সরযূর বুকে সূর্যের আলো

১.

বে কি পিতার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ভুল করেছি? কিন্তু…কিন্তু… কী করার ছিল আমার!” দিগন্তে ডুব দিতে তোড়জোড় শুরু করা সূর্যটার দিকে চেয়ে দমবন্ধ ভাবটা যেন ফিরে এল তাঁর। কী ভেঙে পড়া হতচ্ছাড়া চেহারা হয়েছে সূর্যটার! আর দৌঁড়চ্ছে যেন শরবিদ্ধ কোন সৈনিকের মত কাৎরাতে কাৎরাতে! পিঠ দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তের স্রোত বীভৎস সব রেখা তৈরী করেছে আকাশ জুড়ে।

আজানের কিছুটা দেরি থাকায় তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন মসজিদের সামনে। তাঁকে ঘিরে থাকা লোকজনও দাঁড়িয়ে পড়েছিল একইসাথে, যদিও তাদের চোখ বাদশাহের মতো আকাশপানে ছিল না; তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল সামনের বিশাল প্রান্তরটি যার কেন্দ্রভাগে রয়েছে পায়রার খোপের মত অগণিত ছাউনি। সিপাহিদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নড়াচড়া থেকেই যেন তারা আঁচ করে নিতে চাইছে অনেক কিছু। তিনটে দিন ধরে সরযূর দুই পার ভয়ংকর রকমের শান্ত হয়ে রয়েছে, বারুদ জ্বলে ওঠার পূর্বমুহূর্তে যেরকমটা হতে দেখা যায়। যদি সন্ধির শর্ত এতটুকু ঝুলে যায়, তাহলে দপ করে জ্বলে উঠতে পারে আগুন, শুরু হয়ে যেতে পারে রক্তের হোলিখেলা।

কঠিন ছিল বটে শর্তগুলো, সম্মানকে একপ্রকার জলে ভাসিয়ে দেওয়ারই নামান্তর ছিল; কিন্তু পার্থিব যশ ও সম্মানের মোহ কবেই বা ছিল বুঘরা খাঁর! পিতার অসুখের খবর পেয়ে এই তিনিই তো ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লি, প্রাণ দিয়ে সেবা-যত্ন করে যাচ্ছিলেন মৃত্যুশয্যায় থাকা পিতার। একদিন শিয়রে বসে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে যখন ঝিমুনি এসে গিয়েছিল, ঠিক তখনি চোখ খুলে যায় একটি অন্তর্ভেদী শব্দে। দেখতে পান, ডুকরে ডুকরে কাঁদছে একজন বাদশাহ সারা পৃথিবী যার নামে কেঁপে ওঠে। বুঘরা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে গেলে সুলতান বলবন চেপে ধরেছিলেন সেই হাত তার বুকে, আর পেশ করেছিলেন এক হৃদয়ভাঙ্গা আর্জি, “পুত্র, এই আমার শেষ অনুরোধ… এই বৃদ্ধ ছেলেটিকে এবার মুক্তি দাও!”

কোন কথা যোগায়নি বুঘরার মুখে। শুধু টলটল করে গড়িয়ে পড়েছিল অশ্রু যা ভিজিয়ে দিচ্ছিল পিতা-পুত্র দুজনকেই। সাদা পিরানে তৈরি হচ্ছিল টুকরো টুকরো হ্রদ। এক সময় দু’চোখ বুজে এসেছিল সুলতান বলবনের- সেখানে অদ্ভুত এক শ্রান্তি। এদিকে নিদ টুটে গিয়েছিল বুঘরার- এমন কঠিন রাত আর আসেনি তাঁর জীবনে! বড়োভাই মুহাম্মদ মঙ্গোলদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারানোর পর থেকে যে আশংকা ঘিরে ধরেছিল তাঁকে, আজ তা-ই যেন ফণা তুলেছে আর ছুটে আসছে তাঁকে গিলে খেতে।

দিল্লির নয়ন-মনোহর গম্বুজের তলে যুবরাজ বুঘরার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়তো। সাপের থেকেও পেঁচানো এর প্রাসাদ, ভয়ংকর কুটিল এর খিলান। এদিকে যে খেয়ালী ও আত্মভোলা যুবরাজকে নিয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না, সেই তাঁকেই তিনি পাঠালেন বাংলায়, যাঁর বিদ্রোহের ঘনঘটায় অষ্টপ্রহর শংকিত থাকতো দিল্লির দরবার। ফরমানটা জারি হওয়ার পর থেকেই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন বুঘরা। কী জানি কোন অচেনা মুল্লুকে তাঁর বলি হতে যাচ্ছে! কিন্তু যতই এগিয়ে আসছিল একটি নদীবিধৌত সবুজ অঞ্চল, মন-প্রাণ জুড়িয়ে আসছিল বুঘরার। মনে হচ্ছিল, এতদিন বুঝি এর অপেক্ষাতেই ছিলেন। বাংলার প্রকৃতি ছিল খেয়ালি- এমন ঘনঘোর বর্ষা, এমন অঝোর ধারায়, এক টানে, এক সুরে- আর কোথাও দেখেননি বুঘরা। খেয়ালী বাংলা ও বুঘরা হয়ে উঠলো হরিহর আত্মা। আজ সেই আত্মাকেই ছেড়ে দেওয়ার কাতর আহ্বান উঠে এসেছে পিতার কণ্ঠে। কিন্তু কী করে সম্ভব! কী করে!

সারারাত যুদ্ধ করেছিলেন বুঘরা নিদ্রামগ্ন পিতার শিয়রে বসে। বিদ্রোহী তুঘরল খাঁকে দমনের পর পিতা যখন একটি অতিকায় অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করেন বুঘরাকে, তখন কিছু গুপ্তচরও রেখে যান তাঁকে চোখে চোখে রাখতে। কিন্তু দিল্লির চোখের উপর দিয়েই তো তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়াতেন বাংলার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে। দিল্লির সোনায় নির্মিত প্রাসাদে বসে থাকলেও বাংলা তাকে দু’বাহু বাড়িয়ে ডাকছিলো, কাতর আহ্বান জানাচ্ছিলো তার সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে বসতে। এক সময় পিতার আহ্বানের কথা আর খেয়ালই থাকলো না বুঘরার। ভোরের আলো ভালো করে না ফুটতেই বেরিয়ে পড়লেন দেশের পথে। হ্যাঁ, বাংলাই তাঁর দেশ, না জন্মেও যার সাথে বাঁধন তাঁর জন্মান্তরের।

২.

আজকের রাতটা সেদিনের থেকেও যেন কঠিন মনে হচ্ছে বুঘরার। মাগরিবের জামাত শেষে সৈন্য শিবির যতটা পেরেছেন ঘুরেছেন। শত শত মাইল পেরিয়ে এলেও সিপাহিদের চোখে মুখে কোন ক্লান্তির চিহ্ন নেই। দিল্লির পরাশক্তির সাথে লড়তে হতে পারে জেনেও তারা ভীত নয়। সেনাশিবির চাঙ্গা করে তোলে বুঘরাকে; অথচ আজ সকালে অমাত্যদের জেরার মুখে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে মন্ত্রীরা জানতে চেয়েছেন অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। হ্যাঁ, দিল্লীর শাসক কায়কোবাদকে সঠিক পথে ফেরানোর কথা নিজে থেকেই বলেছেন সুলতান কিন্তু একজন সম্রাটকে নসিহত করতে এত বড় বাহিনী নিয়ে আগমন! খুবই বালখিল্য নয় কি?

সভাসদের দিকে নির্বাক চেয়ে থেকেছেন শুধু বুঘরা। পুত্রকে শেষ যে চিঠিটি দিয়েছিলেন তাতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল। কিন্তু তারপরেও তো কর্ণপাত করেনি সে! বুঘরা নিশ্চিত উজির নিজামউলমুলকই কলকাঠি নাড়ছেন নেপথ্যে। হয়ত তাঁর লেখা সতর্কবাণীগুলোকে বিকৃত করে ব্যাখ্যা করেছে সে, আর তা-ই বিনা প্রশ্নে গিলেছে তাঁর সতেরো বছরের ছেলে! এমনো হতে পারে চিঠি পৌঁছানোই হয়নি কায়কোবাদের কাছে। আর এই ছলচাতুরী ধরতে পারার কোন সুযোগই ছিল না দিনরাত নেশায় ডুবে থাকা দিল্লির বাদশাহের। একটা তীব্র ব্যথার শর বিদ্ধ করতে থাকে বুঘরাকে! পিতা সুলতান বলবনের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া ফরমান অনুসারে ভাইপো কাইখসরুরই মসনদে বসার কথা। কিন্তু তাকে হত্যা করে কায়কোবাদকে ক্ষমতায় বসানোর খবর এসে পৌঁছুলো যখন, চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলেন বুঘরা। তিনি জানতেন, এ অন্যায়! ভীষণ অন্যায়! যে মসনদ তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন, তা যেন তাঁকে ছাড়লো না। তারই রক্তের রূপ ধরে সবকিছু গ্রাস করতে সে ছুটে আসছে প্রবল বেগে।

একটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন বুঘরা। ভারী চোখ দুটো চলে যায় সরযূর ওপারে, একটা কালো চাদরে মুড়ে রয়েছে যার সারাদেহ। বড় ইচ্ছে করছে তার শিশুপুত্রকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। কিন্তু কায়কোবাদ তো আর একা নেই… কত মানুষ ঘিরে রয়েছে তাকে! একটা দীর্ঘশ্বাস ঝড়ের বেগে ঝাপটাতে থাকে একটুখানি পথ খুঁজে নিতে রক্তমাংসের সরু নালীর মধ্যে। কায়কোবাদ মসনদে বসেছে বটে, কিন্তু বুঘরা ভাল করেই জানতেন সাম্রাজ্য পরিচালনা করবে ষড়যন্ত্রকারীরা। তবে যা ঘটছে, তা তার আশংকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। দিল্লির বাতাস শুকিয়ে গেছে অত্যাচারের পোড়া গন্ধে, কান পাতলেই শোনা যায় অসহায় প্রজাদের হাহাকার আর বুক চাপড়ানি।

এভাবে আর কিছুদিন চললে সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে। বুঘরার মানসচক্ষে ভেসে উঠলো, কায়কোবাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রাখা হয়েছে দিল্লির রাস্তায়। আরও অসংখ্য নারী-পুরুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে খন্ডিত দেহ আর মস্তকে। কেঁপে উঠে দু’চোখ ঢেকে ফেলেন বাংলার সুলতান। তারপর সোজা জায়নামাজে লুটিয়ে পড়েন। বেশিক্ষণ সিজদায় পড়ে থাকতে হয়নি, রাতের রেখা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নির্দেশ চলে এসেছিল। অনুচরবর্গ দেখতে পেল বুঘরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন মন্ত্রণাসভায়, ‘প্রস্তত হোন সবাই। সময় নেই, দিল্লি যেতে হবে।‘

রাত্রি দ্বিপ্রহর হয়েছিল। প্রবল একটা হাওয়া ওলট-পালট করে দিচ্ছিল সরযূর বুক। বুঘরার ঘুমে মুদে আসা চোখে এক সময় মহাসাগর মনে হতে থাকে সরযূকে। আর একটা অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে আসে তার কণ্ঠ থেকে। কী জানি, কী করছে এখন চক্রান্তকারীরা তার পুত্রকে নিয়ে। তিনি জানেন, তাঁর বালক পুত্র নির্দোষ, তাকে নষ্ট করা হয়েছে। আর তাইতো তিনি ছুটে এসেছেন বাংলা থেকে। এ কথা আর কেউ জানে না। কিন্তু তিনি তো জানেন, স্বয়ং খোদা-ই তার পিতা বলবনকে পাঠিয়েছিলেন তিনি যখন বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন জায়নামাজে। কায়কোবাদকে শয়তানদের অভিশপ্ত ছোবল মুক্ত করা গেলে যে দিল্লিও মুক্ত হবে! রক্ষা পাবে সাম্রাজ্য। শান্তি নেমে আসবে প্রজার ঘরে।

৩.

রাত শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। বাংলার সুলতান বুঘরা কাঠের সিঁড়ি অতিক্রম করে উঠে এলেন কাছেই বানানো একটি উঁচু পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে। নদীর ওপারে দেখতে পেলেন শত শত বিন্দু। বুঘরা জানেন ওরই একটিতে অবস্থান করছে তার পুত্র। আচ্ছা সেও কি তাঁর মতো দুশ্চিন্তায় সারারাত জেগে কাটাচ্ছে! না কি এখানেও মেতে রয়েছে মদ আর নর্তকী নিয়ে! বুকটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে।

বুঘরা জানেন, তাঁর অমাত্যদের মধ্যে এখনো চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। পিতার মৃত্যুর পর থেকে বাংলায় বুঘরার নামে মুদ্রা বের হয়, পাঠ হয় খোৎবা। বাংলা এখন আর দিল্লির অধীনস্থ না। তাহলে কেন দিল্লির বাদশার হস্ত চুম্বন করবে বাংলার সুলতান? কেন জানাতে হবে কুর্নিশ? বুঘরার মন্ত্রীদের রক্ত ফুটতে থাকে, তাদের স্বাধীন সত্তাকে যেন দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া হয়েছে। তিনদিন ধরে দূত চালাচালির পর যখন ওপার থেকে শর্ত এল, শাহি কানুন মানা হলেই কেবল দুই সুলতানের সাক্ষাৎ সম্ভব, তখন বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছিলেন বুঘরা।

ভোরের প্রথম আলো আস্তে আস্তে পর্দা উন্মোচিত করছিল বিশ্বচরাচরের। একটু একটু করে কেন জানি পিতা গিয়াসউদ্দিন বলবনকে মনে পড়ছিল বুঘরার। প্রজাসাধারণের মর্যাদা রক্ষা করা, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ন্যায়বিরুদ্ধ কাজ না করা, সংসারের মায়া ত্যাগ করে ঈশ্বরের আশ্রয় নেয়া মহাপুরুষদের সান্নিধ্যে থাকা– এমন আরো কত উপদেশ তাঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন তার জান্নাতবাসী পিতা। সেই উপদেশগুলিই তো তাকে একজন দায়িত্ববান নৃপতি বানিয়েছে, প্রজাসাধারণের কাছে করেছে জনপ্রিয়। আজ সেই উপদেশগুলো তিনি তাঁর পুত্রকে দিয়ে যাবেন। এতে যদি তাঁকে পুত্রের ভূমি চুম্বন করতে হয়, মাথা নত করে সেলাম করতে হয় তাকে, নির্দ্বিধায় করবেন তিনি। এতে যদি তাঁর সম্মান যায় তো যাক। ব্যক্তিগত সম্মানের কথা কবেই বা ভেবেছেন তিনি।

৪.

১২৮৮ সালের একটি রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল। সরযূ নদীর দুই পার গিজগিজ করছে সমরসাজে সজ্জিত অগণিত সৈন্যে। পশ্চিম পারে অবস্থান নিয়েছে পুত্র কায়কোবাদের নেতৃত্বে দিল্লির রাজকীয় বাহিনী। পূর্ব পারে টগবগ করে ফুটছে সুদূর বাংলা থেকে ছুটে আসা পিতা বুঘরা খাঁর নেতৃত্বে অশ্ব, হাতি ও পদাতিক মিলে গড়ে তোলা এক দুর্বার সেনাদল।

নদী পার হয়ে দিল্লির সুলতান কায়কোবাদের অস্থায়ী দরবার কক্ষে প্রবেশ করলেন বাংলার সুলতান বুঘরা খাঁ। দু’পারের অগণিত সৈন্য আপাদমস্তক সন্ত্রস্ত হয়ে রইলো। তারা জানে, যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। মুহূর্তেই বেজে উঠতে পারে যুদ্ধের দামামা সরযূর বুকে ভেসে যাতে মানুষ ও জন্তুর গলিত দেহে, শকুনের মিছিলে ভেঙে পড়তে পারে এর নরম পাড়।

প্রাসাদের মধ্যে নিজ আসনে উপবিষ্ট কিশোর সম্রাট কায়কোবাদ। এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না, তার স্নেহপরায়ণ পিতা যে কিনা শৈশবে তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দূর থেকে চেয়ে দেখতো, সে-ই তার মসনদ কেড়ে নিতে এসেছে! কেমন যেন জড়োসড়ো দেখাচ্ছে কায়কোবাদকে। ঘনঘন চোখের পাতা পড়ছে। কিছুক্ষণ তাকাচ্ছে উজির নিজামের দিকে, কিছুক্ষণ পিতার দিকে। এক একটি মুহূর্তকে বছর মনে হচ্ছে কায়কোবাদের। ওদিকে দৃপ্তপায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন বুঘরা। তাঁর চক্ষুদ্বয় আর কারো দিকে নেই, সোজা কায়কোবাদের দিকে নিবদ্ধ। এক মুহূর্তের জন্যও সরছে না পলক। অদ্ভুত এক দৃষ্টি সেখানে!

একটা সময় থামলো বুঘরার সেই অভিযাত্রা কায়কোবাদের সিংহাসনের মাত্র কয়েক ফুট দূরে। বাংলা থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশাল এক বহর নিয়ে, তাও যেন থামল একই সাথে। দরবারে উপস্থিত সবাই বিষ্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে পিতা-পুত্রের দিকে। অপেক্ষার অসহনীয় প্রহর বয়ে চলতে থাকলে এক সময় দিল্লির উজির নিজাম একটা ইশারা করলেন দন্ডায়মান বুঘরা খাঁর প্রতি। সঙ্গে সঙ্গেই কায়কোবাদের সামনে দু’হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন বুঘরা। এরপর যখন নীচু হয়ে কুর্নিশ করতে যাবেন, তখন কী যেন হলো! মাথাটা স্থির হয়ে গেল আর সমবেত দর্শকেরা দেখতে পেলেন ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে শাহী কার্পেট।

এই সময়টা দরবারের সাথে সাথে পৃথিবীটাও থেমে গিয়েছিল। হঠাৎ বুঘরার মাথাটা নীচু হতে দেখলো সবাই– কোনো কিছু চমকে দিয়েছে তাকে। বুঘরার চোখ থমকে আছে তাঁর সামনে তৈরি হওয়া একটি অশ্রুনদীতে। তাতে জ্বলজ্বল করছে এমন কিছু ফোঁটা, যেগুলো নিশ্চিতভাবেই তাঁর নয়। বুঘরার নীচু মাথাটা এরপর উপরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখে ফুটে উঠলো তাঁরই মতো হাঁটু গেড়ে মাথা নত করে থাকা এক মানুষের ছবি। অর্ধেক পৃথিবীর বাদশার মতো দেখালেও বুঘরা জানে, এই কিশোর কেউ নয়, তাঁরই পুত্র, তাঁরই ধমনীর রক্তে গড়া।

মুহূর্ত আগেই গড়ে উঠেছিল যে অশ্রুনদী, তা শুকিয়ে যাওয়ার আগেই বুঘরা ও কায়কোবাদ জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। উপস্থিত সভাসদরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, বাংলা ও দিল্লি মিলে গিয়েছে, কিন্তু কোথাও কোনো সুলতানকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না আর। একজন পিতা ও একজন পুত্র গলা জড়াজড়ি করে আছে সেখানে। উপস্থিত দর্শকেরা নিজেদের আর সংবরণ করতে পারলো না। দরবারের কানুন উপেক্ষা করে হৈ হৈ করে উঠল তারা। হাততালি আর অট্টহাসির দমক মুহুর্মুহু ঝংকার তুলতে লাগলো দেয়ালে। দরবারের বাইরে বেজে উঠল বাদ্য। সরযূর শান্ত জল অনেক দিন পর নেচে উঠল আনন্দে। সূর্যের অগণিত রশ্মি অপরূপ সব ফোয়ারা খেলে চললো সেখানে।

তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse