সপ্তপদী

 

জীবনে এমন দিন কোনোদিন আসবে এটা কখনোই চিন্তা করেনি সপ্তপদী গ্রুপ। এটা বিখ্যাত কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা স্পোর্টস ক্লাবের নাম নয়। নিজেদেরকে নিজেরা এই নামে অভিহিত করে একধরনের তৃপ্তি পায় ওরা। নামের আবির্ভাব ঐ সপ্তপদী সিনেমা থেকেই, কারণ সিনেমাটা ওদের সবার খুব প্রিয়। সমাজিক কাজে ওদের খুব নামডাক। একটু আড়ালে সামান্য বদনামও আছে, তবে কারও তেমন ক্ষতি কখনো হয়নি বলে পাড়ায় বা সমাজে ওটাকে তেমন কুনজরে কেউ দেখে না। ওরা সাতজন ছিল, আজ ছয়জন হয়ে গেছে। ওদের এক গেলাসের দোস্ত দীনু আজ নেই হয়ে গেছে। ব্যাপারটা খুবই  মর্মান্তিক। গত দশদিন অনেক ঝক্কিঝামেলা গেছে। থানা-পুলিশ, ডুবুরি, মেম্বার চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, এমনকি দীনুর বউ ও পরিবার সবাই ওদেরকেই দুষছে। সবার এককথা ভাসান দিতে গিয়ে ওরা সোমরস পান করে গেল কেন ? গেল তো গেল মদমত্ত অবস্থায় দীনুকে প্রতিমার পিছন দিকের ব্যালেন্স রাখার দায়িত্ব দিল কেন? যার নিজেরই সেসময় ব্যালেন্স নাই সে কি করে এতবড় কাঠামোর প্রতিমা একা ব্যালেন্স করবে ? এমনভাবে দোষারোপ করছে যেন ভাসানে যাওয়ার সময় সবাই মায়ের চরণামৃত পান করে যায়!

ঝন্টু রাগে দুঃখে আপনমনে গরগর করে কথাগুলো ভাবছে, মুখে কিছু বলছে না। শালা; জীবনে কত ভাসানে গেলাম, কতজনকে দেখলাম নেশার ঘোরে মায়ের প্রতিমা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘ মা-গো- যাসনে মা,যাসনে, কৈলাশে এখন বরফ পরা শুরু হবে, তোর খুব কষ্ট হবেরে মা’। তখন ভক্তিরস সবার উথলে উঠে ! বক্তা যদি কেষ্টবিষ্টু কেউ হন অমনি সবাই তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁউমাঁউ করে চোখের জলে বুক ভাসাবেন ! শালা হিপোক্রেট!  কিন্তু কাউকেই ওরা বুঝাতে পারল না, সেদিন বিসর্জনের সময় ওরা কেউ এক ফোঁটাও মদ গিলেনি। মায়ের ভাসানে সবারই অন্তর কাঁদে,তখন কি আর মদ খাওয়া চলে ! তাছাড়া ওরা এলাকার চিহ্নিত মাতাল হতে পারে, কিন্তু আর কোনো বদনাম ওদের শত্রুরাও দিতে পারেনি আজ পর্যন্ত। ওরা থাকে নিজেদের মতো। কারও সাথে লাগালাগি নেই। কেউ শহরে চাকরি করে কেউ টুকটাক ব্যবসা। সন্ধ্যার পর, পরের দিনের কর্ম স্পৃহা এবং এনার্জি বাড়াতে পাড়ার রক্ষাকালী মন্দিরের পেছনে জংলা মতো জায়গায় একটু সোমরসের আসর বসায় মাত্র।

এখানে ওরা সাতজন ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। নেই মানে ওরা দেয়নি। কারণটা ওদের কাছে পরিষ্কার। ওরা মদ খায় বটে কিন্তু মদ ওদের খেতে পারেনি। তাই ওদের সংস্পর্শে এসে কেউ উচ্ছন্নে যাক এটা ওরা কেউই চায় না। অথচ গ্রামের ছোটলোক থেকে বাবুমশাইরা কে না পানাসক্ত নয় ? কেউ গোপনে গৃহদ্বার বন্ধ করে,আবার কেউ প্রকাশ্যে বাজারে। অনেকের কেচ্ছা তো গ্রামে খুব মুখরোচক। পান কার্য শেষে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার তালগাছ ঠেলে সরানোর চেষ্টায়রত দেখা গেছে কাউকে কাউকে। সে আরেক মজার কান্ড। জনাবের মুখে তালগাছকে উদ্দেশ্য করে সে কী খিস্তি ! – ‘ শালা মাতাল নাকি! মাল খেয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করিস?  রাস্তা কি তোর বাপের?  এটা দিয়ে সবাই যাবে,মা-বোন, বাবুমশাই,কর্তামা,বামুন পুরুত, মওলানা সাহেব, সবাই। শালা হায়াশরম নেই? নড় নড়, রাস্তার ধারে গিয়ে মুতে আয় শালা।’ তারপর নিজেই পাছার কাপড় খুলে ঝরঝর করে ছেড়ে দেয় তলপেটে জমে থাকা ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়া তরল। কাপড়টাও আর ঠিকমতো পরতে পারে না। কোনোরকমে টেনেটুনে, কখনও সখনও মাথায় বেঁধে বাড়ি ফিরে। কিন্তু সপ্তপদীর কাউকে  আজ পর্যন্ত কেউ ঐ অবস্থায় দেখেছে, মাকালীর পা ছুঁয়ে বলুক তো ! শালার ঐ স্বর্গীয় পানীয়টা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে সোজা হিমালয় চলে যাবে, এই প্রতিজ্ঞা ওদের।

দীনু অনেকটা ওদের লিডার। এমনিতে প্রাইমারি স্কুল থেকে ওরা সহপাঠী। বয়সের তফাৎ কমবেশি থাকলেও শৈশব থেকেই ওরা হরিহর আত্মা। দীনু লেখাপড়ায় ভালো ছিল। কলেজ অবধি যাওয়ার পর হঠাৎ ওর বাবা বিশ্বনাথবাবু  একদিনের নোটিশে সোজা স্বর্গধাম। তারপর থেকেই মা আর ছোটবোন দীপালিকে নিয়ে সংসারের জোয়াল ওর কাঁধে। অবশ্য ওর বাবা যে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন, উনারা মানে মালিকপক্ষ,  বিশ্বনাথবাবুর  কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ততার অবদান স্বরূপ দীনুকে ছোটখাটো একটা পোস্টে ঢুকিয়ে নেন। দীনুও মগজ খাটিয়ে কোম্পানির অনেক বিশ্বস্ত হয়ে উঠে ক্রমেই। দশটা পাঁচটা অফিস। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়, সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে।

চাকরিতে একটু উন্নতি হলে মা অনেকটা জোরকরে দীনুর বিয়ে দেয়। বউ গ্রামের গার্লস স্কুলের দিদিমণি। এমনিতে খুব ভালো, কিন্তু ওদের সাতজনের গোপন কান্ডটা জানার পর একটু নাখোশ। তেমন ঝামেলা করে না,তবে দীনুর মুখেই শুনেছে বউ ইদানিং জানতে চায় আর কি কি বদ অভ্যেস আছে ? তাই বউয়ের সন্দেহ মুক্ত হতে দীনু ইদানিং ধর্মেকর্মে মন দিয়েছে। সন্ধ্যা আটটার সময় বাড়ি থেকে বের হয় কালীবাড়ির উদ্দেশ্যে, প্রাত্যহিক কীর্তন করবে বলে। কীর্তনও হয়, কিন্তু কোনো এক ফাঁকে ওরা ক’জন চুপিচুপি উঠে যায় কীর্তনের আসর ছেড়ে পিছনের জঙ্গলে। ওখানে ওরা একটা জায়গা বেছে পরিষ্কার করে রেখেছে। এদিকে শ্মশান আর  কাঁটা ভরা ঝোপজঙ্গল বলে দিনের বেলায়ও কেউ খুব একটা আসে না। ওদের লিমিট তিন পেগ। মাঝেমধ্যে, মানে এই বন্ধ ছুটির দিনে একটু এদিক সেদিক হয়, নয়তো রুটিন সবসময় ঠিক। সাথে একটু ঝাল নুন, ভাজাপোড়া, আর সব শেষে দু’একটা এলাচ লবঙ্গ দানা চিবুতে চিবুতে আবার কীর্তনের আসর। সব শেষে মায়ের প্রসাদ পেয়ে হরি নাম করতে করতে বাড়ি ফেরা। ওদেরকে কি মদো মাতাল বলা যায় ? কিন্তু কে বা কারা থানার ওসি সাহেবের  কানভারী করেছে, ওরা সবকটাই পাঁড়মাতাল।

দীনুর দূর্ঘটনার পর সেজন্যেই ওদের একদিন একরাত থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ওসি সাহেবের অফিসাররা। কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার,ওখানেও থানার সাহেবরা ওদের সাথে পেগ ভাগ করতে চেয়েছেন ! ঝন্টু চোখের ইশারায় সবাইকে সাবধান করেছে। খবরদার জান গেলেও ছুঁবি না। কথার একটু এদিক সেদিক হলেই ফাঁসিয়ে দেবে। তদন্ত ফাইলে সোজা লিখে দেবে দীনুকে আমরা ঈর্ষা করে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিয়েছি। আরও কত কি যে কেচ্ছা কাহিনি জুড়ে দেবে ঠিক নাই। আমাদের সাথে মদের আসর বসানোর উদ্দেশ্য, কোনো ক্লু বের করা। ক’দিন একটু উপোস কর। মনে কর আমরা দীনুর জন্য বাবা আশুতোষ আরাধনায় উপবাস ব্রত পালন করছি।

পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত। থানা থেকে ফিরে ওরা গিয়েছিল দীনুর বাড়ি। বউদি প্রথমে কথাই বলতে চায়নি। অনেক কাকুতি মিনতি করে শেষে বুঝানো গেল সেদিনের ঘটনাটা। দীনু নিজেই সবাইকে সরিয়ে দিয়ে প্রতিমার পিছনের দিকটা আগলেছিল। দুটো বড়সড় নৌকা পাশাপাশি বেঁধে তার উপরে বাঁশের সারি সাজিয়ে প্রতিমা বসানোর ব্যবস্থা করা হয় প্রতিবছরের মতো। এক-এক করে সবকটা প্রতিমা তোলার পর বাঁশের পাটাতনটা জল আর কাদায় পিচ্ছিল হয়ে গেছে। দীনু গায়ে গতরে শক্তপোক্ত মানুষ। পুজো কমিটির হোমড়া চোমরাও বটে। তার নির্দেশে সবাই সামনের দিকে ঢাকের তালে ধুনচি নাচছে। ছোট প্রতিমা গুলো কেউনা কেউ ধরে রেখেছে। মা দুর্গার কাঠামো সামনে থেকে ধরে আছে ঝন্টু, পানু, অটল আর শিবু। পেছনে একটা বাঁশে ঠেক দিয়ে মোটা দড়ি বেঁধে পাহারা দিচ্ছে দীনু একা। বাজনার তালে তালে নৌকা এগিয়ে চলেছে নদীর মাঝ বরাবর সাগরের মোহনার দিকে। নদীর পাড়েই ওদের গ্রাম,এই নদী ওদের বুদ্ধির বয়স থেকেই চেনা, মায়ের মতো।

দীনুর বোধহয় মা দুর্গার জন্য কান্না পাচ্ছিল। তাই হয়তো ঝন্টুকে ডাক দিয়ে বলেছিল, ঝন্টু সাথে এনেছিস কিছু ? থাকলে একটু দে তো বড্ড শীত করছে। সূর্য ডুবে গেছে, আলো আঁধারির রহস্যময়তায় সামনে ঢাকের তালে ধুনচি নাচের উল্লাসে পেছনে কারও দৃষ্টি দেওয়ার চান্স নেই। সেই ফাঁকে ঝন্টু আর দীনু ছোট্ট বোতলের ছিপি খুলে গলায় একটু ঢেলে দিয়েছে। এই ঢালাঢালি নির্জলা আর মাত্রাও ছাড়াতে পারে। তারপর যথারীতি মায়ের বিসর্জন হয়ে গেল। যারা মায়ের প্রতিমার সাথেসাথে জলে ঝাঁপিয়েছিল তারা একে একে সবাই উঠে এল নৌকায়। কিন্তু দীনু উঠল কিনা কেউ খেয়াল করেনি। খেয়াল করার কথাও নয়। কারণ তখন চারিদিকে আতশবাজি ফুটছে। ঢাকের দ্রিমদ্রিম তালে এবছরের শেষ আনন্দ নৃত্য নাচছে। সবার কন্ঠে এক উচ্ছ্বাস  – বল দুর্গা মা’ই কী – জয় !

দশদিন হয়ে গেল, দীনুর লাশটাও পাওয়া গেল না। উজান ভাটিতে মাইলের পর মাইল খুঁজেও কোথাও কোনো লাশ ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেল না! সাধারণত ইচ্ছাকৃত ভাবে ডুবিয়ে না রাখলে কোনো প্রাণীর মরদেহ নদীতে ভেসে উঠবেই। বরাবরই এরকমই দেখে আসছে নদীপাড়ের মানুষ। তাহলে দীনুর কি হলো ? ওর তো চোখে দেখা তেমন কোনো শত্রু ছিল না। পুলিশ অবশ্য এরমধ্যেই একটা মিসিং ডাইরি লিখিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। ওঁদের তো সরকারি বেসরকারি, দরকারি বেদরকারি অনেক কাজ। তাছাড়া মাঝেমধ্যে  এমন ঘটনা ভাসানে ঘটে। কেউকেউ যেদের সান্তনা দিতে আসে,’ সবই মায়ের ইচ্ছে, পুণ্যাত্মা পুণ্যাত্মা তোমার ছেলে পুণ্যাত্মা ! বুঝলে, মা তাকে নিজের সাথে কৈলাশ নিয়ে গেছেন গো!’ হায় সান্তনা! যার গেছে সে জানে তার কী গেছে, কতটুকু গেছে।

ঝন্টু, পানু ,অটল, গোল্লা, ধীরাজ, শিবু সবাই এক পেগ করে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। দ্বিতীয় পেগের কথা কেউ ভাবছে না। সপ্তম গ্লাসটা আজও বের করেছে, মদও ঢেলেছে, কিন্তু তেমনই  রয়ে গেছে ওটা। গোল্লা ভিন্ন ধর্মের মানুষ, কিন্তু ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে সে সবকিছুতেই থাকে। ভাসানের দিন ওর দায়িত্ব থাকে মাঝির। নৌকা বাইচে এ অঞ্চলে ওর জুরি মেলা ভার। গোল্লা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না দীনু পানিতে ডুবে মরতে পারে। যে ছেলে এক ডুবে নদীর মাঝখানে চলে যেতে পারে সে কি করে ডুবে মরে ! হায় খোদা, তোমার লীলা বান্দার বোঝা দায় ! সবাই আসরে বসেছে ঠিক, কিন্তু আজ সুরা যেন বেসুরো, বেতালা তান ধরেছে। মনে মনে সবাই বোধহয় অপেক্ষা করছে, দীনু এখনই এসে জয় মা বলে গ্লাসে চুমুক দেবে।

হঠাৎ খেয়াল করলো,কালীবাড়ির ওদিক থেকে জংলার ভেতর দিয়ে যে সরু পায়েচলা পথ ওরা বানিয়েছিল, তার মধ্যদিয়ে একটা আলোর শিখা তাদের আস্তানার দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের জ্বালানো কুপীটা নিভিয়ে দেবে কিনা ভাবতে ভাবতে আলোর শিখা আস্তানার সামনে চলে এল। ওরা অবাক হয়ে দেখল,দীনুর ক্লাস এইট পড়ুয়া ছেলে অভিজিৎ তাদের সামনে ! নারকেলের মালার ভেতর মাটির প্রদীপ বসিয়ে টর্চের মতো বানিয়েছে।  ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে। দীনুর খুব আশা ছিল,ছেলেটা মানুষ হলে তার সব দুঃখ কষ্ট অভাব লাঘব হবে একদিন। পরিবারের প্রতি দীনু সবসময়ই দায়িত্বশীল। ছোটবোন দীপালির বিয়ে দিয়েছিল গতবছর। বর বেশ ভালো, রেলে চাকরি করে। চালচলন দেখলে বোঝা যায় কামাই রোজগার ভালোই। বিধবা মা, বউ আর ছেলে নিয়ে বেশ ছিমছাম সুখের সংসার ছিল দীনুর।

আস্তানায় অভিজিতের আগমনে ওরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঝন্টু গ্লাসগুলো আড়াল করলো, তবে অভিজিতের চোখে যে পড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নাই। কালীবাড়ি থেকে ভেসে আসা কীর্তনের সুর আজ বড়োই করুণ শোনাচ্ছে। অটল উঠে এসে অভিজিতের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো, কি রে বাবা অভি তুই এখানে কেন? অভি মুখ নিচু করে বললো, ‘ কাকু আমি জানতাম তোমরা রোজ রাতে এখানে আস। তোমাদের ফলো করে আমি কয়েকবার দেখে গেছি। কিন্তু এতে কারও কোনো অসুবিধার কারণ হচ্ছে না বলে কাউকে কিচ্ছু বলিনি। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু বলার ছিল, ভাবলাম তোমাদের এই গোপন আড্ডায় বিষয়টা বলা ভালো হবে। আমাকে কি তোমাদের সাথে একটু কথা বলার সুযোগ দেবে?

মাত্র এই কয়েকদিনে এইটুকুন ছেলের এমন ম্যাচুরিটি দেখে সবাই অবাক হয়ে পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। ধীরাজ উঠে এসে ওকে হাত ধরে এনে বসালো সবার সামনে। পানু বললো, বল বাপ, তোর বাবার জন্য আমাদেরও বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কী বলার আছে বল। অভি মুখ নিচু রেখেই বলতে শুরু করল। কাকু, আমার মনে হয় আমার বাবা জলে ডুবে মরেনি, বরং ডুব সাঁতারে নদী পার হয়ে কোথাও চলে গেছে।

আস্তানায় যেন বজ্রপাত হলো। গোল্লা চেঁচিয়ে উঠলো, বলিনি, আমি বলিনি, পানিতে ডুবে দীনু মরতে পারে না। কিন্তু ভাতিজা, তোমার এই কথা মনে হইলো কেন? যুক্তি কি? অভি ধীরেসুস্থে প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সবার সামনে রাখলো। ওটা শহরের নামকরা এক বস্ত্র বিপণীর বিক্রয় রশিদ। ওতে তিনটা শাড়ি বাবদ প্রাপ্ত টাকার অংক লেখা আছে। দীনুর ছয় বন্ধুর কারও মাথায় ঢুকছে না এর মানে ! শিবু আর পানু একসাথে বলে উঠলো, এর মানে কি ভাতিজা? একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ঝন্টু বললো, বাবা অভি, তোমার মনের প্রশ্নটা একটু খুলে বলবে ? অভি মাথা নিচু করেই আছে, ফিসফিসিয়ে যেন বললো, ‘ কাকু আমি আপনাদের চোখে এখনও ছোট, কিন্তু আমি অনেকে কিছু বুঝি এবং দেখি। সবটা ধরতে না পারলেও অন্তত মন্দটা ধরতে পারি। এই রশিদের তারিখটা দেখুন, পুজোর পঞ্চমী দিনের তারিখ। রশিদ অনুযায়ী আমাদের বাড়িতে তিনটা শাড়ি আসার কথা, কিন্তু এসেছে দুইটা। একটা ঠাম্মার, আরেকটা মায়ের। তাহলে তৃতীয় শাড়িটা গেল কই? পিসি, পিসার পুজোর গিফট আগের সপ্তাহে দেওয়া হয়ে গেছে।

সবাই চুপ, কেউ বুঝতে পারছে না এরপর অভি কি বলবে। অভি আবার শুরু করলো – আসলে বেশ কিছুদিন ধরে বাবা আর মায়ের মধ্যে চাপা স্বরে ঝগড়া হতো। আমি একরাতে ঘুমের ভান করে কান পেতে শুনি, মা বাবার অফিসের এক মহিলার সাথে বাবার সম্পর্ক আছে সন্দেহ করে ঝগড়া করছে। বলছে তোমার মতো মাতালের আবার বিশ্বাস কি? সেই মহিলা আবার আমার পিসার দূরসম্পর্কের বোন হন, যাঁর প্রস্তাবে পিসির বিয়ে হয়েছিল।  অষ্টমীর দিন বাবার প্যান্ট ধুতে গিয়ে পকেটে এই রশিদটা পায় মা। তারপর ঐ রাতেই তুমুলঝগড়া। নবমী দিন সকালে আবার সব ঠিকঠাক।

বিষয়টা বন্ধুদের অজানা। কিছু কথা প্রত্যেকেরই একান্ত নিজের থাকে। কারও সাথে শেয়ার করা যায় না বলে সেই কথাগুলোই হৃৎপিণ্ডটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়। অথচ প্রকাশ্যে আমরা সবাই বলি, এইতো বেশ আছি।

তারমানে তোদের ধারণা, তিন নম্বর শাড়িটাই তোর বাবার খোঁজ পাওয়ার সূত্র। অটল গম্ভীর গলায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অভির উদ্দেশ্যে।

আমি নই কাকু, প্রশ্ন এবং সন্দেহ আমার মায়ের। আমি শুধু জানতে এসেছি ঘটনা সম্পর্কে আপনারা কেউ কিছু জানেন কি-না। যদি ঘটনা সত্য হয়,তবে আমরা সেই মহিলার কাছে যেতে চাই। বাবা মায়ের উপর রাগ করে কি ঐ মহিলার কাছে চলে গেলেন ?

ঝন্টু খেঁকিয়ে উঠে, কি যা তা বলছিস?  আমরা ড্রিংক ফ্রিংক করি বটে কিন্তু আমাদের কারও আলুর দোষ নেই, মা কালীর শপথ।

পানু তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে দিল। কি বলছিস ছোট ছেলেটার সামনে! একে ওরা প্রচন্ড শোকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে!  বাবা অভি, তুমি কিছু মনে কর না। এই আমি, আমরা কথা দিচ্ছি, কালকেই আমি আর অটল তোমার বাবার অফিসে যাব। ঐ মহিলাকে আমরা চিনি। প্রয়োজনে ওকে টুঁটি চেপে ধরব। তবে একটা কথা বলি, আমাদের চোখে কখনও সে-রকম কিছু পড়েনি যে দীনুকে সন্দেহ করব। যা ই হোক, স্বয়ং ব্রক্ষ্মারও মতিভ্রম হয়েছিল, আমরা তো মানুষ।

অভিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় করে ওরা দ্বিতীয় পেগ ঢাললো। বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবনায় থাকতে থাকতে কখন যে দৈনিক লিমিট ক্রস করে গেছে কারও খেয়াল নেই। খেয়াল হলো গোল্লার ‘ যাঃ শালা ‘ বলে খিস্তি দিয়ে মদের খালি বোতলটা আছড়ে ভাঙার শব্দে।

দীনুর কলিগরা সবাই খুব উদ্বিগ্ন এবং মর্মাহত ওর নিখোঁজ সংবাদে। কিন্তু প্রগতি দেবী মানে দীনুর সেই আত্মীয়া দুদিন ধরে অফিসে আসছেন না। ফোনে জানিয়েছেন তিনি মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছেন, তাই কদিন ছুটি চান। বিষয়টি সন্দেহজনক, কিন্তু এখানে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। কৌশলে প্রগতি দেবীর বাসার ঠিকানা নিয়ে পানু আর অটল রওনা হলো সেই ঠিকানায়।

প্রগতি দেবীর বাসা শহরের একটু বাইরের দিকে। নিরিবিলি এলাকা,শহরের ভেতরে যেন এক পল্লি। ছিমছাম দোতলা বাড়ি। সামনের দিকে সুন্দর একটা বাগান। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল বাড়িটা উনার পৈতৃক। উনি একা মানুষ কোনো ভাগিদার নেই। ভালো চাকরি করেন,আর বাড়িতে তিনি বেশ কয়েকজন বৃদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছেন। বলতে গেলে ওটা এখন এই এলাকায় বৃদ্ধাশ্রম হিসেবেই সবাই চেনে। পানু আর অটল কোনো হিসাব মিলাতে পারছে না। কি সন্দেহ করে এসেছে কিন্তু আসলে কি ঘটেছে, কিছুই মাথায় আসছে না। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ওরা দ্বিধায় পড়ে গেল আর এগুবে কিনা।

বাড়ির গেইটে নাম লেখা আছে “আশার আলো “। নামটা পড়ে অটল বললো, চল ঢুকেই পড়ি। আশার আলোতে নিশ্চয় কোনো আলো পেয়ে যাব। গেইটের সামনে এক মাঝবয়েসী লোক জিজ্ঞাসা করলেন, দাদারা কাউকে খুঁজছেন?  অটল বিনয়ের সাথে বললো, আজ্ঞে প্রগতি দেবীর সাথে একটু  দেখা করা যাবে ?  আমরা ওঁর আত্মীয় এবং কলিগ দীননাথ সেন, মানে দীনুবাবুর গ্রাম থেকে এসেছি। দীনুবাবুকে নিশ্চয় চেনেন?

নিশ্চয়, কেন নয়!  আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি দিদির পারমিশন নিয়ে আসি। দুজনের নামধাম জেনে ভদ্রলোক ভেতরে গেলেন। একটু পরেই সাদরে তাদের বাড়ির ভেতর নিয়ে সামনের একটা বড় ঘরে বসালেন। ভদ্রলোকের নাম জানা গেল কমলেশ। ওঁকে দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে না এখানে কি দায়িত্বে আছেন। তবে দারোয়ান বা মালী নন এটা পোষাক আষাকে বোঝা যায়। একটু পরে প্রগতি দেবী এলেন। বেশ শান্ত গম্ভীর দেখাচ্ছে উনাকে। দীনুর অফিসে দুএকবার দেখা হয়েছে, তখন কিন্তু ভদ্রমহিলাকে বেশ হাসিখুশি মনে হয়েছিল। সম্ভবত দীনুর সিনিয়র কোনো পোস্টে আছেন। বয়স চল্লিশের ভেতরেই হবেন। ধীর শান্ত হয়ে বসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপারটা কেমনে ঘটলো ? যতটুকু খবর পেয়েছি, আপনারা সবাই একসাথেই ছিলেন সেদিন।

অটল আর পানু পরস্পর আড়চোখে তাকাল নিজেদের মধ্যে। ভদ্রমহিলা কি অতিচালাক? দীনুর সব খোঁজ খবর যে রাখেন তা প্রশ্নের ধরন শুনে বুঝা যাচ্ছে। এখন কিভাবে কথা শুরু করা যায় তা দু’জনে ভাবছে। দীনু যদি এখানে এসে থাকে তবে ভদ্রমহিলাকে এত বিমর্ষ দেখাতো না। যতই চালাকি করুন, পরকীয়ায় ধরা পড়লে বিব্রত হন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। তবু্ও দীনুর বউয়ের সন্দেহটা ওদের মাথায় ঘুণপোকা হয়ে ঘুরছে। আচ্ছা তাই যদি হয় তবে সেটা কতটুক এগিয়েছিল জানা দরকার। অটল গলাটা পরিস্কার করে মুখ খুলতে যাচ্ছিল তখনই প্রগতিদেবী ম্লান কন্ঠে আবার বলতে শুরু করলেন।

পঞ্চমী দিন অফিসে আমাকে একটা শাড়ি দিয়ে বলেছিল, দিদি আমারতো তেমন সামর্থ্য নেই, তাই বেশিকিছু দিতে পারলাম না। আপনার আশার আলোর মায়েদের যেকোনো একজনকে এই শাড়িটা দেবেন। আর এই পাঁচশো টাকায় যদি ওঁদের মিষ্টিমুখ করান আমার খুব শান্তি লাগবে। পুজোর ছুটির পর আমি সবাইকে প্রণাম করে আসব। হায়!  ঈশ্বরের কি ইচ্ছে ছিল জানি না, এমন আন্তরিক মানুষটার এভাবে সলিল সমাধি হলো!

এরপর আর কোনো প্রশ্ন করা চলে না। করলে সেটা পুলিশি জেরা হয়ে যাবে,যা পানু বা অটলের অধিকারে পড়ে না। কিন্তু পানুর মনটা খচখচ করছিল, ভদ্রমহিলা ওভার চালাক নয়তো ? পানু খুব সাবধানে সমব্যথী হয়ে বললো, হ্যাঁ দিদি, দীনু আপনার কথা প্রায়ই বলতো। আচ্ছা শেষ কবে আপনার সাথে ওর দেখা বা কথা হয়েছিল? শাড়ির আঁচলে কান্না লুকিয়ে তিনি বললেন, বিজয়ার দিন সকাল দশটার দিকে ফোনে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। আমার এখানকার সব মায়েদের আশীর্বাদ নিয়েছিল। ওর জন্য এখানের সব মায়েরা খুব ব্যথিত। আপনারা যে দীনুর বন্ধু এটা কাউকে জানানো হয়নি। জানলে একটা করুণ দৃশ্যের সৃষ্টি হবে। তাই আপনাদের আশার আলোর শুভাকাঙ্ক্ষী বলে জানিয়েছি। চাইলে ওঁদের সাথে দেখা করতে পারেন।

‘আজ থাক দিদি,আমাদের মনও ভালো নেই। পরে একদিন আসব। আমরা আসলে একটা বিষয় জানতে চাইছিলাম’  –  অটল পানুর হাতটা চেপে ধরে প্রশ্নটা থামিয়ে দিল। ভদ্রমহিলা ঠিকই খেয়াল করলেন দৃশ্যটা। ক্লান্ত কন্ঠে বললেন – জানি। আমাদের সমাজে এটাই স্বাভাবিক। দুজন নারী পুরুষ একসাথে সুখ দুঃখের কথা বললেই সবাই চোখ টেরিয়ে তাকায়। দীনু আসলে আমার আত্মীয় বা কলিগ শুধু নয়, ও কখন যেন আমার ছোট ভাই হয়ে গিয়েছিল।

এই সহজসরল স্বীকারোক্তির পর পুলিশ বা ইন্টেলিজেন্স ব্রান্সের ঝানু গোয়েন্দা ছাড়া আর কারও মাথায় কোনো প্রশ্ন গজাবে না নিশ্চিত। প্রগতি দেবীকে নমস্কার জানিয়ে ধীর পদক্ষেপে আশার আলো ছেড়ে বেরুলো পানু আর অটল। দীনুর বউ আর ছেলেকে বিষয়টা এখনই জানানো দরকার,যাতে নিখোঁজ মানুষটা সম্পর্কে তাদের হারিয়ে যাওয়া শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধার হয়। যদিও এতে কিছু আসবে যাবে না। মৃত মানুষের স্মৃতি কে আর কতদিন মনে রাখে বা রাখার অবসর পায়।

দীনুর পরিবারের বর্তমান যে আর্থিক অবস্থা তাতে ওদের মোটামুটি চলে যাবে। অফিস থেকে দীনুর কিছু পাওনা থাকলে সেটা পেতে হয়তো কিছু ঝক্কিঝামেলা হতে পারে। কারণ ডেথ সার্টিফিকেট তো কেউ দিতে পারবে না।

আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে,চল ফেরার পথে থানা হয়ে যাই, দীনুর কোনো খোঁজ ওঁরা পেলেন কিনা জেনে আসি। অটলের প্রস্তাব শুনে পানু  দু’মিনিট ভাবলো, তারপর বললো, দেখ থানায় আমাদের মাতাল বলে চিহ্নিত করা হয়ে আছে। বেশি খোঁজ খবর  নিতে গেলে শেষে ওরা বিরক্ত হয়ে অন্য কেইসে ফাঁসিয়ে বড় ডেকের ভাত খাইয়ে আনবে। জানিস না থানার সামনে দিয়ে কানাও হাঁটে না। সোজা বাড়ি চল। রাতে ডেরায় গিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। বলেই পানু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সায় উঠে পড়লো। অগত্যা অটলও ফিরে চললো নিজ গ্রামের দিকে।

দেখতে দেখতে কালী পুজোও এসে গেল। এবার পুজো নমোনমো করে শাস্ত্র মতেই হবে। দীনুর জন্য প্রার্থনাই হবে এবার মাকালীর চরণে নিবেদন। পুজো কমিটির সভাপতি পন্ডিত ব্যক্তিত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত শিরোধার্য। দীনু গ্রামের মানুষের কাছে এত প্রিয় ছিল আগে বুঝতে পারেনি ওর বন্ধুরা। ঝন্টু একটু ঘোঁৎঘোঁৎ করছিল কিন্তু সর্বজনীন মিটিংয়ে কিছু বলল না। রাতে ডেরায় বসে দুপ্যাগ পেটে পড়তেই সভাপতির বিরুদ্ধে খিস্তি ঝাড়ল। – শালা পন্ডিত, লোকদেখানো মায়া মহব্বত দেখাতে ওস্তাদ। প্রতিবছর বলি ভাসানের জন্য একটু উন্নত ব্যবস্থা করতে, তা করবে না ! সেই আদ্যিকালের ব্যবস্থা। এ নিয়ে পুজোর প্রস্তুতি মিটিংয়ে দীনুর সাথে তর্কাতর্কিও হলো। প্রতিবছর যে একটা দুইটা তলিয়ে যায় না সেটাই মায়ের কৃপা।

অমাবস্যার মধ্যরাতে পুরোহিত ঠাকুরের উচ্চস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ সপ্তপদীর ডেরা থেকেও শোনা যাচ্ছে। আজকের সব আয়োজন যেন দীনুর জন্য অশ্রু মাখা। আজ ওরা কেউ মন্দিরে যায়নি। যাবে একেবারে শেষে, অঞ্জলির সময়। অথচ দীনু থাকলে সবাই মন্দির চত্বরে  ব্যস্ত থাকতো কোনো না-কোনো কাজে। ইতিমধ্যেই দু প্যাগ হয়ে গেছে, আজ বোধহয় লিমিট ছাড়াবে সবাই। হঠাৎ গোল্লা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাতালদের আসরে হাসি বা কান্না একবার ছড়িয়ে পড়লে তা কন্ট্রোল করা মুশকিল। ওর দেখাদেখি সবাই  জড়াজড়ি করে কাঁদতে লাগলো। শুধু অটল সবাইকে শান্তনা দিচ্ছে  – কাঁদিস না,কাঁদিস না, এভাবে কাঁদলে নেশায় চেপে ধরবে,বুদ্ধি গুলিয়ে যাবে। তারচে’ চল বিষয়টা নিয়ে আমরা আরেকটু ভাবি।

মানুষ মাতাল হলে মনে হয় খুব সহজ সরল হয়ে যায়। সত্যিকথা সব বেরিয়ে আসে। আর কেউ ভালো কোনো কথা বললে সাথে সাথেই তাতে সহমত পোষণ করে। এমনিতে এত সহজে ঐক্যমতে পৌঁছানো বাঙালির পক্ষে সম্ভব নয়। কান্না থামিয়ে সবাই সোজা হয়ে বসলো, বুদ্ধি পরামর্শ চলছে,কিন্তু কোনো সমাধান বের হয়ে আসছে না। হঠাৎ শিবু জয় মা বলে চিৎকার করে বলল,

– শালা সবকটাই মাতাল, তোরা করবি দীনুর সন্ধান! আমরা ওকে কোথায় খুঁজেছি? শুধু নদীতে। নদীর পাড়ের গ্রাম বা সমুদ্রের কোনো দ্বীপেও তো চলে যেতে পারে ভাসতে ভাসতে।

– শালা মাতাল, মদে তোকে আজ খেয়ে ফেলেছে!  ঝন্টু শিবুকে খিস্তি ঝাড়ল। একটা মানুষ কয়দিন নদী বা সমুদ্রে ভাসতে পারে? মাছেই তো ঠুকরে খেয়ে ফেলবে। দেখ গিয়ে হয়তো সেটাই ঘটেছে। নয়তো লাশটাতো ভেসে উঠতো?

কালীবাড়ি থেকে মাইকে অঞ্জলি দেওয়ার ঘোষণা হচ্ছে। ওরা আসর গুটিয়ে মুখে লবঙ্গ এলাচ চিবুতে চিবুতে পুজো বাড়ির দিকে রওনা হলো।

ইতিমধ্যে দীনুর শ্রাদ্ধ-শান্তি নিয়েও সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত। শাস্ত্রজ্ঞদের একদল বলছেন এখনই দীনুর পারলৌকিক শান্তি কামনায় কিছু করা উচিৎ, যাতে তার রেখে যাওয়া পরিবারের কোনো অমঙ্গল না হয়। আরেকদল বলছেন,শ্রা দ্ধ-শান্তি এসব হয় মৃতের। দীনু যে মৃত তার প্রমান কি ? ও নিখোঁজ, নিখোঁজ মানুষের জন্য একবছর অপেক্ষা করা শাস্ত্রীয় নিয়ম। তার আগে দীনুর স্ত্রীর শাখা সিঁদুর ত্যাগ করা অশাস্ত্রীয় হবে। দীনুর মা আর বউ পন্ডিত ব্যক্তিদের আলোচনা চুপচাপ শুনছিলেন। গ্রামদেশে এখনও সমাজ বলে একটা বিষয় আছে। সমাজের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মানতে হয় ছোট বড় সবাইকে।

অটল আর পানুর মুখে প্রগতি দেবী সম্পর্কে শুনে দীনুর বউ আর ছেলের মনে দ্বিধা বা সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া প্রগতি দেবী নিজে এসে সমবেদনা জানিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করে গেছেন।

সময় মানুষকে কতকিছু ভুলিয়ে দেয় ! প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকার চাপে সব দুঃখ বেদনা ভুলে মানুষ এগিয়ে চলে সামনে জীবন পথে। দীনুও আস্তে আস্তে দেওয়ালে ঝোলানো ছবি হয়ে গেল। তবে সর্বসম্মতিক্রমে একবছর পর দীনুর শ্রাদ্ধ করার সিদ্ধান্ত স্থীর হয়। ঝন্টু মাথা থেকে কিছুতেই ঘটনাটা ফেলতে পারে না। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ওরা একসাথে ছিল প্রতিমার পিছন দিকে। ভাসানের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনের সময় চিৎ করেই ভাসানো হয়। অন্ধকার থাকায় সামনের ওরা কেউ খেয়াল করেনি ওদের। কিন্তু বিসর্জনের আগে বল দুর্গা মা-ই  কী  – জয় ! শুনেই ওরা দুজন দু’দিকে সরে গিয়েছিল। তারপর সবাই সাঁতরে নৌকায় উঠে। কিন্তু দীনুর না ওঠা সবার নজরে আসে নৌকা ঘাটে আসার পর। তৎক্ষনাৎ আবার স্পিডবোট নিয়ে খুঁজতে নেমেছিল  বন্ধুরা, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। একে রাত,তার উপরে  প্রবল স্রোত। আরও অনেক প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে কিন্তু স্রোতের টানে ততক্ষণে সব সমুদ্রের দিকে চলে গেছে।

টঝন্টুর মাথায় বারবার একটা কথাই ঘুরছে, দীনু কি তাহলে প্রতিমার কাঠামোর কোথাও আটকে গেছিল? অথবা ব্যালেন্সের জন্য বাঁধা বাঁশ বা দড়ির সাথে? কোনো প্রশ্নেরই সঠিক জবাব নেই। সে শুধু এটা ভেবে শিউরে উঠছে, ব্যাপারটা তার বেলায়ও ঘটতে পারতো ! তাহলে কি অবস্থা হতো তার পরিবারের। তাদের অবস্থা দীনুর মতো এতটা সচ্ছল নয়। ঝন্টুর জেদ চেপে গেল মনেমনে।  দীনুর বিষয়টার একটা সুরাহা করতেই হবে। তার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন সে সেদিন মদের বোতল সাথে নিয়েছিল ?  সেরকম কোনো প্ল্যান তো ছিল না ওদের মধ্যে।

বাজারে ঝন্টুর একটা মোবাইল সারানোর দোকান আছে। মোবাইল সংক্রান্ত টুকটাক জিনিসপত্রও বিক্রি করে। একমাত্র দোকান হওয়ায় মোটামুটি বিক্রিবাট্টা ভালোই। মানে সংসার গড়গড়িয়ে চলে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঝন্টু বিভিন্ন অঞ্চলের মোবাইল ব্যবসায়ীদের ফোন নাম্বার জোগাড় করে উনাদের সাথে দীনুর বিষয়ে খোঁজখবর নিতে লাগলো। বিষয়টা অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। ছবি দেখে বা বর্ননা শুনে কার এতো দায় পড়েছে অযথা সময় নষ্ট করার। সবাই আছে যারযার ধান্দায় ব্যস্ত। তবুও জানিয়ে রাখা, যদি কারও দয়া হয়। সব মানুষতো সমান নয়। ঝন্টু মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে রাজি নয়। থানা পুলিশ এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে তেমন ইচ্ছুক নয়। কত মানুষ রোজ নিখোঁজ হচ্ছে, ক’জনকে খুঁজবে ওরা। ওঁদের তো অনেক কাজের চাপ। তবে কড়া করে জানিয়ে রেখেছে, জীবিত বা মৃত দীনুর কোনো খোঁজ পেলে যেন থানায় রিপোর্ট করা হয়। এটা নাকি রাষ্ট্রীয় মহান দায়িত্ব।

শিবু মোটরসাইকেল মেকানিক। থানার কাছেই তার গ্যারেজ। থানার অফিসাররা প্রায় সবাই তার কাছে বাইক সার্ভিসিং করাতে আসে। সততার জন্য ওর সুনাম আছে বেশ। বলতে কি, ওর জন্যই দীনুর নিখোঁজ হওয়ার কেইসে থানা পুলিশের ঝামেলা অল্পের উপর দিয়ে গেছে। শিবু সময় সুযোগে থানায় যোগাযোগ রাখে। কিন্তু কোনো খবর এখনো কেউ দিতে পারেনি। সবারই এক কথা, বেঁচে নেই, বেঁচে নেই, লাশ চোরা স্রোতে চলে গেছে গভীর সমুদ্রে। এতদিনে কঙ্কালের ভেতর ইলিশ মাছে বাসা বেঁধেছে দেখ গিয়ে। কিন্তু শিবুর কেন যেন মনে হয় দীনু মরেনি। রোজ রাতেই স্বপ্নে দেখে ও দীনুকে। কী যেন বলতে চায় ও,কিন্তু ঘুম ভাঙলে আর মনে করতে পারে না জানের দোস্ত কী বলতে চায় !

থানার এক সেন্ট্রি  ফোরকান,বাড়ি হাতিয়া দ্বীপে। সমুদ্রের মাঝখানে এক রূপবতী দ্বীপ এটি। এর সাথে লাগোয়া আরও এক অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ। ফোরকান সদ্য বিয়ে করেছে ওখানে। ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল সে। সেই ফাঁকে শ্বশুরবাড়ির হাওয়া একটু গায়ে না লাগালে চলে। ছুটি শেষে ফিরে তার উর্ধতন অফিসারের বাইক সারাতে নিয়ে এসেছে শিবুর দোকানে। কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো,

– তা হ্যাঁ রে শিবু, তোদের পাড়ার দীনুবাবু নাকি ভাসানে দুগ্গামায়ের সাথে কৈলাশ চলে গেছে?

কথাটার মধ্যে টিটকারি আছে। এদেশে অনেকেই এরকম বলে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পুতুল পূজা করে, আবার ঢোল বাদ্য বাজিয়ে সে পুতুল পানিতে ফেলে দেয়। এটা কীরকম ধর্ম তোদের?  ত্যাগ, বিসর্জন এসবের মানে কি সবাই বোঝে? বুঝলে ধর্ম নিয়ে এত কলহ কখনো হতো না। শিবু ফোরকানের  টিটকারি গায়ে না মেখে স্বাভাবিক ভাবে বললো, হ্যাঁ স্যার, ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক। তবে আমার মনে হয় দীনু মরেনি। সে ভেসে কোনো অচেনা জায়গায় চলে গেছে। হতে পারে সে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গেছে, ঐ যে সিনেমায় যে রকম দেখায়।

– শালা মাতাল, দিনেও গিলেছিস নাকি?  সিনেমার ভুত মাথায় ঠোক্কর মারে? কাজ কর,কাজ কর। ওসব ভেবে ভেবে নিজের ধান্দাও বরবাত করবি বেটা।

বয়সে অনেক ছোট হবে এই  সেন্ট্রি । শিবুর ইচ্ছে করছিল শালার কানকো বরাবর একটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু পুলিশ তো তাই ইচ্ছেটা গিলে ফেলতে হলো।

ঘন্টা না পেরুতেই ফোরকান ফিরে এসে শিবুকে এক চমকপ্রদ তথ্য দিলো। আচ্ছা শিবু তোর কথাটা শুনে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো, তোকে সেটাই জানাতে এলাম। তোদের ভাসানের দুতিনদিন পর আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের কিছু জেলে সমুদ্র থেকে একটা অর্ধ মৃত  মানুষকে উদ্ধার করে। লোকটা খড়-কাঠের একটা চালির সাথে ভাসছিল। লোকটা যে আমাদের হাতিয়া বা নিঝুম দ্বীপের নয় সেটা নিশ্চিত। কারণ এই ছোট্ট জায়গায় মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। লোকটার গায়ে একটা টিশার্ট ছিল,কিন্তু ছেঁড়া- মলিন। নোনা পানি আর কাদায় টিশার্টে লেখা প্রায় নষ্ট। শুধু চট্টগ্রাম শব্দটা কোনোমতে বুঝা গেছে। পুলিশি ঝামেলার ভয়ে ওরা বিষয়টা অনেকটা চেপে যায়। স্থানীয় চিকিৎসায় লোকটা কিছুটা ভালো হলে ওকে কুমিরা ঘাটে নিয়ে ছেড়ে দেয়। উদ্দেশ্য ওদিকে চট্টগ্রামের কারও চোখে যদি লোকটা পড়ে তবে ঠিক পৌঁছে যাবে বাড়ি। আমি ওসখালী বাজারে জেলেপাড়ার একজনের সাথে কথাপ্রসঙ্গে শুনেছি। কি বলবো বল ,মানুষ এখনও পুলিশকে কেন বন্ধু ভাবতে পারে না বুঝি না।

শিবুর মুখে পুলিশের উদ্দেশ্যে একটা খিস্তি বের হয়ে যাচ্ছিল প্রায়,কিন্তু কোনোপ্রকারে সামলে নিয়ে বললো, –

ঠিক বলেছেন ওস্তাদ, আমরা তাহলে কুমিরা গিয়ে একটু খোঁজখবর করি। শিবুর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সাথে সাথে ঝন্টু আর অটলকে ফোনে জানাল বিষয়টা। অটল ধীরস্থির ভাবে বলল,বিষয়টা আমরা ছয় বন্ধু ছাড়া আর কাউকে জানাস না। পারলে তুই আর ঝন্টু এখনই রওনা হয়ে যা। আমি বিকাশে তোর নাম্বারে টাকা পাঠাচ্ছি।

কুমিরা সমুদ্র ঘাট খুব জমজমাট। এখান থেকে হাতিয়া,সন্দীপ দ্রুত যাতায়াত করা যায়। প্রচুর মানুষের আনাগোনা এই জলপথে। এখান থেকে চট্টগ্রামে প্রবেশ মুখ পর্যন্ত বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বিশেষকরে পুরনো জাহাজ ভাঙা পণ্যের বিশাল কারবার। লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে একমাত্র রাজনৈতিক নেতা আর বিখ্যাত কোনো নাটক সিনেমার নায়ক  ছাড়া সাধারণ কোনো মানুষকে কেউ নজর করে মনে রাখার কথা নয়। তবে একটা ভরসা, নৌকাডুবি বা ঘুর্ণিঝড়ে অনেক মানুষের জীবিত বা মৃত ভেসে আসার ঘটনা এখানে অনেক ঘটেছে অতীতে। সেই ক্ষীণ ভরসা বুকে নিয়ে ঝন্টু আর শিবু ঘাটের আশেপাশে প্রচুর অনুসন্ধান চালাল।

এই কয়েকমাস ঘুর্ণিঝড় বা নৌকা ডুবির কোনো ঘটনা হয়নি তাই হতাশ হয়ে ওরা ফিরে আসার চিন্তা করছে। একটা চা এর দোকানে একটু জিরিয়ে নেবে বলে বসল। কথাপ্রসঙ্গে দোকানদার বললো, পনের বিশ দিন আগে আপনাদের বর্ণনা মত লম্বা একটা লোক, অনেকটা ফকির মিসকিন টাইপের, আমার এখানে দেখেছি মনে পড়ছে। লোকটা ইঙ্গিতে আমার কাছে খাবার চেয়ে খেয়েছে। মুখে কোনো কথা বলতে শুনিনি। হয়তো বোবা, আবার সাধক দরবেশও হতে পারেন। মাঝেমধ্যে সেরকম লোকও আমরা দেখি। বারো আউলিয়ার দেশ এই চট্টগ্রাম, এখানে এরকম কতজন যে ঘুরে বেড়ায় তা কি আমরা বুঝতে পারি ?

কথায় কথায় দোকানদার মারফতি লাইনে চলে যাচ্ছিল। আপাতত আধ্যাত্মিক লাইনে জম্পেশ আড্ডা মারার কোনো ইচ্ছা নাই ঝন্টু বা শিবুর। কথা লাইনে আনার জন্য শিবু তাড়াতাড়ি বলল,আচ্ছা দাদা, লোকটাকে শেষপর্যন্ত  কোনদিকে যেতে দেখেছেন ?  দোকানদার গভীর একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,সেকি আর আমার মতো লোকের চোখে পড়ে ভাইজান !  তবে যতটুকু মনে হয় লোকটাকে চট্টগ্রাম শহরের দিকেই হাটতে দেখেছি।

সাধারণত পাগল বা ফকির টাইপের লোকগুলো ঘুরেফিরে বাজারঘাট বা লোকালয়ের কাছাকাছি থাকে। ক্ষুধা যার আছে সে তো খাবার পাওয়ার সম্ভাব্য স্থানেই থাকবে। ক্ষুধার্ত মানুষ রাজা বা ফকির যে ই হোক না কেন সব সমান। ঐ চা এর দোকানে এক বয়স্ক লোক একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তাঁর কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তাঁর মতে, লোকটা পাগল বা ফকির দরবেশ নয়। কোনো কারণে সে বাক ও স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে। তবে হয়তো কিছু স্মৃতি এখনও রয়েছে, তাই সে হাঁটছে চট্টগ্রামের দিকে। পথ ভুলে এদিক সেদিক চলেও যেতে পারে। আপনারা বরং তথ্যগুলো পুলিশকে জানান। তারা চাইলে একদিনেই লোকটার খোঁজ বের করতে পারবে। ভদ্রলোকের কথা ফেলনা নয় কিন্তু লোকাল থানা কেইসটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। তাদের জানাতে গেলে আবার যদি উল্টো কিছু হয় তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে বন্ধুরা। বলাতো যায় না পুলিশ যদি তাদের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে সন্দিহান হয়। তারচেয়ে ওরা ছয় বন্ধু দুভাগে ভাগ হয়ে দীনুকে খুঁজতে বের হলো। ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের আশেপাশে প্রচুর মন্দির, মাজার। কেন যেন ওদের মনে হলো দীনু তেমন কোনো ধর্মশালায় আশ্রয় পেতে পারে। বারো আউলিয়ার মাজার,সীতাকুণ্ড মন্দির, কৈবল্যধাম, এরকম প্রসিদ্ধ মাজার মন্দির প্রাঙ্গণে অনেক অনাথ মানুষ পরমপিতার কৃপায় বেঁচে থাকে।

অটলের মনে হলো চট্টগ্রামে ‘ মানবিক পুলিশ ‘ নামে পুলিশের একটা ইউনিট আছে। তাদের জানালে হয়তো কোনো সাহায্য পেতে পারে। ওদের ফেইসবুক পেইজের ইনবক্সে  বিষয়টি জানাতেই উনারা ফোনে আশ্বাস দিলেন সহায়তার,এবং দীনুর কয়েকটা ছবিও চেয়ে নিলেন। সাধারণ মানুষের অনুসন্ধান আর ট্রেইনড কোনো ইউনিটের অনুসন্ধানে তফাৎ তো থাকবেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন বন্ধুরা ব্যর্থ, তখন মানবিক পুলিশ তাদের কাছে একমাত্র ভরসা ।

নদীর পাড় ঘেষা গ্রাম। শতবছরের পুরনো একটা লোহার সেতু শহর আর দীনুদের গ্রামটাকে পরম মমতায় যেন বেঁধে রেখেছে। মূলত রেলসেতু হলেও সারাদিনে রেল চলে দু’চার বার। তাই সেতুটা  সড়ক পথ হিসেবেই ব্যবহার হয় বেশি। সেতুটার উভয় পাশে কিছুদূর পরপর বক্স এর মতো জায়গা রাখা হয়েছে। যাতে রেলগাড়ি বা বড় কোনো গাড়ি সেতু পার হতে থাকলে সেতুতে পায়ে হেঁটে চলা লোকজন নিরাপদে সেইসব রেলিং ঘেরা জায়গায় আশ্রয় নিতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় আশ্রয় নেওয়া লোকের চেয়ে আড্ডা মারা লোকজনই বেশি। বিশেষকরে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নদীর মিঠে হাওয়ায় আড্ডারুর অভাব হয় না এখানে।

কয়েকদিন ধরে সেতু মেরামতের কাজ চলছে। রেললাইন সম্প্রসারিত হবে কক্সবাজার পর্যন্ত। তাই এক সপ্তাহ গাড়ি চলাচল বন্ধ। অবশ্য লোকজনের হেঁটে পারাপার হতে বাধা নেই। অটল আর পানু অফিস শেষে বাড়ি ফিরছে। পথেই শিবুর সাথে দেখা। ও শহরে এসেছিল মোটরসাইকেল সারানোর কোনো কাজে। প্রায়ই আসতে হয় তাকে। সাধারণত তার পুরনো মোটরসাইকেলেই আসাযাওয়া করে, কিন্তু এখন সেতু বন্ধ বলে লোকাল কোনো গাড়িতে এসে হেঁটে সেতু পার হবে। বন্ধুদের দেখা পেয়ে একসাথে কথা বলতে বলতে ওরা হাঁটছিল সেতুর ওপর।

সন্ধ্যার অন্ধকারে নিচে নদীতে জেলে নৌকাগুলোর টিমটিমে আলো অদ্ভুত এক মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। জাল পেতে কেউ কেউ বাঁশি বাজায়,আবার কারও কন্ঠে শোনা যায় প্রাণজুড়নো গান। মাগরিবের আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এখন নদীর উত্তর পাড়ের মন্দির থেকে মাইকে ভেসে আসছে কৃষ্ণ নাম। সেতুর মাঝামাঝি এসে ওরা তিন বন্ধু থমকে দাঁড়াল। সেতুর সাইট বক্সে লম্বা মতো একটা লোক একা দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ দিকে মুখ করে। লম্বা চুল দাড়ি, ময়লা জামা কাপড় সবকিছু ছাড়িয়ে শৈশবের বন্ধু দীনুকে চিনতে ওদের কারুরই একটুও ভুল হলো না। শিবু চিৎকার করে উঠল  দী- – নু- –  লোকটা হঠাৎ ওদের দিকে ঘুরে দূর্বল স্বরে একবার বলল জয় মা – তারপর লুটিয়ে পড়লো বক্সের ভেতর।

পরদিন কত কী ঘটে গেল!  থানা-পুলিশ, মেম্বার- চেয়ারম্যান, প্রেস, মিডিয়া সে এক বিশাল কান্ড। এতদিন যারা দায়সারা ভাবে নিজেদের দায় সেরেছেন, উনাদের দাপটেই এখন দীনুর কাছেও ভিড়তে পারছে না স্বজনরা। নিশ্চিত মৃত ধরে নেওয়া কোনো মানুষ যখন অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় প্রায় দুই-তিন মাস পর নিজভূমে ফিরে এসেছে, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক, ঐশ্বরিক ব্যাপার আছে। এই ধারণা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। মিডিয়া নানারকম গল্প এরমধ্যেই ছেড়েছে। বাজারে খাচ্ছেও খুব খবরগুলো। ফায়দা তো আছেই, নয়তো ওরা এমন উঠেপড়ে লেগেছে কেন ! শেষ পর্যন্ত দীনুর বউ ফুঁসে উঠায় সবাই পিছু হঠতে বাধ্য হলো।

ভাসানের সেই মুহূর্তে দীনু ঠিকই চাপা পড়েছিল বিশাল প্রতিমার কাঠামোর নিচে। পড়ার সময় মাথায় শক্ত কিছুতে আঘাতও পেয়েছে। তার মনে আছে ঐটুকু। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে তখন মাথার উপর শরতের শিউলি ফোটা আকাশ দেখে। কিন্তু মুখে কোনো শব্দ করতে পারে না। প্রতিমার দশ হাতের কোনো এক ফাঁকে আটকে আছে সে। প্রবল স্রোতে কোনদিকে ভেসে চলছে কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। হঠাৎ তার মনে হলো,লতা মুঙ্গেস্করের মতো কোকিলকণ্ঠী কেউ যেন বলছে, ভয় কি বেটা আমি আছিতো সাথে,তুই ঘুমা বাবা। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।

বাড়ি ফেরার আগপর্যন্ত সেই অসাধারণ  কন্ঠ তাকে বারবার অভয় দিয়ে বলেছে, এগিয়ে যা – এগিয়ে যা – কালো পিচের রাস্তাটা তার খুব চেনা চেনা লাগতো।  হঠাৎ করে একদিন একটা নাম মনে পড়লো, কর্ণফুলী। কিন্তু সে বসে আছে সমুদ্রের পাড়ে। কেন ! কেন ! কেন ? ভাবতে ভাবতে এলোমেলো পা বাড়ালো সে। ভেতর থেকে আবার সেই কোকিলকণ্ঠী সাহস দিয়ে চলছে ক্রমাগত।

সময়ের সাথে সাথে সাড়াজাগানো কত ঘটনা এক সময় থিতু হয়ে আসে। সংসার আর নিত্যকর্ম  মানুষকে কতকিছু ভুলিয়ে রাখে। অবশ্য ভুলিয়ে রাখে বলেই মানুষের জীবন এত গতিশীল। দীনুও একসময় সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। ওরা সাতজন ছন্দে ফিরল সপ্তপদীর সুরে। তবে একটা দারুণ পরিবর্তন ঘটলো ওদের সেই জংলা ডেরায়। নিত্যদিনের তিন পেগের আসর এখন শুরু হয় এক বিশেষ আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সেবছর তোলা মা দুর্গার একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে ডেরায়। ওদের ডেরা এখন গ্রামের সবাই চেনে। কিন্তু দীনুর ফিরে আসার পর ওর প্রতি লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। সবার ধারণা, ওর মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ ঘটেছে। তাই লোকজন এখন ওদের ঘাঁটাতে সাহস পায় না।  সাতটা গ্লাস আগে মায়ের চরণে নিবেদন করে প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে প্রসাদ গ্রহণ করা হয়। গোল্লা এই সময়টায় চোখ বুঁজে হয়তো তার খোদাকে ডাকে, মুখে কোনো শব্দ করে না। তারপর ছয়জন কালীবাড়ির কীর্তনে যোগ দেয়। আর  গোল্লা গুনগুনিয়ে একটা বাউল গানের সুরে মন মজিয়ে  বাড়ির পথ ধরে –

” জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি – – –

আমরা বহু নামে ধরাধামে, কত রকমে ডাকি ।। “

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Bhupendra
Bhupendra
3 years ago

খুব সুন্দর লিখেছেন দাদা।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse