চেনা অচেনা
সাগরিকা মুখার্জি
।১।
“ওই তো এসে গেছে অতসী” স্বগতোক্তি করলো দেবরাজ।
সেই তেল চপচপে চুলে টেনে বাঁধা খোঁপা, কপালে ধ্যাবরা সিঁদুরের টিপ, মোটা শাঁখা-পলা, বাজুতে মাদুলি, ফুলে থাকা তাঁতের শাড়িতে ঘটের মতো চেহারা — তেতো মুখে দেখে সে। আজকের দিনে এমন সাজ কেউ করে? কতবার বলেছে সে অতসীকে একটু আধুনিক হতে। খোলা চুল, ট্রেন্ডি পোশাক সে পছন্দ করে, কিচ্ছু শুনবে না সে মেয়ে। অমন পাকা গমের মতো গায়ের রং, ঘন কালো চুল, টিকালো নাক, ভাসা ভাসা গভীর চোখ, পারফেক্ট ফিগার, পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করা মেয়ের এমন সাজগোজ!! সেই সাতের দশকে আটকে আছে — ডিসগাস্টিং! বিরক্তি বাড়তে থাকে দেবরাজের।
মনে মনে সে বলে, আর কোর্টও হয়েছে আজকাল, একটা অসুখী বিয়েকে টেনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা! ডিভোর্স চেয়েও শান্তি নেই। কোর্টের অর্ডার দিন দশেকের জন্য সংসারের বাইরে কোথাও দুজনকে একসাথে থাকতে হবে। একসাথে এতোগুলো ছুটি ম্যানেজ করা! উফ! তাও আবার এই ফালতু কারণের জন্য? অসহ্য লাগছে তার।
বড় ঘড়ির নিচে দাঁড়িয়ে, এদিক ওদিক তাকায় অতসী। কখনও একা একা হাওড়া স্টেশনে আসেনি সে। এতগুলো লোকের মাঝে সে দেবরাজকে খুঁজে পাবে কী করে? বাবা মা পইপই করে বলে দিয়েছেন, ভয় না পেতে, বুদ্ধি করে কাজ করতে। এমনকি তার ন’বছরের ছেলে তাতাইটাও তাকে মনে সাহস জুগিয়েছে, হাতে ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করতেও শিখিয়েছে।
।২।
ওহ! ফোনের কথা মনে পড়তেই অতসীর মনে হলো একটা কল করেও তো দেবরাজকে খোঁজা যেতে পারে। একটু ইতস্তত করে সে ফোনটা করেই ফেলে।
ওই তো রিং হচ্ছে। নিজেকে গুছিয়ে নেয় সে। দেবরাজ ফোন ধরতেই ঈষৎ কাঁপা গলায় সে তার অবস্থান জানায়। আজও দেবরাজের সামনে প্রথম দিনের মতোই কুন্ঠা। রঘুনাথ গঞ্জের হরিদাস নগরের মেয়েটার সাথে বালিগঞ্জ প্লেসের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের আজও তফাৎটা একই রয়ে গেছে।
দু’ মিনিটের মধ্যে দেবরাজ আসে অতসীর সামনে। কোনও কথা না বলে নিজের ট্রলি ব্যাগের সঙ্গে অতসীর ট্রলি ব্যাগটা টানতে টানতে পুরী এক্সপ্রেসের ফার্স্টক্লাসে গিয়ে ওঠে। অতসীও কাঠের পুতুলের মতো তাকে অনুসরণ করে, আগেকার মতোই।
আটটা বাজলে খাবারের বাস্কেট থেকে লুচি আলুরদম বের করে প্লেটে সাজায় অতসী। অন্যন্য সহযাত্রীদের সামনে কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে নেয় দেবরাজ।
প্রয়োজনীয় কথা আর রেলের ঝমঝমে কেটে যায় জোর করে বয়ে নিয়ে যাওয়া দাম্পত্যের আরও একটি রাত।
।৩।
স্বর্গদ্বার ছেড়ে একটু আউটস্কার্টেই হোটেল বুক করেছিল দেবরাজ। স্বর্গদ্বারে ভিড় করা আর পাঁচটা গড়পরতা লোকের মতো করে সমুদ্র দেখতে চায় না সে। একটু ভেবেচিন্তে একটা গোটা স্যুট দেবরাজ ভাড়া করেছিল, যাতে এখনও পর্যন্ত নিজের স্ত্রী হলেও অতসীর সাথে বেড শেয়ার করতে না হয়।
ব্রেকফাস্টের পর বারমুডা পরে গায়ে টাওয়াল চাপিয়ে একাই বেরিয়ে যায় দেবরাজ। একা ঘরে অতসী বুঝতে চেষ্টা করে, এখানে এসে আদৌ কোনও লাভ হলো কী না? আজ প্রায় আট মাস হলো তারা আলাদা রয়েছে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়েকে কিনে দেওয়া কসবার ফ্ল্যাটে সে এসে ওঠে ডিভোর্সের নোটিশ হাতে পাবার পর। বাবা মাও এখন তারই কাছে।
অতসী মাঝে মাঝে নিজেকেই অপরাধী মনে করে। মনে হয় তারই জন্য বাবা আর দেবরাজের বাবা রাজেনকাকার ছোট বেলার বন্ধুত্বে ফাটল ধরলো। আবার কখনও রাগ হয় তার পরম প্ৰিয় দাদুভাইএর ওপর। কেন যে দাদুভাই বাবার ক্লাসমেট পিতৃ মাতৃহীন মেধাবী রাজেনকাকাকে তাদেরবাড়িতে স্থান দিতে গেছিলেন, কেনই বা লেখাপড়া শিখিয়ে বিলেতে পাঠাবার খরচ বহন করেছিলেন, আর কেনই বা এর বিনিময়ে তিনি বাবা আর রাজেনকাকাকে বেয়াই হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন! তখন অভিজাত ধনী সহৃদয় দাদুভাই বুঝতেই পারেননি জীবনটা সিনেমার মত নয়। মফস্বলে বেড়ে ওঠা অতসী আর শহরে বেড়ে ওঠা দেবরাজের মানসিকতা সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ার খেসারত তাদের জীবন দিয়ে চোকাতে হচ্ছে।
ডিভোর্সের আবেদন দেবরাজ করলেও বিয়ের দশ বছর পর স্ত্রীকে ‘যথেষ্ট আপডেট নয়’ মনে হওয়াটাকে যুক্তি হিসাবে বিচারকের বেশ নড়বড়েই লেগেছিল। তাই দিন দশেক একসাথে থেকে তাদের সম্পর্কটাকে নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন।
।৪।
তিনটে দিন কেটে গেল কেবল নামমাত্র কথাবার্তা বলেই। চতুর্থ দিনে মৌনতা ভেঙে অতসীই বলে “এখানে এলাম, জগন্নাথ দেবের মন্দির দর্শন করব না?”
স্বভাবসিদ্ধ গুরু গম্ভীর গলায় দেবরাজ জানায় “তোমাকে তো বারণ করিনি, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও। আগেও বলেছি ওসব মন্দির ফন্দির, তাবিচ কবচ আমার পোষায় না।”
কথা বাড়ায় না অতসী। শুধু স্নান করতে ঢোকার আগে বলে যায়, “গেলে দুজনেই যাব, তোমার ইচ্ছা না থাকলে আমিও যাব না।”
দেবরাজ নেট অন করে মগ্ন হয় ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। বন্ধু বান্ধবরা কত ভাল ভাল ছবি আপলোড করে, কী দুর্দান্ত সব পোস্ট দেয় ফ্যামিলি নিয়ে। তাদের ডন বস্কর নাইনটি ফোরের ব্যাচের একটা বড় গ্ৰুপ আছে হোয়াটসঅ্যাপে। সবাই বৌয়ের সাথে রং মাখামাখির কত ছবি দিয়েছে। রনি-ডোনা, রাজ – নিলি রিক-লিজা, স্যান্ডি – রিয়া —- কুল ড্রেসে এরা জাস্ট ফ্যাবুলাস। বিস্বাদ হয়ে যায় মেজাজটা, শুধু তার কপালে এসব জুটলো না। বাবা যে কেন কথা দিয়ে বসেছিল তার জন্মের পরে কে জানে? আরে আজকের ডেটে এসব চলে নাকি? এটা কি উত্তমকুমারের সিনেমা হচ্ছে নাকি? ধুস! বলে সিগারেট টানতে যায় বাইরে।
হোটেলের সুইমিংপুলে কত গুলি নরনারীকে জলকেলি করতে করতে দেবরাজ ভাবতে লাগল, চেষ্টা তো সেও কম করেনি। বারবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে মফস্বলে তো অনেকেই বড় হয় কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিরর সাথে তো নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। উদাহরণ দিয়েছে রাজের বৌ নিলির, সেই নীলিমাও তো কাঁথির মেয়ে, সে তো দিব্য মানিয়ে নিয়েছে, বলতে গেলে সব চেয়ে ট্রেন্ডি পোশাক নিলিই পরে। কিন্তু কে শোনে কার কোথা! শাড়ি ছাড়া কিচ্ছু পরবে না অতসী, শুধু পরিবারের ঐতিহ্য , পরিবারের শিক্ষা এইসব বলে এড়িয়ে গেছে সে।
আচ্ছা ঠিক আছে শাড়িই সই। তাতাইএর পাঁচ বছরের জন্মদিন বেশ বড় করে অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। দেবরাজ সাধ করে একটা লাল শিফনের শাড়ি কিনে এনেছিল সাথে ম্যাচিং গয়না। আরও একটা কাজ করেছিল সে, চুপিচুপি অতসীর একটা ব্লাউজ নিয়ে গিয়ে স্লিভলেস ডিজাইনার ব্লাউজও বানিয়ে এনেছিল রিয়াকে দিয়ে। কিন্তু পরাতে পেরেছিল সে অতসীকে?
শুধু লজ্জা আর অস্বস্তি। কোনও পার্টিতে যাবে না, বাড়ির গেটটুগেদারেও জড়োসড়ো। অথচ বাড়ির সবার দেখভাল করা, সংসারের খুঁটিনাটিতে সাবলীল, উচ্ছল সে। তাতাইএর স্কুল টিউশন শুরু হওয়ার পর তো অতসীকে সেভাবে কাছেও পেতোনা দেবরাজ।
।৫।
দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে গেল বিকেলে যথারীতি দেবরাজ একাই বেরিয়ে গেল আজও।
দূরত্ব দুজনের মধ্যে শুরুর থেকেই ছিল, ধীরে ধীরে তা ফাটলে পরিণত হয়েছিল। লড়াইটা অতসীর মনেও চলছে। রক্তাক্ত হয়েছে সে। প্রাণের বন্ধু শিউলি তাকে অনেক বুঝিয়েছে, বলছে নিজের ঘেরাটোপ থেকে একবার অন্তত বেরিয়ে দেখতে। কিন্তু দ্বিধা সংকোচ, আজন্মলালিত কিছু অভ্যাস পায়ের বেড়ি হয়েছে তার।
কিন্তু নাহ্। এভাবে আর চলতে পারেনা, ভাবে অতসী। তাতাইএর অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আর চলতে পারেনা। তাতাই তার বাবাইকে খুব মিস করে। খুব ডিপ্রেসড থাকে ছেলেটা আজকাল। লড়াইটাতে হেরে গেলে চলবে না, ভাবে সে। নোটিশ হাতে পেয়ে যখন ছেলেকে নিয়ে কসবায় চলে এসেছে, তখন তাতাইয়ের মনের কথা ভাবেইনি সেভাবে। কিন্তু এবার ভাবতে হবে।
ব্যাল্কানি থেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তাতাইয়ের জন্য মনটা হুহু করে ওঠে অতসীর। ভাবে, কী এমন চাহিদা দেবরাজের? অতসী কি পারেনা নিজেকে একটু বদলে নিতে? মানুষটার মনটা এতো ভাল, কোনও কিছুর অভাব রাখেনি সে, শিউলির স্বামী কুন্তলের মতো পরনারীতে মোহও নেই তার, শুধু অতসীকে সে তার মানসী গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এটা কি খুব বড় অপরাধ? তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা অন্যদের মতো সহজ নয়, এতে কি দেবরাজের একার দোষ? তাতে কি তারও যথেষ্ট অসহযোগিতা নেই!
আয়ানার সামনে দাঁড়াল সে। হয়তো বা নিজের সামনেই। এতো কি কঠিন নিজেকে বদলানো? সে কেন পারবে না? এক টানে বাজু থেকে খুলে ফেলল সে মাদুলি দুটো। কাঁপাকাঁপা হাতে শাঁখা-পলায় হাত দিল, কী হবে এসব রেখে যদি স্বামীর সাথে সম্পর্কই না থাকে? একটা একটা খুলে ফেলল সেগুলি, সাথে খুলে ফেলতে লাগল আজন্মলালিত কিছু চিন্তাধারা।
লাল শিফনের শাড়িটা তুলে নিল সে। সেই শাড়ি যেটা দেবরাজ তাতাইয়ের জন্মদিনের পার্টির জন্য সখ করে কিনে এনেছিল, সাথে ম্যাচিং স্লিভলেস।যেটা দেখে প্রায় আঁতকে উঠে অতসী কাঞ্জিভরম পরেই অতিথি আপ্যায়ন করেছিল দেবরাজের সব আশায় জল ঢেলে। মনে আছে এরপর টানা সাতদিন দেবরাজ কথা বলেনি তার সাথে।
সেই শাড়ি-ব্লাউজ অতসী এবার কী ভেবে ভরে নিয়েছিল ব্যাগ গোছানোর সময়। সব সংকোচ, কুন্ঠা বিসর্জন দিয়ে অতসী তার অঙ্গে তুলে নিল সেই শাড়ি ব্লাউজ ম্যাচিং গয়নাসহ। যত্ন করে নতুন সাজে সাজালো নিজেকে। সকালে শ্যাম্পু করা এক ঢাল চুল সে খুলে দিল। আয়নায় নিজের রূপে নিজেই চমকে উঠল সে।
অপেক্ষা করতে লাগল দেবরাজের।
।৬।
একা একা সমুদ্রের ধারও আর ভাল লাগে না দেবরাজের। সাতদিন হয়ে গেল, এখনও কিছুই এগোল না। তাহলে সত্যিই কি ছাড়াছাড়িটা হয়ে যাবে তাদের? সে তো বছরের অর্ধেক সময় ট্যুরেই থাকে, মা বাবাকে নিয়ে হবে মহা সমস্যা, তাঁরা অতসী ছাড়া চলতে পারেননা। সে টের পায় তার অনুপস্থিতিতে তাদের বাড়িতে অতসীর যাতায়াত অবাধ। বাবা মায়ের সব কিছুর দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে আলাদা থেকেও। তাছাড়া তাতাইকে ছাড়াও বড় তিতকুটে লাগে আজকাল।কলকাতায় থাকলে ছুটির দিনে যখন তাতাইকে নিয়ে বেড়াতে বেরোয় সে, তখন বড্ড মনমরা থাকে ছেলেটা, অথচ খারাপ আচরণ করে না। কোনও চাহিদা নেই, এক্কেবারে মায়ের স্বভাব পেয়েছে সে। আপন মনে দেবরাজ ভাবতে লাগে কোনও অভিযোগ কোনও দিনই ছিলনা অতসীর, এখনও নেই। এই যে সে রোজ বেরিয়ে আসছে একা, একটা দিন অতসী একটাও প্রশ্নও করেনি, বাধাও দেয়নি।
পাশে বসে থাকা পরিবারের ঝগড়ায় চিন্তায় ছেদ পড়ে তার। অসম্ভব ডিমান্ডিং বউয়ের সাথে পেরে উঠছে না লোকটি। সাথের বাচ্চাটিও হাজারো বায়নাক্কায় নাঝেহাল করে তুলছে ভদ্রলোকটিকে। কথায় কথায় মুখঝামটা দিচ্ছে মহিলা — শ্বশুরবাড়ি, সংসার এসবের জন্য কী কী সাধ সে বিসর্জন দিয়েছে তার ফিরিস্তি চলছে।
কালও সে দেখেছে এরকম ঝগড়া। এক কেরিয়র-সর্বস্ব মহিলার স্বামীর সাথে ইগো ঝনঝনানো বিবাদ। শুধু কাল কেন, খুব কাছ থেকে সে বেশ কিছু মানুষকে কিছু দাম্পত্য কলহকে চাক্কুস করেছে যারা ফেসবুকের হাসিহাসি মুখের বেআব্রু রূপ। যেখানে জোর করে ‘ভাল আছি’ দেখানোর লড়াই নেই — একেবারে মেকাপ-হীন বিবর্ণ মনশ্ছবি।
বিরক্ত দেবরাজ উঠে জলের কাছে যায়। এমন সময় সে দেখতে পায় হইহই করে কতগুলি দেহাতি নারী পুরুষ শিশুর সাথে বেমানান এক দীর্ঘাঙ্গী সুপুরুষ এগিয়ে আসছে, ওই পরিবারগুলির কারোর একটি শিশুকে কোলে নিয়ে।
আরে শিবুদা না? অবাক হয় দেবরাজ। শিবুদা মানে বিখ্যাত অঙ্কলজিস্ট ডক্টর শিবাশিস সেনগুপ্ত, দেবরাজের চেয়ে প্রায় পনের বছরের বড় তার আপন পিসতুতো দাদা।
এক অদ্ভুত লোক এই শিবুদা। দেশ বিদেশের ডিগ্রি পকেটে নিয়ে দিল্লি এইমস এর চাকরি, প্রাইভেট প্র্যাকটিস ছেড়ে মেতেছে দেশের ক্যান্সার আক্রান্ত দুস্থ শিশুদের নিয়ে।
দেবরাজ এগিয়ে যেতেই কোলের শিশুকে তার মায়ের কাছে দিয়ে শিবাশিস বুকে জড়িয়ে ধরে দেবরাজকে। বহুদিন পর দেখা তাদের। সাথের মানুষগুলিকে অপেক্ষা করতে বলে জানালেন তিনি এখন কালাহান্ডির শ্রমিক কলোনিতে ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চাদের চিকিতসায় জড়িত।
কথায় কথায় অতসী, তাতাইয়ের প্রসঙ্গ আসে। স্বাভাবিক ভাবেই শিবুদা জানেন না দেবরাজ অতসীর বর্তমান সম্পর্কের স্টেটাস। আচমকাই শিবুদা প্রশ্ন করে বসেন গত ছ’মাস অতসী যায় না কেন ‘কাছের মানুষ’এ। আকাশ থেকে পড়ে দেবরাজ। শিবুদার কাছেই সে জানতে পারে শিবুদার হাতে গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কাছের মানুষ’ এর কথা। সেখানে সপ্তাহে প্রতিদিন দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় বইপত্র ও টিউশন দেওয়া হয়। অতসী সপ্তাহ দু’দিন নিয়মিত পড়াতে যায় সেখানে এবং প্রয়োজনীয় স্টেশনারী ও খাবার কিনে দিয়ে আসে। বছর তিনেক আগে যখন শিবাশিস ঈর্ষণীয় মোটা অঙ্কের উপার্জন ছেড়ে জনসেবায় মন দেয় তখনই অতসী উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রমদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাঁর মহাযজ্ঞে। সংসার সন্তান সামলে খুব সুন্দর ভাবে সমাজে পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের পড়ানো ও সঠিক পথে চালিত করায় ব্রতী হয় অতসী। শিবাশিস জানায় তাঁর কাছে শিশুদের কষ্টের কথা শুনে অতসীর মনে এতটাই নাড়া দেয় যে মৃত্যুর পর দেহদান করার কাগজপত্রও সে তৈরি করে ফেলেছে শিবাশিসের সহযোগিতায়।
।৭।
শিবুদার কথায় ছটফটিয়ে ওঠে দেবরাজ। অতসীর এই রূপ তো তার জানা হয়নি! আপাত গ্রাম্য সাজ পোশাকের আড়ালে এতো আধুনিক মনস্কা মেয়ে অতসী! নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হয় তার, মন ব্যাকুল হয় অতসীর জন্য। ফিরে আসে সে হোটেলে।
দরজা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়ায় অতসী। ঘরে ঢুকে তাকে দেখে হতবম্ভ হয়ে যায় দেবরাজ। এ কী? এ কাকে দেখছে সে! এ যে তার মানসী অতসী! অন্যরকম সাজলেও মুখটা তার মায়ায় ছেয়ে রয়েছে। এ তো ঐশ্বরিক রূপ! এগিয়ে যায় সে অতসীর দিকে। অতসীও মুখোমুখি হয় দেবরাজের — হয়তো বা নিজের বিবেকেরও। কিন্তু ধরে রাখতে পারেনা নিজেকে। “দেবরাজ, গড়ে নাও আমাকে, তোমার মনের মতো হতে চাই আমি” — সম্পূর্ণ সমর্পন করে নিজেকে, ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে দেবরাজের বুকে মাথা রেখে। ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত রাখে দেবরাজ। তার বুকের ভিতরে গলতে থাকা অভিমানের পাথর আরও দ্রবিভুত হয়। স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে অশ্রুজলে ভাবে দেবরাজ, সেও তো পারত অতসীকে আর একটু স্পেস দিতে। সমাজ , সংসার সব কিছুর প্রতি অতসীর ভালোবাসা, নিষ্ঠা না দেখে সে কেবল বাইরের সাজসজ্জায় নজর দিল? তার ইনসেন্স,কমিটমেন্ট এগুলোর দাম দিলো না সে? জানলো না ভিতর ভিতর মেয়েটা কতটা আধুনিক! দেবরাজের নিজের ওপর নিজেরই ঘৃণা আসে — এই কি সে শিক্ষিত!
।৮।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে মুক্ত করে অতসী চলে যায় নিজের কক্ষে। মনের তোলপাড়ে সারা রাত বিনিদ্র কাটে দেবরাজের। অতসীর বিছানার পাশে দাঁড়ায় সে — ভোরের আলো অতসীর মায়া জড়ানো মুখকে আরও পবিত্র করে তুলেছে। দু’চোখ ভরে দেখে সে অতসীকে, তার নিজের স্ত্রীকে, তার নিজের গর্বকে।
নিষ্কলুষ ভোরের ভৈরবে চেতনা জাগরিত হয় দেবরাজের। স্নান সেরে পাট ভাঙা পোশাক পরে হাসি মুখে অতসীকে ডাকে সে “ওঠো অতসী,যাবেনা জগন্নাথ দেবের দর্শনে?”
ঘুম ভেঙে মন্দিরে যেতে প্রস্তুত দেবরাজের নতুন রূপ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয় অতসী। ধীরে ধীরে সে স্নানে যায়। মায়ের গরদ খানি পরে সে তৈরি হয় নেয়। সব গুছিয়ে বেরোবার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে খুলেই ফেলে হাত খোঁপাটা। আয়নাও তাকে ফেরত দেয় খোলা চুলে, গরদের শাড়িতে, গজদাঁতের ঝিলিকে দ্বিধাহীন অনন্যা এক নারী।
মনের পবিত্রতায় অবগাহন করে সদ্যস্নাত মুক্তমনা দু’টি মানুষ নতুন আলোক পথে এগিয়ে চলে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২
একটি টান টান গল্প |বিষয় পরিচিত, কিন্তু পড়ার সময় এক বিন্দু উত্তেজনা হ্রাস পায়নি | একবারে খুব তাড়াতাড়ি শেষ করলাম | সাহিত্যের দিক থেকেও উৎকর্ষ |ভালো লাগলো |
শুভলগ্না
বাহ। মন ভালো হয়ে গেলো। এমন গল্প আরও চাই।