স্পর্শ
ভবেশ দাস
সুকুমার বোসকে পাড়ার লোকে ভালো মানুষ বলেই জানে। সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যে সব দোষ গুণ থাকলে একে অপরের নামে সুখ্যাতি ছড়িয়ে বেড়ান, সুকুমারবাবুও তার বাইরে ন’ন। এই “ভালো” বিশেষণটি সুকুমারবাবুর একমেবাদ্বিতীয়ম স্ত্রী পুষ্পদেবী তো মানেনই না, বরং উল্টো কথা বলেন। বলার ভঙ্গিমাটি এতই সুমধুর যে, শুনলে মনে হবে, মন্দিরে দেবতা বোধহয় কাঁসর ও করতালের তীক্ষ্ণ হৃদয় বিদারক শব্দ শুনতেই বেশি পছন্দ করেন।
গৃহে কবিগানের তরজা চলতে থাকলেও সুকুমারবাবু বেশ রসে বশে থাকেন।
এই স্বভাবের জন্য পুষ্পদেবী মাঝে-মধ্যেই, গরম কড়ায় ধোঁয়া ওঠা তেলে শুকনো লঙ্কা সম্বরা দেবার মতো, চিড়বিড়িয়ে ওঠেন। আসলে রমণীকুলের সংজ্ঞা অনুসারে, পুষ্পদেবী কখনো মেনে নিতে পারেন না, যে, তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত স্বামী নামক জীবটির হাসি মস্করায় অপর নারীকুল প্রফুল্ল বদনে খিলখিলিয়ে উঠুক।
আজ সকালে কুসুমরঙা সূয্যি ঠাকুর উঠেছে পুবদিকে। সুকুমারবাবু নিজের বাড়ির উঠোনের মাঝে শীতলপাটি বিছিয়ে প্রাণায়াম করছেন রোজকার মতো। রবির নরম আলো তাঁর মুখে পড়তেই মনটা ঝকমকিয়ে উঠল। প্রশ্বাস নিঃশ্বাসের মাঝে হঠাৎ তিনি মৃদু গলায় গুনগুনিয়ে উঠলেন,’’ এসো আলো এসো হে তোমায় সুস্বাগতম…’’
সকালের প্রথম কিরণ রাতের মলিনতা মুছে দেয় এটা সুকুমারবাবুর ধারণা। সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে, খোশমেজাজে গানে সুরের তানটা একটু জোরে হয়ে গেছিল। সেই শব্দে ঘর থেকে রাম শিঙায় ফুঁ দেবার গর্জনে পুষ্পদেবী বলে উঠলেন, “বোড়া সাপের মতো ফোঁসফোঁসানি না করে দু’কাপ চা বসাতে পারো তো গ্যাসে। তা করলে কি বোস বংশের মানহানি হবে?”
সুকুমারবাবু কথাটা শুনেও গায়ে মাখলেন না। বরং দম নেবার ক্রিয়াকলাপ বাড়িয়ে দিলেন। প্রত্যুষে এই উপেক্ষা সইতে পারলেন না পুষ্পদেবী। তাই মৃদঙ্গের উপর তীব্র বোলকারির লহরা তুলে দাঁতে দাঁত পিষে, চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “রান্নাঘরে ঢুকলে কি বাবুর জাত যায়?”
সুকুমারবাবু ঠাণ্ডা মাথায় হাল্কা হেসে বললেন, “শ্বশুরমশাই কে চিঠি লিখে জেনে নিই ক’ কাপ চায়ে ক’ চামচ চিনি দিতে হয়, তারপর না হয় চা করে খাওয়াবো ?”
পুষ্পদেবী তীব্র ঝঙ্কারের সাথে বললেন, “সাত সকালে আমার বাপের বাড়ি তুলে টানাটানি করবে না বলছি। ভগবান কপালের মাঝে দু’খান টুনিবাল্ব দিয়েছেন। সে দুটো ব্যবহার করলেই দেখতে পেতে মহিম ঠাকুরপোর কতো গুণ।”
সুকুমারবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “বিবাহিত মানুষের নির্বান্ধব হওয়া আই.পি.সি তে উল্লেখ থাকা উচিত ছিল।” কথাটা বলেই তিনি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন তাঁর সাধের বাগানে জল দিতে। উঠোনের চারপাশে শখের বাগান করেছেন বোস দম্পতি। বিভিন্ন ফুলগাছের শোভা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়িটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। বিশেষ করে মাধবীলতার গাছটি বাড়ির সদর দরজার উপরে ডালপালা ছড়িয়ে আহ্লাদে-আটখানা হয়ে জড়িয়ে থাকে। বাগানটি যেন বোস জায়ার নয়নের মনি। সুতরাং, রান্নাঘর থেকে বাসনের ঝনঝনানির আওয়াজ একটু পরেই কমে গেল।
মধ্য ষাটের বোসবাবু সন্ধির প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলেন। খবরের কাগজে মুখ ঢেকে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে চায়ের অপেক্ষায় আঙুলের কর গুনতে লাগলেন। ঘড়ির কাঁটার টিক টক শব্দে প্রতীক্ষার পারদ আরও বেড়ে চলেছে তাঁর। তিনি ভাবছেন পাড়ার মোড়ের মাথায় সকালের চা খেতে যাবেন কি না ! কিন্তু, সেখানেও হয়তো মহিম নামে আপদ ওৎ পেতে থাকবে। শেষে গায়ে পড়ে বাড়ি এসে বৌঠান বলে ডেকে, দু’জনে মিলে আমায় তুলোধোনা ধুনবে। ভাবনার তরঙ্গে এবং চায়ের নেশায় প্রাণটা যখন আকুলি বিকুলি, সেই সময় এক কাপ ধুমায়িত চা ভর্তি কাপ-ডিশের মিশ্র শব্দে চটকা ভাঙল সুকুমারবাবুর। পেয়ালার চা একটু চলকে ডিশে পড়তেই খাস্তা বিস্কুটের মুচমুচে ভাব নরম হয়ে গেল।
সুকুমারবাবু চা মুখে তুলে পরম তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, “আজকের চা কিন্তু খাসা হয়েছে গিন্নি।” পুষ্পদেবী ঠোঁটের কোনে বক্র হাসি ঝুলিয়ে বলেন, “আর মাখন লাগিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে, চা’টি গলায় ঢেলে বাজার করে আনলে আমি উদ্ধার হই।” সুকুমারবাবু ফাজিল হেসে বলেন, “সে তো ত্রেতা যুগেই উদ্ধার পর্ব সাঙ্গ হয়েছে। এই ঘোর কলিতে নতুন করে আর পোষাবে না, লক্ষ্মীটি।”
পুষ্পদেবী চোখের তারা ঊর্দ্ধপানে তুলে বললেন, “ভারি আমার রামচন্দ্র এসেছিলেন গো! সারাজীবন অশোক বনে নির্বাসন কাটিয়ে দিলাম, তবুও প্রাণনাথ মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এর থেকে রাবণকে বরণ করলে বেশ হতো, মণ মণ সোনা পরতে পেতাম অঙ্গে।”
সুকুমারবাবু চুপসে গেলেন। তিনি জানেন এরপর কথা বাড়ালেই কেলেঙ্কারি। বিকাল বেলা স্যাকরার দোকান যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না! আর, পুষ্পদেবী বুঝলেন এবারে তিনি মোক্ষম জায়গায় আঘাত হেনেছেন। স্বামী বেচারা আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারবে না। পৃথুলা শরীর নিয়ে গজগামিনী চালে তিনি যুদ্ধ জয়ের আনন্দে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। সহধর্মিনীর গমন দেখে সুকুমারবাবু নিজের বুকে আলতো হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “ত্রিশ বছর আগে যে সুতনকা যুবতীর হিল্লোলের মাদকতায় মজেছিলাম…কালের প্রভাবে রাজ্যের তেল ঘি তার শরীরে বাসা বাঁধল! সবই মায়া…’’
বাজার যাবার পথে মহিমের সাথে দেখা হল সুকুমারবাবুর। দুই বন্ধু একসাথে বাজার করতে গিয়ে খোশগল্পে মাতলেন। আলোচনায় সেই এক’ই প্রসঙ্গ – ব্যাঙ্কের সুদের হার নিম্নমুখী কেন? এম.আই.এস থেকে প্রাপ্ত টাকার পরিমান যেমন কমছে, তাতে আগামীদিনে তাঁদের মতো অবসর প্রাপ্ত মানুষদের ফুটো বাটি মজুত করতে হবে। নিজেদের সুখ-দুখের কথা বলে মন একটু হাল্কা করে বাড়ি ফিরলেন।
বাড়ি ঢুকেই বাজারের ব্যাগটা থপ করে রেখে সুকুমারবাবু ক্লান্ত স্বরে বললেন, “আর এককাপ জীবনদায়ী সঞ্জীবনী সুধা পাওয়া যাবে নাকি গিন্নি?তোমার দুষ্মন্ত পথশ্রমে ক্লান্ত।” কথাটা বলেই বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে সকালের আধপড়া কাগজে পুনরায় মন দিলেন।
পুষ্পদেবী চায়ের সাথে মুড়ি-বাদাম মিশিয়ে টেবিলে রেখে গেলেন। একমুঠো মুড়ি মুখে ফেলেই সুকুমারবাবু গলা তুলে ব্যাজার কন্ঠে বললেন, “একটু আমতেল মেখে দিতে পারতে তো? শুকনো মুড়ি গলা গিয়ে নামে!”
ঘরের ভেতর থেকে মৃদু ভর্ৎসনায় জবাব এল, “শরীরে যা সয়, তাই খেতে হয়। বয়সের তো গাছ-পাথর নেই। এখনও এত নোলা কেন বাপু ? সব সময় তরিবত করে খাবার দিতে হবে? এখন আমতেল দিয়ে মুড়ি খেলেই দুপুরে ভাত খাবার দফা সাড়া। অম্বল-গ্যাসে নিজে যতোটা না কষ্ট পাবে তার থেকেও বেশি ঝক্কি আমাকে পোয়াতে হবে।”
সুকুমারবাবু সকালের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যেতেই আর কথা বাড়ালেন না। শুধু স্বভাব দোষে স্ত্রী’কে উহ্য রেখে আপন মনে বললেন, “শাস্ত্র মতে এইসকল নারীকে ধীরা বলা হয় কি এমনি?” কথাটা কানে যেতেই পুষ্পদেবী শাস্ত্রের পিণ্ডি চটকাতে লাগলেন। তবুও ‘ধীরা’ কী পদার্থ সেটা না জানা পর্যন্ত একটা কাঁটা মনে খচখচাতে লাগল।
সুকুমারবাবু জলখাবার খেয়ে পাড়ার মোড়ে আড্ডা দিতে চললেন। এই সময়টা তাঁর বরাদ্দ পাড়ার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। বেশি দূর এগোতে হল না তাঁকে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। সেই বৃষ্টিতে কাকস্নান করে বাড়ি ফিরে এলেন।
ভাদ্রের আকাশ – তার মন বোঝা দায়! বৃষ্টি ও রোদ্দুর যেন পরস্পরকে চোখে হারাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে যাচ্ছে অজানার দেশে। বাগানের এককোণে শিউলি গাছে কুঁড়ি এসেছে ঝেঁপে। সুকুমারবাবু গাছটির দিকে উদাস ভাবে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন, সব কুঁড়িতেই কি ফুল ফুটবে?
দুপুরে একসাথে খেতে বসলেন দু’জনে। কেউ বেশি কথা বললেন না। দু’জনেই ভাবছে আবার কী কথা থেকে কী ঝামেলা পাকে! আজকের দিনটা লঙ্কার ঝালে অতিষ্ঠ হয়ে আছে।
দুপুরবেলা সুকুমারবাবু ছাদে উঠলেন। একতলা বাড়ি হলেও ছাদে তাঁর নিজস্ব ছোটো একটা ঘর আছে । সেই ঘরে বইপত্র ঠাসা। নিজের পছন্দ মতো একটা বই নিয়ে পড়তে লাগলেন। বই পড়তে পড়তে কখন যে ভাতঘুমে চোখ বুজে এসেছে সে খেয়াল নেই। পুষ্পদেবী রান্নাঘর পরিষ্কার করে, কাপড় কেচে, শোবার ঘরে গেলেন। বাড়ির একটু দূরে থাকা উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ তার কানে বাজলো। তড়িঘড়ি করে তিনি সদর দরজায় সামনে এসে দাঁড়ালেন। স্কুলের এক দিদিমণির সাথে তাঁর ভাব আছে। সেই দিদির হাতে সময় থাকলে দু’মিনিট কথাও বলেন। তাঁদের বাগানের ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেন। ওনার সঙ্গে এই ঘনিষ্টতা খুব উপভোগ করেন পুষ্পদেবী। আজকেও স্কুলের বালক বালিকার দল চলে যাবার পর সেই দিদিমণি বাড়ি ফিরছেন। পুষ্পদেবী হেসে কিছুক্ষণ কথা বললেন। কথার ফাঁকে জেনে নিলেন ‘ধীরা’ শব্দের অর্থ।
ছোট্ট ঘরের ঘুলঘুলি জানালা দিয়ে বিকালের পড়ন্ত আলো তেরছা ভাবে সুকুমারবাবুর মুখে পড়েছে। ভ্যাপসা গরম ও রোদের তাপে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে উঠে পড়লেন। ঘর থেকে বেরিয়ে, আনমনে ছাদে পায়চারি করতে লাগলেন। দিনের শেষে দিবাকরের অস্তরাগের বিচ্ছুরণ মনের বিষণ্ণতা কাটিয়ে দিল। হঠাৎ করে সিঁড়ির মুখে গিয়ে আলতো স্বরে ডাকলেন, “কি গো একবার ছাদে আসবে? এসো না লক্ষ্মীটি! অস্তগামী সূর্যকে একসাথে দেখি। মনের জানলা খুলে যাবে, জানো…’’
এই ডাক উপেক্ষা করার বাসনা পুষ্পদেবীর নেই। ধীর পায়ে ছাদে উঠে এলেন। দুই প্রৌঢ় মানুষ, পরস্পরের হাত সঙ্গম মুদ্রায় আবদ্ধ করে দিনমণির পাটে যাওয়া দেখতে থাকলেন অবাক বিস্ময়ে।
গোধূলির আলো মাদকতা মিশিয়েছে প্রকৃতির অনির্বচনীয় মহিমায়। আকাশের পশ্চিম কোণে সন্ধ্যাতারা জ্বলছে। সুকুমারবাবুর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর অর্ধাঙ্গিনী। ধরা গলায় বললেন, “আমি সবসময় ব্যাঁকা কথা বলি, তাই তুমি রাগ করো?’’ এই প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে তা জানা নেই সুকুমারবাবুর। তাই নির্বাক হয়ে রইলেন। পুষ্পদেবী সজল চোখে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন, “ধীরা কথাটার মানে স্কুলের দিদির থেকে জেনেই তোমায় বলছি। আমার প্রতি অনেক অভিযোগ তোমার, তাই না? জানো স্কুলের দিদির সাথে ভাব জমিয়েছি শুধু ওঁর ছাত্র-ছাত্রীদের দু’চোখ ভরে দেখবো বলে। নিত্যদিন দাঁড়িয়ে থাকি গল্প করার নেশায় নয় গো…ওই বাচ্চারা যখন বাড়ি ফেরে তখন আমার মমতা জেগে ওঠে। দিদিটা কত ভাগ্যবান!
অত বাচ্চাদের সঙ্গ পায়।”
তারপর ডুকরে কেঁদে পুনরায় ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলে উঠলেন,
“আসলে দেবকী হতে পারি নি তো! কিন্তু যশোদা হতে চেয়েছিলাম, তবুও তুমি রাজি হলে না। আমার দিকটা একবারও ভেবে দেখলে না তুমি?”
দুই চোখের জলের ধারা সুকুমারবাবুর পরনের ফতুয়া ভিজিয়ে বুকের ওপর রেখাপাত করল। সেখানেও যে অন্তঃসলিলা ফল্গু বয়ে চলেছে। সুকুমারবাবু স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে অস্ফুটে বললেন, “না পুষ্প কাঁদবে না একদম। আমরা পরস্পরের সঙ্গী তো! তোমার সৌরভে আমি, আমার চেতনায় তুমি।’’
চিলেকোঠার ছাদের আলসেতে দুটি গোলা-পায়রা একে অপরের চঞ্চু স্পর্শ করে ডাকতে লাগলো, বক…বকম-বকম…
তারিখঃ জুলাই ৬, ২০২১