সহযাত্রী ও প্রত্যাশা
মিলন কুমার মুখার্জি
জানলার ধারের সিটটা পাওয়ায় ভালই হয়েছে l পাহাড় দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে l প্রকৃতির মুখ অনেক ভাল, কোন মুখোশ নেই l প্রকৃতি দেখার প্রকৃতি আমার কোনদিনই ছিল না l কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি দিন দিন যেরকম হয়ে যাচ্ছে তাতে একটু দড়ি-ছেঁড়া হওয়া নিতান্তই দরকার হয়ে পড়েছিল l ছোট সুটকেসটা সঙ্গে নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়েছিলাম l বেরোবার আগে নিয়ম রক্ষার্থে ব্রততীকে বলেছিলাম, কয়েকদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। ব্রততী টিভি দেখতে দেখতে ঘাড় নেড়েছিল l কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করেনি l প্রণব তখন নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিল l জেগে থাকলেও যে জিজ্ঞাসা করত, এমন মনে হয় না l মোবাইল, জিম আর বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা – এর বাইরে কোন কিছুতেই ওর উৎসাহ নেই l তবু মায়ের সঙ্গে একটু আধটু কথা বলে, কিন্তু বাবা ওর কাছে অস্তিত্বহীন, শুধু কলেজের ফীস ভরার সময় ছাড়া
চলে এসেছিলাম শিলিগুড়ি l একবার এখান থেকেই সপরিবারে গিয়েছিলাম গ্যাংটক, প্রণব তখন বছর চারেকের l তারপরে সে ভাবে ঘোরা হয়নি l ব্রততীর বুটিক, ছেলের পড়ার চাপ আর আমার ছুটির অভাব – কিছু না কিছু সমস্যা এসেছে আর বেড়ানো স্থগিত হয়েছে l শিলিগুড়ি ডিপোয় এই লজঝরে বাসটা যখন এসে দাঁড়ালো তখন দেখে মোটেই ভাল লাগেনি l সে যাবে জুকিয়ং বলে কি একটা জায়গায় l বাস গুমটির লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম জায়গাটা পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত একটা ছোট্ট অখ্যাত জনপদ l ফাঁকা জায়গা l যেতে প্রায় কয়েক ঘন্টা লাগবে l কেটে ফেললাম টিকিট l
ছোট ছোট লোকালয় পেরিয়ে বাস কখন যেন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে l বোর্ডে লেখা আছে – সেবক ফরেস্ট l উঁচু উঁচু গাছ, মাঝখান দিয়ে রাস্তা l এক এক জায়গায় জঙ্গল বেশ ঘন l সেবারেও এই রাস্তা দিয়েই গিয়েছিলাম l জঙ্গল দেখে প্রণব খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল l ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে কত প্রশ্ন তার “বাবা, এখানে বাঘ আছে? হাতি বেরোয়? বাস খারাপ হয়ে গেলে কি হবে? রাত হওয়ার আগে আমরা ফরেস্টটা পেরিয়ে যাব বাবা?”
ব্রততীও বলেছিল “কি দারুণ সিনিক বিউটি, না? নর্থ বেঙ্গলটা খুব সুন্দর!” ওর চোখে মুখে খুশির ঝিলিকটা ছিল খুব স্পষ্ট l এ রাস্তায় ওটাই ছিল ওর প্রথম বার এবং এখনও অবধি শেষ বার l বিয়ের আগে একবার দীঘা আর একবার পুরী গিয়েছিল মা-বাবার সঙ্গে l আর হানিমুনে মুকুটমণিপুর l মধ্যবিত্তর মধ্যম বৃত্ত l তখনকার সেই একাউন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট অনেক সাহস করে সপরিবারে বেরিয়ে পড়েছিল বড় ট্যুর গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে, গোনাগুনতি পয়সা নিয়ে l কিন্তু জার্নিটা খুব উপভোগ করেছিলাম, আজও স্পষ্ট মনে পড়ে l
আজ পাশের সিটে ব্রততীও নেই, প্রণবও নেই l কে একটা লোক বসে আছে l নোংরা নোংরা জামাকাপড়, উস্কখুস্ক চুল, কাঁচাপাকা না-কামানো দাড়ি, চোখে একটা হাই পাওয়ারের চশমা l কোলে একটা কাপড়ের ব্যাগ, বেশ বড় l কি একটা বই পড়ছে l লোকটা জানেও না, পাশের মানুষটা কত বড় কর্পোরেটের কান্ট্রিহেড l আমাদের কারোরই একে অন্যের প্রতি কোন উৎসাহ নেই l স্রেফ সহযাত্রী l কয়েক ঘন্টা পাশাপাশি বসে থাকা l তারপর যার যার স্টপেজে নেমে যাওয়া l দু-একদিন পরে স্মৃতি থেকেও গায়েব l
কখন যেন জঙ্গল পেরিয়ে গেছে l সঙ্গী হয়েছে একটা নদী, তিস্তাই হবে l চওড়া নদীখাত, কিন্তু সে তুলনায় নদীটাকে একদম লিকলিকে লাগছে l নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্রাক, কি জানি কী করছে! আগের বার নদী দেখে বলেছিল, “কি ছোট্ট নদী! দ্যাখো বাবা, যেন সরু সাপের মতl” সেবারে কিছু মানুষ নদীর ধারে বোধহয় পিকনিক করছিল l তাই দেখে প্রণব খুব খুশি, বলেছিল, “বাবা একবার পিকনিক কর না!” বলেছিলাম, “তিনজনে পিকনিক হয় নাকি? “ সঙ্গে সঙ্গে ও বলে উঠল,” দাদু-দিম্মা, বড়মামা, মামী, বোনু, ছোটমামা, মেজকা, ছোটকা,সন্টাই – সবাই থাকবে l” তখন আসলে সবাই আমাদের বাড়ি আসত l শোভাবাজারের সেই শ্যাওলাধরা ভাড়া বাড়িl সরু গলি দিয়ে গিয়ে ডানদিকের সাত নম্বর বাড়ি l কাঠের দরজায় কড়া নাড়ার কোন কমতি ছিল না l নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়িটাতে চায়ের জল সারাদিনই ফুটত l এখনকার মত পার্টি করার ব্যাপারটা ছিল অজানা l এমনকি ব্রততীও অনেক পরে কিটি পার্টি ব্যাপারটা জেনেছে l এখন অবশ্য ও-ই তার প্রধান উদ্যোক্তা l এখন আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কটা কমে এসেছে l কারণও আছে l সব্বার ধারণা, আমরা খুব বড়লোক, আর যার যা হবে তাকেই টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে l আবার টাকা ফেরৎ চাওয়াও চলবে না l আমাদের রোজগার তো দেখ, খরচটা কি দেখ? ফ্ল্যাটের মেন্টেনেন্স, দুটো গাড়ি, ছেলের টিউশন ফীস, তিনটে অভিজাত ক্লাবের মেম্বারশিপ, তিনটে কাজের লোক, দুটো ড্রাইভার, মান্থলি মেডিকেল চেক আপ, হেল্থক্লাব, এন জি ও-দের কন্ট্রিবিউশন… আরো কত কি! আরেকটা ব্যাপারও আছে – আমাদের সমাজের সঙ্গে এই পেটি মিডলক্লাস মেন্টালিটির লোকেরা মানিয়ে নিয়ে চলতেও তো পারবে না l
পাহাড়ী রাস্তা শুরু হয়ে গেছে l সরু আঁকাবাকা রাস্তা l এক পাশে উঁচু পাহাড়, অন্য পাশে ঢাল l ঢালে উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীচের উপত্যকা, নদী, ব্রিজ, ধাপচাষের ক্ষেত, গ্রাম l ছবির মতো l হাইট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাও বেশ বেড়ে গেছে l সুটকেশ খুলে হাফহাতা সোয়েটারটা বার করে পরে নিলাম l পাশের লোকটা মনে হল আড়চোখে একবার দেখল l সেবারে এই রকম উঁচুতে ওঠার সময় ব্রততীর শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল l মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব l আমার কাঁধের ওপর নেতিয়ে পড়ে ছিল l বেশ ভয়ও লাগছিল, খারাপও লাগছিল l আনন্দ করে বেড়াতে এসে এ কি কাণ্ড! কন্ডাক্টরটা ভাল ছিল, ব্রততীকে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে বলেছিল l প্রণব কুঁকড়ে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল l ব্যাগ থেকে বার করে ফুলহাতা সোয়েটারটা পরিয়ে দিয়েছিলাম l ছেলে তখন আরাম করে বসল l
নিলোপোখড়ি বলে একটা ছোট্ট জায়গায় বাস থেমেছে, লাঞ্চের জন্যে l ছোট ছোট দুটো থাপা হোটেল আর প্রধান ফুড পয়েন্ট। হোটেল মানে কাঠের ঘর, পেছনে পাহাড়ের ঢালে ওয়াশরুম l এইসব অস্বাস্থ্যকর জায়গায় খেতে আজকাল ভয় হয়, কিন্তু খিদে বড় বালাই! তাই থাপাতেই ঢুকে পড়লাম l লাঞ্চে আছে ভাত, ডাল, আলুভাজা, স্কোয়াশের তরকারি, পাঁপড় আর আচার l চিকেনও পাওয়া যায়, তবে আমি নিইনি l সেবারেও কোনো একটা ছোট জায়গায় বাস থেমেছিল l আমি আর প্রণব খেয়েছিলাম, ব্রততী খায়নি শরীর খারাপ বলে l আমিই প্রণবকে খাইয়ে দিয়েছিলাম l মনে পড়ে যাচ্ছিল l বাসের সহযাত্রীও আমার সামনের চেয়ারটাই দখল করেছে l নেপালিতে কিসব অর্ডার দিল l দেখতে নেপালিদের মত না হলেও, যেরকম গড়গড় করে নেপালি বলছে, তাতে মনে হয় নেপালিই হবে l
আমার মোবাইলে একটা কল এল, পার্সোনাল লোনের মার্কেটিং, বাংলাতে l না বললাম l এবার হঠাৎ সহযাত্রী বলে উঠল, “আপনি বাঙালি? স্পষ্ট বাংলা উচ্চরণ l বললাম, “হ্যাঁ, আপনি?” বলল “হ্যাঁ, আমিও l তবে প্রায় আট বছর জুকিয়ং-য়ে আছি l তা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” বড় গায়ে পড়া লোক! তবু ভদ্রতা রেখে বললাম, “জুকিয়ংl”
লোকটা বলল “বেড়াতে যাচ্ছেন? জুকিয়ং তো টুরিস্ট স্পট নয়, আর ওখানে তো অফিস-কাছারিও কিছু নেই”
ঔৎসুক্যর কারণটা বোঝা গেল l বললাম, “এমনিই চড়ে বসেছি বাসে l আমি এরকমই আনপ্ল্যানড ঘুরতেভালবাসি l আমি আসলে এরকমই l লোকটা বলল, “ইন্টারেস্টিং! আপনাকে দেখে কিন্তু বেশ পরিপাটি এবং ওয়েল প্ল্যানডই লাগে l” লোকটার নজর আছে! বললাম, “কী দেখে বুঝলেন?” লোকটা মুচকি হেসে বলল, “জামা প্যান্টে ইস্তিরির পাট পাট ভাঁজ আর সুন্দর করে গোছানো সুটকেস তো তাই বলে l যখন সোয়েটার বার করলেন, তখন সুটকেসটা এক ঝলক দেখতে পেলাম যে! যাই হোক, একটা কথা বলি, আপনাকে খুব অন্যমনস্ক দেখছি l জুকিয়ং-য়ে একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন l অনেক উঁচু এবং রাস্তাঘাটে রেলিং-টেলিং নেই l পাশে কয়েক হাজার ফুটের খাদ l সন্ধ্যের পর রাস্তাঘাট পুরো অন্ধকার হয়ে যায় l তাছাড়া মাঝে মাঝেই ভাল্লুক বেরোয় l অন্যমনস্ক হওয়ার খেসারত ভারী পড়বে l” বললাম, “আমি অন্যমনস্ক আছি, এটা আপনার কেন মনে হল?”
ভদ্রলোক বললেন, “রাস্তার দৃশ্য ভারি সুন্দর l যারা প্রথম বার আসে, তারা তো অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে l আপনার ভাসা ভাসা চোখে সে ভাষা ছিল না l”
বললাম, “আপনি তো বই পড়ছিলেন, আমার এত কিছু কখন নজর করলেন?” লোকটা বলল “যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে l আপনার মধ্যে একটা ডুয়ালিজম কাজ করছে l আপনি কিছু ভুলতে কিছু পেতে চাইছেন বলে আমার মনে হচ্ছে l” চমকে উঠলাম, এ তো ভয়ঙ্কর লোক! এর ধান্দাটা কী? বাবাগিরি না কি উঁচুদরের ফেরেব্বাজ? আমায় চুপ দেখে লোকটা বলল, “সরি, হয়তো একটু ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলে ফেলেছি, মাফ করবেন l”
নাঃ, দেখা যাক l আমিও গোটা ভারত জুড়ে লোক চড়াই! বললাম, “আরে না না, তেমন কিছু নয় l আপনার ব্যাপারটা কী? আপনি বাঙালি হয়ে সিকিমের এই ইন্টিরিয়রে থাকেন কেন? অবশ্য এটা একদমই ব্যক্তিগত প্রশ্ন, জানি না জিজ্ঞাসা করে উচিৎ করলাম কিনা!” লোকটা বলল, “আমার সেভাবে লুকোবার কিছু নেই l আপনি হান ফার্মার নাম শুনেছেন? বললাম,হ্যাঁ, ভারতের প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানি l ওদের শেয়ারও আছে আমার কাছে ; লোকটা হাসে, বলে, আমি ওখানেই চাকরি করতাম l এক সময় অফিসের আর বাড়ির চাহিদা মেটাতে মেটাতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল l শেষে ছেলে যেই দাঁড়াল, বাই বাই করে দিলাম কলকাতার বাড়িকে l চলে এলাম এই নিরালা জায়গায় l গ্রামের লোকগুলো ভারি ভাল, জানেন! বাচ্চাগুলোকে ফ্রী-তে পড়াই আর গ্রামের লোকগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোয় সাহায্য করি l কি ভালবাসা যে পাই, বলে বোঝাতে পারব না l” লোকটার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে l কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না l বললাম, “ বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই?” বলল, “মাঝে মাঝে যাই, নিয়মিত কিছু নয় l কি জানেন, এখন বাড়ির লোকেদের আমার কাছে বা আমার ওদের কাছে কোন চাহিদা বা এক্সপেকটেশন নেই l ফলে, রাগ, অভিমান, দুঃখ – এসবগুলো কমে গেছে l আবার এখানেও আমি স্থানীয়দের যে সাহায্য করি, তার জন্যে কোন প্রতিদান বা প্রশংসার প্রত্যাশা রাখি না l” এরই মধ্যে হোটেলের ছোকরা টাকা নিতে এল l টাকা বার করার সময় লোকটার পার্স থেকে কি যেন একটা কাগজ পড়ে গেল আমার পায়ের কাছে l নীচু হয়ে তুলতে তুলতে দেখলাম বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা বিজনেস কার্ড l তাতে লেখা আছে – কে সি রয়, সি ই ও (এশিয়া প্যাসিফিক),
হান ফার্মা। ঝটকা লাগল! অবাক চোখে আরেকবার দেখে নিলাম আধ নোংরা সাদামাটা পোশাক পরা লোকটাকেl কার্ডটা ওনার হাতে দিতে দিতে বললাম, “এটা পড়ে গিয়েছিল l এটা নিশ্চয় আপনার কর্ম জীবনের শেষ স্মৃতি”, ভদ্রলোক হাসলেন l বললেন, “আসলে জীবনে মোটামুটি খুশি থাকতে গেলে এক্সপেকটেশন কমাতে হবে আর একসেপ্টেন্স বাড়াতে হবে l অতীতকে আঁকড়ে ধরলে এক্সপেকটেশন বড় বেড়ে যায় l এখানকার জীবনে আমি এই শিক্ষাই পেয়েছি l” ঠিক তখনই বাসের হর্ন শোনা গেল l ভদ্রলোক বললেন, “চলুন যাওয়া যাকl”
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২