বাউণ্ডুলের গল্প
তৃণা ঘোষাল
কিছু কিছু গল্প শুধু বাউণ্ডুলেরা জানে। কাঁধের ঝোলায় জমানো চিঠি – অনেক অনেক বছর আগে প্রেয়সীকে লিখেছিল বটে। টিবোর্ডের সামনে যে প্রেমের গল্প শুরু হয়েছিল এই ঘনঘোর শ্রাবণে, হাজার বৃষ্টির জলছাপও কিন্তু ধুয়ে দিতে পারেনি সেই প্রেমকে।
গল্পের শুরুটা হয় বিস্তর ব্যস্ত এক রাস্তায়। এধারে চিনে পাড়া ওধারে অফিস। আর তার মাঝে মাঝখানে বাউণ্ডুলের তার প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম দেখা। তার প্রেমিকা? কোলকাতা। আবার কে!
যন্ত্রের ছোঁয়ায় যখন পৃথিবী এক ক্লিকে হাতের মুঠোয়, সেই যুগেও তার প্রেমিকা এখনও নীল সাদা আর সবুজ হলুদে বাঁচে। ভরা নন্দন চত্বরে স্রেফ প্রাণের খেয়ালে গান গায় মানুষ। বাউণ্ডুলে কিন্তু এ দেখে প্রেমে পড়েনি।
টিবোর্ডের সামনের বয়ে যাওয়া কোলকাতা ছুঁয়ে ছেলেটা মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল। মেট্রো থেকে বেরিয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছোটার মাঝে হাতব্যাগ থেকে ল্যান্ডস্কেপটা পড়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত হাওড়া ব্রিজ – ভিড় আর দুজন হাত ধরাধরি। ছবিটা তুলে রেখেছিল সে, আর তার ক’দিন পরেই ঠিক সিনেমায় যেমন হয় তেমনভাবে আচমকা দেখতে পেয়েছিল কফি চোখের মেয়েটাকে। মাটির নীচে কোলকাতায় – যেখানে হাজার মিথ্যের ভিড়ে মৃত্যুই বোধহয় একমাত্র সত্য – সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত, সহজ, অবশ্যম্ভাবী একটা পরিণতি জড়িয়ে শুয়ে আছে কত শত ইতিহাস।
তারপর? তারপর গালিব, তারপর হাতচিঠি, নন্দন, প্রিন্সেপ ঘাট, বাগবাজার, গঙ্গা আর কবিতা। কোলকাতা মানে কবিতা আর তাই হাতচিঠির হাতখড়ি কারো শেষের কবিতায় তো কারোর সুনীলে।
কোনো কোনোদিন কফি চোখের মেয়ের ভুল হতো কাজল পরতে – কোনোদিন আবার চুল উড়তো হাওয়ায়। দুজন মিলে ওরা কত খুঁজেছে লুসিয়ার গ্রেভ, এলিজাবেথের কবরে দিয়ে এসেছে স্থলপদ্ম।
তর্ক করতো বটে ওরা – বাগবাজারের অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, গল্প করতে করতে একটা ছোট্ট পয়েন্ট – ব্যাস। টেবিল চাপড়ে হাতে রইল পেন্সিল আর ঠোঁটে রইল তুখোড় লজিক। দুজনে মিলে ইলজিকাল হয়ে যেতে আটকাতো না। তর্কের শেষ না হলেও রাস্তা আর সময়ের একটা শেষ আছে ঠিকই – কখন কীভাবে বরাদ্দ সময়টুকু কেটে যেত কে জানে!
সময় – সত্যিই চলে গেলে ফিরে আসে না। তাই সেই প্রথম দিনের ছবিটা রয়ে গেছে বাউণ্ডুলের কাছে। যে এঁকেছিল সে নেই কিন্তু বাউণ্ডুলে আগলে রাখে ছবিটা আর ও বৃষ্টি পছন্দ করে না মোটে – বৃষ্টি হলে ছবিটা ধুয়ে যাবে না? শুধু কফি চোখের গোলাপী ঠোঁট মেয়েটা আঁকার খাতা ফেলে দিয়েছে কবেই।
শুধু সেই হাতচিঠিটা রয়ে গেছে।
প্রিয়,
তোর সঙ্গে আমার আর আমার সঙ্গে তোর একসঙ্গে কোলকাতা ঘুরে দেখার ছিল। একসঙ্গে ফেলুদার বাড়িটা দেখার কথা ছিল। একবার অন্তত ঘোড়দৌড়ের মাঠে যাওয়ার ছিল সানগ্লাস আর দূরবীন হাতে। আজকে নীল শাড়িটা পরবি রে? আমরা বরং চা খেয়ে ভাঁড়টা না ফেলে তাতে বৃষ্টি জমাবো- কোলকাতার দিব্যি।
ইতি,
বাউণ্ডুলে
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১