সিকিয়াঝোরার অন্দরে
তরুণ প্রামানিক
ডুয়ার্স মানে গহন বনানীর অপার নির্জনতার কুহকে ঢাকা মায়াবী চুপকথা। ডুয়ার্স মানে ঝকঝকে নীলাকাশের নিচে হলদেটে সবজে চায়ের বাগানের গালিচাআর নীলচে পাহাড়ের হাতছানি। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো শান্ত ও স্নিগ্ধ সে। আজ আমার ঝুলিতেগজরাজের পিঠে চেপে বন্য শ্বাপদে ভরা অসূর্যম্পশ্যা অরণ্যের গভীরে অবাধ বিচরণ নয় বরং এক অন্য অচেনা ডুয়ার্সের গল্প।
হেমন্তের বিদায় বেলায় বাতাসে সদ্য হিমেল ছোঁয়া।উচাটন মন ছুটে চলেছে দূরের নীলচে পাহাড়ের স্যালুয়েটে চোখ রেখে সিকিয়াঝোরা ইকোপার্কের পথে।
হাসিমারা স্টেশন থেকে প্রায় ২৫কিমি দূরে, ভৌগোলিক অবস্থানগত বিচারে এটি আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তর পানিয়ালগুড়িতে অবস্থিত। সিকিয়াঝোড়া একটি পাহাড়ি নদী, যা বক্সা জঙ্গলের পূর্ব দিকে দমনপুর রেঞ্জ আর পশ্চিম দিকে বক্সা টাইগার রিজার্ভ এর মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চুপিচুপি বয়ে গেছে জঙ্গলের একদম গভীরে। বেশ কয়েক কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বালা নদীতে। স্থানীয় মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত একটা সেলফ হেল্প গ্রুপ নদী পথে জঙ্গলের অপার সৌন্দর্য আর এডভেঞ্চার এর মজা নিতে ব্যবস্থা করেছে নৌকা সাফারির। বক্সা জঙ্গলের একদম গভীরের কিছু জায়গা পায়ে হেঁটে যেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়, এই নৌকা বিহারে সেখানে পৌঁছানো যায় অনায়াসে। ডুয়ার্সের আমাজন হিসাবে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে রোমাঞ্চকর এই সফর।
সঙ্গী সহযাত্রীদের মতো টিকিট কেটে নৌকোয় উঠে বসলাম আমরা চার বন্ধু, খাড়ি পথে নৌকা সাফারিতে আমাজনের রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে। টলটলে নদীর স্বচ্ছ জল, দু’ধারে বাদাবনের মতো ঘন বন দুপাশে রেখে এঁকে বেঁকে খাড়ির মত বয়ে গেছে গভীরে। এক অজানা রোমাঞ্চে মন নেচে উঠল। ছলাৎ ছল মাঝির দাঁড় বাওয়ার আওয়াজ সেই রোমাঞ্চকে বাড়িয়ে দিলো হাজারগুণ । চারপাশে জারুল, পানিয়াল, চিকরাশ, পানিসাজ, কদম, লালি আর নাম না জানা অজস্ৰ গাছের সারি। খানিক এগোতেই শাপলা পাতায় জলফড়িংএর লাফালাফি দেখে মনের আতঙ্ক খানিকটা প্রশমিত হলো। আসলে অচেনা জায়গায় চেনা জিনিসের দেখা মিললে বাঙালি মনে খানিক স্বস্তি জাগে।
নৌকা বামদিকে বাঁক ঘুরতেই সকালের নরম রোদটা হঠাৎ করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম জঙ্গলের আরো গভীরে প্রবেশ করেছি। কুয়াশা জড়ানো শীতের সকালে নদী পথে জঙ্গলের একদম গভীরে সূর্য বড় অভিমানী। ঝিম ধরা কুয়াশা ঘনিয়েছে নদীর বুক জুড়ে। সেই কুয়াশা পেরিয়ে হিলহিলে হাওয়া এসে নদীর অন্য পাড়ের গল্প বলে। কতরকম পাখির ডাক কানে আসে। কতক বুঝি, বেশির ভাগটাই বুঝি না। জলে ভেসে থাকা পানকৌড়ি নীরবতা ভঙ্গ করে ঝটপট করে উড়ে যায় দূরে। আস্তে আস্তে বয়ে চলেছি আমরা ক্লোরোফিলের গন্ধ গায়ে মেখে সবুজ আরো সবুজের গভীরে। মাথার উপর সুনীল শামিয়ানা, নিস্তব্ধ সকালে নিঃসঙ্গ চিল আর এক ঝাঁক সবজে টিয়াদের ওড়াউড়ি। প্রকৃতি এখানে বাতাসের সাথে কথা বলে। মেঘ আর পাখিদের দল সেই বাতাসের ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায়। একটা ভালোলাগার আবেশ গ্রাস করে ক্রমশ। কী নিবিড় শান্তি ! অনাবিল এক প্রশান্তিতে মন ভরে যায়।
সহসা একটা বাঁক ঘুরতেই মনে হল জঙ্গলের বাদাবনের ফাঁক দিয়ে কারা যেন অনেকক্ষণ থেকে অনুসরণ করে চলেছে আমাদের। মুখ তুলে দেখলাম দু’পাশ থেকে বড় বড় ডাল নুইয়ে নদীর মাঝখান অবধি চলে এসেছে। সেই ডালের ছোঁয়া বাচিয়ে এঁকে বেঁকে কোনো মতে চলেছি আমরা। গাছের ডালে মাঝে মাঝেই নাকি পেঁচিয়ে থাকে ছোট বড়ো সব সাপ। শুনলাম প্রায়ই নাকি বন্য জন্তুরা বন থেকে বেরিয়ে এসে নদীতে জল খেতে আসে। মাঝি আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তর্জনী উচিয়ে দেখালো কালকেই একদল দানবাকার দাঁতালের দল সারবেঁধে ঢুকেছে নদীর এ পাড়ে। তাদের পায়ের চাপে ভেজামাটির গর্ত আর আশেপাশের ধ্বংসের ছবি প্রত্যক্ষ করলাম আমরা। মুহূর্তেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল ,মাঝির নির্দেশে সবাই চুপ। শুধু নিঃশ্বাস আর বুকের ধড়ফড়ানির আওয়াজ। স্বচ্ছ নদী জলের নীচে জলজ অর্কিড সাপের মতো এঁকেবেঁকে উপরের দিকে উঠছে। দুই হাতে গাছের ডাল, লতা, পাতা সরাতে সরাতে মূল নদীর ধারের এক গভীর খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে পাড়ে এসে নৌকা আটকে গেল। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নেবে মাঝিরা। দিনের এই সময়টাতেও এখানে যেন জমাট বাঁধা অন্ধকার। চারপাশে বড় বড় গাছ থেকে জটার মতো শিকড় নেমে এসেছে নিচে। জঙ্গলের বুনো গন্ধ নাকে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। মাঝির হাজার বারণ সত্ত্বেও আমার দুই বন্ধু নৌকা থেকে লাফ দিয়ে ফোটোগ্রাফির নেশাতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলো। আনন্দ প্রকাশের এহেন আতিশয্য মনকে কিঞ্চিৎ পীড়া দিল। নৌকার উপর বসে বসেই দু’চোখ মেলে উপলব্ধি করলাম অসূর্যম্পশ্যা এই জঙ্গলের শিহরণ জাগানো রূপ, মাটির সোঁদা গন্ধ। কান পেতে শুনলাম পাতার মর্মর ধ্বনি, শন শন বেগে বাতাস বওয়ার ছন্দ, ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের বিরামহীন কোরাস।
ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগল না। ঊর্ধ্বশ্বাসে হঠাৎ ছুটে এল দুই ফটোগ্রাফার বন্ধু। পোশাকে কাদার দাগ, রক্তবর্ণ চোখ মুখে আতঙ্কের ছাপ। পড়িমরি করে উঠে বসলো নৌকাতে। দুহাত দিয়ে কী যেন বলতে চেষ্টা করল মাঝিকে! মাঝি কী বুঝলো জানি না। বিদ্যুৎ বেগে নৌকা বার করলো ওই খাঁড়ি থেকে। একটা চাপা আতঙ্কে তারও ঠোঁট দুটো কাঁপছে। বাকরুদ্ধ আমরা সবাই। খানিকটা ঘোলাটে জলের পথ পিছনে ফেলে রেখে পুনরায় পিছন ফিরে দেখি জঙ্গলের বড়ো বড়ো গাছগুলো ঝড়ের মতো জোরে জোরে দুলছে ,মনে হলো কোনো অতিকায় দানব যেন তাদের পিঠ দিয়ে গাছগুলোতে গা ঘসছে। দূর থেকে কানে এলো স্পষ্ট বৃংহণের সোল্লাশ, পাতায় পাতায় তা ধাক্কা খেয়ে জঙ্গলের গভীরে হিল্লোল তুলছে।
তারিখঃ জুলাই ৬, ২০২১