়েছিল। আর একটু একটু করে গল্পের প্রতিটি দৃশ্য কল্পনা করছিল। শেহেরজাদকে হাইস্কুলের ছাত্রী ভাবতে কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিল হাবারার। স্কুলের পোশাকে, সাদা মোজায় দু’বেনী করা শেহেরজাদকে কেমন লাগতো?

 

তেমন একটা ক্ষুধার্ত ছিল না হাবারা। তবুও রাতের খাবারের পাট চুকিয়ে বই পড়তে শুরু করল। কিন্তু, কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারল না। লুকিয়ে লুকিয়ে শেহেরজাদ ওর সহপাঠীর বাড়িতে ঢুকছে, তার ব্যবহৃত পোশাকে মুখ ডুবিয়ে নি:শ্বাস নিচ্ছে… আচ্ছন্ন করে রাখছিলো হাবারাকে। মন জুড়ে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে, তারপর কী হয়েছিল?

 

উইক এন্ড শেষে তিনদিন পর শেহেরজাদ ফিরে যায় আবার সেই বাড়িতে। এবার বড় একটা পেপার ব্যাগে প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল। ফ্রিজের এক্সপায়ার্ড খাবারগুলো, যা বোতলে এবং ক্যানে ছিল সব ফেলে দিয়ে নতুন খাবার রেখে আসে। রান্নাঘরের আলমারিতে যে খাবারগুলো শেষ হয়ে এসেছিল, সেগুলোর একটা তালিকা তৈরী করে। নতুন বই এবং কিছু ডিভিডিও ডেস্কে রেখে আসে।

 

“আরো কিছু জানতে চেয়েছিলে কি?” শেহেরজাদ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় হাবারাকে।

 

“নাহ, তেমন আর কিছু এই মুহূর্তে ভাবতে পারছি না” — হাবারা ছোট্ট করে জবাব দেয়।

 

এরপর প্রতিবারের মতোই পরিচিত ভঙ্গিতে তারা দুজন বিছানায় যায়, এবং সঙ্গমে আবদ্ধ হয়। সঙ্গম শেষে শুরু হয় পরবর্তী গল্প।

 

*****

 

শেহেরজাদ যতবার সেই বাড়ি থেকে ফিরে আসতো, আগামী দশদিন সে আনন্দ এবং ফুর্তিতে ভরপুর থাকতো। ক্লাসে মন বসতো না কিছুতেই। প্রায়ই সে পেন্সিল কেস থেকে সে ছেলেটির ফুটবল ব্যাজ বের করে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করতো, পেন্সিলের নিব ঠুকরে ঠুকরে ভেঙে ফেলতো। সারাক্ষণই সে একটা ঘোরের মধ্যে বিরাজ করতো। যেন সে সেই ঘরটার মধ্যেই ঘুরছে ফিরছে, ওর পোশাক হাতড়াচ্ছে, ড্রয়ারের জিনিসপত্র ঘাঁটছে।

 

স্কুলের পড়ালেখার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। বাড়ি ফিরে হোম ওয়ার্ক করার মতো যথেষ্ট মনোযোগ ছিল না, ধীরে ধীরে পরীক্ষায় খারাপ করতে শুরু করলো। ক্লাস টিচার যখন তাকে প্রশ্ন করল, কোনো সদুত্তর দিতে সক্ষম হয়নি। শুধু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেছিল, যার কোনো অর্থই হয় না। শেহেরজাদের এই অধ্যায়টি এতই গোপন এবং অন্ধকারাছন্ন ছিল যে, তার সম্পূর্ণ ভার শুধু তাকেই বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়েছিল।

 

“এর পরও আমি আবার সেই বাড়িতে ফিরে ফিরে গিয়েছি। আমার কোনো উপায় ছিল না। এক অদৃশ্য অমোঘ শক্তি আমাকে যেন টেনে নিয়ে যেতো। সবসময় মনে হতো, আমি একদিন ধরা পড়ে যাবো, পুলিশ ডাকা হবে…তারপরও এক চৌম্বকীয় আকর্ষণ অনুভব করতাম। আমার বাবা মার নিজস্ব ব্যবসা ছিল, এবং ব্যস্ততার জন্য আমার দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া সম্ভব ছিল না। অন্যদের নোটস নকল করতাম, কখনও কখনও মিথ্যে অজুহাত দিতাম। বলতাম, অসুস্থ ছিলাম বলে আমাকে অর্ধেক দিনই হাসপাতালে থাকতে হয়েছে।”

 

শেহেরজাদ গল্প করতে করতে চট করে সময় দেখে নিলো ঘড়িতে। “তৃতীয়বার যখন একদিন আমি ওই বাড়িতে , মনে হলো সেদিন ফ্রিজের শব্দ যেন প্রতিদিনের তুলনায় অনেক বেশি। হঠাৎ একটা ফোন এসেছিল, রিং এর আওয়াজ ছিল অসম্ভব তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ। আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম, যে ঘামে আমার শরীর ভিজে গিয়েছিল। অবশ্যই কেউ ছিলনা উত্তর দেয়ার। দশবার রিং হবার পর থেমে যায়। তারপর মনে হলো, আমি যেন এক স্থবির, পিনপতন নিস্তব্ধতায় ক্রমশঃ তলিয়ে যাচ্ছি।”

 

শেহেরজাদ সেদিন দীর্ঘ সময় চুপচাপ বিছানায় শুয়েছিল। তার মন ছিল শান্ত, সৌম্য। তার হৃদস্পন্দনে কোনো ছন্দপতন ছিল না। মনে হচ্ছিল, তার পাশেই শুয়ে আছে সেই ছেলেটি। পাশ ফিরলেই তার পেশিবহুল বাহু ছুঁয়ে দেয়া যেতে পারে। যেন, পাশে শুয়ে শেহেরজাদকে সে দেখছে নিশ্চুপ নীরব দৃষ্টিতে। এক অতলান্ত ধোঁয়াশা…স্বপ্ন এবং বাস্তবের মধ্যে দূরত্ব ছিল অসীম।

এক অদম্য ইচ্ছের তোড়ে শেহেরজাদ বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে চেস্ট অফ ড্রয়ার খুলে আবারও ওর পোশাক আশাকে নাক ডুবিয়ে বসে থাকল। কিন্তু, সবগুলোই সদ্য ধোয়া। দৌড়ে নিচতলার লন্ড্রিরুমে যেখানে নোংরা কাপড় রাখা হয় সেখানে গেল। অন্যান্যদের কাপড়ের মধ্যে থেকে ক্রুকাট একটা টি শার্ট বের করে নাকে চেপে ধরল। আহা, এর সন্ধানেই সে এতদিন ছিল। পুরুষালি কাঙ্খিত সুঘ্রাণ তাকে আচ্ছন্ন করলো। কামও জেগেছিল। কিন্তু এখানে এভাবে নয়, এই ভেবে সে থেমে গিয়েছিল। শেহেরজাদ মনে মনে ঠিক করল, আজ শার্টটা নিয়ে যাবে। আবার এও মনে হলো, নিশ্চয়ই ওর মা এই শার্টের খোঁজে পুরো বাড়ি তছনছ করবে, এবং ছেলের ঘরে গিয়েই হাজির হবে। এরপর এটা সেটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে শেহরজাদের জিনিসগুলোও বের করে ফেলবে। এই সব মনে করে, শার্টের পরিকল্পনা বাতিল করলো। ভাবলো, ওর অন্তর্বাসটাই আজ না হয় রেখে যাবে। কিন্তু, শেষমেষ সে পরিকল্পনাও খারিজ করে দিলো।

 

শেহেরজাদ এখানেই এই গল্পটির ইতি টেনেছিল। এরপর চোখ বুঁজে চুপচাপ শুয়ে ছিল অনেকক্ষণ। হাবারার মনে হচ্ছিল, এর পরেও হয়তো কিছু বলার আছে। কিন্তু, শেহেরজাদ খুব আদুরে কণ্ঠে হাবারাকে আরও একবার আমন্ত্রণ জানালো দ্বৈরথে সাথী হওয়ার জন্য। এবারে, শেহেরজাদ ছিল ভয়ংকর হিংস্র, কাঁপছিল আসঙ্গলিপ্সার জোয়ারে। হাবারার মনে হচ্ছিল, সতেরো বছরের এক অতৃপ্ত কিশোরী যেন আটকে আছে পঁয়ত্রিশ বছরের একটি সাধারণ নারীঅঙ্গে। শেহেরজাদের তৃপ্ত মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছিল, সেই কিশোরের ঘর্মাক্ত টিশার্টে সে নাক ডুবিয়েছে পরম সুখে। আনন্দে স্ফূরিত এক দোলায় সে ভেসে বেড়াচ্ছে দূর অজানায়।

এই প্রথমবারের মতো, সঙ্গমের পর কোনো গল্প হলো না। শেহেরজাদ এবং হাবারা পাশাপাশি শুয়ে থাকল অনেকটা সময়। শেহেরজাদ তাকিয়ে ছিল সিলিং এর দিকে। মনে হলো, সে আবার ফিরে গেছে ল্যাম্প্রে জন্মে। ভেসে বেড়াচ্ছে জলের স্রোতে আর ঠিক ওপরেই রয়েছে আলোর উৎস। হাবারার তখুনি খুব অভাববোধ হলো। অনুভব করলো, এমন এক পূর্বজন্ম তার থাকলে সেও তার ইচ্ছেমতো সময়ের ডানায় ভর করে ঘুরে বেড়াতে পারতো। মুক্ত হতে পারতো, নোবুকা হাবারা নামের একজন সামান্য মানুষের জীবন থেকে। সে এবং শেহেরজাদ ল্যাম্প্রে ঈলের মতো সাঁতার কাটছে, পাশাপাশি রং বেরঙের মাছ ভাসছে তাদের চারপাশে, বাধা পড়ছে নাম না জানা আগাছার জালে।

একসময় নিস্তব্ধতা ভেঙে হাবারা প্রশ্ন করল, “সেদিন শার্ট এর বদলে কী নিয়ে এসেছিলে?

 

শেহেরজাদ বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো, “এই প্রথমবারের মতো আমি কিছু রেখে আসিনি। শুধু নিয়েই পালিয়েছিলাম । সেদিন আমি একজন চোরে পরিণত হয়েছিলাম।”

 

আবারও শেহেরজাদ ফিরে যায় ওই বাড়িতে। ততদিনে, বাড়িতে নতুন তালা লাগানো হয়েছে। সোনালি রঙের তালাটি যেন এবার মেরুদণ্ড সোজা করে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাদুরের নিচে কোনো চাবিও লুকোনো ছিল না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, শার্টটি হারানোর পর ওর মা বুঝতে পেরেছে, বাড়িতে অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে। তাঁর সন্দেহ ছিল নির্ভুল এবং ক্ষিপ্র গতিতে এর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

শেহেরজাদ এহেন পরিবর্তনে খুশি যে হয়নি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, তার মনে হয়েছিল এভাবে অব্যাহতি পেয়ে হয়ে ভারমুক্তই হলো সে । মনে হচ্ছিল, কোনো সুহৃদ পেছন থেকে এগিয়ে এসে তার কাঁধ থেকে একটা বিশাল বোঝা নামিয়ে নিয়েছে। যদি এই আমূল পরিবর্তন না হতো, এই বাড়ি তাকে বারবার টেনে নিয়ে যেতো এবং কিছুতেই এই নেশা থেকে সে মুক্ত হতো পারতো না । যতবার ফিরে গেছে, ততবারই সে একটু একটু করে চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছিলো। হয়তো কোনো একদিন সে ধরা পড়ে যেতো দোতলার সেই ঘরে। ব্যাখ্যা দেবার মতো তার কাছে তো কিছুই ছিল না। ইচ্ছে করছিলো, ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ নজরধারী এই মহিলার একটা ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য ছিল।

 

শেহেরজাদের মানসিক অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। ক্লাসে মনোযোগী হয়ে উঠল সে । কিন্তু, শেহেরজাদের চোরা দৃষ্টির কবল থেকে তার সহপাঠী এর পরও রেহাই পায়নি। শেহেরজাদ বুঝতে চেষ্টা করছিল, বাড়ির এই পরিবর্তন ছেলেটিকে বিচলিত করেছে কিনা। কিন্তু, সে ছিল ঠিক আগের মতোই। ওরকমই উদ্দাত্ত কণ্ঠে অট্টহাসি, ফুটবল খেলার সময় উল্লসিত চিৎকার সবই ছিল অপরিবর্তিত। কোনো কিছুই ছেলেটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরাবরের মতোই আত্মবিশ্বাস এবং সচেতন এক তরুণ।

 

একটা আলোআঁধারি ছায়া শেহেরজাদের সাথে লুকোচুরি খেলতো মাঝে মাঝে। যখন সে তৃতীয়বার ওর ঘরে গিয়ে ড্রয়ারের জিনিপত্র ঘাঁটছিল, তখন খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখা কিছু পর্নোগ্রাফি ম্যাগাজিন পেয়েছিলো। খুব মন দিয়ে সেও পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে সব ছবিগুলো দেখেছিল। হয়তো, এই বয়সি ছেলেদের জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক।

 

“যখন ওই বাড়িতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, আমি আস্তে আস্তে ওর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেললাম। যেন এক পাহাড় সমান জোয়ার ঢালু পথে ভাটার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে। ওর পেন্সিল, টিশার্ট, ফুটবল ব্যাজ আমাকে আর উত্তেজিত করে তুলতো না। মনে হতো, আমার জ্বর ভালো হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় সবারই কখনো না কখনো এমন হয়।

 

তোমার হয়েছে এমন কোনো সময় ? ”

 

হাবারা অনেক চেষ্টা করেও এমন তীব্র কোনো অতীত ঘটনা মনে করতে পারলো না।

 

মনে হলো, তার উত্তর শেহেরজাদ খুব একটা পছন্দ করতে পারেনি।

 

“যাই হোক, আমি ওকে প্রায় ভুলে গেছি এবং খুব সহজে ও খুব শিগগির। মাঝে মাঝে ভাবি, কী এমন ছিল ছেলেটার মধ্যে যার জন্য আমি এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সতের বছরের মনে তখন এত ঝড় বয়ে গিয়েছিল কেন ? জীবন সত্যি খুব বিচিত্র। আমরা কোনো মুহূর্তে হয়তো কোনো কিছুর জন্য মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছি। আবার দীর্ঘ বিরতির পর হয়তো ওর ওপর থেকেই সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছি। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছে আমূলভাবে। যাকে নিজের করে নেয়ার জন্য একসময় মরিয়া হয়েছিলাম , তার মাহাত্ম ধীরে ধীরে ম্লানও হয়ে যেতে পারে।এই ছিল আমার গল্প। ”

 

শেহেরজাদের কথা শুনে হাবারার মনে হলো, অনেকটা ঠিক “পিকাসোর নীল অধ্যায়” এর মতোই শোনালো।

 

“সত্যি বলি তোমাকে, গল্পটা কিন্তু শেষ হবার পরেও শেষ হয়নি। আমি যখন আমার নার্সিং এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন এক অদ্ভুত ঘটনা আমাদের আর একবার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এতটাই ভুতুড়ে যে একে ভূতের গল্পও বলতে পারো। অবিশ্বাস্য এক বাঁকবদলের কাহিনী। শুনবে ?

 

হাবারা সম্মতি জানালো। কিন্তু, তখন প্রায় শেহেরজাদের যাবার সময় হয়ে এসেছে। পাশ ফিরে বিছানা থেকে উঠে পড়লো। বললো “এর পরেরবার যখন আসবো, তখন শোনাবো। আজ বাড়ি যাই। রাতের খাবার তৈরী করতে হবে।

হাবারা শেহেরজাদের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গী মন দিয়ে লক্ষ্য করলো। খুব ইচ্ছে করছিল, আজ আর একটু থাকুক শেহেরজাদ। গল্পের শেষটুকু শোনার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু, অতি আগ্রহে এই অমূল্য সম্ভাবনাকে মাটি করে দিতে চাইলো না।

 

হাবারা সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ঘুমোতে গেল। যতক্ষণ না ঘুম এলো দুচোখের পাতায়, মন জুড়ে রইল শেহেরজাদ। হতে পারে আজই হয়তো শেহেরজাদের সাথে শেষ দেখা। এক অজানা আশংকায় দোলায়মান হাবারার মন। তাদের সম্পর্কের কোনো শর্ত ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত বোঝাপড়া কিন্তু এক অদৃশ্য সরু সুতোয় যেন বাঁধা ছিল ওরা। ছিল না কোনো আড়াল। যে কোনোদিনই এটা ঘটার কথা ছিল, এটা হাবারা জানতোই, শুধু জানতো না, কখন ?

 

হয়তো জীবনে কোনো একসময় হাবারা সম্পূর্ণভাবে ওর স্বাধীনতা হারাবে। হয়তো ওর জীবন থেকে সব নারীরাই হারিয়ে যাবে একদিন, হারাবে তাদের উষ্ণ সান্নিধ্য, ভুলে যাবে এই শরীরেও কোনো একদিন শিহরণ জেগেছিল।

 

হাবারা চোখ বুজে ফেলে। শেহেরজাদের কথা আর ভাবতে চায় না। বরং সে ভাবতে শুরু করে, চোয়ালবিবীন ল্যামপ্রেদের কথা। ওরা ভেসে বেড়াচ্ছে স্রোতের সঙ্গী হয়ে। কখনও লুকিয়ে পড়ছে রঙ বেরঙের জলজ উদ্ভিদের জালে, আবার সাঁতরে বেরিয়ে পড়ছে গন্তব্যে।সেখানে রয়েছে ট্রাস্টের জন্য প্রতীক্ষা। দীর্ঘতম সেই সময় – ধীরে ধীরে দিনের আলো কমে এলে ল্যাম্প্রের চারদিকে নেমে আসে চাপ চাপ ঘন কালো অন্ধকার।

তারিখঃ এপ্রিল ১৪, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সা’দ জগলুল আববাস
সা’দ জগলুল আববাস
1 year ago

ল্যামপ্রে ঈল! বিচিত্র মানুষ, আরও বিচিত্র চিন্তা ভাবনার প্রক্ষিত, সীমানা।
খুব ভালো লিখেছো।

Rubana Adiba
Rubana Adiba
1 year ago

বৈচিত্র্যময় জীবন এই ল্যাম্প্রে ঈলের। আমিও অভিভূত হয়েছি জেনে। আপনার মনোযোগী পাঠ এবং মতামত আমার পাথেয় হয়ে থাকবে। আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। 

moury.aditi@gmail.com
1 year ago

আপনার লেখা পড়ার অপেক্ষা থাকে আপু, দারুণ লিখেছেন।

Rubana Adiba
Rubana Adiba
1 year ago

অদিতি — এত ব্যস্ততার মাঝেও আমার লেখাটি তুলে নিয়েছ পড়বার জন্য- আমি আনন্দিত। ভালোবাসা রইল। এবারের সংখ্যা তোমার প্রচ্ছদে আলোকিত হয়ে আছে। ভালোবাসা সবসময়ের জন্য। 

Chirantan Bhattacharyya
Chirantan Bhattacharyya
1 year ago

খুবই সুন্দর একটি লেখা। অত্যন্ত পরিণত ও বুদ্ধিদীপ্ত

Rubana Adiba
Rubana Adiba
1 year ago

আপনার মতো একজন গল্পকারের মতামত আমার পরম প্রাপ্তি। আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। 

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse