সিগারেট
মৌসুমী দাশগুপ্ত
We shall overcome
We shall overcome
We shall overcome someday
Oh! Deep in my heart
I do believe
We shall overcome some day…
জোয়ান বায়েজ এর অনন্য সোপরানো কন্ঠ ভরিয়ে তুলছে রাত্রির প্রথম যাম। ব্যালকনিতে রাতের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছিল অভি। বহু বছরের পুরোনো অভ্যেস, কমাতে কমাতে এখন দিনে একটায় এসে ঠেকেছে, কিন্তু একদম ছাড়তে পারছে না। হঠাৎ প্রমা পেছন থেকে এসে সিগারেটের গোড়াটা অভির হাত থেকে নিয়ে নিচে ছুঁড়ে দেয়।
“ডু ইয়্যু নো বাবা! দ্য ওনলি থিং ইয়্যু হ্যাভ টু ওভারকাম ইজ দিজ ঘাস্টলি হ্যাবিট! উই ডোন্ট লিভ ইন সিক্সটিজ, স্মোকিং ইজ নট ফ্যাশনেবল এনি মোর।”
“ইশ! ফেলে দিলি কেন? আরও অন্তত তিনটে টান দেওয়া যেত। ঘরের বাইরেই তো খাচ্ছি বাবা, তোদের কোন সমস্যা হচ্ছে না তো।”
“সমস্যা হচ্ছে না? হু সেইড দ্যাট? আমার খুবই সমস্যা হচ্ছে। এই যে সিগারেট খেয়ে খেয়ে তোমার হার্টের অসুখ হবে, ক্যান্সার হবে, তখন তোমাকে নিয়ে ডাক্তার, হাসপাতাল কে করবে? আমিই তো! তো এটা আমার সমস্যা না? আচ্ছা, কত কিছুই তো জয় করলে জীবনে, আর এই সামান্য একটা নেশা জয় করতে পারছ না?”
“কন্যাকে অভিরুপ সমঝে চলেন। কন্যাটি বড় মায়াবতী, কিন্তু শাসনে পটু। আর সত্যিই তো, এ বয়সে এসেও সিগারেট ছাড়তে না পারাটা লজ্জার। আসলে পারেন না এমনও নয়। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে করে না। সেই তো সারাদিন সবার চাহিদামাফিক, নিয়মমাফিক জীবন যাপন। সকালে ‘নাটস এন্ড ফ্রুটস’ আর কালো কফি, কাঁটায় কাঁটায় অফিস, দুপুরে সবজি, চিকেন, মুঠো মাপের ভাত, সময় মেপে বাড়ি ফেরা। সন্ধ্যেয় যোগাসন, টিভিতে খবর, জরুরী ইমেইল, ওটস আর ইয়োগার্ট, সব একদম মাপে মাপ। শুধু সব নিয়মতান্ত্রিকতা শেষে একটি বেহিসেবি সিগারেট তাঁর একান্ত একার, একদম নিজস্ব একটি জীবনের একমাত্র রূপক।
তা অভির জীবন কোনদিনই বা তার নিজের ছিল! সেই ছোট থেকে শুনে আসছেন, “বাবু, তোমার উপর তোমার বাবা মায়ের অনেক আশা। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে বাবা, তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে।” নতমস্তকে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছে কিশোর অভিরুপ, এর বাইরে অন্য কিছু সে নিজেও ভাবতে পারত না। বাবার রাতদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর মায়ের দৈন্যমাখানো আদরের মাঝে অভিরুপের সামনে একটাই সরল গন্তব্য ছিল। যেকোন মূল্যে যত দ্রুত সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড়ানো, বাবা মায়ের আশা পূরণ করে পরিবারের হালটি শক্ত করে ধরা। কিন্তু পাটিগণিতের সরল অংকের মতই সরল সমাধানে পৌঁছানোর পথটি সহজ ছিল না। দারিদ্র্য কাউকেই আসলে মহান করে না, বরং তাকে প্রতি পদে পেছনে টেনে রাখে, ছোট করে প্রতিনিয়ত। বন্ধুরা যখন গ্রীষ্মের বিকেলে ঘুড়ি হাতে মাঠে তখন গরমে ঘামতে ঘামতে অভি আধো অন্ধকার ঘরে নিজে নিজে পড়া বুঝে নেবার চেষ্টা করছে। বন্ধুদের হাতে পায়ে ধরে চেয়ে আনা নোটগুলো টুকে রাখছে। কখনও কখনও জানালার খোপে আটকে থাকা এক টুকরো আকাশটায় এক পলকে গোত্তা খেয়ে যাওয়া ঘুড়িটা চোখে পড়লে মন চেয়েছে বই খাতা ছুঁড়ে ফেলে এক ছুটে মাঠে চলে যেতে। কিন্তু যাওয়া হয়নি। অভি বড় ভাল ছেলে। চকিত চোখের আহ্বানে কাংক্ষিত সাড়া না পেয়ে নীরবে দূরে সরে গেছে তণ্বী তণিমা, পাড়ার সর্বাধিক আরাধ্যা তরুণী। অভির মন পুড়েছে কিন্তু সাহস হয়নি, সময়ও না। পড়া আর গৃহশিক্ষকতার মাঝে দোদূল্যমান জীবনে চিনেবাদামের প্রবেশাধিকার কই!
এমনকি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে যখন চাকরির পালা এল তখনও রাজধানীর আকর্ষণে সাড়া না দিয়ে অভি জেলা শহরেই থেকে গেল, কারণ অভির মা অভিকে দূরে যেতে দিতে রাজি হলেন না। একটি মাত্র ছেলে, মায়ের আঁচলছাড়া হলে মা বাঁচবেন কী নিয়ে! বাবা চলে গেলেন পড়ালেখার পাঠ চুকোনোর ঠিক আগে আগেই, যেন এই দায়িত্বপালনই তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অভি তখন আগের মত নতমুখ কিশোর নেই আর। সময়টাই যেন তখন অন্য রকম ছিল। পৃথিবীটা একটি বিশাল ফুলের মত পাঁপড়ি মেলছিল যেন। সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্প, জীবন, সবকিছুতেই তখন উদার মানবতাবাদের জয়গান। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণতা অল্পদিনের জন্য হলেও তখন মুখ লুকিয়েছে আপন কোটরে। জন লেনন তখনও গেয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁর বিখ্যাত সেই গান-
“Imagine there’s no heaven/ easy if you try/ no hell below us/ above us only sky…”
এই গানগুলোই যেন প্রথমবার অভির কানে কানে এসে বলে গিয়েছিল পরম্পরার বাইরেও একটা জীবন আছে, জীবন আছে রোজকার তেল নুনের হিসেবের বাইরেও। জানালার খোপের মাপ ছেড়ে আকাশটা কেবলই বড় হতে শুরু করেছিল। কোন কোন দিন তখন সে নিজেকে খুঁজে পেত সেই বিশাল আকাশের নীচে, একা এবং সম্পূর্ণ একজন মানুষ। কারও ছেলে, কারও ভাই, কারও ছাত্র নয়, আদর্শ সন্তান নয়, একজন ব্যক্তি মানুষ।
কিন্তু স্বপ্ন পাখা মেলবার আগেই টুপ করে বাবা চলে গেলেন। অভিই তখন সংসারের অভিভাবক। ধীরে ধীরে একে একে সব দায়িত্ব পালন করতে হল। চাকরির যোগাড়, বোনের বিয়ে, মায়ের চিকিৎসা, একসময় মায়ের অনুরোধ উপরোধে নিজের বিয়ে। দায়িত্ব একটা ফুরোলে আরেক তিনটা এসে পড়ে। মা চলে গেছেন বছর কয়েক হয়, প্রমাই এখন মায়ের ভূমিকা পালন করছে। আর পটভূমিকায় প্রমার মা, অভির অর্ধাঙ্গীনি সোমা সদা বিরাজমান। স্বামীসেবায় তাঁর ত্রুটি নেই কোন। ঘড়ির কাঁটার হিসেবে সেবা পেতে পেতে অভির নিজেকে কখনও কখনও ঠাকুরঘরের নাড়ুগোপাল মনে হয়। অমন অকৃতজ্ঞ চিন্তা ভাবনার জন্যে মনে মনে নিজেকে সে কষে ধমকেও দেয়। কোথা থেকে কোথায় এসে ঠেকেছে তার জীবন! সেই বরষাভেজা টালির ঘর আর ঘিঞ্জি পাড়া থেকে আজ এই বিশাল বাড়ি, তথাকথিত সাফল্য, সমৃদ্ধি, সুখের সংসার, কী নেই বলতে গেলে! নিজের মনে অভি জানে, ‘I have overcome all the hurdles’. তবুও কেন যে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে মাঝে মাঝেই! একঘেয়ে নিয়মের বন্দীত্ব থেকে একটুকুস মুক্তির জন্য মনটা আকুল হয়ে থাকে। রাতের খাবারের পর পুরোনো কিছু প্রিয় গান আর ঐ একটা বেহিসেবি সিগারেট অভিকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত তারুণ্যের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মন চায় চুপচাপ একটা ঝোলা কাঁধে বেড়িয়ে পড়তে। কিন্তু অভি জানে সে কখনোই হবার নয়। তাকে সেভাবে প্রোগ্রামিং করা হয়নি।
“Imagine no possession
I wonder if you can…”
জন লেনন জানত না সত্যিকারের দারিদ্র্য কাকে বলে, জানত না ভিখিরির দানে কোন গৌরব লেখা থাকে না। রাজকুমার সিদ্ধার্থের সংসার বিসর্জন আর যার তিনকুলে কেউ নেই, কিছু নেই তার সংসার বিসর্জন এক নয়। এই অভিই যদি এক ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে যায় সবকিছু ছেড়ে তাতে তার কোন গন্তব্যেই পৌঁছোনো হবে না। বরং তাকে পিছু টানবে প্রমা, সোমা, অনি, প্রায় হুবহু অভির আদল নিয়ে পৃথিবীতে আসা অভির ছেলে অনিকেত। অনির এখন সেই তরুণ বয়স যে বয়সে অভি নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু অনির মনের বয়স শরীরের সাথে সাথে বাড়েনি, সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। অভি জানে তার জন্যে নির্বাণ নয়, তার পৃথিবী এই সোমা, প্রমা, অনি-তেই মিশে আছে এবং থাকবে।
তবুও সেই একটি সিগারেট আর পুরোনো কিছু গানে মুক্তি খুঁজতে ভাল লাগে। কিন্তু সবার স্বাস্থ্যের অজুহাতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেও কেউ না কেউ তার পিছু পিছু আসবেই। মাঝে মাঝে অভির খুব রাগ হয়। তাঁর কি অধিকার নেই পনেরটা মিনিট নিজের করে পাবার? কেন তাঁকে অষ্টপ্রহর কাউকে না কাউকে সময় দিতে হবে! রাগটা তিনি নিজের মাঝেই চেপে যান, কিন্তু রাগটা তাঁকে ভেতরে ভেতরে কুড়ে খায়। অনেকগুলো ‘কী হত যদি’ তে তিনি অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকেন। কী হত যদি অভির জন্ম হত অবস্থাপন্ন ঘরে যেখানে জন্মেই জোয়ালের প্রস্তুতি নিতে হয় না! কী হত যদি বাবা ঐ সময় মারা না যেতেন! কী হত যদি অনি সুস্থ স্বাভাবিক হত! সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে গোপন – কী হত যদি অভিরুপ একটি দায়িত্বজ্ঞানশূন্য, ছন্নছাড়া মানুষের নাম হত!! সিগারেটের গন্ধ রাতের হাসনাহেনার গন্ধে মিশে যায়… মহার্ঘ সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসে –
“Give me one moment in time
When I am more than I thought I could be!
When all of my dreams are a heartbeat away
And the answers are all up to me…”
তারিখঃ জানুয়ারি ১৭, ২০২৩