কাচের দেওয়াল

 

ঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল । রাত তখন দুটো চুয়াল্লিশ।
স্বচ্ছ কাচের ওপারে চাঁদের আলোর বন্যা। নিম গাছের বকটা রাতদুপুরে ডেকে উঠল বলে একটা অচেনা পাখি বিরক্ত হয়ে কিচকিচ্ করে প্রতিবাদ করল।
কিন্তু ঘুমটা ভাঙল কেন ?
মনে হলো, একটা কিছু অস্বাভাবিক শব্দ হয়েছে। কিন্তু এখন কোনো শব্দ নেই। আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য চারিদিকে। একটা রাতচরা পাখি প্রায়‌ই ডাকে। এখন সেটাও চুপ। অস্বস্তি হচ্ছে, আর বোধহয় ঘুম আসবে না। জল খেতে উঠতে হবে। আলো জ্বালতে গিয়ে দেখলাম কারেন্ট নেই। এসব পাহাড়ি অঞ্চলে কারেন্ট হঠাৎ করে চলে যাওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়। উঠে হাতড়ে হাতড়ে জল খেলাম। চেনা হয়ে গেছে এই তিনদিনে।
তিনদিনে ? আশ্চর্য এমন মনে হলো কেন ? তিনদিনের আগে কি আমি ছিলাম না ?
ছিলাম তো ! আমি, শ্রীল শ্রীযুক্ত ভবানী চরণ পাল, ওরফ ‘ভবাল’, তা থেকে ‘ভয়াল’। আমি একজন পেশাদার…হেঁঃ হেঁঃ হেঁঃ!
সে যাগ্গে! পেশা, পেশাই। তার বাছ-বিচার করার আমি কে ? ভগবানের নির্দেশ মনে করে, সততার সাথে কাজ করি। কেউ বলতে পারবে না, কাজ না করে পয়সা নিয়েছি। শুধু একটু ছদ্মবেশ আর মুখোশ লাগে, ওটা আমার কাজের সরঞ্জাম আর কি !
কিন্তু সমস্যা হলো, কেউ কেউ বড্ড ঝামেলা করে আমার কাজের বিষয়ে। শান্তিতে কাজ করতে দেয় না। অমানবিক, জান্তব বলে চেঁচায় !
আরে বাবা, তুমিও করে খাও, আমিও করে খাই। আর এতে যদি কারও ক্ষতি হয়, আমি কী করি ? শুধু শুধু কিছু মানুষের জন্য, এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় আমায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটাতে হচ্ছে। মাঝে মাঝেই হয়। বেশ কিছুদিন থাকতে হবে এখানে।

কিন্তু শব্দটা কীসের ছিল জানা গেল না এখনো। কোনো জন্তু-টন্তু নয় তো ! হলেও আপত্তি নেই, হাতের কাছে কুড়ুল আছে‌ই…
আমি তো আগেই বললাম, ‘ভয়াল’ নামে বেশ পরিচিত আমি। হেঁঃ হেঁঃ হেঁঃ! অবশ্য‌ই ‘পাতাল লোকে’! ওটার ইংরেজি করে নিলে, বুঝতে সুবিধে হতে পারে ।

তো এবার ভয়ালের আন্ডার গ্রাউন্ড হ‌ওয়ার কারণও প্রতিবারের মতোই। তবে এটা ভয়ালের খুব প্রিয় কাজ। বরং বলা যায় নেশা আর পেশা এক হয়ে যায় এখানে। তো হয়েছিল কী !
এক পিতা। তাঁর বিপুল টাকা কড়ির সাথে আরও একটি সম্পদ আছে, তার একমাত্র কন্যা। সেই কন্যা এক ছাপোষা কেরানির ছেলেকে “ভালোবাসি” বলে বায়না জুড়েছে। ছেলেটি সেই বায়নাকে মূল্য দিয়ে জেদ ধরেছে, করবেই বিয়ে। তার তরুণ প্রাণ, টাকা পয়সা, ভয় দেখানো, কিছুতেই কিছু হয় না। শেষে মেয়ের পিতা টাকার কাঁড়ি নিয়ে শরণাপন্ন এই ভয়ালের কাছে। বাঁচাও আমার মেয়েকে। ঐ ছেলেকে আর ফ্যামিলিকে শেষ করে দাও! আরো টাকা চাই তো দেবে সে। শুধু পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে ছেলেকে। মেয়ে যেন না জানে।

তো আমার দোষ হলো, দুঃখ দেখতে পারি না। টাকার বোঝা মুক্ত করে, ছেলের ঠায়-ঠিকানা জেনে নিয়ে, আশ্বস্ত করলাম, “তথাস্তু ! নিশ্চিন্তে বাড়ি যান, মেয়ে আপনার ভালো থাকবে।”

ছেলের বাড়ির খবর নিয়ে জানলাম, মা-ছেলের সংসার। চালচুলো তেমন নেই। যেটুকু আছে, সেটুকু ‘নেই’ করে দেওয়ার ভার পড়েছে এই ভয়ালের ওপর। এটা বাঁয়ে হাত কা খেল। তো একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে ছেলের কলার ধরে বললাম, “বড়লোকের মেয়েকে ফাঁসানো ভালো কথা কি বাবা ? চলো! একটু শিক্ষা নেবে চলো।” নিয়ে আসছিলাম আমার ডেরায়, কিন্তু ঐ মা ! “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”— টাইপের কথা বার্তা বলে পা চেপে ধরল। আঃ আমার হাতে কুড়ুল আছে না ? খুব ধারালো ওটা। বেশি চেঁচামেচি করতে দেওয়া যাবে না। বললাম, “হিম্মৎ আছে! ছেলের সাথে যাওয়ার ? নাকি মরবেন ?”
তো বুড়ি চুপ করে গেল। ছেলেকে বললাম,
“কতটা ভালোবাসো ? মাস ছয়েকের রসদে সামলে নিতে পারবে ? তবে বলো। নাহলে…”
ছেলে ফোন লাগাল। কীসব ফুসুর ফুসুর করে বলল, “হ্যাঁ আমরা রেডি।”
ওদের বেশ কিছুটা টাকা দিয়ে, র‌ওনা করে দিলাম।
চললাম ঐ বাপের বাড়ি। ধণী আর বিখ্যাত লোকের অনেক জ্বালা! একটু একা বসে কথাও বলতে পারে না। আসলে আমিও হেঁঃ হেঁঃ!

তো গাড়িতে তুলে সোজা ডেরায়। আমার ডেরা শহরের বাইরে। খাটে শুইয়ে বেঁধে দিলাম মুখ-হাত-পা।

আয়েশ করে বোতল খুললাম।”কী রে বাপ ! টেস্ট করবি একটু ? দামী জিনিস !”
মুখের বাঁধন খুলে দিলাম ঢেলে কিছুটা। বললাম, “শোনো ! আমি কাজ করি একটু নিজস্ব স্টাইলে। মরতে তো হবেই কাউকে। ওরা তো সুখে শান্তিতে থাকবে। তুই ব্যাটা প্যাঁচ কষবি বাঁচলে। বল, তোর কোনখানটা আগে কাটব ?”

ভেউ ভেউ করছিল… ধ্যাৎ যতসব ছিঁচকাদুনে!
বার করলাম গোল করাত। হেঁঃ হেঁঃ সুইচ দিলেই ঘ্যারর্ ঘ্যারর্ … টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। প্রথমে পায়ের আঙুলগুলো, তারপর হাতের… উঃ কী ছটফটানি! হেঁঃ হেঁঃ… বেশ লাগে দেখতে। শিরাটা কুচ করে…হেঁঃ হেঁঃ…

তবে মরে গেল খুব তাড়াতাড়ি। তখন‌ও আমার বোতল শেষ‌ই হয়নি… ধুরর্ কোনো প্রাণশক্তি নেই। চটপট টুকরো করে ‘নদ্যৈ নমহ্”!
ছেলে-মেয়ে দু’টোকে ফোন করে অবশ্য সাবধান করেছিলাম,
“খবরদার !পুলিশ হয়তো যাবে! আজ নয়তো কাল। একটা কথা জানতে পারলে কিন্তু বাবার কাছে…”
তারপরেই এই অজ্ঞাতবাস, আরকি !

কিন্তু শব্দটা কীসের হয়েছিল ?
ঘুমটা ভাঙল কেন ? বুঝতে পারছি না তো !
যাই হোক, এবার বেশ অবসর, এই অজ্ঞাতবাসের আরেকটা উদ্দেশ্য আছে !
আমার পরের উপন্যাসটা শেষ করতে হবে তো ! বীভৎস রসের উপন্যাসে “ভবানী” এক নম্বরে ! বিপুল জনপ্রিয়তার একটা নেশা আছে! সেটা থেকে বেরোনো যায় নাকি ? হেঁঃ হেঁঃ হেঁঃ!

ঐ আবার শব্দ হলো ! নাঃ এবার স্পষ্ট। কী ব্যাপার!
শব্দটা বাইরে ? না ভেতরে ? কেমন যেন ছমছম্ করে উঠল গা ! উঃ কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার ! একবার দেখা যাক। হতেও তো পারে, আর‌ও একটা উপন্যাসের রসদ! মুখোশটা পরে নেব ? নাঃ অন্ধকার!
কুড়ুলটা দু’হাতে ধরে এগোই! চারিদিক তো বন্ধ! বাইরের দরজাটাও! অবশ্য পাহাড়ের বাড়ি খুব শক্তপোক্ত হয় না। এখানে ছোটো ভালুক-টালুক আসে অনেক সময়।

‌হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল দরজাটা, সঙ্গে সঙ্গে একটা কঠোর কণ্ঠ আছড়ে পড়ল, “হ্যান্ডস্ আপ! এই! বাঁধ এটাকে!”

চেয়ারে বাঁধা মানুষটার সামনে পিস্তলটা নাচাতে নাচাতে বলল কঠোর কণ্ঠ, “বড্ড ভোগান ভোগালে ভয়াল, ওরফ ভবানী…”
এই ঠাণ্ডাতেও কপালের ঘাম মুছলেন ইন্সপেক্টর শশধর মৈত্র।
“এবার চলো ! একটু জামাই আদর খাবে ! এত রক্ত আর এত সাহিত্য ! একই হাতে সামলাও কী করে বাছাধন ?”
পাশ থেকে একজন বলল,
“স্যর মুখোশ, মুখোশ!”
“হুঁউঁউম্ ! কিন্তু পুলিশ বলে একটা বস্তু আছে ভুলে গেলে বাপ ? চারটে কেস, চারটেতেই ঐ শহরের বাইরের ডেরার যোগাযোগ, শুকনো রক্তের দাগ। ওটা কার! সেটাই জানতে পারছিলাম না। চলো বাবা ভবানী চরণ পাল, চলো !”

*******
জেলর দীপেনবাবু সাবধান করলেন,
“দেখুন ডঃ দত্ত! লোকটা সাইকোপ্যাথ! কিন্তু যাদের খুন করেছে, তারা কেউ নির্দোষ ছিল না। ওর মনস্তত্ত্ব খুব জটিল, আর কী নৃশংস ওর খুনের ধরণ ! সাধে কী ভয়াল বলে ! যাই হোক! সাবধানে ডীল্ করবেন। একজন গার্ড দিই আপনার সাথে ?”

প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট মৈত্রেয়ী দত্ত মাথা নামিয়ে বসেছিল। তার মনে তখন…
এন্টি-সোস্যাল পারসোনালিটি ডিস‌অডার। একজন অত জনপ্রিয় রাইটার ! এ কোন অতলের বাসিন্দা ! এর জন্য সমাজের দায়িত্ব কি একেবারেই নেই ? কী করে অস্বীকার করে !
উঠে দাঁড়ালেন।
“নাহ্ দরকার নেই। আমি সামলে নেব। উনি কি খুনের ঘটনা অস্বীকার করেছেন?”
“অস্বীকার? কী বলছেন ডঃ দত্ত ! নদী থেকে তুলে আনা টুকরো লাশের ছবি দেখে হাসছিল। ও মানুষ নাকি ? অথচ আমিও পড়েছি ওর লেখা। বীভৎস লেখাও যে ছাড়া যায় না! না পড়লে বিশ্বাস হয় না।”
“দীপেনবাবু , আমি ওকে একা চাই। প্লীজ়!”
“বেশ! এই বিষ্টু ! ছাব্বিশ নং! যান ম্যাম্”
*******
মৈত্রেয়ী ঢুকে দেখল, কাচের দেওয়ালের ওপারে লোকটা হাতে-পায়ে শেকল পরে বসে আছে। কপালে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। ভবানী! আশ্চর্য! এই কি সে? আস্তে করে ডাকলো,
“ভবানী !”
“কে ?”
চোখদুটো স্থির হলো মৈত্রেয়ীর মুখে।
এ চোখ কার ? সেই ভবানী চরণ ? একবার দেখেছিল স্টেজে সম্বর্ধনা নিতে !
এ মানুষটা তো…আশ্চর্য!

“আমি মৈত্রেয়ী!”
নাম শুনে দৃষ্টি ঘোলাটে,

সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই মন মাতাল করা স্বর! সেই ধীর স্থির ভঙ্গী !
নাঃ এসব মিথ্যে…মৈত্রেয়ী কেন এখানে !

একটা চেয়ার রেখে গেল কনস্টেবল,
“বৈঠিয়ে ডক্টর ম্যাম !”
“ডাক্তার ? তুমি ছদ্মবেশে আমায় ভোলাতে পারবে ?”
“এ তুমি কোন জীবন বেছে নিলে ভবানী!”
ক্রুদ্ধ হিসহিসে স্বর ছড়িয়ে পড়ল, মুখ ফিরিয়ে নিল ভবানী।
“কেন? তুমি আর তোমার বাবার সৃষ্টি আজ তোমার সামনে। খুশি হ‌ও! উৎসব করো! তোমরা সুস্থ সমাজের সদস্য !”
অট্টহাসিতে কেঁপে উঠল ছোট্ট ঘরটা।

“জানি ! তোমার সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এ তার সমাধান নয়!”

“সে তো আমি ঠিক করব ম্যাডাম! কোনটা ঠিক! কোনটা ভুল স-অ-ব! সব তোমরাই বলে দেবে ? আমায় হাত-পা বেঁধে মারবে ? আমার মা!…”
একটু থেমে নিঃশ্বাস চেপে রাখল ভবানী ! চেঁচিয়ে উঠল প্রাণপনে,”তুমি কি নিজের মা কে ঝুলতে দেখেছ কড়িকাঠ থেকে ? ডাক্তার ! দেখেছ ?”

চোখদুটো জলে ভরে উঠল মৈত্রেয়ীর। সেদিকে তাকিয়ে যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল ভবানী। ঘোর লাগা চোখ! শক্ত চোয়াল !
“হ্যাঁ! খুন করতে আমার হাত কাঁপে না ! যেমন এই মুহূর্তে তোমার ঐ ছলছল চোখদুটো আমার চাই। ছোট্ট একটা ছুরি দিয়ে ঘুরিয়ে… সামান্য কষ্ট!”

শিউরে উঠে দু’পা পিছিয়ে গেল মৈত্রেয়ী…

“যারা জীবনকে খুন করে, আমি খুন করব তাদের। খুন করব। বারবার জন্মাব, নৃশংস ভাবে খুন করব । আমাকে থামাতে গেলে, তোমাদের‌ও আমায় খুন করতে হবে ডাক্তার দিদিমণি! হাঃ হাঃ …করো! খুন করো। ভারি মজা…হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…”

মৈত্রেয়ী থর থর করে কেঁপে উঠল, ভবানীকে এখন আর চেনা যায় না। হাসির দমকে গলার শির ফুলে উঠেছে, চোখ লাল, মুখ বিকৃত ! লালা ঝরছে ! না, মৈত্রেয়ী একে চেনে না! দুহাতে কান ঢেকে ছুটে বেরিয়ে এল কাচের ঘর থেকে ! আঘাত করল স্বচ্ছ দেওয়ালে। আঘাত করতেই থাকল। কতক্ষণ! কতদিন এ দেওয়ালের ওপারে অন্ধকার থাকবে!

তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সা’দ জগলুল আববাস
সা’দ জগলুল আববাস
1 year ago

প্রথম দিকে শিউরে উঠেছিলাম , আপনার মুখ ভেসে উঠেছিলো, কী ভাবে এ মানুষটি এ ভাবে ভাবতে পারেন।তারপর শেষে এসে ভুল ভাঙ্গলো। ভাবানীরও কষ্ট ছিলো। সত্যি বলতে কী আমাদের সমাজই কিন্তু মানুষকে বেপথু করে।
আপনার লেখার আমি সবসময়ই ভক্ত। চমৎকার সাবলীলতায় একটি মানসিক সমস্যাকে গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছন।আপনার গল্প বলার স্টাইলটিও খুব পছন্দের।
শুভেচ্ছা।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse