আরশি বদল
সৌরীণ মুখার্জী
শরতের আকাশকে ভরসা করার সৎসাহস আজকাল আর পাই না। শুকনো আবহাওয়া দেখে ঘর থেকে বেরোলাম আর খানিক বাদেই সেই সমস্ত স্বস্তিটুকুর ওপর জল ঢেলে আচমকা বৃষ্টি নামলো। এই প্রবঞ্চনা এড়াতেই সব জায়গায় ছাতাটাকে বগলদাবা করে চলেছি। তবে আজকের এই বৃষ্টিতে ছাতাও বেগতিক মনে হচ্ছে। অগত্যা মাথা বাঁচাতে সামনের চায়ের দোকানটায় দাঁড়ালাম। আর তারপরই সেই লোকটাকে আবার দেখলাম। এদিকেই চেয়ে আছে। খানিকটা উসখুশ করছে বোধহয়।
কালিম্পং শহর থেকে খানিকটা ওপরে এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম লোলেগাও। হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি আর হোম-স্টে ছাড়া সেভাবে কোনো জনবসতি নেই। এই দু’দিনে টুকটাক আরও অনেকের সাথেই আলাপ হয়েছে। হোম-স্টের দাজুও ভারি অমায়িক মানুষ। আসার সময় ট্রেনেই আমার পিঠব্যাগটা চুরি হয়েছে। সেভাবে টাকা পয়সা ছিলো না তবে কাগজপত্র এবং আরো কিছু দরকারি জিনিস ছিলো। মনে মনে ভাবলাম বেশ সমস্যায় পড়বো গিয়ে, তবে সেভাবে এখনও অসুবিধা হয়নি। হারিয়ে যাওয়া কিছু জিনিস এখানের বাজারেই কিনে ফেললাম। ফোনে আগেই খবর দেওয়া ছিল বলে চেক-ইনেও খুব একটা সমস্যা হলো না, বরং উল্টে আমার প্রতি ওদের সমবেদনা আমাকে লজ্জায় ফেলেছিলো। পাহাড়ি লোকের এই সারল্য বারবার আমাকে অবাক করে দেয়।
বাজারের গলিতেই লোকটাকে প্রথম দেখেছিলাম। একমুখ হাসি নিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে এসেছিলো।
– “তন্ময় না? চিনতে পারছিস ? আমি অলোক। তুষার স্যারের ফিজিক্স টিউশন…”
খানিকটা অপ্রস্তুত হলাম। মুখটা তো মনে পড়লোই না আর তুষার স্যার, ফিজিক্স টিউশন এসব তো কিছুই মাথায় ঢুকলো না। আমি সাহিত্যের ছাত্র। ফিজিক্স টিউশন কোনোদিন পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। হয়তো চিনতে ভুল করেছে। আমি বললাম,
-“দুঃখিত ঠিক চিনলাম না। আমি তথাগত। আপনি হয়তো অন্যকারোর সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। যাই হোক, আমার একটু তাড়া আছে, কিছু মনে করবেন না। এগোলাম। ধন্যবাদ।”
কী জানি ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো আমার কথায় যেন আশ্বস্ত হলো না। বললো
-“ওহ সরি। হতে পারে। আসলে বয়স হচ্ছে তো। আমার স্কুলের বন্ধু তন্ময়। আপনার সাথে অদ্ভুত মুখের মিল। আসলে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই, তাই ভাবলাম হয়তো…আপনিও কিছু মনে করবেন না। হ্যাঁ, যান। আমিও এগোই। ভালো থাকবেন।”
ফেরার পথে দেখলাম লোকটা ওখানে দাঁড়িয়েই ফোন নিয়ে খুটখাট করছে। ইচ্ছে করেই আর তাকালাম না। মনে মনে ভদ্রলোকের প্রতি হাসলাম। তথাগতকে আর তন্ময় বানানো হলো না!
পরেরদিন অবশ্য সেভাবে বৃষ্টি হয়নি। মেঘ ছিলো ইতিউতি। এই মেঘলা দিনে পাহাড়ের বুকে চরে বেড়ানোর একটা আলাদাই মজা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই যে দুটো লাইন-
“বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে”
মেঘ বৃষ্টির পাহাড়ে এই কথাগুলো কিন্তু রূপকথার মতোই সত্যি! সব ভুলে গিয়ে এখানে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। লেখার কথাও মাঝে মাঝে ভুলে যাই। তবে সন্দীপবাবুর আইডিয়াটা মন্দ ছিলো না। উনিও শখের লেখক। মাঝে মাঝেই কাগজ কলম নিয়ে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েন। বেশ খোশমেজাজের লোক। এমন একটা সঙ্গ পেলে সময়ের হিসেব থাকে না। তবে নামটা সন্দীপ কি! কী জানি, এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না। আমারও বোধহয় ভোলা-রোগ শুরু হলো। সে যাই হোক, খানিকটা ওঁর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমারও বেরিয়ে পড়া। তবে লেখার কথাটা আর মনেই থাকছে না। লিখতে বসলেই এই প্রকৃতির মাঝে কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে কে আমি, কী নাম, কী পরিচয় সব ভুলে কোন অসীমে যে মিশছি কে জানে! এভাবেই বিভোর হয়েছিলাম বহুক্ষণ। বেখেয়ালে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। জোনাকির মতো আলো জ্বলে জ্বলে উঠছে ওখানে। কারা সব বাড়ি ফিরছে দিনের শেষে, ক্লান্ত। ওরা কি কবিতা পড়ে? গান শোনে? এইসব হাবিজাবি ভাবনার ভেতর হঠাৎই সুর বেজে উঠলো। একটা নেপালি গান। এই গানটা গত কয়েকদিন ধরেই শুনছি, তাই হয়তো সুরটা মনে ধরে গেছে। রণত, আমার হোম-স্টের নেপালি দাজু। ওর গান শুনলে মন শান্ত হয়। হন্যে হয়ে এতক্ষণ যে কবিতার খোঁজে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারও ভীষণ ঘুম পায়। এ প্রশান্তি যেন অনায়াসে গিলে খেতে চায়। তখন এই নিরালায় একমাত্র সত্যি বোধহয় ওই গানটুকুই। বাকি সব বড়ো বেশি অপ্রয়োজনীয় লাগে। মনে মনে ভাবলাম, আমি যদি কোনোদিন রণতের মতো এক বিন্দুও গাইতে পারতাম আমার বোধহয় আর কবিতার দরকার পড়তো না। না, নিখিলবাবু পাহাড়ে এসে যতই লিখুক না কেন, এমন গান নিশ্চয় শোনেননি। শুনলে আর লেখা হতো না। এ সুরের ধারে নতজানু হয়ে বসতেন চিরকালের জন্য। নিখিল নাকি সন্দীপ নাকি তথাগত… কী যেন নামটা! এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না। অবশ্য এইসব অহেতুক স্মৃতির এখন দরকারও নেই।
বৃষ্টিটা ধরেছে। চায়ের দোকানটা থেকে বেরিয়ে এলাম। সেই লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে, তবে এদিকে আর দেখছে না। হয়তো বা আমি দেখলাম বলেই মুখ সরিয়ে নিলো। ভারি অদ্ভুত, বলছি তো কোনোদিন দেখিনি, চিনি না, তারপরও কী চায় জানি না।
পাহাড়ি গাড়িচালকদের নিজস্ব কিছু অলিখিত নিয়ম থাকে। এই যেমন কোনো গাড়ি নামছে, আর পাশেই আরেকটা উঠছে। তখন উঠতি গাড়িটাকে আগে জায়গা দিয়ে দেয়, তারপর নামে। আবার দুই চালকের মধ্যে সৌজন্য বিনিময়ে স্মিতহাসি। বেশ লাগে এই ব্যাপারগুলো। আজ সকালেই লোলেগাও থেকে বেরিয়ে পড়েছি। এখন গন্তব্য পেলিং। কেউ একজন বলেছিলো পাহাড়ের সৌন্দর্য পেলিং ছাড়া অসম্পূর্ণ। সেই স্বাদটুকু নিতেই বেরিয়ে পড়া।
এখন মেঘ অনেকটাই কেটে গেছে। চারিদিক আরো পরিষ্কার হচ্ছে। দু’চোখ ভরা সবুজ ঠেলে আমরা এগিয়ে চলেছি। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কপালের কাছে এসে পড়ছে অবেলার রোদ্দুর। আমি আনমনে গুনগুন করছি-
য়ো সামঝিনে মন ছা
মা বিরশু কাসারী
তিমি নাই ভানি দেও…
এই গানটা কবে থেকে যে এত ভালো লেগে গেল কে জানে! নেপালি ভাষাটা না বুঝলেও গানটা ভীষণ কাছের মনে হয়। যেন কতকালের চেনা। নিজের মতো একটা মানেও খুঁজে পাই ঠিক। আমার গুনগুন শুনেই সামনের সিটের মেয়েটা এদিকে দেখছে বারবার। কী জানি, বিব্রত করলাম বোধহয়। ওর পাশে বসা ভদ্রমহিলা আমার অভিব্যক্তি দেখে কী বুঝলো কে জানে, ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো আমার গান ওর মেয়ের ভালো লেগেছে। তাই বারবার এদিকে দেখছে। আমি আশ্বস্ত হয়ে এক মুখ হাসলাম। ব্যাগে একটা চকলেট ছিলো ওটা ওর মেয়ের হাতে দিয়ে বললাম,
-” Thank you, এটা তোমার জন্য। আমি রণত তামাং। শহুরে মানুষ হলেও পাহাড় আমার রক্তে। মাঝে মাঝেই ঘুরতে চলে আসি। শখের গায়ক বলতে পারো। আর এই গানটা আমার বড় প্রিয়। তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো। গাইবে আমার সাথে? শুরু করছি, তুমি গলা মেলাও-
য়ো সামঝিনে মন ছা…”
গান-গল্পে যাত্রাও প্রায় ফুরিয়ে এলো। সামনেই আমায় নামতে হবে। ও হ্যাঁ, মনে করে একবার হোটেলে ফোন করে নিতে হবে। আজ সকালেই পিঠব্যাগটা হারিয়েছি। কোথায় ফেলে এলাম কে জানে। টাকা পয়সা ছিলো না। তবে কিছু দরকারী কাগজপত্র ছিলো। আশা করছি চেক-ইনে খুব একটা অসুবিধা হবে না।
তথাগত…তন্ময়…সন্দীপ… রণত…উফফ! আবার ঘেঁটে যাচ্ছে!
তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩