সেই সব জ্বরতপ্ত সুখময় দিনগুলো

 

ফোন করেছিলাম বন্ধুকে। পুরোটা বেজে কেটে গেল। আমি কিন্তু একবারে ছেড়ে দেবার লোক নই। কিছুক্ষণ পরে আবার চেষ্টা করলাম। এবারে বন্ধু ফোন ধরল। তবে তার স্বরে কোন উৎসাহ নেই, নেই কোন আমন্ত্রণ। কী জানি কী হ’ল, এই আশংকা নিয়ে জানতে চাইলাম, “কী হয়েছে রে ? তোর গলাটা এমন লাগছে কেন ?”

—-“জ্বর হয়েছে। সঙ্গে অল্প কাশি।”

সাথে সাথেই চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম একটা C বড় করে লেখা। বললাম, “ডাক্তার দেখিয়েছিস ?”

—-“ফোন করেছিলাম। বললেন, আগে করোনা টেস্টটা করিয়ে নিন। রিপোর্ট দেখে চিকিৎসা শুরু করব। জ্বর বাড়লে এখন শুধু প্যারাসিটামল। ডাঃ লাল প্যাথল্যাব থেকে লোক এসেছিল, সোয়াব নিয়ে গেছে। কাল রিপোর্ট দেবার কথা।”

 

এই অবস্থায় কী আর বলব ! একটু সাহস দিয়ে ফোন ছাড়লাম।

 

মনটা বড় জব্দ হয়ে গেল। যেমন হাওয়া চলছে চারদিকে, কারও জ্বর হয়েছে শুনলেই সব ভুলে করোনার কথাই মনে আসে। একটা ভয়ের ভাব যেন ঘিরে ধরে। পাশাপাশি বাড়ি হ’লে তো কথাই নেই, ছোঁয়াছুঁয়ি তো দূর অস্ত, পারলে চোখও না মিলিয়ে বাঁচি। আর খালি ওপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করি, জ্বর দিওনা ঠাকুর, কাউকে যেন জ্বর দিওনা !

 

অথচ, একসময় এই জ্বর কী সুখই না এনেছে জীবনে ! সত্যি জ্বর, মিথ্যে জ্বর, কারণে জ্বর, বিনা কারণে জ্বর, কত রকম জ্বরেই যে পড়তে হয়েছে ! খুব ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে, তখন ইসকুলও শুরু হয়নি। দু’একবার জ্বর হয়েছিল। আমি এক সন্তান, বাবা অফিসে বেরোবার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমার একটা বসে থাকা শিব ঠাকুরের মাটির মুর্তি ছিল। একটু বড়ই। বাঘছাল, গলার সাপ, মাথার জটা সবই খুব স্পষ্ট। বাবাকে বলতাম আলমারির মাথা থেকে ওটা নামিয়ে দিয়ে যেতে। তারপর বিছানায় রেখে তার সঙ্গে খেলা চলত। কী যে খেলতাম তা এখন আর বলতে পারবনা। তবে সেই ছোটবেলা থেকেই না আমার মনে শিব ঠাকুরের জন্য একটা সফ্ট কর্ণার রয়ে গেছে ! ঠিক যে ভক্ত তা কিন্তু না, বরং কেমন একটা ইয়ার দোস্ত ভাব। তবে একটু আপার লেভেলে।

 

আর ছিল একটা লিলি বিস্কুটের বড় টিন। মনে পড়ে কারও ? লিলি বিস্কুট ? আমার মাসতুতো দাদা ওই কোম্পানিতে বড় পোস্টে ছিল। সে মাঝে মাঝে বড় বড় টিনভর্তি বিস্কুট দিয়ে যেত। তবে পয়সা নিত কিনা জানি না। সেই টিনগুলোর গায়ে নানান কিছু আঁকা থাকত। আমার পছন্দের টিনের গায়ে ছিল চাইনিজ অঙ্কনশিল্পের এক অসামান্য উদাহরণ।(ওরে মা ! একরকম ভাবে দেখলে করোনাও তো চাইনিজ শিল্প !) সে যাক গে, আঁকা ছিল ছোট নদী, ছোট নৌকা, ছোট সেতু, ছোট ছোট মানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা, গৃহপালিত অনেক রকম পশু। জ্বর না বাড়া অবধি আমি সেই পারিপার্শ্বিকের অঙ্গ হয়ে থাকতাম। সেই নদীর জলে নৌকা বাইতাম, সেতুর উপরে হাঁটতাম, মানুষগুলোর সাথে কথা কইতাম, তাদের বাড়ি যেতাম। সে যে কী আনন্দ, তা আমি প্রকাশ করতে পারব না। শৈশবকালীন জ্বরগ্রস্থ বেলার এই ছবিই আমার মনে আছে।

 

আমার মামাবাড়ি আর মাসিবাড়ি আমাদের দু’ পাশের বাড়ি। খুব কমই মানুষ পাওয়া যাবে যে আমার মত “মামাবাড়ির ভারি মজা” মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করেছে। আর খেয়েছে মাসীর আদর। মামা ছিলেন ডাক্তার। কিছুটা বড় হবার পর থেকেই একটু জ্বর জ্বর মনে হলেই মামার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম। মামা হাতের শিরা ধরে দেখে বলতেন, “হ, একটু তাপ লাগে। আজ আর স্কুলে যাওন লাগব না। শুইয়া থাক। আমি মিক্সচার পাঠাইয়া দিমুয়নে।” কারো কি কাগজ কেটে শিশিতে আঠানো সেই মিক্সচারের স্বাদ নেওয়া আছে ? সেই জ্বরও নেই, সেই আরকও নেই। তারপর একসময় এল এ্যালকাসিট্রন। এ্যালকাসলের আগের প্রজন্ম। সে বোধহয় এখন ওই নামে আর পাওয়া যায় না। মামা তো প্রথম দিন দু’য়েক এ্যালকাসিট্রন খাইয়েই রেখে দিতেন। এবং অধিকাংশ সময়েই তাতেই সেরে উঠতাম। এর ফলে এই বয়সে এসেও অধিক ওষুধ খেতে বড় অস্থির লাগে।

 

আমার জ্বরজারি প্রায় হতোই না। মনে আছে নরেন্দ্রপুরে পড়ার সময় প্রথম দু’বছরে একবার মাত্র জ্বর হয়েছিল। ওখানে হাসপাতালে আছে। সেখানে ছিলাম। আমি খুব চাইতাম জ্বর হোক। একটা আচ্ছন্নতা নিয়ে শুয়ে থাকব। কিছু ভাবব অথচ ভাবব না। কোনো কোনো দিন আমায় খুশি করেই জ্বর আসত। হঠাৎ তন্দ্রা এলে যেমন হাতে ধরা বই হাত থেকে পড়ে যায় তেমনি হঠাৎ জ্বরের ঘোর এলে আমার মাথা থেকে ভাবনা টুপ করে খসে পড়ত। পরে মনেও আসত না কী যে ভাবছিলাম। একটা কাঁথা বা চাদরের ওমে জড়িয়ে নিতাম দুর্বল শরীরে। বাড়িতে থাকলে তো কথাই নেই। মামাবাড়ি থেকে দিদিরা দেখতে আসত। বড় খাটে আমি শুয়ে, চারদিকে মামাতো মাসতুতো দিদিদের মেলা। সে আড্ডা যেন অন্য এক জীবনের গল্প। আর যদি জ্বর বেশি হত, চোখ খুলতে ইচ্ছে হ’ত না, টের পেতাম কপালে হাতের স্পর্শ। স্নেহ অকৃপণ। আর মাঝে মাঝে জলপট্টি। বেশ বাড়াবাড়ি জ্বরের সময় কপালে জলপট্টি কিংবা মাথা ধোয়ানো যে কী অপূর্ব এক সুখের ছোঁয়া আনে, বলুন তাই না ! একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আসছে যাচ্ছে আর তার মাঝে তপ্ত কপালে অথবা উষ্ণ মাথায় শীতল জলের পরশ। আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আছে এই ব্যাপারে। তখন সব বাড়িতেই প্রায় অয়েল ক্লথ থাকত। মাথা এবং বালিশের মাঝে সেই অয়েল ক্লথ রেখে ঝুলিয়ে দিয়ে জল ঢালা হত। আমার এক মাসীমার বাড়িতে অয়েল ক্লথ ছিল না। আমি বাড়িতে বোরড হচ্ছিলাম বলে জ্বরগায়েই তার বাড়িতে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে জ্বর বাড়ে। মাসীমার বাগানে কচুগাছ ছিল। বড় বড় পাতা। মাসীমা সেই পাতা কেটে এনে অয়েল ক্লথের কাজ চালালেন। কচুপাতাও পদ্মপাতার মতো। জল বসে না।

 

বড় হবার পর তো কয়েকবার ইচ্ছামতো জ্বর ঘোষণা করেছি। আর বাড়ির জামা কাপড়েই পাশের বাড়ি যাচ্ছি বলে ম্যাটিনি শো মেরে এসেছি। তবে জ্বরের সময় সবচাইতে বড় সঙ্গী ছিল ট্রানজিসটর। ঘুমোবার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময় ম’জে থাকতাম গানে। বাংলা হিন্দি দুই-ই। হিন্দি একটু বেশি। গানের ঢেউয়ে ভেসে যেতাম। কখনো চড়ছি মানে জেগে আছি, আবার কখনো ডুবছি মানে ঘুমিয়ে পড়েছি। বই পড়লে চোখ ধরে যেত। তাই গানেই বেশি মন দিতাম।

 

আর এখন ! এই করোনার জ্বর কতজন বন্ধুকে, আত্মীয়কে না-ফেরার-দেশে নিয়ে চলে গেল ! জ্বরাতঙ্কে ভুগছি সবাই। জ্বরও যে সুখের ছবি দেখাত কখনো, সে কথা কাকে আর বলব !

তারিখঃ জুলাই ৯, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse