সেই মূর্তিটা

 

ভেম্বরের শেষ। সবে পুজোর হুল্লোর একটু থিতিয়ে শীতের তোড়জোড় শুরু হয়েছে, এমন সময় আকাশের হাসিমুখ থাকার কথা। কিন্তু আজ থমথমে মুখে পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে সে। সম্প্রতি রিটায়ার করে পাকাপাকিভাবে জন্মভূমিতে এসে বসেছেন তামসিক ভট্টাচার্য্য। একা মানুষ, তাই সন্ধেটা পাড়ার ক্লাবেই কাটান। আজ বৃষ্টির সম্ভাবনায় তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবেন ভেবে বললেন,

 

“তোরা গল্পটল্প কর। আমি যাই।”

 

কিছু ছেলেবেলার বন্ধু এখনো রয়ে গেছে, তারাই ধরে বসিয়ে দিলো,

 

” কী করবি বাড়িতে ! তার থেকে গল্প বল শুনি। তোর চা বাগানের গল্প শোনা।”

 

অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। তামসিক বললেন, “যদি বৃষ্টি আজ না ছাড়ে ?” গলাটা একটু কেঁপে গেল।

 

রবীন, দুলাল আর নির্মলের দল হেসে বলল,

 

“উঃ তুই বুড়ো হয়ে গেছিস, বৃষ্টিকে আবার ভয় ? ওরে ভয় নেই! তোকে বাড়ি দিয়ে আসব। নে শুরু কর।”

 

তামসিক একটু অপ্রস্তুত মুখে বলল, “শুনবি ? বিশ্বাস কর বা না কর, কোনো প্রশ্ন না করেই শোন।”

 

কিছুক্ষণ চুপ করে যেন নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে শুরু করলেন,

 

“আমি তখন তাবাকোশি থেকে একটু দূরের এক চা বাগানের ম্যানেজার। পাহাড়ের বৃষ্টি দেখেছিস ? হঠাৎ করে ঝর্ণা গজিয়ে ওঠে। তীব্র গতিতে চারিদিক দিয়ে জলস্রোত বইতে থাকে। তো তেমনই একদিন, চা বাগান থেকে বেরোনো মাত্রই বাহাদুর মোটোরসাইকেলটা গ্যারাজ থেকে বার করে দিয়ে বলল,

 

“তুরন্ত চলা যাইয়ে বাবু, বারিস আ রহা হ্যায়।”

 

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘেরা অনেকটা নেমে এসেছে নিচে। চারিদিকটা কেমন ধূসর হয়ে উঠেছে। পাইনের বিশাল বিশাল গুঁড়িগুলো ডাইনোসরের পায়ের মতো উঠে গেছে ওপরে। বাকিটা মেঘের আড়ালে। খুব বেশিদিন আসিনি এখানে। তাবাকোশি জায়গাটা পাহাড়ের ঢাল। পাহাড় আমি চিরকালই ভালোবাসি, তাই আর দুবার ভাবিনি, যখন চা বাগানের ম্যানেজারের চাকরিটা পেয়ে গেলাম।

 

 

বেশ কিছুটা ওপরে আমার কটেজে যেতে হবে পাহাড়ি রাস্তায়, মোটোরসাইকেলে । খানিকটা ওঠার পরই বৃষ্টি এল, ফোঁটায় ফোঁটায়। মুখটা উঁচু করে প্রসাদের মতো গ্রহন করলাম বৃষ্টি ফোঁটা… ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়ায় ফোঁটাগুলো কেটে বসে যাচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তায় অনেকগুলো হেয়ারপিন কার্ভ। সামনেটা ঝাপসা ঝাপসা। একটু দাঁড়াব কি? যাওয়া আসার পথে, একটা মন্দির মতো চোখে পড়ে । ঢুকিনি কোনোদিন। মোটরসাইকেলটা যখন মন্দিরের সামনে দাঁড় করালাম, বৃষ্টি তখন ঝমঝমিয়ে পড়ছে। যদিও এসব অঞ্চলে বৃষ্টি খুব বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না। ঢুকলাম মন্দিরে। একজন লোক হাসি হাসি মুখে বসেছিল। সম্ভবত লেপচা। বলল, “আপ বাঙ্গালি হো না ?”

 

ঘাড় নাড়ি, “বৃষ্টিটা জোরে এল তাই…”

 

“বৈঠিয়ে, বারিষ রুক যানে সে চলে যানা।” লোকটা হাসি হাসি মুখে চেয়ে রইল।

 

আবছা আলোয় একটা মূর্তি দেখা যাচ্ছিল। এ সব জায়গায় পাথরের মূর্তিই হয়। কিন্তু মনে হলো, রঙ করা। এরকম সচরাচর দেখা যায় না। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটি একমুখ হেসে বলল,” ইয়ে মূর্তি কো দেখ রহে হো সাবজী? ইসকা এক হিস্ট্রি ভি হ্যায়”

 

এই রে! এইবার শুরু হবে কাহিনী! কিন্তু কিছু করারও তো নেই। চলো, সময় কাটানো যাক! বললাম, “কহিয়ে আপকা হিস্ট্রি! শুনতে হ্যায়”

 

হয়তো এতদিনে এমন একজনকে পেয়েছে, যে জানে না ! লোকটা মহা উৎসাহে শুরু করল,

 

“এক বুদ্ধিস্ট থা। শুনা হ্যায়…”

 

ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর বাংলায় গল্প শুনিয়েছিল এরপর… কোনো এক বাঙালি মেয়ে বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে জানতে এসেছিল। এসে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রেমে পড়ে। সন্ন্যাসীর সংযমও নাকি টলে গিয়েছিল। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর মেয়েটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সন্ন্যাসীও বিতাড়িত হয়, এখানে চলে আসে। শোনা যায় সে-ই এ মূর্তি গড়েছিল।

 

“কিসের তৈরি এটা ?”

 

“শায়দ মিট্টিকা বনা হুয়া! পূজা নেহি হোতা হ্যায়।

 

শুনা হ্যায় কোঈ ছু নেহি সকতা। আগর কোই ছু লেতা, তো বিজলী গিড় যাতি হ্যায় উসকে উপর।”

 

ততক্ষণে বৃষ্টি কমে গিয়েছে। লোকটি “আচ্ছা জী, লাগতা হ্যায় বারিষ রুকনেওয়ালা হ্যায়, ম্যায় চলতা হুঁ” বলে টিপটিপ বৃষ্টিতেই বেরিয়ে পড়ল।

 

আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। টুপটাপ বৃষ্টিতে বাইক চালানো মুশকিল। খুব ইচ্ছে করল, একবার ছুঁয়ে দেখি মূর্তিটা। আবছা আলোয় পাথরের দেওয়াল অনেকটা গুহার মতোই লাগছে। হঠাৎ মনে হলো, আলো আসছে কোথা থেকে? বিকেল হয়ে গেছে। ভেতরে অন্ধকার হওয়ার কথা। কিন্তু প্রদীপ তো দেখা যাচ্ছে না। গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। তবুও আকর্ষণ অদম্য… একবার ছুঁয়ে দেখব? হাত বাড়ালাম মূর্তির দিকে। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্ব… যদি বাজ পড়ে!

 

পড়ুক, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক, তবু একবার ছুঁতেই হবে। মাথার মধ্যে যেন ঝিঁঝি পোকার ডাক, হাত আর বশে নেই ! কাঁপা কাঁপা আঙুল স্পর্শ করল মূর্তির আঙুল। মুখের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। একটা চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে…

 

বাইরে একটা বেড়াল ডেকে উঠতে চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে! কই! বাজ তো পড়ল না ! যত্তোসব, গাঁজাখুরি গালগপ্পো। থাকো বাবা মূর্তি, তুমি তোমার মতো। এই একবিংশ শতাব্দীতে আর মায়া ফায়া দেখাতে এসো না। মোটোরসাইকেল স্টার্ট করলাম সশব্দে।

 

কদিন পরেই তাবাকোশি থেকে নেমে যেতে হলো ডুয়ার্স অঞ্চলে। আস্তে আস্তে সেই মূর্তি, মন্দির সব বিস্মৃতির ধুলোয় মলিন হয়ে গেল।

 

এরপর কেটে গেছে কয়েকটা বছর। এক মেয়ের প্রেমে পড়লাম। বহ্নি, ভীষণ সুন্দরী । ও কোনো অনাথাশ্রমে মানুষ বলেছিল। আমার ওর অতীত নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমি মুক্ত পুরুষ। কেউ কোথাও নেই।

 

ইতোমধ্যে আমার বেশ বড় রকমের উন্নতি হলো। অনেক টাকা এরিয়ার পেলাম। ভাবলাম লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে, ছাড়া নেই একে। শুধু কয়েকটা জিনিস… ওকে খুব বেশি সচেতন লাগত আমার। সবসময় সেজেগুজে সুগন্ধী টুগন্ধী মেখে একেবারে যেন পুতুল পুতুল ভাব। একদিন বললাম, “আমার ভিজে চুল খুব ভালো লাগে। বেশ পবিত্র মায়াময়।”

 

ও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “সরি! আমার ভিজে চুলে খুব অস্বস্তি লাগে।”

 

তো আর কখনো বলিনি। ওটা নিয়ে মাথাও ঘামাইনি। চলছিল ভালোই। শুধু কিছু কিছু ব্যাপার একটু অন্যরকম ছিল। জল এড়িয়ে চলত। বলেছিল, ওর নাকি জল থেকে বিপদ আছে, তাই!

 

একদিন ভাবলাম, আমার প্রথম জীবনের কর্মক্ষেত্র দেখিয়ে আনি। তখন আমি মালদায় চাকরি করি। সারপ্রাইজ দেব বলে কোথায় যাচ্ছি বললাম না। জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষে বললাম, “চলো! চার দিনের ছুটি পেয়েছি বেরিয়ে পড়ি।”

 

মহা আনন্দ ! বলল, মোটরসাইকেলে যাবে। রওনা হলাম। পিঠে রাকস্যাক, মাথার হেলমেট খুব স্মার্ট লাগছিল বহ্নিকে। যেন বকের ডানায় সওয়ার হয়ে উড়ে চলেছি আমরা। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে আবার চলা…

 

কিছুটা গিয়ে বহ্নি বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”

 

বললাম, “আমার পুরোনো জায়গা। চলোই না! অসাধারণ জায়গা। বলেছিলে পাহাড় দেখোনি ! চলো।”

 

ও চুপ করে গেল। আমি যতই কথা বলি, ওর যেন মুড অফ। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। পাহাড়ের রাস্তায়, মোটরসাইকেলের একটা আলাদা মজা আছে।

 

দূর থেকে মন্দিরটা দেখে, সব মনে পড়ে গেল। দাঁড়ালাম। বললাম, “চলো ভেতরে যাই।”

 

বহ্নির মুখ খুব গম্ভীর। দাঁড়িয়ে রইল। ওর হাত ধরে ভেতরে ঢুকলাম।

 

সেই লেপচা লোকটা…

 

সেরকমই হাসি হাসি মুখে তাকাল। বহ্নিকে দেখেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে কেমন যেন ভয় ফুটে উঠল ! দেখলাম বেদিতে মূর্তি নেই। বললাম, “মূর্তি নেই? কোথায় গেল?”

 

বলল,” আপনি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আর মূর্তিটা দেখা যায়নি সাবজী!”

 

বহ্নির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অল্প হেসে চলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকাল।

 

ফাঁকা মন্দিরে আমি আর ও। বেশ রোম্যান্টিক পরিবেশ! ওকে জড়িয়ে ধরতে বহ্নি যেন ছটফট করে উঠল। আজ মন্দিরের ভেতরে আর সেই আলো নেই। অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হয়ে এল… গা ছমছম করে উঠল। ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

 

মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। মেঘ করে এল, কালো হয়ে। বহ্নি বলল, “এখানে কোথাও দাঁড়িয়ে যাই। বৃষ্টি আসবে।”

 

“আরে দূর ! সে আসুক !”

 

একটু ঝাঁজালো স্বরে বলল, “বলতে পারতে আমায়, পাহাড়ে আসতাম না। বলেছি না! জলে বিপদ!”

 

“আরে বৃষ্টিতে কী আর তুমি ডুবে যাবে ? কী বিপদ! আসুক দেখি, আমি আছি না ?”

 

বহ্নি তবু ঝোঁক ধরে “দাঁড়িয়ে যাও।”

 

এবার আমার বিরক্ত লাগল। বললাম, “আচ্ছা, দাঁড়াব। আরো একটু ওপরে।”

 

এমন সময় বৃষ্টি নামল বহ্নি অস্থির হয়ে বলল, “কোথাও দাঁড়িয়ে যাও না !”

 

আমি কেন জানি না, জেদ ধরে বললাম, “প্যানিক করো না তো! দাঁড়াব ঠিক জায়গায়।”

 

বৃষ্টি জোরে এল। সত্যিই আড়াল নেই কোথাও। হঠাৎ বহ্নির গলা পেলাম, “তামসিক আমি আর…”

 

ওর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। আমি মোটর সাইকেল দাঁড় করাতে দেখি বহ্নি কেমন অদ্ভুত ভাবে বেঁকে গেছে। যেন শরীরটা নরম হয়ে গেছে। ওকে ধরে নামালাম। দাঁড়াতে পারল না। পথের ধারে বসে পড়ল। ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। হেলমেট খুলে দিলাম। বৃষ্টি তখন অঝোর ধারায়…”

 

একটু যেন শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলল তামসিক। আস্তে আস্তে বলল, “সেদিন ঐ পথের ধারে বহ্নি হাত বাড়িয়ে আমার আঙুল ছোঁয়ার চেষ্টা করল। আমি ওকে ধরতে চেয়েও পারলাম না। চোখের সামনে আমার দুহাতের মধ্যে বহ্নি বৃষ্টির জলে গলে গলে মাটি হয়ে বয়ে যেতে লাগল খাদে। বিকৃত গলায় একবার শুনলাম, ‘তা-ম-সি-ক’ ! একটা চোখ অসহায় ভাবে শেষ পর্যন্ত আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার চিনতে পারলাম। অবিকল সেই মূর্তির চোখ। কিছুক্ষণের মধ্যে

ওর পুরো দেহটা…

 

ঘরে নৈঃশব্দ। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। কান পাতলে শোনা যায়, বোল উঠছে, তা-ম-সি-ক… তা-ম-সি-ক…!

তারিখঃ জুলাই ১৯, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Saad
Saad
1 year ago

আপনার গল্পে একটা অন্যরকম কিছু চলে আসে, আধাভৌতিক, অতীন্দ্রিয় কিছু। খুব ভালো লাগলো।
শুরুতেই একটা বানান কি ভুল পেলাম ? হুল্লোড় হবে না শব্দটি?

সুচরিত চৌধুরী
সুচরিত চৌধুরী
1 year ago

একটা রহস্যময় আবহে ঘেরা গল্প।

priyanka chayterjee
priyanka chayterjee
1 year ago

কী সুন্দর! একদম অন‍্যরকম। আধাভৌতিক!

Bijaylakshmi Mukherjee
Bijaylakshmi Mukherjee
1 year ago

অসাধারণ , শিহরিত হলাম

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse