হলুদ পাখির ডায়রি
রুবানা ফারাহ আদিবা (ঊর্মি )
১
আষাঢ়ের আকাশ জোড়া কালো মেঘে মাঝে মাঝে বিজলি চমকে উঠছে। ইচ্ছা করেই জানলার পাল্লাদুটো আজ হাট করে খোলা রেখেছি। দু’একটা জলের ছাঁট গালে মুখে এসে আছড়ে পড়ছে আর তখন, চোখ বুজে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ ফুসফুসে ভরে নিতে ভীষণ ভালো লাগছিল। আচ্ছা, মা কি করছে? মাঝে মাঝে মা কেমন চুপচাপ হয়ে যায়। ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা মাকে সেই সময়টাতে। খুব করে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে মাথা ডুবিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তখন। মায়ের গায়ের গন্ধটাও বৃষ্টি আর মাটির গন্ধের মতো, তবে মায়ের একটা সম্পূর্ণ নিজস্ব এসেন্স মিশে থাকে তাতে।
আমি রানু, ছটফটে স্বভাবের এক তরুনী। বাইশ পেরিয়ে তেইশে পড়েছি সদ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে এবার প্রথম বছর। বয়সে দুবছরের বড় আমার একমাত্র ভাই রণো, বস্টনে মাষ্টার্স করছে মাইক্রোইকমিক্সে। বাবা সদাসর্বদাই তাঁর কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট এর কারণে ছুটে ছুটে বেড়াতে হয়। তবুও এর মাঝে যখনই আমাদের সকলের সময়র অন্ত্যমিল মিলে গেলে, বলা যেতে পারে একসাথে খুব ভালো পারিবারিক সময় কাটে। আমার মা বন্যা ইসলাম, পেশায় একজন আর্কিটেক্ট। নিভৃতচারী এবং মিতবাক। নয়টা—দুটো অফিস, শখ—বাগান করা এবং সঙ্গীত। বুদ্ধি হবার পর ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, সংসার ধর্ম পালনে আমার মায়ের কোনো ক্রুটি নেই। অফিসের দায়িত্ব সামলে নেয়া, আমাদের দুষ্টুমি বরদাস্ত করা থেকে শুরু করে বাদবাকি সব দায়িত্ব হাসিমুখে করেছে। বন্ধুদের কাছে ওদের বাবা মার কত অশান্তির কথা শুনেছি, ভেবেছি, আর আশ্বস্ত বোধ করেছি এই ভেবে যে, যাক, আমাদের সংসারে এক তিল পরিমান দু:খ নেই। আমার সুখী সুখী মায়ের পাখির নীড়ের মত দুচোখে কখনও অতৃপ্তির ছাপ দেখিনি। কিন্তু আমি একদিন খোঁজ পেয়ে গেছিলাম যে, মায়ের মনের চোরা গলির এক কোণে একটা দু:খ পড়ে আছে ধূলোবালি মেখে ,অনাদরে অবহেলায়।
২
তখন আমার ক্লাস টেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছি। ঘরে ঢুকে চাপা গলায় মা, বাবা দুজনের উত্তেজিত কথোপকথন শুনে ফেলেছিলাম। দরজার এপাশে আমার উপস্হিতি ওরা বুঝতে পারেনি।এই প্রসঙ্গে অভীক মামার পরিচয় দিতে হয়— উনি মায়ের কৈশোরের বন্ধু। উদাসীন এবং বোহেমিয়ান একজন অগোছালো মানুষ। কবি এবং লেখক হিসেবে সুখ্যাতি আছে। নরওয়ে থেকে বহুবছর পর দেশে এসেছিলেন একুশে সাহিত্য পদক প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে। কত বছর পর মায়ের সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল আজ আর মনে নেই। মাকে সেই অনুষ্ঠানে সরকারী পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল গান গাইবার জন্য। সেই কয়েকটা দিন মাকে সম্পূর্ণ অন্য এক আলোয় দেখেছিলাম। যেন ফিরে এসেছিল, কৈশোরের সেই অকারণ খিলখিল হাসি, শাড়ি পড়ে বারবার নিজেকে পরখ করার মত সুখের মুহূর্তগুলো ….. নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে যেন ভরপুর এক প্রাণ।
আজ হয়তো আমি এমন করে ভাবতে পারছি। কিন্তু সেই দিনগুলোতে আমার কেন যেন মাকে খুব অসহ্য লেগেছিল…. মনে হত মাকে হারিয়ে ফেলছি। আমার কাছে, মা মানেই স্কুলের পর বাড়িতে ফিরেই মাকে জড়িয়ে ধরা, মা মানেই রান্নাঘরের হিসেব নিকেশ, বাবার রুমাল আর জুতো বের করা আছে কি না তার নজরদারী, ভাইয়ের পরীক্ষার রুটিন নিয়ে সচকিত হয়ে ওঠা … ইত্যাদি ইত্যাদি। ভুল বুঝবেন না, আগেই বলেছি, অফিস সামাল দেয়ার পরও মা নিপুন পারদর্শী ছিলেন এই কাজগুলোতে। মার সেই কদিনের ব্যস্ততায়, আমার অভিমান জমে উঠছিল বরফের মতো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, অভীক মামার কারণেমায়ের এই উচ্ছলতাকে বাবা বরদাস্ত করতে পারছিল না। এই নিয়ে বাড়ির অশান্তি সেদিন চরমে উঠেছিল। কিছুতেই বাবাকে বোঝাতে পারছিল না মা। বাবার জেদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল মাকে। এয়ারপোর্টে অভীক মামাকে সি অফ করতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি মা।অনেকক্ষন ঘরের ভেতর প্রচন্ড চিৎকার চেচামেচির পর মা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে, খাবার ঘরে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিব্রত হয়ে পড়েছিল।চোখের নীচে জলের দাগ স্পষ্ট, আর ফর্সা গালে …. না না, নিশ্চয়ই না। বাবা এমন অমানুষ হয়ে উঠতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না ।
তার পর থেকে মাকে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখেছি। গুটিয়ে ফেলতে দেখেছি নিজেকে। কিন্তু সংসারের প্রতি কখনই কোনো অমনোযোগ দেখিনি এবং ছিলও না কখনো প্রকৃত অর্থে। যখন আমার ঘুম আসত না, লক্ষ্য করতাম মা শান্ত হয়ে বসে আছে বারান্দায়। কোলের ওপর কখনও একটা বই, নিবিষ্ট চোখ দুটো হয়তো আটকে আছে কোনো পাতায়। একটা ডায়েরি ছিল মায়ের। কালো রঙের সোনালী বুকমার্কার দেয়া। বাবা বাড়ি থাকত না যখন, তখন খসখস করে কিছু লিখত, ভাবত চুপচাপ আর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যেত মাঝে মাঝে। সেই ডায়েরিটা রাখা থাকত মার ড্র্যাফটিং টেবিলের সাথের লাগানো ড্রয়ারে। আর চাবিটা সযত্নে কোথায় রাখা থাকত জানি না। বাবা সেবার দিনাজপুরের পাওয়ার প্ল্যান্ট এ ট্যুর এ গেছে। ছুটির দিন। কিছু ড্রইং নিয়ে মা বসেছে।হঠাৎ অফিস থেকে একটা জরুরী ফোন এল। গুরুত্বপূর্ণ একজন ক্লায়েন্ট তার অফিস প্ল্যানের খসড়া ডিজাইন দেখতে ইচ্ছুক। বিকেলের ফ্লাইটে অ্যামেরিকা যাওয়ার আগে প্ল্যান অ্যাপ্রুভ করে দিয়ে যেতে চায় সে।মা চটজলদি একটা কুর্তা গায়ে চাপিয়ে বের হয়ে গেল অফিসের পথে। কিন্তু ভুলে গেল চাবিটা ঝুলছে ড্রয়ারের পাল্লায়।
হ্যাঁ, আমি অপরাধ করেছিলাম সেদিন। আমার কৌতুহলী মন অশান্ত হয়ে উঠেছিল। কী এমন লেখে মা, কেন উদাস হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। কাঁপা কাঁপা অপরাধী আঙ্গুলে খুলেছিলাম সেই ডায়েরি, দেখেছিলাম পাতার পর পাতা লেখা একটা চাপা দু:খের উপাখ্যান। দুজন তরুণ তরুণীর জীবনের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা ভেঙে যাওয়ার অসম্পূর্ণ এক গল্পের কথা বলা ছিল। অভীক মামার যাযাবর জীবনকে মায়ের জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয়ার অনুমতি দেয়নি কোনো পক্ষের অভিভাবক।তাই, ওদের স্বপ্নকে একটা পাখির ডানায় বেঁধে ওরা উড়িয়ে দিয়েছিল অজানা গন্তব্যে।
এরপর মায়ের সংসার, আমাদের নিয়ে ব্যস্ততা এবং নিজের কাজে আকন্ঠ ডুবে থেকেছে মা। মরশুমি ফুল, তানপুরা হয়ে উঠেছে তাঁর একান্ত সহচর।পরের তেইশ বছর সে নিজেকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করে গেছে গোপন ক্ষত থেকে।সেদিনও যেমন শেষ কথা ছাড়াই বিচ্ছেদ, তেইশ বছর পরও মায়ের এই অসহায় অপারগতা কাটেনি।
৩
“আপামনি, ও আপামনি, উঠেন। কলেজ যাইবেন না?”
কবুতরীর ডাকে ঘুম ভাঙল। চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে কখন জানতেই পারিনি। বারান্দায় বেয়ে ওঠা মাধবীলতা ছুঁয়ে আছে ঝিকিমিকি রোদকে আদুরে খরগোশের মতো। মা নাশতার টেবিলে ডাকাডাকি, বাবার রুমাল, ওয়ালেট, চশমা ইত্যাদি গুছিয়ে দেবার পাশাপাশি প্রতিদিনের মত নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে। আমার মধ্যবয়সের মায়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি মাঝে মাঝে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে মা প্রতিদিন একটা টিপ পড়বেই, যতই ব্যস্ততা থাকুক। মাঝে মাঝে মনে হয়, দুই ভ্রুর মাঝখানে মার তৃতীয় নয়ন থাকে।
মাকে তাড়া দিয়ে আমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ার জন্য খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়লাম। মাকে নিয়ে আজ একসাথে বেরোনোর প্ল্যানটা আগেই ঠিক করা ছিল। দুজনেই ফ্লু ভ্যাকসিন নেব, তারপর আড়ং বা যাত্রা থেকে পছন্দের কিছু শীতের চাদর কিনব। আবেদ ভাইকে বলে দিয়েছিলাম গাড়ি ইউনাইটেড হসপিটালে যাবে। আজ আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। হলদে কুসুম রোদ মার গালে এসে পড়েছে, কথার ফাঁকে মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ হাসি …মন ভুলানো চোখ জুড়ানো। ভুলেই গিয়েছিলাম হাসলে আমার মায়ের এক গালে দুর্দান্ত টোল খেলে যায়।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। গাড়ি পার্ক করতেই টের পেলাম এসে পড়েছি গন্তব্যে। হসপিটাল লবিতে মাকে বসতে বলে রিসেপশন থেকে বিস্তারিত সব জেনে নিয়ে এলিভেটরে উঠলাম। বুঝতে পারছি, মা একটু অস্হির হয়ে পড়ছে, কেননা ভ্যাকসিন বুথটা নীচেই ছিল। মায়ের হাত ধরে ৩০২ নং কেবিনের দরজায় মৃদু টোকা দিতেই দরজা খুলে গেলো। মার চকিত চাহনিতে দেখলাম, পাখির নীড়ে তখন জল থৈ থৈ —-
শুধু বললাম, “গাড়ি রেখে যাচ্ছি, তুমি যখন খুশি এসো”-
গত সপ্তাহে একটা পত্রিকাতে অভীক মামার দেশে ফেরার সংবাদ পেয়েছিলাম। পত্রিকা অফিস থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে তাঁর সাথে কথা বলে জেনেছিলাম, জীবনের শেষ কটা দিন তাঁর দেশে থাকার ইচ্ছে।পুরোপুরি মেডিকাল চেক আপের জন্য আজ এই হাসপাতালে আসবেন। না, অভীক মামাকে আমাদের এখানে আসবার কথা কিছু বলিনি। কী অসুস্হতা তাও জানতে চাইনি। আজকের দিনটা শুধুই ওদের হোক। মা তার কিশোরবেলার নরম রোদে একটু বসে থাকুক। ডায়রীর হলুদ পাতাগুলোতে না হয় আবীর লাগুক। কার এমন কী ক্ষতি তাতে?
আমি এলিভেটরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি…. আমার দু’চোখেও বৃষ্টি নেমেছে।
তারিখঃ ডিসেম্বর ১৯, ২০২০