2039

 

একটু বেলা বাড়লেই রোদের তেজটা বাড়ছে। শুকনো কয়েকটা পাতা হাওয়ায় উড়ছে। বসন্ত এসে গেছে। আমি আর মৌরী এজলাস থেকে বেরিয়ে সামনে একটা চায়ের দোকানে এসে বসলাম। কোর্ট রুমের ভেতরটা খুব স্টাফি। যদিও এখন বাতানুকুল যন্ত্র চালু থাকে সব জায়গাতেই। ঊষ্ণায়ন বাড়ছে গোটা পৃথিবী জুড়েই। একটু খিদে খিদে পাচ্ছিল। আমি চায়ের সঙ্গে দুটো বিস্কুট চাইলাম। কাচের বয়ামে রাখা মামুলি দেশি বিস্কুট। সাদা জমির ওপরে কয়েকটা জোয়ান আর কালোজিরে ছড়ানো। আমার বেশ লাগে। মৌরীকে জিজ্ঞাসা করাতে জানালো ও শুধু চা নেবে। ওর মনের ওপর খুব ধকল গেছে এই কয়মাসে সেটা বোঝাই যায়। আজকেই ফাইনাল আর্গুমেন্ট আর রায়দান। ফাইনাল আর্গুমেন্ট হয়ে গেছে। তারপরেই খাওয়ার ব্রেক পড়ে গেল। লাঞ্চ আওয়ার শেষ হলেই বিচারক রায় জানিয়ে দেবে। একটা সম্পর্ক কিভাবে শুরু হয় আর তার শেষটা কিরকমভাবে হয়! আমি মৌরীকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘কি রে মনখারাপ লাগছে?’ মৌরী আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘হুস! মনখারাপ কিসের জন্য লাগবে! বিরক্ত লাগছে। এসব ফালতু ঝামেলায় সময় নষ্ট। ওদিকে অফিসের প্রজেক্ট জমা দিতে হবে। চাকরি চলে গেলে খাবো কী?’ কথাটা ফেলে দেবার নয়। আজ এই কঠিন সময়ে সবাইকে প্রতি মুহূর্তে দৌড়তে হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে। সেখানে এই কোর্ট আর উকিল এইসব করে মৌরীর কম সময় নষ্ট হল না। আমি পরিবেশটা হালকা করার জন্য বললাম ‘তোরা যদি কোর্ট কাছারী না করিস তাহলে ধর এই জজসাহেবের চাকরি থাকতো না। আবার এই উকিল বাবুদের ব্যবসা চলতো না! এটাও তো ভাবতে হবে!’ মৌরী আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো ‘তোর মত অত বিশ্ব দরদী তো আর হতে পারলাম না। ওই দেখ চা দিয়েছে। বিস্কূট আর চা গিলে চ বিয়ের শ্রাদ্ধটা শেষ করে আসি।’ চায়ের কাপ হাতে নিয়েই দেখলাম সৌর ওর এক বন্ধুর সঙ্গে উল্টোদিকের দোকানে দাঁড়িয়ে চা আর সিগারেট টানছে। স্বাভাবিক। এখন তো আমরা ওদের প্রতিপক্ষ। কিছুদিন আগে হলেও আমাকে টেনে ধরে নিয়ে যেত বা এখানে এসে একসঙ্গে সিগারেট টানতো। মৌরীকে দেখলাম ওদের দিকে তাকাচ্ছেই না। আমারই যেন কেমন মনটা খারাপ লাগছিলো। এই তো সেদিন কত হইচই। কত পরিকল্পনা। বিয়ে তো এখন এমনিই কমে গেছে। অধিকাংশ মানুষই আর বিয়ের চুক্তির মধ্যে যেতে চাইছে না। তার মধ্যেই এইরকম একটা দুটো বিয়ের অনুষ্ঠানে খুবই আনন্দ করা যায়।

 

এই 2039 সালে ডিজিটাল টেকনোলজি অনেকটা এগিয়ে গেছে। কৃত্রিম বুদ্ধি বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর যে চর্চা গত শতাব্দী বা সহস্রাব্দের শেষ দিকে শুরু হয়েছিলো সেটা এখন বিরাট এগিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে মানুষ এন্ড্রয়েড মানুষ তৈরী করছে। এর প্রাথমিক একটা বিরাট উপকারিতা হচ্ছে নিঃসঙ্গতাকে অনেকটা এড়ানো যায়। সত্যি বলতে কি এই এন্ড্রয়েড মানুষ বা রোবোট মানুষ আবিষ্কারের পরে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এই কঠিন সময়ে একটা মানুষের পক্ষে অন্য আরেকটা মানুষকে সঙ্গ দেওয়া খুবই কঠিন। তাই বিয়ের মত চুক্তিভিত্তিক সম্পর্কগুলো ক্রমশঃ কমে আসছে। এই 2039 এ এন্ড্রয়েড মানুষের দাম মোটামুটি মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে। তাছাড়া ব্যাঙ্ক আর ফাইন্যান্স কোম্পানীগুলো বসেই আছে ফাইন্যান্স করার জন্য। প্রায় সবারই এখন একটা করে এন্ড্রয়েড মানুষ সঙ্গী আছে। এরা এতটাই উন্নত এখন যে এমনকি যৌনতার মত অতি সূক্ষ্ম বিষয়কেও খুব ভালোভাবে সামলে নিতে পারে। কিন্তু সৌর আর মৌরীর মধ্যে গোলটা বাধলো এই এন্ড্রয়েড মানুষকে নিয়েই। এখন আর ডিভোর্স কোনো মামলা নয়। নিজেরা গিয়ে পোষাচ্ছে না সংসার করতে বললেই সঙ্গে সঙ্গে কোর্ট অর্ডার বার করে দিচ্ছে। তাদের সন্তান থাকলে অবশ্য তার জন্য আইনের অনেক রকম ফ্যাকড়া আছে। মৌরী আর সৌরর কোনো সন্তান হয়নি। তাই ওদের সমস্যাটা ডিভোর্স পাওয়া নিয়ে নয়। সমস্যাটা হলো এন্ড্রয়েড মানুষকে নিয়ে। মানুষের মত এন্ড্রয়েডেরও মেল আর ফিমেল ভাগ আছে। যে যার রুচি অনুযায়ী এদের ব্যবহার করে। সৌর মৌরীকে কয়েক বছর আগের জন্মদিনে বেশ দামী একটা এন্ডয়েড ম্যান কিনে উপহার দেয়। সে দেওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। এই সময়ে এগুলো খুব স্বাভাবিক। কারণ সৌর মাসের মধ্যে কেন বছরের মধ্যে কয়েকটা দিন ছাড়া মৌরীর সঙ্গে থাকতেই পারে না। তাই এটাকে একটা কম্পেনসেশনও বলা যেতে পারে। মৌরীরও দিন খারাপ যাচ্ছিল না। কিন্তু কয়েকমাস আগে মৌরী ফোন করে জানালো ওরা ডিভোর্সের মামলা করছে। সেই শুনে আমি যে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম তাও না। ডিভোর্সের মত মামলা এখন আকছার। সহমতের সঙ্গে বিচ্ছেদের মামলা আনলে সেদিনই অনেকসময় ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়া যায়। আমিও তাই ফোনটা পেয়ে অত কিছু আর ভাবিনি।

 

গরম চায়ের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়া আমার অভ্যেস। কিন্তু এই লোকাল মেড বেকারি বিস্কুটগুলো পেল্লায় সাইজের। তুলনায় ছোট কাঁচের গ্লাসের সরু ব্যাসের মধ্যে কিছুতেই কবজা করতে পারছিলাম না। মৌরী আমার হাত থেকে একটা বিস্কুট নিয়ে লম্বালম্বি আধখানা করে ভেঙে আমার হাতে দিয়ে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘তোর মাথার ঘিলুটা কি গোটাটাই শুকিয়ে গেছে? এইবারে পারবি দেখ।’ মৌরী চিরকালই এরকম কটকট করে কথা বলে। ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বললাম ‘তোর আর সৌর’র মধ্যে ঝামেলাটা কি নিয়ে বাধলো? তোরা তো বেশ হ্যাপি কাপল ছিলি!’ চোরা একটা হাওয়া কোথা থেকে এসে কয়েকটা শুকনো পাতাকে নিয়ে ‘কুমিরডাঙা’ খেলছিলো। মৌরী আনমনে সেদিকে তাকিয়ে চা’য়ে একটা চুমুক দিয়ে বললো ‘ঝামেলার তো কিছু ছিলো না এমনিতে। সম্পর্কটা মরে এসেছিলো। সবেরই তো এক্সপায়ারি ডেট থাকে। তাছাড়া সৌর তো বেশ কয়েকবছর বাতিস্লাভা, স্লোভাকিয়া তে। আমিও নিউইয়র্ক ছিলাম, তারপরে সিডনি। আর এখন এই বছর দুই কলকাতায় এসে গেড়ে বসেছি। অত দূরে দূরে রিমোট কন্ট্রোল সম্পর্ক আর কতদিন চলবে?’ চায়ের মধ্যে বিস্কুটের টুকরোটা বেশ নরম হয়ে গিয়েছিল। আন্দাজ করে ঝটপট তুলতে পেরেও বেশ খানিকটা খসে মাটিতে পড়লো। আমি মৌরীর দিকে তাকিয়ে বললাম ‘ডিভোর্স তো এখন আকছার ঘটছে। মানুষ যখনই বুঝতে পারছে সম্পর্কটা একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন সরে যাচ্ছে। লিখিত বা অলিখিত সব চুক্তিরই বিচার আদালত করে দিচ্ছে। তোদের তো যৌথ সম্পত্তি বা এসব খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। তাহলে এত কোর্ট কাছারি বা করা কেন? আর তোদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই কেন?’ মৌরী আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো ‘বিয়ে মানেই একটা লিখিত চুক্তি! তোর এই কথা আমি জীবনে মানি না। মানুষ ছেড়ে দে কুকুর – বিড়ালও তোর সঙ্গে থাকবে না! যদিও বিয়েটা আমার কাছে তেমন সুখের হলো না তাও তোর এই কথা আমি মানি না!’ আমি হেসে বললাম ‘অবিবাহিত কাপলদের তো অলিখিত চুক্তি বলেছি! ওসব কথা ছাড়। এখুনি কোর্ট রুমের ভেতরে যেতে হবে। আসল কথাটা বল।’ চায়ের কাপে আলতো একটা চুমুক দিয়ে বললো ‘আমার গত জন্মদিনের আগের জন্মদিনে সৌর আমাকে একটা বিশেষ গিফট দিয়েছিলো তোর মনে আছে? তোরা সবাই সেই নিয়ে আমার লেগ পুলিং চালিয়ে গেলি!’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ। সৌর সেবার কলকাতায় এলো তোর জন্মদিন মানাতে। তুই দারুন খুশী হয়েছিলি। ও একটা লেটেস্ট মডেলের অ্যান্ড্রয়েড ম্যান তোকে উপহার দিয়েছিলো। তুইও তো খুব উচ্ছসিত হয়েছিলি!’ মৌরী খুব উদাসীনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘দিয়েছিলো। আমিও খুব ভেসেছিলাম সেদিন। কিন্তু ওই অ্যান্ড্রয়েড ম্যানের প্রোগ্রাম সেট করা ছিলো সৌর’র ডুপ্লিকেট হিসাবে!’ আমি বললাম ‘এটা তো নরমাল। লিখিত চুক্তির সম্পর্কে, সরি, মানে বিবাহিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তো বর বা বউ রা তাই করে। নিজের অ্যান্ড্রয়েড রেপ্লিকা বানিয়ে পার্টনারকে গিফট করে। যাতে ভালোবাসার মানুষ অনুপস্থিত কখনো না থাকে!’ মৌরী আমার দিকে তাকিয়ে প্রচলিত একটা অশ্লীল গালি দিয়ে বললো ‘অবিবাহিত প্রেমিক – প্রেমিকারাও এটা করে! ছাগল! যাইহোক সমস্যাটা সেখান থেকেই শুরু হয়েছিলো।’

 

চায়ের দোকানের ওপরে টিনের চালা। তাপটা নীচে নামছে। একটা মান্ধাতার আমলের টেবিল ফ্যান ঘড়ঘড় করে ঘুরছে। একমাত্র এই জায়গাগুলো মনে হয় সেই ব্রিটিশ আমল থেকে একইরকম রয়ে গেছে। চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি মৌরীর দিকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘কিন্তু এর মধ্যে সমস্যা কোথায়? এখন তো এটা নরমাল।’ মৌরী বললো ‘নরমাল ততক্ষণ যতক্ষণ তুই অরিজিনালটাকে ভালোবাসতে পারবি। অরিজিনালকেই পছন্দ নয় তো তার রেপ্লিকাকে কে পছন্দ করবে!’ আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম ‘কিন্তু যখন এটা পেয়েছিলি তখন তো খুব খুশী হয়েছিলি। সে তো আমি নিজেই দেখেছি। তাহলে আবার কী হয়েছিলো? একটু ডিটেইলসে বল!’ মৌরী উদাসীনভাবে বাইরের রোদের দিকে তাকিয়েছিল। একটু পরে বললো ‘তোকে তো সব কথাই বলি। তাই বলেই দিই। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগছিলো। আর ওই অ্যান্ড্রয়েড টা খুব কাজের। মনেই হতো না যে সৌর আমার থেকে দূরে। একদম পুরোপুরি রেপ্লিকা। কিন্তু এরপরেই আমি চরম সত্যিটা উপলব্ধি করতে পারলাম!’ উল্টো পারের দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সৌর ওর বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় মশগুল। রায় নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য ওর উদ্বেগ থাকার কথাও না। এই 2039 সালে দাঁড়িয়েও আমি জানি যদি দাম্পত্যের রাস্তায় কাদা থাকে তাহলে সেই কাদার দাগটা শুধু ফিমেল পার্টনারের গায়েই লাগে। সুতরাং সৌর’র কাছে এটা উইন উইন গেম। রায় ওর দিকে গেলেও ভালো আবার না গেলেও ক্ষতি নেই। একটু চুপ করে মৌরী নিজেই বললো ‘ওই রেপ্লিকার সঙ্গে কয়েকটা মাস কাটিয়ে আমি বুঝতে পারলাম ভাগ্যিস সৌর আর আমি দূরে দূরে থাকি। না হলে এই সম্পর্ক অনেককাল আগেই শেষ হতো।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘সবই ঠিক আছে। এটাও নরমাল। কিন্তু এর মধ্যে পরকীয়া তত্ত্ব কোথা থেকে এলো? তাও আবার অ্যান্ড্রয়েড ম্যানের সাথে? ওই জিনিষের ব্যাবহার তো লিগাল। তাহলে?’ মৌরী আমার দিকে রাগ রাগ মুখ করে বললো ‘একটু সবুর কর! গাছে না উঠেই কলার কাঁদি পাড়বি না কি? বলতে দে ঘটনাটা। এর কিছুদিন পরে একবার সৌর এলো। সেই রাতে ও মজা করে প্রথমে অ্যান্ড্রয়েড টাকে পাঠালো। আমি এক লাথি মেরে ওটাকে বেড রুম থেকে বার করে দিলাম। এতে সৌর খুব খুশী হলো। আমি যে অরিজিনালের সঙ্গে রেপ্লিকার তফাৎ করতে পেরেছি এটা ওকে খুব আনন্দ দিয়েছিলো। বেশ খুশী খুশী মুখ নিয়ে ও আমার পাশে শোবার জন্য এলো। তার আগে মিউজিক সিস্টেমে ওর প্রিয় আমানত আলি খানের গজল চালিয়ে দিয়েছিলো। মৃদু একটা আলোয় অনেকদিন পরে শোবার ঘরটা যেন বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার আলোর ভিতরে ভাসছিলো। আর এইসব রোমান্টিক আলোয় ভাসতে ভাসতে সৌর এগিয়ে আসছিলো আমার দিকে। আর তখনই, ঠিক তখনই আমার পা আবার সচল হয়ে উঠলো আর এক লাথি মেরে ওটাকেও ভাগিয়ে দিলাম!’ আমি সভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘লাথি মারলি?’ ও হেসে বললো ‘না না লাথি মারার ভঙ্গি করেছিলাম। অ্যান্ড্রয়েডটাকে লাথি মারলে নিজের পায়ে লাগতে পারতো আর সৌরকে মারলে পরকীয়ার সঙ্গে ফিজিক্যাল টর্চারের একটা ধারা জুড়তো!’

 

পরকীয়া। একটা প্রচলিত শব্দ। লিখিত চুক্তিবদ্ধ পার্টনার ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক বা আরেকটু বিশদে বললে যৌনতার সম্পর্কে জড়ালে সেই প্রক্রিয়াকে প্রচলিত অর্থে পরকীয়া বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সেই অন্য কারো বলতে একজন মানুষকেই বোঝায়। মৌরীর ক্ষেত্রে যে অভিযোগ ছিলো সেখানে পরকীয়া বলতে একটি যন্ত্রের সাথে অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড ম্যানের সাথে। কিন্তু এই 2039 সালে এভাবে যন্ত্র দ্বারা সঙ্গ সুখ উপভোগ করা সম্পূর্ণ বৈধ। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ছিলো? অভিযোগ আসার তো কথাই নয়! কিন্তু তাও এসেছিলো। সৌরর অভিযোগ ছিলো যে সৌর ওই অ্যান্ড্রয়েড ম্যানের মধ্যে যে সফটওয়্যার ইন্সটল করেছিলো সেটা মৌরী পাল্টে দিয়েছে। ওই যন্ত্রের মধ্যে সৌর’র চরিত্র ম্যাপ করা ছিলো। কিন্তু পরের দিকে সৌর আবিষ্কার করে যে ওই অ্যান্ড্রয়েড ম্যানের মধ্যে অন্য একজনের চরিত্র ম্যাপ করা হয়েছে। সৌর আদালতকে জানিয়েছে ও কার চরিত্র ইন্সটল করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে। কিন্তু যেহেতু এক্ষেত্রে সেই তৃতীয় ব্যাক্তি তার সম্পূর্ণ অজান্তে পার্টি হচ্ছে তাই সেই নাম গোপন রাখা হয়েছে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু বিশিষ্ট মানুষকে সাক্ষী হিসেবে আহ্বান জানানো হয়েছিলো। অবশ্যই যারা স্বেচ্ছায় এই সময়টুকু দিতে রাজী হয়েছিলেন তাদেরকেই ডাকা হয়েছিলো। অধ্যাপক সৌমসুন্দর ‘পরকীয়া’ এই শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়ে একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বললেন ‘মানুষ তার প্রাণের টানে আপনজন খোঁজে। অনেকসময় আমরা তাকে বলি ভালোবাসার মানুষ। লালনের ভাষায় মনের মানুষ। এই কেসের ক্ষেত্রে পরকীয়া শব্দটি সঠিক নয়। কারণ পরকীয়া শব্দটি পরকীয় শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। যেহেতু এখানে অভিযুক্ত একজন মহিলা এবং তার আকর্ষণ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তাই পরকীয় শব্দটি যথাযথ। পরকীয় শব্দের অর্থ হলো পরসম্বন্ধীয় বা অন্যের। এখন প্রশ্ন হলো নিজের ভালবাসার মানুষ অন্যের হয় কি করে? এবং সত্যিই কি একজন মানুষ কারোর সম্পত্তি হতে পারে? যদি সম্পত্তি হয় তবেই সেখানে নিজের কিংবা অন্যের, এমন অধিকারের প্রশ্ন উঠে আসতে পারে। ভালোবাসার মানুষ তো আপনজন, তাই না?’ ফাইনাল হিয়ারিং এর সময়ই মোটামুটি পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো যে সৌর’র তোলা অভিযোগটা টিকবে না। সেটাই হলো। কারণ এখন মানসিক কিম্বা শারীরিক সাহচর্যের ব্যাপারে যন্ত্রের ব্যবহার বৈধ। আর মৌরী নিজে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার কোনোভাবেই নয়। এবং এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে ও যন্ত্রের সফটওয়ার চেঞ্জ করেছে তাই ‘পরকীয়া’র অভিযোগ ওখানেই খারিজ হয়ে গেলো। যদিও সৌর’র পক্ষের উকিল বারবার এটা তোলার চেষ্টা করছিলেন যে ওই অ্যান্ড্রয়েড ম্যান যার চরিত্র এখন ‘রোল প্লে’ করছে তার নাম প্রকাশ্যে আনার। কিন্তু আদালত এই প্রয়াসকে হাস্যকর এবং অপচেষ্টা বলে রায় দিয়ে দিলো। রায়দান হয়ে যাবার পরে মৌরী আমাকে বললো ‘চল আজকে একটু আমাদের সেই ঠেকটায় গিয়ে বসি। মনটা অনেকটা হালকা লাগছে।’

 

এই 2039 সালে আধুনিক টেকনোলজি সম্মৃদ্ধ কলকাতা শহরে এমন একটা জায়গা যে থাকতে পারে ভাবাই যায় না। অথচ আছে। অনেককাল আগের কোনো একটা থিয়েটার হল। এখন ভেঙে পড়েছে। সম্ভবত জমির জটে কোনো বিল্ডার্স কোম্পানী হাত দিতে পারেনি। একটা মরচে পড়া লোহার গেট। সেই গেটটা পেরোলেই কুমারের চায়ের দোকান। ওটাই ছিলো আমার আর মৌরীর ঠেক কোনো এককালে। তারপরে গঙ্গার ওপরে অনেক জল গড়িয়েছে। মৌরী চাকরি পেয়ে চলে গেলো হায়দ্রাবাদ। তারপরে হেলসিঙ্কি। আবার কয়েকবছর বাদে ফিরলো অবশ্য কলকাতায়। কিন্তু ওর সময়ের অভাবে আর এই ঠেকটায় আসা হতো না। এর মধ্যেই প্রায় ঝড়ের মত ওর জীবনে সৌরের আবির্ভাব ঘটে গেলো। অনেকগুলো ভাষা জানে সৌর। যেমন পড়াশোনায় চৌখস, সেইরকম জানে কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। বলতে পারা যায় মৌরীকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। যদিও জীবন আমাকে অনেকদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু মৌরীর সঙ্গে যোগাযোগ কোনোদিন পুরোপুরি চলে যায়নি। আমার সঙ্গে ওদের জীবনচর্চার কোনো তুলনাই চলে না তাও কোনো গেট টুগেদার হলে আমাকে অবশ্যই ডাকতো। মৌরীর জীবনের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নেই যেখানে আমি কোনোভাবে উপস্থিত থাকিনি। শুধু এই একটা মামলায় এই শেষের দিনটা ছাড়া আমাকে ও কোনোদিন আসতে দেয়নি। আজকে অবশ্য ও নিজেই আমাকে ডেকেছিলো। কুমারের ছেলেটা ভাঁড়ে করে চা দিয়ে গেলো। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম ‘সৌর হঠাৎ ওই অ্যান্ড্রোয়েড ম্যানের ম্যাপিং নিয়ে পড়েছিল কেন রে?’ মৌরী চায়ে চুমুক না দিয়ে বললো ‘খিদে পেয়েছে। একটা করে ওই কেক দিতে বল না!’ তারপরে আবার বললো ‘সৌর ঠিকই সন্দেহ করেছিল। পুতুলটা এখন আর ওর রেপ্লিকা নেই। বহুত হারামী পুতুল ওটা। নিজেকে পাল্টে নিয়েছিলো! ওই একরাতে লাথি খাওয়ার পরের রাতে দেখি গুটিগুটি এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তাকাতেই দেখি গড়গড় কর বললো :

Gentle beam, shall I implore

Gold or sailing – ships

Or beg I hate forevermore

A pair of lying lips?

 

Swing you high or low away,

Burn you hot or dim;

My only wish I dare not say –

Lest you should grant me him. ’

 

আমি আস্তে আস্তে করে বললাম ‘Star Bright’, Star Bright ডরোথি পার্কারের লেখা। সৌর তো এনাদের কবিতা কখনও পড়েনি। তার ওপরে আবার ফিমেল কবি!’ মৌরী কেকের থেকে একটা শুকনো ফল ছাড়িয়ে দাঁতের ডগায় নিয়ে চিবোতে চিবোতে বললো ‘শেষের লাইনটা ভাব। ঠিক ওই কথাগুলোই ওকে বলতে হলো : grant me him. সেইজন্য তো গালিটা দিলাম।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘কিন্তু রেপ্লিকাটা কার? তোর কাকে মনে হয়?’ মৌরী অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো ‘আমি নিশ্চিত জানি সে কে! অনেকবছর আগে আমি নদীর মত একটা মানুষের গুনে সম্মোহিত ছিলাম। জীবনের নানান খেলায় সে হয়তো আমার সঙ্গী হতে পারেনি কিন্তু তাকে তো ফেলতেও পারলাম না কখনও। সেই নদী আজও প্রবাহিত।’ এতক্ষণে আমার কাছে পরিষ্কার হলো মৌরী কেন এতদিন আমাকে ডাকেনি কেসের দিনগুলোতে। কিন্তু এতবছর আগের কথা এখন আর কেন তুলছে মৌরী! সেই তখন বলতাম মৌরী ফুল। সেই নদী তো কবেই জলের অভাবে শুকিয়ে গেছে। এখন মরা খাতে আর মৌরী ফুল কোথায়? শুধু ধু ধু বালুচর আর কাঁটাগাছ। হাঁটতে গেলেই রক্ত ঝরে। আমি মৌরীকে তাও বললাম ‘সেই নদী এখনও প্রবাহিত বলে তোর মনে হয়?’ মৌরীর কেক খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো, চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বললো ‘নদী যে রুপ পাল্টায় তুই জানিস! তুই হয়তো দেখলি শুকনো নদী খাত। দেখলি নদী আর অতুল জলরাশির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একটা পাহাড়। সেটা আসলে তোর ভ্রম। প্রবাহ কখনো বাধা মানে না। সে হয়তো রাস্তা পাল্টায়! কিছু বুঝলি বুদ্ধু?’ আমি জানি বুঝেও কোনো লাভ নেই। সত্যি বলতে কি না বোঝার মতও কিছু নেই। কিন্তু এই কথাটা খুব সত্যি যে প্রবাহ বাধাহীন।

তারিখঃ এপ্রিল ২৩, ২০২৪

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse