নৈসর্গিক
সুকন্যা মিশ্র
“Sit in reverie and watch the changing color of the waves that break upon the idle seashore of the mind.”
– Henry Wadsworth Longfellow
মানবমনের সঙ্গে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সাদৃশ্য। ঋতুবৈচিত্রের ডালি নিয়ে প্রকৃতি এক বহুরূপীর ছদ্মবেশে আমাদের সম্মোহিত করে রাখে। কখনও প্রখর গ্রীষ্মে মাটি ফুটিফাটা, গাছের পলক পড়ে না হাওয়ায়। কখনও সেই শুষ্ক প্রান্তরকে আর্দ্রতায় ভিজিয়ে দেয় বানভাসি বন্যা। আবার কখনও গাছের জীর্ণ পাতা ঝরাতে উপস্থিত হয় শীত। বসন্তের পাগল করা প্রকৃতিতে কার না মন চঞ্চল হয়ে ওঠে? প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গেই মনের ভাব বদলের অদ্ভুত মিল। ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এই যে নিরন্তর ছুটে বেড়ানো, এতো শূন্য মন নিয়ে এক অজানার অনুসন্ধানে মেতে থেকে প্রতিটি ঋতুতে অবগাহনের এক প্রচেষ্টা মাত্র। কী চাই তা জানা নেই, কী পেতে পারি তাও জানা নেই। শুধুই অবিরাম ছুটে বেড়ানো। পথের শেষে কিছু একটার অপেক্ষায় থেকে যাওয়া। এই অপেক্ষাটুকুই বড় মধুর। ভ্রমণে প্রকৃতির মাঝে মানুষ খোঁজার অজুহাতে আমরা আসলে মন খুঁজি। কত জায়গার অনুপূর্ব বিবরণ হয়ত বিস্মৃতপ্রায়। তবুও চা-বাগানে কর্মরত মানসীর পিঠের সঙ্গে বেঁধে রাখা শিশুটির অদ্ভুত নিস্পলক মায়াবী দৃষ্টি কিংবা অমরনাথের প্রবল ঠাণ্ডায়, আতাউরের বানানো মাখন চা পান করে আমার সুস্থ হয়ে ওঠা অথবা হিমাচলের রেশমির প্রতিদিন ঝুড়ি ভর্তি ফুল জানালায় রেখে যাওয়া এতো আমি এখনও ভুলতে পারি না। মনের সঙ্গে তাল মেলাতেই তাই ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পথ চলা যে বিষম দায়। তবুও তাকে ধরে-বেঁধে বৈচিত্রের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি সময় পেলেই। আমার কথনে কখনও আসে প্রকৃতি, কখনও মানুষ কখনও বা দুইয়েরই মেলবন্ধনে সৃষ্ট এক কাব্যগাথা। ক্রমবর্ধমান অতিক্রান্ত পথের হিসেবের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঝুলিও ভারী হতে থাকে।
“In the silence of the woods it felt like I could hear the passage of time, of life passing by. One person leaves, another appears. A thought flits away and another takes its place.”
-Haruki Murakami
জঙ্গলের নিজস্ব এক সাম্রাজ্য আছে। বাইরের পৃথিবীর নিয়মকানুন, হইচই, কলরব সবকিছুই যেন জঙ্গলের সীমানার চৌকাঠের বাইরে রেখে প্রবেশ করতে হয়। নীরব পদক্ষেপে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ না করে, স্বাগতম জানানো শাখাপ্রশাখাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। শান্ত পরিবেশে হঠাৎ ডেকে ওঠে বেনেবউ কিংবা মিষ্টি শীষ দিয়ে ওঠে দোয়েল। মাথার ওপর দিয়ে টি-টি শব্দে উড়ে যায় টিয়ার ঝাঁক। জঙ্গলের জলাশয়ের জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকে গন্ডার। তারই পিঠে বসে হয়ত নিবিষ্ট মনে মাছ শিকার করে মাছরাঙা। প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যে মগ্ন। এমন জঙ্গলে পর্যটকদের মনে হয় নিছক অনুপ্রবেশকারী। জলদাপাড়ায় জঙ্গল সাফারিতে গিয়ে ময়ূর, হাতি, গন্ডার দেখে একটি ভাবনা মনকে বড় ব্যস্ত করে তুলেছে। আচ্ছা, যদি এমন হত আমাদের শোওয়ার ঘর কিংবা বৈঠকখানা টিকিট কেটে দর্শককে দেখানোর ব্যবস্থা হত এবং সেখানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন তাদের কাছে এক আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠত, তবে আমাদের কেমন বোধ হত? সমবেত চিৎকারে “ওই যে গন্ডার স্নান করছে”, “ওই যে হাতি ওর ছানাকে আদর করছে”, “মাহুতভাই, হাতিকে আরেকটু কাছে নিয়ে চলুন না, একটু ভালো করে গন্ডার দম্পতির প্রেম দেখি” এমনই অসংখ্য শান্তি বিঘ্নিতকারী বাক্য ধেয়ে আসে জঙ্গলের বৈঠকখানায়। প্রত্যেক জায়গার এক নিজস্ব নিয়ম আছে। সেটি পালনেই সেই স্থান মাহাত্ম্যময় হয়ে ওঠে, এ কথাটি আমাদের মত শিক্ষিত সামাজিক জীবদের মনে রাখা অত্যন্ত জরুরী। রাতের জঙ্গলের আবার আরেক রূপ। রাত্রি এখানে রাত্রির সঙ্গে জেগে থাকে। রাত জাগা পাখিদের ক্বচিৎ ডাকে, বুনো গন্ধের আবিলতায়, জোনাকীর ঝিকিমিকি আলোয় এক অপূর্ব স্বর্গীয় প্রভার সৃষ্টি হয়। সেখানে সাপের কিংবা ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের ভয় থাকে। কখনও বা পথ আটকে হাতির উপস্থিতিও অসম্ভব নয়। তবুও বিপদের মাঝেই তো আছে প্রকৃত রহস্য। নিঝুম রাত্রে যে জঙ্গলের বুনো গন্ধ মেখে রাতভোর করে দেয়নি সে কোনোদিনই এর মাদকতা অনুভব করতে পারবে না। জঙ্গল যেখানে একটু পাতলা, রাতের তারাভরা আকাশ সেখানে নিজেই এক বিস্ময়ের জগৎ নিয়ে উপস্থিত থাকে। জঙ্গল থেকে ফিরে শহুরে কার্যকলাপে ব্যস্ত হয়ে যখন রাতের ঘুম চোখে আর ধরা দেয় না, তখন মনে হয় একছুটে সেই জঙ্গলের আদিমতায় ফিরে যাই। অন্তত একটি নির্ঘুম রাত্রি তো সার্থকভাবে অতিবাহিত হবে!
“What is this life if, full of care,
We have no time to stand and stare.
No time to stand beneath the boughs
And stare as long as sheep or cows.
No time to see, when woods we pass,
Where squirrels hide their nuts in grass…”
-William Henry Davies
ডুয়ার্সের পরিবেশ প্রকৃতিতে পাহাড়, নদী, জঙ্গলের এক অপূর্ব সমাহার দেখা যায়। বেশ কিছুদিন জয়ন্তীর তীরে কাটানোর পর সেই রাত্রিটুকু ছিল ওখানে থাকার শেষদিন। পরদিন ফিরে আসা। রাত্রিটুকু আর ঘুমিয়ে নষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। হোমস্টের বারান্দায় বসে একঘেয়ে ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে ইচ্ছে হল নদীর ধারটিতে গিয়ে বসি। রাস্তা পেরিয়েই নদীর বেড়। চারিদিকে জনমানব নেই। সমগ্র জনমণ্ডলে কেউ যেন ঘুমের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। চিবুক ছোয়াঁ চাঁদের আলোয় নদীর বালি চিকচিক করছে। বাঁশির সুরে মৃদু বাতাস গাল বেয়ে যাতায়াত করছে। কী এক মায়াবী আলো যেন সমগ্র চরাচর জুড়ে। নদীর ওপারের পাহাড়গুলি যেন নিঃশব্দে আমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এ মরশুমে নদীতে জল কম। ক্ষীণ জলের ধারা যেন শ্রীরাধিকার নিঃশব্দ পদসঞ্চারে অভিসারে বেরিয়েছে। ভাবটা এমন, যেন তার নূপুরধ্বনি কোনোভাবেই কারোর কর্ণগোচর না হয়। মন হারিয়ে গিয়েছিল কোন সে এক সুদূরে। সম্বিৎ ফিরল এক রাতজাগা পেঁচার ডাকে। আকাশের দিকে চোখ পড়তে দেখি, কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীর চাঁদকে মেঘ পরম যত্নে নিজের আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে। চারপাশ অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারেরও নিজস্ব এক আলো আছে। তাকে আপন করে নিলে সে আলো অনুভব করা যায়। পশ্চিম আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের ঝলক যেন ক্ষনিকের জন্য স্বপ্নপুরীতে নিয়ে যাচ্ছিল। গাল বেয়ে একটি বৃষ্টির ফোঁটা চিবুকে পৌঁছল। পরেরটি কপাল বেয়ে নাকে। ধীরে ধীরে মনকেমনের সমস্ত শুষ্কতাকে বৃষ্টির আর্দ্রতা যেন শুষে নিল। সমস্ত চরাচর জুড়ে বৃষ্টি নামা দেখলাম। দেখলাম না, বলা ভালো শুনলাম আর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ধারণ করলাম বৃষ্টিকে। সময় বড় কৃপণ। ধরে বেঁধে রেখে দিতে চাওয়া মুহূর্তগুলিকে বড় তাড়াতাড়ি নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। শুধু মুহূর্তটুকু আজীবনের সঞ্চয় হিসেবে উপহার দিয়ে যায়।
The Color, on the cruising cloud –
The interdicted Land –
Behind the Hill – the House
behind –
There – Paradise – is found!
-Emily Dickinson
দিনের আলো নিভে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের রঙ যখন সবুজ থেকে ধূসর পেরিয়ে ধীরে ধীরে আকাশের কালো রঙের সঙ্গে মিশে যেতে চায় সেইসময় ঝর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে নিশা, আকাশে সন্ধ্যাতারা ফুটে ওঠার অপেক্ষায় থাকে। ও ভাবে, পরিবর্তনশীল জগতে সন্ধ্যাতারাই পারে ওর জীবনের লক্ষ্য স্থির রাখার অনুপ্রেরণা দিতে। একটা এলোমেলো ঘেঁটে যাওয়া জীবনকে ও বারবার গুছিয়ে বাঁধতে চায়। কিন্তু নানাভাবে মালার সুতোর বাঁধন যায় ছিঁড়ে। পুঁতিগুলি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবুও কী অদ্ভুত মনের জোর ওর, প্রত্যেকবার দাঁতে দাঁত চেপে, মুখের হাসিটি ধরে রেখে জীবনের সঙ্গে যুঝে যায়। “কোথা থেকে পাও এমন মনের জোর?” নিশাকে প্রশ্ন করলে বলে, “এই পাহাড় থেকে। এই পাহাড়গুলি হাজার হাজার বছর ধরে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-ভূমিকম্পে অবিচল রয়ে গেছে। আমি আমার এই ছোট্ট জীবনটাকে আমার মত করে গুছিয়ে উঠতে পারবো না? একদিন পারব নিশ্চয়ই।” মহারাষ্টের যে প্রান্তগুলি নিতান্ত জৌলুশহীন, শহুরে গ্ল্যামারের ছিঁটেফোঁটাও যেখানে পৌঁছয় না এমন এক পাহাড় ঘেরা অতি সাধারণ গ্রামে এক কামরার এক ঘরে মেয়ে বিমলাকে নিয়ে তার বাস। হাসিমুখের আড়ালে তার বিষণ্ন চোখদুটি অনেক নির্ঘুম রাত্রির যন্ত্রণার আভাস দেয়। শুধু শুকনো প্রশ্ন করে সে ব্যথার ভার আর বাড়াতে চাইনি। পাহাড়ী প্রজাপতির মত উচ্ছল তার ছোট্ট মেয়ে বিমলা আমায় দিনের প্রথম রোদকে মুঠোয় ধরে রাখতে শিখিয়েছিল। সেই মুঠোভরা রোদ নাকি তখন বন্ধু-রোদ হয়ে যায়। তার সরল দুই চোখে যে বিশ্বাস দেখেছিলাম তা আর ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। থাকুক না ও ওর মত কল্পনা নিয়ে। আমি কোনোকালেই খুব বেগতিকে না পড়লে সকালে উঠি না। কর্মসূত্রে যে ঘরটিতে আমার মাসদুয়েকের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেটি ছিল ওদের ঘরটির ঠিক উল্টোদিকে। ও রোজ সকালে চলে এসে ঘুম ভাঙিয়ে সেই বন্ধু-রোদকে আমার জিম্মায় রেখে যেত। যেদিন মেঘলা হত সেদিন ওর মনও মেঘলা হয়ে থাকতো। বিকেলে আমরা বাঁধের জলে রঙের খেলা দেখতে যেতাম। আকাশের রঙ পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের জল কখনও সবুজ, কখন নীল কিংবা কখনও ধূসর হয়ে যেত। বর্ষায় মেঘেদের ছানাপোনা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেখতে দেখতে বিমলা খুশীতে হাততালি দিয়ে উঠত। কিন্তু আমার যে খুঁটি একজায়গায় বেশিদিন বাঁধা থাকলে চলে না। তাই সেখানের বাস যেদিন ওঠালাম, বিমলার দিকে সেদিন আর চোখ ফিরিয়ে তাকাতে পারিনি। নিশা কঠিন চোয়ালের মাঝে তার অনুভূতিটুকু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় আড়াল করে ফেলেছিল। মায়ায় আটকা পড়লে যে আমার পথ চলায় ফাঁকি পড়বে। কারণ আমি যে মানি ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’। পৃথিবী পরিবারের বাকি সদস্যরাও যে আমার অপেক্ষায় রয়েছে। তাই পেছন না ফিরে শুধুই স্মৃতিটুকু সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলি।
“কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।”
-বুদ্ধদেব বসু
সেবারে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই রম্ভায় গিয়ে উঠলাম। কোলাহলহীন, শান্ত এক জায়গা রম্ভা। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা ভালো না থাকার কারণে জায়গাটি এখনও তার নির্মলতা বজায় রাখতে পেরেছে। রম্ভা নামটির সঙ্গে পরিচিতি কালকুটের লেখা উপন্যাস ‘নির্জন সৈকতে’ পড়ার সময় থেকে। রম্ভার মূল আকর্ষণ হল চিল্কা। চিল্কার সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল বুদ্ধদেব বসুর লেখা ‘চিল্কায় সকাল’ কবিতাটির মাধ্যমে। ভোরের মিঠে হাওয়া গায়ে জড়িয়ে বেরিয়েছি চিল্কায় সূর্যোদয় দেখতে। চারিদিকে রাত শেষের ঘুম জড়ানো পরিবেশ। জেলের দল নৌকা নিয়ে গতরাত্রির বিছিয়ে রাখা জাল গোটাতে ব্যস্ত। পাখিদের মৃদু কলরব পিনপতন নীরবতা ভঙ্গ করছে। আকাশের রং হাল্কা বেগুনী থেকে ধীরে ধীরে যেন কুসুমরাঙা এক আবেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে সূর্যোদয় হল। চিল্কার জলে পড়ল তার প্রতিবিম্ব। জল হয়ে উঠল আগুনরাঙা। তার ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে মাঝিদের দাঁড় বাওয়া নৌকা। ঠিক যেন ছোটবেলার ড্রয়িং খাতা থেকে উঠে আসা মোমরং করা একটি আঁকার পাতা। চিরন্তন এক সূর্যোদয়ের ফ্রেম। মন ক্যামেরায় তোলা ছবির সঙ্গে যখন ক্যামেরায় তোলা ছবি মেলাতে যাই, তখন মনে হয় কিছুই যেন মিলছে না। আসলে ওই মুহূর্তটির সঙ্গে রয়ে যায় শিশিরভেজা ঘাসের আঘ্রান, পাখিদের কলতান, জলজ শব্দ, মন ভালো করা এক অনুভূতি, দিন-রাত্রির এক সন্ধিক্ষণ সবকিছুই। ছবির মধ্যে এই মুহূর্ত যাপনের আস্বাদটুকু থাকে অনুপস্থিত। তাই তা কেবল নিষ্প্রাণ এক ছবি হিসেবেই থেকে যায়, অনুভবের মূহূর্তগুলি ফিরিয়ে দেয় না।
“Come to me in the silence of the night;
Come in the speaking silence of a dream;
Come with soft rounded cheeks and eyes as bright
As sunlight on a stream;
Come back in tears,
O memory, hope, love of finished years.”
-Christina Rossetti
শ্রাবণের ঘনঘোর বর্ষার দিনে মন দৌড়ায় প্রায় দু’হাজার মাইল দূরের এক পাহাড়ী উপত্যকায়। রোদেলা বলে, পাহাড়ে বর্ষা অতি ভয়ঙ্কর। আমি বলি ভয়ঙ্কর সুন্দর। যে কোনো মুহূর্তে ধ্বস নেমে রাস্তা দু’দিক থেকে বন্ধ হয়ে রসদহীন অবস্থায় এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর আগে এই যে মুহূর্তের জন্য বেঁচে থাকার আকুতি ওই তো প্রাণের মূল্য। রোদেলা জানে না, এই বর্ষা পেরিয়ে ও আমাকে আর কখনও দেখতে পাবে কিনা, কিন্তু এই দেখতে পাওয়ার আশাটুকুর আশায় ও প্রতিদিন বেঁচে থাকে। ও বলে ওর নাকি প্রতিদিনই জন্মদিন। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, “এই যে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই এতেই তো নিত্যদিন আমাদের নবজন্ম হয়।” ওর কথা ফেলতে পারি না। প্রতিদিনই তাই মেঘকে সাক্ষী করে একজন্মের ভালোবাসা খামে ভরে পাঠাই ওর কাছে । রোদেলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মানালির কাছে একটি ছোট্ট গ্রাম কোঠিতে। স্বপ্নের মত সুন্দর জায়গা কোঠি। একদিকে বরফঢাকা পাহাড় অন্যদিকে বিয়াস নদী। প্রকৃতি যেন বহু যত্নে জায়গাটিকে সাজিয়েছে মুগ্ধতার পলক পড়তে দেবে না বলে। রোদেলাদের হোমস্টেতেই থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। ওরা স্থানীয় বাসিন্দা হলেও ওর মা ছিলেন বাঙালী। সে কারণে ও বাংলা বলতে ও বুঝতে পারত। দিন দশেকের ছুটিতে মানালিতে দু’দিন থেকে কোঠিতে ঢোকার পর সে যে কী এক মায়ায় বেঁধে ফেললো আমায়, আমি আর কোথাও গেলাম না। বাকি দিনগুলো কোঠিতেই কাটিয়ে দিলাম। সকালে গরু চরাতে যাওয়া থেকে শুরু করে তাদের জন্য ঘাস কেটে আনা, বাড়ি ও বোর্ডারদের জন্য রান্না করা সবকাজ নিজে হাতেই হাসি মুখে সারতো। আমিও সারাদিন ওর সঙ্গে সঙ্গে থেকে বকবক করে চলতাম। কখনও কবিতা শোনাতাম, কখনও গল্প বলতাম। এমন আগ্রহী শ্রোতা খুব কম পেয়েছি আমি। শুধু দিনের আলো কমে এলে ও বিয়াসের ধারে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। সারাদিনের প্রাণচঞ্চল ভাবটা তখন কোথায় যেন হারিয়ে যেত। বিষণ্ন চোখে সন্ধ্যা নামা দেখত। প্রশ্ন করেও এর কোনো উত্তর পাইনি। হয়ত এই নিভৃত রহস্যটুকু ওর একেবারে নিজস্ব। এই বিলাসটুকু ও ভাগ করে নিতে চায় না কোনোভাবেই। নুড়িপাথরে ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলা বিয়াসের উচ্ছল স্রোতের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে কখনও বলে উঠত, “তোমরা বাঙালী কবিরা মানুষের মন নিয়ে খেলা কর। এক সৃষ্টি তৈরি হয়ে ওঠার জন্য তোমরা মন ভোলানো রূপকথার গল্প বলে দৃশ্যপট তৈরি কর। তারপর একদিন তোমাদের একঘেয়েমি আসে। তোমরা তখন উড়ে অন্য ডালে বসো।” আমি এর উত্তরে শুধুই হাসি। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিই না। কথা তো সাজিয়ে গুছিয়ে বলাই যায়। আবেগের মুহূর্তে বলা সেই কথা যে প্রতারণার জন্ম দেবে না এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া মুশকিল। সময় কাটুক তার নিজের ছন্দে। আশা রাখি কোনও এক শ্রাবণের ঘনঘোর বৃষ্টিতে রোদেলার সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওর প্রতিদিনের জন্মমুহূর্ত পালন করব। কারণ ‘The eyes never lie’। বৃষ্টি তো অপেক্ষমান প্রতিশ্রুতিরও জন্ম দেয়।
পথ চলতে চলতে কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। কত নয়নমনোহর দৃশ্যপট ছেড়ে ফিরতে ইচ্ছা হয় না। তবুও মায়াটাকে মনে রেখে মায়ার বন্ধন কাটাতেই হয়। প্রবহমানতাই যে জীবন। সেই বৃহত্তর জীবনের খোঁজেই তো পথ চলা। আজকের যা কিছু ভালো লাগা, সেই ভালোলাগার রেশ থাকতে থাকতেই পথ খুঁজে নিতে হয় আগামীর। এ প্রসঙ্গে জাপানী কবি মাতসুও বাশোর লেখা ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের অনুবাদে কবিতার একটি অংশ আমার পথচলার দিকনির্দেশ দেয়-
“কঠিন বাঁধনে বাঁধা ঝিনুকের ডানা
হেমন্তের ছোঁয়া পেয়ে
যেমন আপনি খুলে যায়,
আমাকেও সেইমতো যেতে হবে
পথে ফের
হে বন্ধু, বিদায়।”
তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩
সুন্দর লাগল, রেশ থেকে যাবে অনেকদিন।
সহজ সরল ঝরঝরে গদ্য। বর্ণনাভঙ্গির স্বযত্ন সহাবস্থানে লেখাটি সুপাঠ্য হয়ে উঠেছে। বিখ্যাত পংক্তিগুলির যথাযথ ব্যবহার এবং ছবি লেখাটিকে শক্তিশালী এবং মনোগ্রাহী করে তুলেছে।