হাঙর হ্রদ
চিরন্তন ভট্টাচার্য
হাওড়া স্টেশন থেকেই বেশ কিছু কেক জাতীয় শুকনো খাবার নিয়ে নিয়েছিল হেমন্ত। ট্রেনের প্যান্ট্রির যে খাবার দেয় তার দাম যেমন বেশী স্বাদও ততোধিক খারাপ। টু টিয়ার এসি কামরায় আপার বার্থে বসে উল্টোদিকের আপার বার্থের ভদ্রলোকের দিকে বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল। অথচ একদম সাধারণ একজন বয়স্ক মানুষ। বয়স মনে হয় সত্তরের আশেপাশে। মোটা ফ্রেমের চশমা। সারাটা জার্নি একমনে বই পড়ে যাচ্ছেন। এরকম তো হতেই পারে। তাহলে এত কৌতূহল তৈরি হচ্ছে কেন! আরেকটা বিষয় ওর মনে পড়লো ভদ্রলোককে সারা রাস্তা কিছুই খেতে দেখেনি। ট্রেন যখন মোগলসরাই যার বর্তমান নাম পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশনে ঢুকলো তখন ঘড়ির কাঁটা সবে সবে রাত সাড়ে দশটা পেরিয়েছে। তার মানে ঠিক টাইমেই চলছে। ট্রেন লেট নেই। পাশে রাখা প্লাস্টিকের সাইড ব্যাগ থেকে ফ্রুট কেক আর কলা খেয়ে নিয়ে টয়লেট থেকে ফিরে বার্থে উঠতে যাচ্ছে তখনই ভদ্রলোক নিজে থেকে বললেন ‘তুমি কতদূর যাবে?’ তারপরে একটু থেমে বললেন ‘আমার থেকে বয়সে অনেকটা ছোট তাই তুমি করে বললাম। কিছু মনে করলে না তো?’ হেমন্ত বললো ‘না না। কিচ্ছু মনে করিনি। আপনি বয়সে আমার দ্বিগুণ হবেন। আমার বাবার বয়সী মানুষ। আমি গোয়ালিয়র যাচ্ছি।’ ভদ্রলোক বললেন ‘আমি অনিমেষ রায়। তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে কাকু বলে ডাকতে পারো। তবে মেসোমশাই বলতে পারবে না। কারণ তাহলে আবার একটি মাসীমার দরকার পড়ে!’ নিজের পরিহাসে নিজেই হাসলেন ভদ্রলোক। হেমন্ত এবারে সাহস করে বললো ‘কাকু আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি কিছু একটা পড়ে চলেছেন। কী বই একবার দেখতে পারি?’ অনিমেষ রায় বললেন ‘নিশ্চয়ই। তুমি ইচ্ছে করলে পড়তেও পারো। আমার অনেকবার পড়া।’ হেমন্ত বইটা নিয়ে দেখলো পুরনো সোভিয়েত ল্যান্ডের রাদুগা প্রকাশনের একটা বই। বইটার নাম ‘হাঙর হ্রদ’। লেখকের নাম ইউনি ইউজেঙ্কো। বাংলায় অনুবাদ করা। বইটা একটু উল্টেপাল্টে দেখে ওনার দিকে ফেরৎ দিতে গেল, কারণ রাতে আলো নিভিয়ে দিতে হবে। না হলে বাকি যাত্রীরা আপত্তি করতে পারে। কিন্তু ভদ্রলোক বললেন ‘তুমি কাল সকালে পড়ে তারপরে আমাকে নামার আগে ফেরত দিলেই হবে।’ আলো নিভিয়ে দিতেই বাইরের অন্ধকার এসি কোচের শার্সি ভেদ করে সোজা ভেতরে চলে এলো। মাঝে মাঝে একটা দুটো আলোর ফুলকি পথ ভুলে কামরার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েও আবার নিবিড় অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে রাতপাহারার বাঁশীর মত ঘুম দুই চোখের কোল বেয়ে নেমে আসছিলো।
রাশিয়ায় মস্কো শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা বিশাল হ্রদ ছিলো। সেই হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিলো অনুপম। কিন্তু সেই হ্রদে ছিলো হাঙরের আতঙ্ক। ভয়ে খুব বেশি লোকজন সেই হ্রদের জলে পা রাখতো না। কিন্তু একদিন নিকোলাই নামে একটি তরুণ সাহস করে সেই হ্রদের জলে নামলো। হ্রদের চারপাশে ঘন জঙ্গল। কোনো কোনো জায়গায় পাড়ের মাটি হ্রদের মধ্যে অনেকটা প্রসারিত হয়ে গেছে। তার মধ্যেও প্রাচীন অরণ্যের মত গহীন জঙ্গল। নিকোলাই সাঁতার কাটতে কাটতে একসময় বুঝতে পারে যে সে দিশা হারিয়েছে। যতবার ঠিক জায়গায় যেতে চাইছে ততবার সেই গাছগুলোর প্রলম্বিত ছায়া ওকে বিভ্রান্ত করে তুলছে। একসময় দমহারা হয়ে ধীরে ধীরে নিস্পন্দ হয়ে আসতে লাগলো শরীর। বেশ কিছুক্ষণ পরে নিকোলাই যখন জ্ঞান ফিরে পেলো তখন সে আশ্চর্য হয়ে দেখলো সে একটা আলো ঝলমলে শহরের লাগোয়া বেলাভূমিতে শুয়ে আছে। ওর প্রথমে মনে হয়েছিলো তাহলে হাঙর হ্রদের লাগোয়া তটে নিশ্চয় কোনো শহর আছে যা এতদিন অজানা ছিলো। মনে মনে খুশী হলো খুব। হাঙর হ্রদে নামা তার মানে ওর সার্থক হয়েছে। গোটা দুনিয়াকে জানাতে পারবে এমন একটা আবিষ্কারের কথা। তারপরেই ও বুঝতে পারলো কোথাও একটা ভুল হয়েছে। ও কোনো বেলাভূমিতে শুয়ে নেই, ও শুয়ে আছে জলের তলায়। কিন্তু নিজেই আশ্চর্য হচ্ছিল যে ও বেঁচে আছে। এবং আরও আশ্চর্যের যে শ্বাস – প্রশ্বাস নিতে ওর কোনো কষ্ট হচ্ছে না। নিকোলাই সাঁতার কেটে শহরের ভিতরে ঢুকে এলো। দেখলো রাস্তায় ঝকঝকে আলো। দোকানে সাজানো পশরা। খাবার দোকানে ভিড়। কিন্তু সবাই হাঙর। এইবারে ও ভয় পেয়ে গেলো। বুঝতে পারলো হাঙরগুলো ওকে পেলে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে। কিন্তু দেখলো হাঙরগুলো ওকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। কেউ ওকে খেতেও আসছে না আবার কেউ ওর কাছাকাছি এসে ভাব করারও চেষ্টা করছে না।। নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে অনেকটাই সুনিশ্চিত হয়ে নিকোলাই সাঁতার কেটে কেটে শহরটা ঘুরে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। বেশ জমজমাট শহর। যেমন মানুষদের শহরে হয়। দোকান, পশরা, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া, হইহুল্লোড় সব কিছু। কিন্তু ও কোথাও ঢুকতে পারছে না। তাছাড়া এদের এখানে মুদ্রার প্রচলন কী তাও জানে না। বেশ খানিকটা সময় পার করে অনেক এদিক ওদিক ঘোরার পরে একটা জায়গা দেখতে পেলো বেশ নির্জন। আলো আছে কিন্তু ভিড় নেই। নিকোলাই ওখানেই চুপচাপ বসে রইলো। খিদে পেয়েছে কিন্তু এখানে খাবার কোথায়! হাঙরদের শহরের দোকানের খাবার হয়তো খাওয়া যেতো কিন্তু ওকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে ও শুনতে পেলো কেউ একজন ওর কানের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করছে ‘এই শহরে নতুন নাকি?’
নিকোলাই তাকিয়ে দেখলো একটা হাঙর। ও অবাক হলো যে ও হাঙরদের ভাষা বুঝতে পারছে! ও বললো ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো হাঙর নই। আমি একজন মানুষ!’ নিকোলাই আর সহ্য করতে পারছিল না। ওই হাঙরটাকেই জিজ্ঞাসা করলো ‘তোমরা আমাকে খেয়ে ফেলছ না কেন? তোমরা কি মানুষের মাংস খাও না? আর না হলে তোমাদের খাবার আমাকে দাও। এভাবে থাকা যায়?’ ওই হাঙরটা বললো ‘তুমি কোনো একসময় মানুষ ছিলে কিন্তু এখন আর নেই। অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তুমি এখন একটা হাঙর হয়ে গেছো। তাই কোনো হাঙর তোমাকে খাচ্ছে না। কিন্তু তুমি এখানে নতুন। হাঙর হ্রদে থেকে যাওয়ার চাবিকাঠি হলো প্রথমে তোমাকে একজন সঠিক হাঙর খুঁজে বার করতে হবে যে তোমাকে বাকি শহরের সঙ্গে পরিচিত করে তুলবে।’ হাঙরের কথা শুনে ওর কেন জানি না হাঙরটাকে খুব একাকী আর বিষণ্ণ মনে হলো। ও নিজের মনেই ওর একটা নাম দিলো একাকী হাঙর। একাকী হাঙর ওকে কিছু খাবার দিলো আর ঝিনুকের খোলার মত কয়েকটা জিনিষ দিলো। বোঝা গেল ওগুলোই এখানের মুদ্রা। নিকোলাই শরীরের জোর খুঁজে পেয়ে হাঙরের শহরে আবার ঢুকে পড়লো। এখন ওর কাছে মুদ্রা আছে তাই পশরা করতে কোনো সমস্যা হলো না। নানাভাবে নিকোলাই একদিন হাঙর হ্রদের হাঙরদের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারলো। বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। নিকোলাই এখন হাঙর হ্রদে বেশ পরিচিত। ও যে কোনো একদিন মানুষ ছিলো সেটাই ভুলে গেছে। হঠাৎই একদিন বেশ হইচই করে একা ফেরার সময়ে ওর মনে পড়ে গেলো ও একদিন মানুষ ছিলো এবং কিভাবে এখানে এলো। ও সেই নির্জন জায়গাটায় ফিরে গেলো আবার। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলো সেই একাকী হাঙরকে। নিকোলাই ওর কাছে গিয়ে বললো ‘আমি এখনো হাঙর হ্রদে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি কারণ সঠিক হাঙরকে আমি এখনো খুঁজে পাইনি।’ একাকী হাঙর জিজ্ঞাসা করলো ‘কিন্তু তুমি তাকে খুঁজতে এখানে এলে কেন? এখানে তো আর কেউ নেই। শহরের মধ্যেই তাকে খুঁজে পাবে!’ নিকোলাই ‘কোনো কিছু যেখানে হারায় আমরা সেখানেই খোঁজ করি। অন্য জায়গায় খুঁজলে কি পাবো?’ একটু থেমে একাকী হাঙরের দিকে তাকিয়ে বললো ‘আমি কি ঠিক কথা বললাম?’ একাকী হাঙর উত্তরে বললো ‘আমি জানতাম তুমি একদিন আবার ফিরে আসবে।’
গল্পটা যখন শেষ হওয়ার মুখে তখন ট্রেন একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর দুটো পাতা পড়তে বাকি। জানলার বাইরে চোখ দিয়ে হেমন্ত দেখলো দুপুর নেমেছে স্টেশনের গায়ে। স্টেশনের নাম ঢোলপুর জংশন। এরপরে আর মাঝখানে শুধু একটা স্টেশন – মোরেনা। মোবাইলে সময় দেখলো দুপুর পৌনে একটার কাছাকাছি। খুব তন্ময় হয়ে পড়ছিলো বইটা তাই অনিমেষ রায়কে খেয়াল করেনি। দেখলো ভদ্রলোক নিজের বার্থে নেই। হয়তো টয়লেটে গেছেন। উনিও গোয়ালিয়র যাচ্ছেন বলেই বলেছিলেন। ট্রেন ছাড়তে আবার বইতে মুখ ডুবালো। বইটা শেষ হতে খেয়াল করলো ট্রেন আচমকা কোনো স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। হয়তো সিগনাল পায়নি। অনিমেষ রায় এখনো ফেরেননি। তখনই জানালা দিয়ে তাকাতে খেয়াল করলো ভদ্রলোক প্লাটফর্ম ধরে ট্রেনের উল্টোদিকে হাঁটছেন। বইটা ফেরৎ দেওয়া হলো না অথচ ভদ্রলোক নেমে চলে যাচ্ছেন দেখে কোনো কিছু না ভেবে বইটা নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। প্লাটফর্ম নিচু। ঘাসের কার্পেট। ট্রেনের পাদানি থেকে লাফ দিয়ে নেমে দেখলো উনি ততক্ষণে উল্টোদিকের লাইন পেরিয়ে চলে গেছেন। হেমন্ত ডাকতে ডাকতে যতক্ষণে ওনার কাছে পৌঁছল ততক্ষণে ট্রেন হুইসল বাজিয়ে ছেড়ে দিল। অবশ্য তাতে ওর আফসোস কিছু নেই। ওর সঙ্গে কিছুই ছিল না যা ট্রেনে ফেলে এসেছে। আর রাস্তাও অল্প। অনিমেষ রায় ওর দিকে তাকিয়ে বললেন ‘এই রে তোমার ট্রেন তো ছেড়ে দিল। শুধু বই ফেরৎ দেওয়ার জন্য এত ঝুঁকি নিলে!’ হেমন্ত বললো ‘ওটা কোনো ব্যাপার না কাকু। আপনার বই ফেরৎ দিতে না পারলে মনে স্বস্তি পেতাম না।’ ভদ্রলোক বললেন ‘তুমি এখন কি করবে তাহলে? গোয়ালিয়র যাওয়ার লোকাল ট্রেন আছে সন্ধ্যের মুখে। এখন সবে বেলা একটা। তুমি এক কাজ করতে পারো। কিলোমিটার দুই হাঁটলেই একটা আশ্রম পাবে। ঠাকুর দেবতার ব্যাপার কিন্তু না। কয়েকজন বৃদ্ধা মিলে স্থানীয় বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখায়। আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব সুন্দর। সময় কাটিয়ে আসতে পারো।’ হেমন্ত বললো ‘ঠিক আছে কাকু। ওখান থেকেই ঘুরে আসি। আপনার বইটা রাখুন। খুব সুন্দর লেখাটা।’ ভদ্রলোক হাসলেন ‘বইটা আমি তোমাকেই দিয়ে এসেছিলাম। এমন পাঠকের কাছে বই রেখে যেতে ইচ্ছে করে। রেখে দাও।’ পুরনো সোভিয়েত দেশের বই, এমনিই ওরা খুব কম দাম নিত, সুতরাং বর্তমান আর্থিক মূল্য অতি নগণ্য। বয়স্ক একজন মানুষের কথা আর ফেলতে ইচ্ছে করলো না। ধন্যবাদ জানিয়ে ওনার দেখানো রাস্তা ধরে আশ্রমের দিকে এগোলো।
স্টেশনের সামনেটা ন্যাড়া ন্যাড়া। একটু দূরে দূরে একটা করে বড় গাছ। যত এগোতে থাকলো ততই গাছের ঘনত্ব বাড়তে লাগলো। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিরণ মাটিকে উষ্ণ করছে। শীতল ছায়ায় তবুও গরমের ভাবটা কমে গেল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় গাছগাছালির ফাঁকে কয়েকটা মাটির বাড়ি টালিতে ছাওয়া চোখে পড়লো। তখনই দেখা গেল টিনের একটা ফলকে হলুদ জমির ওপরে কালো কালি দিয়ে হিন্দিতে লেখা ‘আশ্রম’। হেমন্ত কেমন যেন আবিষ্টের মত ওই ফলকের পাশ দিয়ে ঘরগুলোর মধ্যের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রশস্ত উঠোনের চারদিকে কয়েকটা ঘর। দাঁড়িয়ে আছে। তখনই একটা গলা শুনে চমকে উঠলো ‘কে রে? হেম না? কতদিন পরে তোকে দেখলাম।’ খুব স্বাভাবিক গলায় কেউ একজন ভদ্রমহিলা কথাটা বললো। যেন ওর এখানে আসারই কথা ছিলো। তাকিয়ে দেখেই চিনতে পারলো, শিপ্রা কাকীমা। শিপ্রা কাকীমা এতদূরে চলে এসেছে! কাকীমা ওর সামনে এসে বললো ‘কি ভাবছিস? আমি এতদূর কীভাবে এলাম? এই আশ্রম? তাই ভাবছিস তো? এখন অত ভাবতে হবে না। অনেকদূর থেকে এলি বাবা আগে স্নান করে কিছু খেয়ে নে তারপরে শুনবি সব।’ হেমন্ত অবাক হয়ে যাচ্ছিল যেন স্বপ্নের মত হয়ে যাচ্ছে সব কিছু।
স্নানের জন্য নতুন গামছা। পরার জন্য কাচা পাঞ্জাবি আর পাজামা সবই নিখুঁতভাবে রাখা। যে ঘরটায় থাকতে দিল সেই ঘরটা মনে হয় গেস্ট রুম। দুপুরে ভাত খেয়ে একটা ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। তার থেকেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি হেমন্ত। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সামনে খোলা জানালা দিয়ে দেখলো সূর্য আকাশ জুড়ে মুঠো মুঠো রঙ ছড়িয়ে নিজেও টকটকে লাল হয়ে বসে আছে। একটু পরেই অস্ত যাবে। আবছায়ার মধ্যে চোখ একটু ধাতস্থ হতেই দেখলো শিপ্রা কাকীমা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে ওর একটা আগে পাওয়া বইটা ‘হাঙর হ্রদ’। তখনই ওর মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগে ওর মা – কাকীমারা এই শিপ্রা কাকীমাকে বলতো ‘হাঙর’। বাবা বা কাকাদের কারোকে শিপ্রা কাকীমার সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই বাড়িতে তুমুল অশান্তি। শিপ্রা কাকীমা ছিলেন একটি মাত্র কন্যাকে নিয়ে বিধবা। তবে অন্নের সংস্থান ছিলো। চাকরি করতেন প্রাইমারি স্কুলে। তবে ওনাকে নিয়ে ছিলো প্রচুর গুজব। একজন ভদ্রলোক আসতেন ওনার মেয়ে লিলিকে পড়াতে। সবাই বলতো ওই টুকু মেয়ের আবার পড়াতে লোক লাগে নাকি! ওসব সাজানো। ভদ্রলোক আসলে শিপ্রা কাকীমার প্রেমিক। তাছাড়া লিলির জন্ম নিয়েও ছিলো ধোঁয়াশা। ভৈরব কাকু মারা যাওয়ার আর লিলির জন্মানোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা সময়ের ব্যবধান ছিলো যার থেকে হয়তো ওনার অসতীত্ব প্রমাণ করা যেতো। কিন্তু কেউ কখনো হাতেনাতে কিছু ধরতে পারেনি তাই এর বেশী আর কিছু হয়নি। শিপ্রা কাকীমার জগৎ ছিলো দুটি – এক হলো তার মেয়ে আর দুই হলো তার বই। ওই বইয়ের টানে টানে নিষিদ্ধ জেনেও শিপ্রা কাকীমার বাড়ি দৌড়তো হেমন্ত। পরের দিকে অবশ্য বুঝতে পারছিলো অন্য একটা দিকে টান বাড়ছে। লিলি বড় হয়ে পড়তে চলে গেল দূরে। আর কাকীমাও রিটায়ার করার পরে কোথায় চলে গেল সে খবর আর কেউ রাখেনি। হঠাৎ এতদিন পরে এই আশ্রম, গিরিবালা, দাশরথি, মল্লিকা এই সব বৃদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে এই বিদ্যাচর্চার আলয় খুলে বসা – এটা শিপ্রা কাকীমাকেই মানায়।
সেই রাতটা থেকে যেতেই হলো ওখানে। শিপ্রা কাকীমা ‘হাঙর হ্রদ’ বইটা দেখিয়ে বললো ‘অনিমেষ তোকে বইটা দিলো?’ হেমন্ত অবাক হয়ে বললাম ‘তুমি কী করে জানলে?’ কাকীমা হাসলেন ‘বইটার একদম সামনের ফাঁকা পাতাটা তুই বোধহয় খুলিসনি! ওখানে আমার নাম লেখা আছে। এই একটা মাত্র সম্পদ তো ওর কাছে গচ্ছিত ছিলো আমার।’ হেমন্ত অবাক হয়ে বললো ‘তোমার জিনিষ উনি আমাকে দিয়ে দিলেন?’ কাকীমা বললেন ‘হাঙর হ্রদের নিয়ম হলো প্রথমে তোমাকে একটি সঠিক হাঙর নির্বাচন করতে হবে।’ হেমন্ত অবাক হচ্ছিল কাকীমার কথায়। কাকীমা বিষণ্ণ একটা হাসি দিয়ে বললেন ‘অনিমেষ তাহলে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিলো!’ এই কথার কিছুটা বুঝতে পারছিলো হেমন্ত। কাকীমা জিজ্ঞেস করলেন ‘তুই কোথায় যাচ্ছিলি?’ হেমন্ত বললো ‘গোয়ালিয়র’। কাকীমা বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করলেন। বললেন ‘সব হাঙর কিন্তু আমরা নিজের ইচ্ছেয় নির্বাচন করি না হেম। এসে যায়। তারা অনেকসময় প্রিয়তর হয়ে ওঠে অধিক।’ হেমন্ত মাটির দিকে তাকিয়ে বললো ‘হাঙর হ্রদে কুয়াশা জমে অনেক সময়। সব মা তো সন্তানের জন্ম দেন না!’ কাকীমা অবাক হলেন না। বললেন ‘সঠিক হাঙর চিনে নেওয়া শক্ত। কিন্তু একবার যদি তাকে চিনতে পারিস তাহলে সে থেকে যায়।’ হেমন্ত বললো ‘কাকীমা আমি গোয়ালিয়রে পৌঁছে লিলির হাতে বইটা তুলে দেব। যে প্রকৃত উত্তরাধিকারী সেই পাক।’ কাকীমা বললেন ‘কিন্তু অনিমেষ তো তোকে দিয়েছে। ওর নির্বাচন কে তো বাতিল করতে পারিস না!’ সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। নিশাময়ির পরিষ্কার আকাশে অজস্র তারা। ওরা ওই বিরাট উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। কাকীমার ঠিক পেছনে আধ খাওয়া চাঁদ, ঘোলাটে। হেমন্ত হঠাৎ সাহস করে বললো ‘কাকীমা তাহলে যদি উত্তরাধিকার ভাগ করে নিই লিলির সাথে?’ কাকীমা বললেন ‘তোর জন্য বা লিলির জন্য কে প্রকৃত হাঙর তা কি আর আমি বলতে পারি! তবে একটা কথা বলি তুই কি পারবি এটা? তুই তো সবটা জানিস না।’ হেমন্ত রাতের তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো ‘এখন আমি সবটাই জানি কাকীমা। কিন্তু হাঙর হ্রদের নিয়ম তো প্রকৃত হাঙর খোঁজার। হাঙরের হ্রদে তার আসার উৎস তো দরকার পড়ে না।’ একটু থেমে বললো ‘গল্পের নিকোলাই তো সমস্ত শহর ঘুরে আবার তার প্রথম হাঙরের কাছে ফিরে গিয়েছিল। সঠিক হাঙর কখনো ফিরিয়ে দেয় না বলেই তো জানি।’ কাকীমা জিজ্ঞাসা করলেন ‘লিলির ঠিকানা তুই জানিস?’ হেমন্ত মাথা নাড়লো ‘জানি। তাই তো শূন্য হাতে আসতে পারলাম।’ কাকীমা অল্প হাসলেন। যেন ভরসা পেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুই কি নিজেই ঘুরতে ঘুরতে এখানে এলি? নাকি অনিমেষ তোকে পাঠালো?’ হেমন্ত উত্তর দিলো ‘পাঠালেন বলাই যায়’ কাকীমা বললেন ‘তাহলে এবারে আমাকেও ব্যাগ গোছাতে হবে। সঙ্কেত খুব পরিষ্কার।’ হেমন্ত জিজ্ঞাসা করলো ‘কেন কাকীমা?’ কাকীমা বললেন ‘তুই হয়তো আমাকে ঘেন্না করবি। তাও বলি হেম – এই আমার হাঙর জীবন। বড় ভালো কাটালাম। পর জন্মে বিশ্বাস নেই। না হলে বলতাম আরেকটা এমন হাঙর জন্ম যেন পাই।’ হেমন্ত নিচু হয়ে শিপ্রা কাকীমাকে প্রণাম করলো। কাকীমার হাত ওর মাথায় ছুঁয়ে গেলো। স্পর্শের একটা ভাষা আছে। এই ভাষা ভরসার। মাথা তুলতে দেখলো চাঁদটা কাকীমার ঠিক মাথার ওপরে বিরাজমান। হেমন্ত বুঝতে পারলো কাকীমা ব্যাগ গোছানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩
আপনার গল্পের এই সুররিয়ালিস্টিক চিন্তা, আচ্ছন্ন করে দেয়।
আহা! কী সুন্দর সাবলীলভাবে গল্পের মধ্যে গল্পকে এনেছ চিরন্তন। মুগ্ধপাঠ আমার।
বাহ চমৎকার !