সুনীল সাগরে

বর্ধমান বইমেলার সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেক স্বনামধন্য সাহিত্যিকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তাঁদের সাথে পরিচিত হয়ে, কথা বলে ঋদ্ধ হয়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। সেই ১৯৮৪ সাল থেকে এই মেলার সাথে যুক্ত আমি। তখন বর্ধমান বইমেলায় প্রতি বছর কলকাতা থেকে অনেক সাহিত্যিক আসতেন। কয়েকজনকে প্রায় প্রতি বছর আসার আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখেছি। সেইসময় এত “অ্যাপিয়ারেন্স মানি” নেওয়ার চল হয়নি। সাহিত্যিকদের আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেই হতো। বর্ধমানে সেই রাতটুকু থাকতে চাইলে, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হতো। অনেকে আবার পরিচিত কারোর বাড়িতে থেকে যেতেন। প্রথম যেবার শুনলাম, মেলায় সুনীল গাঙ্গুলী আসছেন আমার আনন্দ দেখে কে? তখন “সেইসময়” ধারাবাহিকভাবে বেরুচ্ছে। গোগ্রাসে গিলছি। সমগ্র বাংলার সাথে নবীন কুমারের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছি। যত পড়ছি তত সুনীলদাকে দেখার আগ্রহ বাড়ছে। একটা নির্দিষ্ট সময়কে কী নিপুণভাবে ধরতে চেষ্টা করছেন! নবীন কুমার যেন আমার কাছে স্বয়ং লেখক। যাঁর কবিতা পড়ে আমার প্রথম কবিতা প্রেম। কবিতা পড়তে আর লিখতে উৎসাহ পাওয়া। সুতরাং তাঁর না আসা পর্যন্ত রাত লম্বা হতে থাকে, দিন রুদ্র হতে থাকে। ধৈর্য যেন আর ধরে না! অবশেষে তিনি এলেন। বর্ধমান স্টেশন থেকেই আমি তাঁর পাশে। তখন আমি বইমেলার দ্বাররক্ষীর কাজে ব্যস্ত থাকতাম। অগুনতি লোকের আসা যাওয়ার মাঝে বুকে বইমেলার ব্যাজ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার আনন্দ আর মজাই আলাদা। খুব ভাল লাগত। কত বইপ্রেমীর সাথে পরিচিত হতাম গেটে দাঁড়িয়ে। এখন এই কাজগুলো সিকিউরিটি সার্ভিসের লোকজন করে। সেই আনন্দের অজুহাত আর নেই। সুনীলদা এলেন আর আমাকে যেন দ্বাররক্ষী থেকে দেহরক্ষীতে উন্নীত করলেন। যতক্ষণ মেলার মাঠে ছিলেন ততক্ষণ একভাবে তাঁর পাশে রইলাম। স্টেজে ওঠার সময়ও পাশ থেকে সরিনি, প্রশ্নই ওঠে না। সবশেষে আগ্রহী মানুষজনকে তাঁর কাছে আসার সুযোগ দেওয়া হলো। তিনি বইমেলার অফিসে একটা চেয়ারে বসলেন। সামনে লম্বা লাইন। একে একে সবাই আসছে, তাঁর লেখা বইতে অথবা ডায়েরিতে অটোগ্রাফ নিয়ে চলে যাচ্ছে। দুটি কমবয়সী মেয়ে ব্যতিক্রমী ছিল। তারা সুনীলদার পায়ের কাছে বসে তাঁর দুটো পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল। আমরা হাঁ হাঁ করে ছুটে গেলাম। সুনীলদা বাধা দিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই ওরা বলতে থাকল
–দয়া করে নবীন কুমারকে মারবেন না সুনীলদা। ওকে বাঁচিয়ে রাখুন প্লিজ।
“সেইসময়” উপন্যাসের নায়ক নবীনকুমার তখন মৃত্যুশয্যায়। যে কোনো সময় লেখক তাঁর জীবনে যবনিকা টানতে পারেন। আমারও এমনটাই মনে হয়েছিল যে নবীনকুমার আরো কিছুদিন বাঁচুন। অনেক কাজ তাঁর বাকি রয়ে গেছে! কিন্তু সুনীলদাকে বলতে পারিনি। তাই মেয়েদুটি এমন বলাতে বেশ খুশি হয়েছিলাম। সুনীলদা ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন
–তা কী করে হয়? যাঁকে চিন্তা করে আমি নবীন কুমারকে এঁকেছি তিনি তো এই বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। তোমরা এমন করো না, ওঠো।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? মেয়েদুটি পা ছাড়ল না।ওই এক কথা বলে যেতে থাকল। এদিকে অফিসে ভিড় জমে যাচ্ছে। লম্বা লাইনে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। সুনীলদাকেও কলকাতা ফিরতে হবে। শেষে তিনি বলতে বাধ্য হলেন
–ঠিক আছে, আমি ভেবে দেখব।
মেয়েদুটি আনন্দে লাফিয়ে উঠে প্রথমে সুনীলদাকে প্রণাম করল। তারপর তাঁর দু’গালে চুমু খেয়ে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, লেখা কতটা বাস্তব হলে পাঠক এমনভাবে চরিত্রের সাথে একাত্ম হতে পারে! নবীন কুমার বাঁচেননি, আমরা সবাই জানি। কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলীর সেই লেখা আজও বেঁচে আছে।

এরপর তিনি যখন এসেছিলেন তখন আমি বইমেলায় অনেকটাই পরিণত। সুনীলদার সাথে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। অদ্ভুত লোক এই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। স্টেজে বসে সুনীল গাঙ্গুলীর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন
–আমি সুনীলকে এতটাই ভালবাসি যে ও বলাতে শূন্যস্থান পূরণ করতে চলে এসেছি। আজ শক্তির আসার কথা ছিল। ও আসতে পারেনি। বিশেষ কাজে আটকে গেছে। তাই আমি এখানে আসার সুযোগ পেলাম। শূন্যস্থান পূরণ করলাম।
সুনীল গাঙ্গুলীর মুখে তখন এক অনাবিল হাসি। ফেরার সময় তাঁরা রাতের লোকাল ট্রেনে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। রেলে চাকরি করার সুবাদে আমি দায়িত্ব পেলাম বর্ধমান স্টেশনে তাঁদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসার। ট্রেন ছাড়ার আগে অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম
–সুনীলদা, নীরা কে? নীরার কি সত্যি কোনো অস্তিত্ব আছে?
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জোরে হেসে উঠে বলেছিলেন
–এই রে! কঠিন প্রশ্ন।
সুনীলদা বলেছিলেন
–জীবনের প্রথম প্রেম কেউ ভুলতে পারে?
আমি হেসে বলেছিলাম
–আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
তিনি বলেছিলেন
–তাহলে তুমি বুঝবে না। নীরা যে কোনো মানুষের জীবনের সেই প্রথম নারী।
সুনীলদার মুখের হালকা হাসির মূলধন নিয়ে ট্রেন চলে গিয়েছিল।

বর্ধমানে অভিযান গোষ্ঠীর নিজস্ব পত্রিকা “অভিযান সাময়িকী” নিয়ে তখন জোর মেতে আছি। সেই সময় বর্ধমানে এই পত্রিকাতে লেখা ছাপা হওয়া মানে আনন্দের ব্যাপার। লেখক হিসাবে বাজারে খাতির পাওয়া যায়। চারিদিক থেকে লেখা আসে, বাছাই করি। বিশেষত কবিতা বিভাগটা আমি দেখি। সেই প্রথম অনুভব করেছিলাম, এই কাজটা কত কঠিন! এমনও হয়েছে, কেউকেটা কারোর কবিতা পত্রিকাতে দিতেই হবে। গোষ্ঠীর সম্পাদকের হুকুম। প্রয়োজনে কবিতা আর কবির নাম বাদ দিয়ে সবটাই নতুন করে লিখে দিতে হবে। তাই করতে হয়েছে। তখন বর্ধমানে “আলোবাতাস” পত্রিকার তরফে প্রায় প্রতি বছরই কলকাতা থেকে কোনো না কোনো সাহিত্যিক নিয়ে এসে বড় করে সাহিত্যসভা করত। সে বছর এলেন সুনীলদা। হলদিতে খড়ি নদীর ধারে আলোবাতাসের সাহিত্যসভা। অভিযান গোষ্ঠীর তরফে আমি আর একজন গিয়েছি। খড়ি নদীর ধারে আমবাগানের ভেতরে সভার আয়োজন। গাছে গাছে মুকুল হামলে পড়েছে। গোধূলির কনে দেখা আলোর সাথে আমের মুকুলের গন্ধ মিশে এক মোহময় পরিবেশ। খোলা আকাশের নিচে চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা। আমার একেবারে পাশের চেয়ারে বসে সুনীলদা আর স্বাতীদি। মনে আছে অনেক কথার মাঝে তিনি আমাকে বলেছিলেন
–সমীরণ (আমাদের গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, সমীরণ চৌধুরী। আমৃত্যু সম্পাদক ছিলেন।) খুব ভাল গল্প লেখে। বর্ধমানের সংস্কৃতিতে ওর অবদান ভোলা যাবে না।
আমি থ। এ কী শুনছি? কে কার প্রশংসা করছেন? পরে ভুল ভেঙ্গেছিল। লোকটা এমনই। আর সমীরণদা? সবদিক বজায় রেখে চলতে তাঁর জুড়ি ছিল না। সুনীলদাও তা জানতেন।

এরপর তিনি এলেন সম্ভবত ২০০৩ সালে। সেটাই বোধহয় শেষবার। বইমেলার উদ্বোধক হিসাবে। এর আগে তিনি কোনোদিন উদ্বোধক হিসাবে আসেননি। যথারীতি আমি তাঁর দেহরক্ষীর ভূমিকায়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। মেলা শেষ হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে আমি আর সমীরণদা গেলাম সার্কিট হাউসে। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো আলোচনা। মূলত সমীরণদার সাথে। আমি নীরব শ্রোতা। নিজে পানীয়ের বোতল খুলে গ্লাসে ঢেলে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমরা দুজনেই বায়বীয় নেশায় আসক্ত ছিলাম তখন, তরলে নয়। সুতরাং “না” না বলে চুপ করে রইলাম। সুনীলদা বুঝলেন। নিজের গ্লাসে দু চার চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন
–তোমার তো নেওয়া উচিত ছিল। জীবনে এখনও নীরা না আসার দুঃখে।
আমি হেসেছিলাম। বুঝেছিলাম, মানুষটার অসীম স্মরণশক্তি। ঠিক মনে আছে আগেরবারে বলা কথাগুলো। কত রকমের যে আলোচনা হয়েছিল! সেদিনের আলোচনায় জেনেছিলাম, শুধু কলকাতা নয়, ছোটোখাটো মফস্বলের সাহিত্যচর্চা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন তিনি। কোন জায়গায় কী পত্রিকা বেরোয় সব তাঁর নখদর্পণে। সমীরণদা আমাদের পত্রিকা তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার পর ওখানে বসেই সমীরণদার লেখা গল্পটা পড়ে নিলেন। খুব প্রশংসা করলেন গল্পটার। আর একটা বিষয় লক্ষ করেছিলাম। যে ভালবেসে তাঁকে ডাকে, তার কাছেই তিনি যান। সেদিন অনেক রাতে তিনি বর্ধমান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।  বোলপুরের উদ্দেশ্যে। পরদিন সেখানে এক সাহিত্যসভা ছিল।

এই মানুষটাকে নিয়েই লিখেছিলাম একদিন-
এই একটা লোকের জন্যে আমি কবিতাকে ভালবেসেছি
এই একটা লোকের জন্যে আমি কলম হাতে নিয়েছি
যতবার লোকটার কাছে এসেছি অপলকে তাকিয়ে থেকেছি
ভালবাসার নামে উদ্ভ্রান্ত হয়ে লোকটার মনের তল খুঁজেছি
এই একটা লোকের জন্যে আমি বোহেমিয়ান হতে চেয়েছি
এই একটা লোকের জন্যে আমি সুনীল সাগরে ডুবেছি।
আজ সেই মানুষটা আমাদের মাঝে নেই। রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টিগুলো। আর রয়ে গেছে আমাদের মতো কিছু অর্বাচীনের সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু স্মৃতি। এই হীরে জহরতগুলো নিয়েই আগামী দিনের গল্প লেখার প্রয়াসে মাতবো আমরা।

তারিখঃ এপ্রিল ১২, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mousumi
Mousumi
2 years ago

খুব খুব ভাল লাগল। অনবদ্য স্মৃতিচারণ, প্রিয় লেখককে নিয়ে। অনেক ধন্যবাদ।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse