ভাষা মুখেরই নয় অন্তরেরও দর্পণ

 

পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় মা শব্দটির ধ্বনিগত উপস্থাপন সাযুজ্যপূর্ণ। তার মানে কি ভাষার তারতম্য যা-ই থাকুক বোধ বা অনুভূতির তারতম্য মানুষের মধ্যে ততটা নেই!  সময় এবং সামাজিক বুননের হেরফের যত কম থাকবে ভাবনার ও কৃষ্টির নৈকট্য তত বেশি হবে। তবে জলবায়ু ও জীবনধারায় তারতম্য সেখানে দূরত্ব বাড়াতে থাকে।

 

ভাষা এমন একটা বিষয় যা মানুষের প্রকাশ স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বাধীনতার সঙ্গে পরিপূরক। এশিয়ার একটি দেশে একবার প্রথম গিয়ে খাবারের অর্ডার দিতে হিমসিম খাচ্ছিলাম। অবশেষে রেস্টুরেন্টে সাজানো ছবির কল্যাণে উদ্ধার পেয়েছিলাম। সেবার যদ্দিন ছিলাম সেখানে ওই একই রকম খাওয়া খেয়ে পার পেয়েছি। ভিনদেশে গেলে উপলব্ধি করা যায় আপন ভাষায় কথা বলবার আনন্দ ও সুবিধা।

 

এই ভাষার জন্য জীবন দিয়ে আমরা নজির গড়েছি বিশ্বে। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ আমাদের ভাষা শহীদ দিবস পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। এ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য পরম গৌরব ও অহংকারের। আবার এই দেশেই এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গিয়ে ভাষাগত সংকটে পড়তে হয়। সিলেট ও চট্টগ্রামের একেবারে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা অন্য জেলার মানুষের জন্য কখনও কখনও একেবারেই দুর্বোধ্য। কথায় আছে এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি। তাই ভাষা এক অর্থে অতি সংবেদনশীলও বটে।

 

কয়েকবার সিলেটে গিয়ে এবং সিলেটি বন্ধুদের কল্যাণে অনেকটা বুঝি বলতে না পারলেও এমন ধারণা ব্যক্ত করায় একবার এক সিলেটি আমাকে এমন একটা বাক্য বলেছিল যে তার একটা বিন্দু বিসর্গও আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব ছিল না। ভাষা এমনই এক বিশাল ব্যপ্তির বিষয়। মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ দখলটুকুও খুব কম মানুষেরই আছে। যাঁরা সাহিত্য নির্মাণ করেন তাঁদের এই দখলটা সবচেয়ে ভালো থাকার কথা। তথাপি কতটা সর্বজ্ঞ হতে পারেন একজন সাহিত্যিকও, সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন।

 

এতটা জটিলতা যখন ভাষা নিয়ে তখন এক বর্ণ ভাষা না বুঝেও মানুষের অভিব্যক্তি বুঝতে অনেক সময়ই আমাদের অসুবিধা হয় না। শিশুর কান্না বা হাসি বুঝতে যেমন আমাদের ভাষাবিদ হতে হয় না। তেমনি কারো রাগ, দুঃখ, খুশি, আনন্দ, উদ্বেগ, উচ্ছাস বুঝতে পারি আমরা অনায়াসেই – তার ভাষার একবিন্দু না বুঝলেও। এটাই হলো শরীরের ভাষা। এটুকুর সাথে হাত পা নেড়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ভাষার আদানপ্রদান করে নিতে পারি আমরা অন্য ভাষার বিন্দুবিসর্গ না বুঝেও।

 

অভিনয় এমনই একটি মাধ্যম যেখানে শরীরের ভাষা প্রকাশে এর কুশীলবরা কৃতিত্বপূর্ণ দখল রাখেন। তাই ভিনদেশি ভাষার চলচ্চিত্র আমরা ভাষা না বুঝেও অনেকাংশে বুঝে আগ্রহভরে দেখতে পারি অনায়াসে। শরীরের ভাষার আরো গভীর ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছে মানুষ। যেমন একজন মানুষের বসার ভঙ্গি, হাত রাখার আঙুল নাড়াচাড়ার ধরন এসব দেখেও একটা মানুষ সম্পর্কে যুতসই বিশ্লেষণ দিতে পারেন কেউ কেউ। সাইন ল্যাংগুয়েজ বা সাংকেতিক ভাষার মতো কোনো সংকেত বা ইশারা ছাড়াই কেউ কেউ পড়ে নিতে পারেন অন্য মানুষের ব্যক্তিত্ব বা রকমসকম।

 

তথাপি সব কথার শেষ কথা নিজের ভাষায় কথা বলার তৃপ্তি অন্য ভাষায় কথা বলে হয় না মানুষের। সেই নিজ ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করার এবং তার সমৃদ্ধি বজায় রাখাটিও তাই প্রতিটি ভাষাভাষীর সচেতন জনগোষ্ঠীর নৈতিক দায়িত্ব। ভাষার বিবর্তন যখন এক অবসম্ভাবী পথ পরিক্রমণ তখন ভাষাকে এক জায়গায় থিতু করতে পারার সক্ষমতা মানুষ কোনোকালেই পাবে না। ভাষা হলো নদীর মতো। তার গতিপথ একেক জায়গায় যেমন একেক রকম তেমনি স্থান ছেড়ে নড়তে থাকলে ভাষাও নদীর মতো পালটাতে থাকবে। আবার একটা নদীর অবস্থান যেমন সময়ের সাথে সাথে পালটাতে থাকে, গতিপথ পালটে কখনও বেগবান হতে থাকে আবার কখনও নদী মরেও যায়। তেমনি ভাষাও শক্তিমান হয় আবার বিলুপ্তও হয়।

 

আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হলে ভাষা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদেরকে আন্তরিক ও সচেতন – সচেষ্ট হতে হবে এর মানের উৎকর্ষ বজায় রাখার লক্ষে। অন্য ভাষার বই নিজ ভাষায় অনুদিত হতে হবে বেশি। পাঠ্যক্রমে সকল বিষয়ে বিশ্ববিবেচনায় সেরা ভাণ্ডার নিজ ভাষায় তৈরি করতে হবে। নিজ ভাষায় পৃথিবীর সম্যক জ্ঞানের ভাণ্ডার মজুদ রাখতে পারলে এবং সকল স্তরে পড়াশোনা করার মতো সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে নিজ ভাষাটি। এই সত্যের অপর পিঠের সত্যটি হলো পাঠাভ্যাসের চর্চা এবং বিকাশ। এর জন্য আমাদের সবারই অল্পবিস্তর দায় ও দায়িত্ব আছে। সেখানে আমরা সকলেই সচেতন ও সক্রিয় থাকবো, এই প্রত্যাশা অমোঘ। এই প্রত্যাশা আমারও।

তারিখঃ এপ্রিল ৮, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse