স্মৃতিতে হুমায়ুন আজাদ

 

ক্লাসে ঢুকলেন হুমায়ুন আজাদ স্যার। আমার তাঁর সঙ্গে প্রথম ক্লাস। চুপচাপ বসে আছি, আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন। সেই হাসি আজও আমার চোখে লেগে আছে। হাসিটা ছিলো গর্ব মেশানো। তাঁর একজন উত্তরসূরী পেয়েছেন যে বাংলায় পড়তে এসেছে তাঁর মতো হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।

 

১২ই অগাস্ট ছিলো হুমায়ুন মামার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিটি মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। আমাদের পরিবারের একজন সদস্য, দেশের একজন বিখ্যাত বড় মনের মানুষ। তাঁর মতো এমন অমায়িক একজন মানুষের অমানবিক মৃত্যু মেনে নিতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়।

 

হুমায়ুন আজাদ তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় কিন্তু তাঁর বড় বোন ছিলেন আমার চাচীমা। সব ভাইদের নামের শেষে কবির আছে, মামার নামও হুমায়ুন কবির কিন্তু একসময় তিনি পরিচিত হলেন হুমায়ুন আজাদ নামে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক ও ভাষাবিদ। তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী, ধর্মসংস্কারবিরোধী মুক্তমনের প্রাণখোলা মানুষ। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্‌স্কি-উদ্ভাবিত রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণতত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল “প্রোনোমিনালাইজেশান ইন বেঙ্গলি” অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ।

 

বিক্রমপুরের মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ভীষণ গর্বিত। বিভিন্ন লেখায় তিনি বিক্রমপুরের রাঢ়িখালের স্মৃতি তুলে ধরেছেন। বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে কথা বলতেন। আমার দেখা হুমায়ুন আজাদ যদি আমি লিখতে যাই তাহলে তেমন কিছুই হয়তো লিখতে পারবো না কারণ তাঁকে আমরা খুব ভয় পেতাম। আমি খুব বেশি ছোট হওয়াতে এবং তিনি খুব ব্যস্ত মানুষ হওয়ায় তাঁকে আমি তেমনভাবে কখনো পাইনি। কালো ফ্রেমের চশমার সাথে কোঁকড়ানো চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। চেহারায় একটা ভারিক্কি ভাব থাকলেও খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। আমার বাবাকে খুব দুষ্টুমি করে কথা বলতে শুনতাম তাঁর সঙ্গে আর তা ছিলো ধর্ম নিয়ে তর্ক।

 

হুমায়ুন মামার বই সবসময়ই আমাদের বাসায় থাকতো কারণ আমার বড় ভাইয়া জিয়া করিম ছিলেন তাঁর লেখার ভক্ত। ভাইয়া তখন বুয়েটে পড়ে। মামা বইগুলো প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই ভাইয়াকে গিফট করতেন। মজার কথা হলো যখন ‘নারী’ বইটা প্রকাশ হলো ভাইয়াই আমাকে প্রথম বইটি পড়তে দিল। বই খুলে দেখলাম অটোগ্রাফ দেওয়া ভাইয়াকে আর আমাকে। এই বইটি তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলো নারীবাদী লেখক হিসেবে এবং পরে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ায় তাঁকে প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। একসময় এসব কারণেই তাঁকে ঘাতকদের শিকার‌ হতে হয়। তাঁর লেখা আমার প্রিয় বই ‘বুক পকেটে জোনাকি পোকা’ নাম শুনেই আমি মুগ্ধ। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ প্রিয় কবিতা। ‘আমাদের মা’ কবিতায় তিনি তাঁর পরিবারের নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন। নানু এমনই ছিলেন – যেন ‘পদ্ম পুকুর’, সবসময় টলমল করতেন। কবিতাটি পড়ে আমার তখন থেকেই ইচ্ছে হলো আমি হুমায়ুন মামার মতো কবিতা লিখবো। শুরু হলো আমার কবিতার সাথে পথ চলা।

‘ভালো থেকো’ কবিতাটি পড়তে গেলে আমি ভালোথাকায় ডুবে যেতাম‌। স্কুলে থাকাকালীন সময়েই আমি ঠিক করে ফেললাম আমি কবিতা লিখবো এবং বাংলায় পড়াশোনা করবো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজির ছাত্রী হয়েও আমি বাংলায় একটা মাস্টার্স করলাম তা’ও হুমায়ুন মামার উৎসাহে। আমার কবিতা পড়ে তিনি খুব উৎসাহ দিতেন। বলতেন, “লিখে যাও বেশি বেশি করে। একদিন দেখবে তুমি খুব ভালো লিখবে।”  আজও এই কথা আমার কানে বাজে। আজও আমি উৎসাহ পাই তাঁর লেখা পড়ে। “সব কিছু নষ্টদের দখলে যাবে” এই ভবিষ্যতবাণী আমাকে ব্যথিত করে।

 

আমার দেখা মতে মামা ছিলেন খুব স্পষ্টভাষী, সত্যবাদী, আধুনিক একজন মানুষ। তিনি কাউকে ভয় পেয়ে কখনো থেমে যাননি। আমরা তাঁর ভাগনা ভাগ্নী যারা পড়াশোনায় ভালো, প্রিয় ছিলাম। রেজাল্ট ভালো হলে খুব খুশি হতেন। যদিও সবাই জানতো পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি খুব কঠিন ছিলেন কিন্তু আমি জানি তিনি ছিলেন সবার খুব প্রিয় শিক্ষক। তিনি কখনো ইউনিভার্সিটির কোনো ছাত্রছাত্রীকে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য আটকাননি। যখন আমি মাস্টার্স ফাইনাল দেবো মামা তখন ডিপার্টমেন্টের প্রধান। আমরা যারা পার্সেন্টেজের জন্য পরীক্ষা দিতে আটকে গেলাম তিনি সবাইকে অনুমতি দিয়ে দিলেন পরীক্ষা দেওয়ার। এর থেকে বোঝা যায় তিনি কতো বড় মনের আর কতো মহৎ প্রাণ শিক্ষক ছিলেন। তিনি কখনোই চাননি কেউ পড়াশোনায় থেমে যাক।

 

২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় বই ‘আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’। এতে তাঁর মনে দেশপ্রেমের এক ব্যথিত চিত্র ফুটে উঠেছে। আমার মনের কথাগুলোই যেন তিনি বলেছেন আক্ষেপ করে। যে প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখতেন সেই সমাজ তৈরি হয়নি। এই সমাজের অধঃপতন তিনি দেখতে চাননি। ভাইয়ার সাথে এ নিয়ে তাঁর বেশ কথা হতো। ২০০৪’র ফেব্রুয়ারির বইমেলার সময় শুনতে পেলাম মামাকে আততায়ীরা হামলা করেছে। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। যদিও দেখা করতে পারিনি। তখন তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ড থেকে ফিরে এলেন। তার কিছুদিন পর ৭ই অগাস্ট তিনি চলে গেলেন জার্মানিতে একটা গবেষণার কাজে কিন্তু ১২ই অগাস্ট তাঁকে ফিরে আসতে হলো লাশ হয়ে। ঘাতকের হামলার পর শুনেছি তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও এই ক’মাস শরীর বেশি ভালো ছিল না। মৌলি তখন ছোটই বলতে গেলে। মামী খুবই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন তিনটি বাচ্চা নিয়ে। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় তাঁর প্রিয় রাঢ়িখাল গ্রামে।

 

আমার দেখা মতে তিনি একজন স্পষ্টভাষী সত্যবাদী মানুষ। তিনি সমাজের নোংরামি অরাজকতা বদলে দিতে চেয়েছিলেন। প্রতিবাদী মনোভাব তাঁর বিশাল মনের পরিচয় বহন করে। যুগ যুগ ধরে অনেক কবি সাহিত্যিকদের জন্ম হবে কিন্তু হুমায়ুন আজাদের মতো প্রতিবাদী লেখকের জন্ম হবে কিনা সন্দেহ। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, অধ্যাপক, সমাজসংস্কারক ছিলেন।‌ আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন। সে হুমায়ুন আজাদ, আমার প্রিয় বড় মামা।

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse