মাস্টারমশাই : শঙ্খ ঘোষ
চন্দ্রাণী গোস্বামী
তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই নিজেকে বড়ো উচ্চকিত মনে হয়। মনে পড়ে তাঁর সেই অমোঘ শব্দবন্ধ – “শব্দহীন হও।” তিনি আমার মাস্টার মশাই, নমস্য ব্যক্তিত্ব শঙ্খ ঘোষ।
তাঁকে নিয়ে লেখা, অর্থাৎ কিছু অক্ষর শব্দ বা বাক্যের সীমায়িত গণ্ডীর মধ্যে ধরা যে অসম্ভব তা বলাবাহুল্য। তিনি অনেকটা আকাশের মতো, কখনো তিনি মাটির মতো, আবার কখনো তিনি গাছের মতো মহীরুহ। চিরহরিৎ তাঁর হৃদয়। সুবিশাল তাঁর অন্তঃকরণ। হিমালয়ের মতো প্রজ্ঞা আবার তৃণসম তার বিনয়।
তিনি ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আর আমি আদ্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। তার পরবর্তী পড়াশোনাও আমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তবে তিনি আমার মাস্টার মশাই হলেন কী করে সে গল্পের অবতারণা করার জন্যই এই ভূমিকা। আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি সবে। অবসর প্রচুর, বই পড়ে সময় কাটাচ্ছি। আমার এক দিদি তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। রোজ এসে মাস্টারমশাই এর প্রচুর সুখ্যাতি করেন। আমি তখন তাঁর বেশ কিছু কবিতার বই পড়ে তাঁর একান্ত অনুরাগিনী। মনে মনে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। সাধ হয় যদি কোনোদিন তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারি। দিদি গল্পে গল্পে জানাল যে শর্ট টাইম তুলনামূলক সাহিত্যের ওপর একটি কোর্স পড়ানো হবে ছয় মাসের। এবং মাস্টারমশাই সেখানে ক্লাস নেবেন। ব্যাস! আমায় পায় কে! জয় মা বলে পরীক্ষা দিলাম আর চান্স পেলাম। সেই ছয়মাস সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁকে সামনে থেকে দেখার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সময় চলে যেত। একটি একটি বিষয় ধরে নিয়ে পড়াতে পড়াতে কোথা থেকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন। তাঁর ক্লাস শুনতে বাংলা ছাড়া বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র ছাত্রীরাও আসতো। এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা ছাত্ররাও। অবারিত দ্বার ছিল তাঁর ক্লাস রুম। তাই তিনি গ্যালারি রুমেই ক্লাস করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।
ওই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমার মুখ চিনে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই যোগাযোগ অটুট ছিল। যখন যেখানে কোনো বাংলা বিষয়ে খটকা লেগেছে তাঁকে জানতে চেয়েছি। তিনি অকৃপণ হয়ে শিখিয়ে দিয়েছেন। এত উদার অথচ মাটির গন্ধ মাখা মানুষ আমি কম দেখেছি। তাঁর পোশাকের মতোই শাদা ছিল তাঁর মন। কোনো পাপ, কোনো অহং, কোনো রঙ সেখানে স্পর্শ করেনি। তিনি বলতেন, ভালো কবি হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া খুব জরুরী।
আজ তাঁর চলে যাওয়ায় সত্যিই আমি বড়ো অভিভাবকহীন বোধ করছি। প্রণাম জানাই তাঁকে। আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নেবেন মাস্টারমশাই।
তারিখঃ জুলাই ১০, ২০২১