গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও যাদু বাস্তবতা

 

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ — এই কলম্বিয়ান লেখক ম্যাজিক রিয়ালিটি বা যাদু বাস্তবতার এক অমর স্রষ্টা। নোবেল জয়ী এই স্প্যানিশ লেখক তাঁর বিখ্যাত দুটি উপন্যাস ” ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড” এবং ” লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য সৃষ্টি।

১৯২৭ সালে কলম্বিয়ার আরকাটাকা শহরে জন্ম মার্কুয়েজের। শৈশবে ঠাকুরদা এবং ঠাকুরমার স্নেহচ্ছায়ায় বড় হওয়া মার্কেজের জীবন এবং সৃষ্টিতে এঁদের দুজনের প্রভাবও ছিল খুব বেশি। তাঁর যুক্তিবাদী সামরিক অফিসার প্রপিতামহের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতিফলন মার্কেজের সাহিত্যে দেখা যায়। শিশুকালে পিতামহীর মুখ থেকে শোনা ভৌতিক ও অলৌকিক গল্পের প্রভাব তাঁর যাদু বাস্তবতার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।

মার্কেজের সাত বছর বয়সে তাঁর পিতামহ মারা যান। তারপর তিনি কলম্বিয়ান ক্যাপিটাল বোগোটা তে চলে আসেন। শিশু বয়স থেকেই পাঠে তাঁর আগ্রহ ছিল।

এইসময় ফাৎজ্ কাফকার ‘ দ্যা মেটামরফোসিস’ খুব প্রভাবিত করে তাঁকে এবং হাতে কলম তুলে নেন তিনি। যদিও প্রথম জীবনে আইনকে পেশা হিসেবে নেবারই ইচ্ছে ছিল তাঁর।

১৯৫০ সালে ইউরোপ‌ ভ্রমণ কালে তাঁর বামপন্থী মনোভাব গড়ে ওঠে। ১৯৫৭ সালে ল্যাটিন‌ আমেরিকায়‌ একটি পত্রিকা সম্পাদনায়‌ সহকারী হিসেবে যোগ দেন তিনি।পরের‌ বছর বারাংক্যুইলায়‌ ফিরে আসেন এবং শৈশব সাথী‌ মার্সিডিজ‌ বার্চা‌ পার্ডোকে‌ বিয়ে করেন। ১৯৬৭ সাল‌ মার্কেজের সৃষ্টি জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বছরই তাঁর বিশ্ববন্দিত‌ উপন্যাস ‘ ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড‌ ‘ প্রকাশিত হয়। ম্যাজিক‌ রিয়ালিজমের ব্যবহার মার্কেজের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজে বলেছেন তাঁর সৃষ্টিতে যাদু বাস্তবতার ব্যবহার মূলতঃ হেমিংওয়ে এবং ফকনার দ্বারা‌ প্রভাবিত।

মার্কেজের প্রতিটি উপন্যাস কাঠামোগত দিক দিয়ে সহজ এবং সরল, প্রতিটি প্লটের‌ বুনন যাদু‌ বাস্তবতার ব্যবহারে এক কালোত্তীর্ণ মহিমায় পাঠককে আবিষ্ট‌ করে। তাঁর ‘ লাভ ইন দ্য‌ টাইম অফ‌ কলেরা‌ ‘ এক অসাধারণ উপন্যাস। মানুষের একাকীত্ব — সে ব্যাক্তিরই‌ হোক‌ অথবা সামগ্ৰিকভাবে‌ মানুষেরই‌ হোক, একধরনের রোগ। ভালবাসাও‌ একধরনের রোগ‌ যা‌ মানুষকে‌ বিপন্ন ও একা করে দেয় — মানষিক ও শারীরিকভাবে বিপন্ন করে। এই উপন্যাসে মার্কেজ দেখাতে চেয়েছেন ভালবাসাও আবেগের ক্ষয়রোগ‌ যা‌ প্লেগের‌ মতোই সর্বগ্ৰাসী‌ ।

‘ হান্ড্রেড‌ ইয়ার্স অফ সলিটিউড‌ ‘ উপন্যাসটি‌ নিয়ে আমরা যদি‌ আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো‌ ম্যাজিক‌ রিয়ালিজমের কী অপূর্ব ব্যবহার এই উপন্যাসে। বহুস্তরীয়‌ এই উপন্যাসে কলম্বিয়ার ইতিহাস, সময়ের সাথে সাথে অপরিবর্তনীয় কিছু জিনিষের‌ বর্ণনা কী অসীম দক্ষতার সাথে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠকের মনন‌ ঋদ্ধ করে। গার্সিয়া মার্কেজের অনন্য রচনাশৈলী এবং বর্ণনার‌ মাধ্যমে পাঠককে টেনে রাখেন উপন্যাসটিতে। পুরো উপন্যাসটি‌ জুড়ে বাস্তবের সঙ্গে পরাবাস্তবের‌ এক অসাধারণ সংমিশ্রণ ঘটেছে। এই যাদু বাস্তবতাই , ( magic realism) মার্কেজের রচনাশৈলীর‌ মূল বৈশিষ্ট্য,যদিও‌ সব উপন্যাসে তার তিনি ব্যবহার‌ করেন নি। উপন্যাসের মূল বিষয় হলো নির্জনতা‌ বা একাকীত্ব। বুয়েন্দিয়া‌ পরিবারের স্বার্থপরতা এবং অহংকেন্দ্রিকতা‌ চিত্রিত‌ হয়েছে অরল্যান্ডো‌ চরিত্রের‌ মাধ্যমে।বুয়েন্দিয়া‌ পরিবারের স্বার্থপরতা একসময় ভেঙ্গে যায়। উপন্যাসের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আভিজাত্যের অসারতা। মার্কেজ ল্যাটিন‌ আমেরিকার অভিজাতদের অন্তঃসারশূন্যতা‌ একটি অভিজাত পরিবারের ইতিহাসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে।

মার্কেজের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ‘ নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কলোনেল’ – এই ঔপন্যাসিকা টির কথা বলতেই হয়। হৃদয়স্পর্শী এই ঐপন্যাসিকাটি‌ ( নভেলা‌ ) মার্কেজ রচনা করেন ১৯৫৭-১৯৫৮ সালের মধ্যে। গল্পটি একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের যিনি‌ দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন তাঁর না আসা পেনশনের জন্য। বাড়িতে তাঁর অসুস্থ স্ত্রী‌ , চরম‌ অর্থকষ্ট এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি চরম আশাবাদী তাঁর পেনশন একদিন ঠিক চালু হবে এবং প্রতি শুক্রবার মেল চেক করেন তিনি। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর তারই‌ একটি পোষা মোরগ‌ এই দম্পতির একমাত্র অবলম্বন। মার্কেজ‌ এই উপন্যাসিকার‌ মাধ্যমে সরকারি‌ অব্যবস্হা‌ এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির‌ বিভিন্ন দিক‌ তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর অন্যান্য‌ উপন্যাসের‌ মতো এটি যাদু‌ বাস্তবতার বাইরে। যদিও‌ গল্পে‌ মোরগটি‌ প্রতীক হিসেবেই এসেছে।

 

বিংশ‌ শতাব্দীর শেষার্ধে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ এই কলম্বিয়ান লেখকের আবির্ভাব সাহিত্য জগতে এক মূল্যবান ঘটনা। সাহিত্য বোদ্ধাদের মতে‌ তিনি হোর্হে‌ লুইস‌ বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাজারের মতো বিংশ‌ শতাব্দীর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দক্ষিণ আমেরিকান কথাসাহিত্যিক। লেখক হিসেবে চার্লস ডিকেন্স, লেভ‌ তলস্তয়, আর্নেষ্ট‌ হেমিংওয়ের‌ সাথে একই সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়।১৯৮২ সালে এই প্রবাদপ্রতিম লেখক নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৪ সালের ১৭ ই এপ্রিল মেক্সিকো শহরে ৮৭ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে কলম্বিয়ার‌ এক গৌরবময় অধ্যায়ের‌ অবসান ঘটে এবং বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Ranu Sil
Ranu Sil
1 year ago

অত্যন্ত সুন্দর প্রবন্ধ। ধন্যবাদ নেবেন।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse