চতুষ্কোণ
মৌসুমী দাশগুপ্ত
জন্মেজয়ের কথা:
জীবনের সূতোটা আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে, জন্মেজয় সেকথা জানে। তাকে দেখতে আসা লোকজন ইদানিং তার দিকে তাকিয়ে কথা বলে না, বলে মাটির দিকে চেয়ে অথবা সুতপার দিকে চেয়ে।
জন্মেজয়-সুতপা কলেজেখ্যাত জুটি। সেই কবে থেকে তারা একসাথে পথ চলছে! কলেজের করিডোর পেরিয়ে, ভার্সিটির ক্যান্টিন হয়ে পারিবারিক বিবাহ বন্ধনের সিলমোহরের পথে তাদের সপ্তসহস্রপদী চলন। তাদের বন্ধুমহল এক, তাদের শুভাকাঙ্খীরাও এক, এমনকি আত্মীয়দের মাঝেও দুয়েকজন ‘বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি’ গোছের আছেই। তাদের সবার কাছে জন্মেজয়-সুতপা মানেই single entity, একক অস্তিত্ব। ওদেরকে আলাদা করে ভাবতে তারা শেখেইনি। অন্তত এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত।
দুর্দান্ত টেবল টেনিস প্লেয়ার, লম্বা, একহারা চেহারার জন্মেজয় যখন মধ্য চল্লিশে এসে হঠাৎ করেই শুকোতে শুরু করল তখন সবাই ভাবল সে বুঝি ডায়েট আর ফিজিক্যাল ফিটনেস এর ফল। পারিবারিক আবহে সবাই বলল, “বাহ্, বেশ তো লাগছে!” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুগল ছবিতে “ইশ! কী হ্যান্ডসাম লাগছে!” “সিক্রেটটা বলে দিন তো!” ধরণের মন্তব্য ভেসে আসল বারবার। শুধু সুতপাই খুশি ছিল না। বারবার বলত, “চল, একবার সব চেকআপ করাই। কেন এমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছ বলো তো!” জন্মেজয় মুচকি হেসে বলত, “তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি! সবাই আমাকে হ্যান্ডসাম বলছে আর তোমাকে কিছু বলছে না তাই? আরে, তুমি তো আমার সবসময়ের সুন্দরী বউ!” তাও সুতপা একদিন জোর করেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ততদিনে অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে।
খবরটা ওরা দীর্ঘদিন কাউকে জানায়নি। মানুষের করুণা জন্মেজয় নিতে পারে না একদমই। তার বাবা মায়ের দেওয়া নাম সার্থক করে সে জন্ম থেকে জীবনের সব পর্যায়ে জয়ী হয়েই এসেছে। আজন্ম সুঠাম সুন্দর, পড়ালেখায় ভাল, মোটামুটি ভালো খেলোয়াড়, ভালো উপার্জন, দারুণ প্রেমের পরে চমৎকার একটি বিয়ে এবং সংসার, কোথাও কোন খামতি ছিল না। মানুষ হিসেবেও জন্মেজয় মোটের উপর ভালই, চোখে পড়ার মতো তেমন কোন দোষ নেই, বেশ দিলদরিয়া লোক। আত্মীয়-বন্ধুমহলে সুতপার চেয়েও জন্মেজয়ই বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু দীর্ঘদিন খবরটা গোপন রাখাও গেল না। জন্মেজয়ের চেহারা তখন আর ডায়েটজনিত হ্যান্ডসাম নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই রুগ্ন এবং শ্রীহীন হয়ে উঠছে। লোকে অবাক হয়ে সুতপাকে প্রশ্ন করে, “কী রে, বরের এই হাল কেন?” মানুষের মন্তব্যের ভয়ে সুতপা এখন যুগল সেলফি পোস্ট করা ছেড়েই দিয়েছে। ক্রমে ক্রমে সবাই জেনে গেল জন্মেজয় দুরারোগ্য কর্কট রোগের শিকার, সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সুতপা তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছে, করছে। তার কোন ত্রুটি কেউ ধরতে পারবে না। তাদের ছেলেমেয়েদুটিও বাবার সাথে সাথেই আছে প্রায় রাতদিন। আছে আত্মীয়-বন্ধু-শুভাকাঙ্খীরা।
কিন্তু ওদের সবাইকে তার অসহ্য লাগে, পুরোপুরি অসহ্য। ওদের করুণাভরা দৃষ্টি, ওদের ‘আহা, উহু’, ওদের ফিসফাস কথা আর ফোঁসফাঁস কান্না সবই তার অসহ্য লাগে। মনে হয় সবাই যেন অপেক্ষা করে আছে শেষদিনটার, যখন তারা মন খারাপের মুখোশটা খুলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। এর চেয়ে ভালো ছিল যদি সে হার্ট অ্যাটাকে বা রোড এক্সিডেণ্টে মারা যেত। Gone with a bang! তারও কষ্ট কম হত, বাকি সবারও।
ঈশ্বরের প্রতিও তার ভয়াবহ রাগ। “কোন পাপে ঠাকুর? কোন পাপে এই শাস্তি দিলে? কীইবা এমন বয়স হয়েছে আমার? কোনদিন নেশা ভাঙ করিনি, সিগারেট পর্যন্ত না। মানুষের ভাল ছাড়া খারাপ করিনি কখনও! কেন তবে এই দশা আমার? আয়নায় নিজের চেহারা নিজেই দেখতে পারি না, দেওয়ালে টাঙানো যুগল ছবি কেবলই যেন অট্টহাস্যে উপহাস করে! ছেলেমেয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে খেলতাম আর এখন বাথরুমে যেতেও ওদেরকে ডাকতে হয়। এক পয়সা উপার্জন নেই, বরং দুজনের ভবিষ্যতের সব সঞ্চয় আমার জন্যে ধ্বংস হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নষ্ট হচ্ছে। এই গ্লানি থেকে মুক্তি দাও এবার! অনেক তো কষ্ট দিলে, আর কত!”
সুতপার কথা:
ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে আয়নার সামনে বসে লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে নিচ্ছিল সুতপা। ইচ্ছে করছে না একদম, হাত পা ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছে যেন। কিন্তু চুল একবার আঁচড়ে না নিলে সকালে বড় জট বেঁধে থাকে। ইশ! কতদিন একটানা শান্তিতে ঘুমোনো হয়নি! রাতে কতবার যে ঘুম ভাঙ্গে! কখনও উৎকণ্ঠায়, কখনও জন্মেজয়ের প্রয়োজনে। ওদিকে আবার খুব সকালে না উঠলে অফিসে যাবার আগে সবকিছু গুছিয়ে তোলা যায় না। একটা দিন, শুধু একটা দিন যদি নির্ভেজাল একটা ছুটি মিলত! সেই যখন ওরা ছুটিতে বেড়াতে যেত! জন্মেজয়ের কার্পণ্য ছিল না, ভাল হোটেল নিত সে সবসময়। আয়েশ করে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে হোটেলের সাজানো খাবার থেকে আলতো হাতে খাবার তুলে নেওয়া, উষ্ণ কফিতে চুমুক…. পেয়ালার ওপারে জন্মেজয়ের দিকে চেয়ে এক টুকরো তৃপ্তির হাসি… ছেলেমেয়েদের কলকাকলি… জীবনের তুচ্ছ তুচ্ছ সুখগুলো। গলার কাছে ঠেলে আসা কান্নাটুকুকে সে জোর করে গিলে নেয়। জন্মেজয় ইদানিং বড় খিটখিটে হয়ে গেছে। সুতপাকে কাঁদতে দেখলেও সে বিরক্ত হয় আবার কখনও ভুল করে একটু হাসলেও সরু চোখে তাকায়। অথচ মানুষটা মোটেই এমন ছিল না। হঠাৎই পেছন থেকে জন্মেজয়ের গলা ভেসে আসে, “তুমি অনেকটা শুকিয়ে গেছ, তাতে তোমাকে আরও সুন্দর লাগছে।“ সুতপা মুখ ফিরিয়ে তাকায়। পুরোনো মানুষটাকে পড়ে নেবার, খুঁজে পাবার চেষ্টা করে। সেই অষ্টাদশীর কোঠায় এই মানুষটির সাথে তার প্রথম দৃষ্টিবিনিময়। সেই থেকে আর কারও দিকে তাকানোর প্রয়োজনই বোধ করেনি সে। জন্মেজয় তার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম। অন্যসব রঙ্গমঞ্চচারীরা সাড়া না পেয়ে নীরবে সরে গেছে একে একে। ভয়ে ভয়ে সুতপা একটু হাসল। চোখ তখনও ভেজা। জন্মেজয় চোখে চোখ রেখে বলল, “সেজন্যেই বুঝি আমার সাথে এখন আর ছবি তুলতে চাও না? আমার এই হতকুৎসিত চেহারার পাশে তোমাকে বুঝি আর মানায় না, না?” তারপর দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সুতপা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর গিয়ে পাশে বসে জন্মেজয়ের গায়ে হাত রাখল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারার আগেই জন্মেজয় বলে উঠল, “আর বেশি দিন না। এর পর আবার একজন হ্যান্ডসাম কারও সাথে ছবি তুলতে পারবে। তোমার তো অ্যাডমায়ারারের অভাব নেই!” সুতপার মনে হল সে যেন প্রাইমারি স্কুলের ডেস্কে দাঁড়িয়ে আর তার পিঠে শপাং করে বেতের বাড়িটা পড়ল! ঠিক ছোটবেলার মতই ঠোঁট চেপে কান্নাটা গিলে নিল। ধরা গলায় বলল, “কেন এভাবে ভাবছ? তুমি কি আমাকে চেন না?” হঠাৎ করেই জন্মেজয় ঘুরে তাকাল। জ্বলন্ত চোখে বলল, “খুব চিনি। তোমাদের সব্বাইকে চেনা হয়ে গেছে আমার। সবাই হাঁ করে আমার মরার জন্য বসে আছ। তাহলেই তোমাদের ফুরফুরে জীবন ফিরে আসবে আবার। তোমার মেয়ে ড্যান্স ক্লাসে যাবে, ছেলে বন্ধুদের সাথে ফুর্তি করবে, তুমি সেজেগুজে এলো চুলে ছবি তুলে ফেসবুকে দেবে! আমার জন্যই তো তোমাদের মিথ্যামিথ্যি দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে!” এতক্ষণে জন্মেজয়ের গলা চড়তে চড়তে চিৎকারের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাই শুনে জিত আর সূচী দুজনেই ছুটে এসেছে কী হল দেখতে। ক্ষোভে, দুঃখে সুতপার মুখটা নীচু হয়ে যায়, ছেলেমেয়ের সামনে কোন প্রত্যুত্তর মুখে যোগায় না।
জিত এবং সূচি:
জন্মেজয়ের রাগ এবার মেয়ের উপর গিয়ে পড়ে। “কী রে! খুব ঝামেলায় আছিস না? বান্ধবীদের সাথে হৈ হল্লা বন্ধ, বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘোরাঘুরি বন্ধ, বাপি মরলেই বাঁচিস!” সূচি কান্না চাপতে চাপতে ঘর থেকে একছুটে বেরিয়ে গেল। সুতপা ভাবল ছেলেটাও বোনের পিছুপিছু বেরিয়ে যাবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে জিত এসে মায়ের পিঠে হাত রেখে দাঁড়াল। জন্মেজয়ের ছেলে জন্মেজয়ের মতই লম্বা, সুতপাকে মাথায় ছাড়িয়ে গেছে সে কবেই! বাবার চোখে চেয়ে বলল, “বাপি, কেন এসব ভেবে নিজেও কষ্ট পাচ্ছ, বাকি সবাইকেও কষ্ট দিচ্ছ? আমরা কি কেউ চেয়েছি তুমি অসুস্থ হও? জীবন তো আসলে কারও জন্য থেমে থাকে না, তাই না বাপি? মনে পড়ে ঠাম্মির অসুখের কথা? মাকে রাতদিন ঠাম্মির দেখাশোনা করতে হত বলে তুমি কিন্তু বিরক্তই হতে। তুমি চাইতে আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যেতে, কিন্তু ঠাম্মিকে ফেলে যেতে পারতে না। ঠিক না বলো? সূচি তখন অনেক ছোট, ওর হয়তো মনে নেই। আমার কিন্তু মনে আছে বাপি। এখন আমরা সবাই তোমার পাশে থাকছি, তবে হ্যাঁ, আমাদেরও হয়তো কখনও কখনও একটু হালকা হতে ইচ্ছে করে, বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। সেটা কি দোষ বলো?” একটু থেমে আবার বলল, “আমাদের চারজনার যেটুকু সময় বাকি আছে সেটুকু সময় কি আমরা আর একটু ভালভাবে কাটাতে পারি না? তুমি জান তোমাকে আমরা অনেক ভালবাসি বাপি!” বলতে বলতে জিতের গলাটা ভেঙ্গে আসে। মায়ের পিঠে আলতো একটু চাপ দিয়ে সে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
সুতপা জলভরা চোখ তুলে জন্মেজয়ের দিকে তাকাল। মনে হলো অনেকদিন পর পুরোনো জন্মেজয় ফিরে আসছে। কাছে গিয়ে কাঁধে মাথা রাখল পুরোনো দিনের মতো। অনেকক্ষণ পর জন্মেজয় বলল, “তপা, অনেকদিন বাড়িতে কোন উৎসব হয় না। সামনে পয়লা বৈশাখ আসছে। চলো সবাইকে ডাকি। তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজবে সেদিন। সবাই যেন হাসিমুখে আসে, ঠিক আগের মত। আমি কারও করুণা সহ্য করতে পারি না, একদম না। সরি, তপা, তোমার সাথে, ছেলেমেয়েদের সাথে ইদানিং খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। ওগুলো মনে রেখ না তপা, প্লিজ! শুধু আগের আমাকে মনে রেখো, আগের আমাকে…”।
আজ নতুন বছরের প্রথম দিন। ঘর ভরা মানুষ এসেছে জন্মেজয়ের আমন্ত্রণে। অসুস্থ শরীর নিয়েই জনে জনে সবাইকে ফোন করেছে জন্মেজয়। সূতপার পরনে লাল সাদা তাঁতের শাড়ি, লম্বা চুলের বেণীতে বেলি ফুলের মালা। জিত আর সূচীর বন্ধুরাও এসেছে বৈশাখী সাজে, তারুণ্যে ঝলমল। সাদা চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবিতে জন্মেজয়কেও আজ ভালই লাগছে দেখতে। সবাই বলল, “বাহ, এই তো বেশ সুস্থ হয়ে উঠছ!” তরুণ তরুণীর দল ঝুপঝুপ প্রণাম করে বলল, “ইশ! কাকু, তোমাকে আর কাকিমাকে দেখতে কী যে ভাল লাগছে!” ওদের আগে সূচী আর জিতও এসেছিল প্রণাম করতে। ছেলেমেয়েকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখেছিল জন্মেজয়, কোন কথা বলেনি। কখনও কখনও ভাষা বাহুল্য মাত্র। আগের রাতে সূতপার সাথে একান্ত চুম্বনটিও ছিল অনেক না বলা কথায় ভরা।
জন্মেজয়ের স্কুলশিক্ষক বাবা বলতেন, ছাত্র, পুত্র এবং মিত্র, এই তিনজনের কাছে হারায় লজ্জা নেই, বরং আছে গৌরব। ছেলের কাছে হেরে গিয়ে মৃত্যুর তিনদিন আগে জিতে গিয়েছিল আজীবন জিতে আসা জন্মেজয়।
তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২৩
খুব সুন্দর।এবার সুতপা কমন হয়ে গেছে।