টোপ

 

গল্প লিখতে ভালোবাসে এবং রোজ সকালে নিয়ম করে ডেস্কটপে বসে গল্প লিখে সেই দুপুরেই নিজের প্রাণের বন্ধু প্রবীরকে বাড়িতে ডেকে এনে গল্পটা পড়িয়ে আনন্দ পায় অপেশাদার সাহিত্যিক প্রভাত চক্কোত্তি। আজ সকালেও একটা নতুন গল্প লিখে লেখার খাতাটা টেবিলের ওপর গুছিয়ে রেখে সবে এসে বসেছে বারান্দায় পেতে রাখা নিজের আরাম কেদারায়। তখনই প্রবীর প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ওকে বলে– “তোর সঙ্গে জরুরী একটা কথা আছে প্রভাত। আমাকে ঝটপট একটা ছোটগল্প লিখে দিতে হবে তোকে। আজ বিকেলেই ক্যুরিয়ারের হাত দিয়ে গল্পটা পাঠিয়ে দেবো একটা প্রতিষ্ঠানে।” ছোটগল্প লিখতে হবে শুনে নড়েচড়ে বসে প্রভাত। সবটা শুনে প্রভাত হেসেই বলে– “গল্প কি আর যখন তখন লেখা যায় প্রবীর? এর জন্য সাধনা করতে হয়। সাধনা করে বাগদেবীকে তুষ্ট করে তাঁকে অধিষ্ঠিত করতে হয় মনের আসনে। তবেই না একটা গল্প লেখা হয়ে ফুটে উঠবে লেখার খাতায়। আমি অবশ্য ডেস্কটপেই লেখালেখি করে থাকি।” শুনে প্রবীর ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয় বন্ধুর কথা– “ধুস, তুই ইচ্ছে করলেই যখন তখন জুতসই একটা গল্প লিখে ফেলতে পারিস। আমি জানি সেই এলেম আছে তোর। আজ দুপুরের মধ্যেই আমাকে লিখে দিবি একটা ছোটগল্প, ঠিক আছে? আর হ্যাঁ, এই প্রতিযোগিতায় দুটো শর্তের কথা বলা হয়েছে। এক) লিখতে হবে সাতশোর বেশি অথচ পনেরোশো শব্দের মধ্যে একটা ছোটগল্প। দুই) প্রতিযোগিতায় একমাত্র প্রথম স্থানাধিকারীকেই দেওয়া হবে স্বর্ণপদক এবং জেলাশাসকের স্বাক্ষর করা একটা শংসাপত্র। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই প্রতিযোগিতায় তুই সহজেই জিতে নিবি ওই পুরস্কার। গল্পের বিষয় কি হবে সেটাও বলে দিয়েছে ওরা। বিষয়বস্তুটা ভারি অদ্ভুত! গল্পের বিষয় হলো…”

 

প্রভাত চক্কোত্তি খুব মন দিয়ে শুনছিল বন্ধুর কথা। দ্বিতীয় শর্তটার কথা শুনতে শুনতেই ওর চোখের সামনে আচমকা ভেসে ওঠে বিশাল একটা খাঁচা। মাসখানেক আগে দেখেছিল উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে। গাড়ি ভাড়া করে ও যখন সস্ত্রীক লাটাগুড়িতে গভীর বনের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছিল উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি শহর লাভার দিকে, তখনই বনেরই একটা নির্জন স্থানে একটা প্রাচীন গাছের মোটা ডালে খাঁচাটা ঝুলতে দেখেছিল। ভাবনায় ডুবে থাকলেও প্রবীরের বলা কথাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ধরা দিচ্ছিল ওর কানে।

 

বেড়ানোর সময় নিজের প্রিয় ডি.এস.এল.আর ক্যামেরায় হামেশাই ছবি তুলে থাকে বলে ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যাবলী দেখছিল খুব মন দিয়ে। তখনই আচমকা বিশাল খাঁচাটাকে ঝুলতে দেখেছিল একটা প্রাচীন গাছের ডালে। ইচ্ছে ছিল ঝুলন্ত খাঁচাটার ছবি তুলে রাখে। কিন্তু ছুটন্ত গাড়িতে বসে আচমকা চোখের সামনে এসে পড়া খাঁচাটার ছবি তুলতে পারেনি। ওদের নিয়ে গাড়িটা তখন বেশ জোরেই ছুটছিল গন্তব্যস্থলের দিকে। অবশ্য গাড়ির ড্রাইভার আগে থেকেই একটা ব্যাপারে ওদের সাবধান করে দিয়েছিল। বনের ওই অঞ্চলেই নাকি রাস্তার ওপর আচমকা গাড়ির সামনে এসে পড়ে দলবদ্ধ হাতি। ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় একমাত্র ঈশ্বরের কৃপায়। সেকারণে বিশাল খাঁচাটা ঝুলতে দেখেও গাড়ি থামানোর সাহস পায়নি প্রভাত। তবে এক ঝলকেই দেখে নিয়েছিল, খাঁচার ভিতরটা খাঁ খাঁ করছে। খাঁচার ছোট্ট দরজাটা খোলা রয়েছে এবং খাঁচার ভিতরে টোপ হিসেবে রাখা হয়েছে বেশ কিছু শস্যের দানা। ও আরও দেখেছিল যে, ওই বিশাল খাঁচাটার সামনেই দুটো প্রাচীন গাছে উড়ছে বসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট এবং মাঝারি ধরণের রঙ-বেরঙের বনের পাখি। একঝাঁক পাহাড়ি ময়নাও ছিল ওই পাখির ঝাঁকে। তাতেই প্রভাতের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বোকা ও ক্ষুধার্ত পাখিগুলো ওই শস্যদানার টানেই উড়ে এসেছে ওখানে। দানার লোভে দু-তিনটে পাখি ঢুকবো ঢুকবো করছিল খাঁচার ভেতর।

 

সেদিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে প্রবীরের কথার মাঝেই আনমনা প্রভাত আচমকা বলে ওঠে– “খাঁচা, বিশাল একটা খাঁচা।” শুনে প্রবীর চমকে উঠে বলে– “তুই কি জানিস এই প্রতিযোগিতায় গল্পের বিষয়বস্তু হলো ‘খাঁচা’?” প্রভাত এবারও আনমনা হয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে– “ওই স্বর্ণপদক এবং জেলাশাসকের স্বাক্ষর করা শংসাপত্র হলো খাঁচার ভিতরে রাখা টোপ। বোকা পাখিগুলো ওরই লোভে স্বেচ্ছায় এসে ঢুকবে ওই বিশাল খাঁচাটার ভেতর।”

 

এবার প্রবীর একেবারে নিঃসন্দেহ হলো যে, বরাবরের ভাবুক প্রকৃতির প্রভাত নিশ্চয়ই ভাবের ঘোরে থেকে এসব কথা বলছে। সেই ভেবেই দু’হাত দিয়ে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধুকে বাস্তবে ফিরিয়ে এনে প্রবীর শুধোয়– “তুই কি এখন ভাবের ঘোরে রয়েছিস প্রভাত? বলিসনি তো এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে সবই জানা আছে তোর?” বাস্তবে ফিরে এসে বন্ধুর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে প্রভাত শুধোয়- “প্রতিযোগিতায় গল্পের বিষয়বস্তু কি যেন বললি তখন?” অগত্যা প্রবীরকে আবার বলতে হয় আগের বলা কথাগুলো– “এই প্রতিযোগিতায় গল্পের বিষয় হলো ‘খাঁচা’। পারবি খাঁচাকে কেন্দ্র করে লিখে ফেলতে একটা জম্পেশ গল্প, যার প্রতিটি ছত্রে থাকবে টানটান উত্তেজনা কিংবা পরতে পরতে জমে উঠবে প্রেমিকের হারিয়ে যাওয়া এবং প্রেমিকার কাছে ফিরে আসার চরম দুঃখ এবং আনন্দঘন মুহূর্তগুলো? অথবা খাঁচা নিয়ে মন বিষণ্ণ করে দেওয়া একটা করুণ কাহিনীও লিখতে পারিস তুই।” প্রভাত এবারও আনমনা হয়ে জবাব দেয়– “লিখেছিলাম ছোট্ট একটা গল্প। খাঁচা নিয়েই লিখেছিলাম। ওই খাঁচায় ছিল একটা কথা বলা টিয়াপাখি। ওই টিয়াপাখি ছিল গল্পেরই সাত বছরের মেয়ে টুয়ার খুবই প্রিয়। কচি মেয়েটা সেবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল। মুখে এতটুকুও রুচি ছিল না বলে কিছুতেই খাবার খেতে চাইতো না। অথচ খাবার খাওয়াতে না পারলে ওষুধ খাওয়ানো সম্ভব নয় বলে খাবারের সঙ্গে মায়ের কাছে কম বকাঝকাও খেতে হচ্ছিল না মেয়েটাকে। অসুস্থ টুয়া বিছানায় পড়ে থেকে সর্বক্ষণ খাঁচায় বন্দী টিয়াপাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকতো। টিয়াপাখিটারও নিশ্চয়ই মন খারাপ হতো চনমনে টুয়াকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে। তাই হয়তো খাঁচার ভিতর ছটফট করতে করতে টুয়াকেই বারবার ডাকতো, ‘টুয়া-টুয়া’। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করার দরুন টুয়াকে সময় মতো ওষুধ খাওয়াতে না পারায় দিন পনেরোর মধ্যে টুয়া এতোটাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে ওর বাঁচার আশা প্রায় নেই বললেই চলে। সেদিন টুয়ার মা অনেক দুঃখে মেয়েকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিনরাত টিয়া টিয়া করছো তো? দেবো যেদিন ওই পাখিটাকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে সেদিন বুঝবে কেমন লাগে।”

 

এর আগে প্রিয় বন্ধুর লেখা এই গল্পটা পড়ার সুযোগ হয়নি প্রবীরের। তাই প্রভাত সামান্য দম নেবার জন্য বলা থামাতেই প্রবীর তাকে বলে– “তোর লেখা এই গল্পটা তো আমি পড়িনি কখনো! টুয়ার মা কি টিয়াপাখিটাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন? না কি ওসব বলেটলে মেয়েকে ভয় দেখিয়ে খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করেছিলেন?” প্রভাত চক্কোত্তি ম্লান হেসে জবাব দেয়– “মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাবার খাওয়ানোটাই ছিল ওর মায়ের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু অসম্ভব জেদি টুয়া ওই দুর্বল শরীরেই প্রতিবাদ করে বলেছিল, “ওকে উড়িয়ে দিলে আমিও কিন্তু ওর সঙ্গে উড়ে যাবো দূর আকাশে। আমার কথাটা সেদিন মিলিয়ে নিও তুমি।” শুনে মা নরম গলায় ওকে বলেছিলেন, “আমি কি আর সাধ করে পাখিটাকে উড়িয়ে দেবার কথা বলছি সোনা? তুমি যদি খাবার না খাও তাহলে তোমাকে যে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। খালি পেটে কি কড়া কড়া ওষুধ খাওয়া যায় বলো? তাই বলছি কি সোনা মা, লক্ষ্মী মেয়ের মতো খাবারটুকু খেয়ে নাও তুমি। খাওয়ার পর ওষুধ খাইয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলবো তোমাকে। সুস্থ হয়ে উঠে যত খুশি টিয়াপাখিটার সঙ্গে গপ্পো করো তুমি, কেউ বাধা দেবে না তোমাকে।” এত করে বুঝিয়েও জেদি মেয়েকে কিছুতেই খাবার খাওয়াতে না পেরে এক সকালে মা রেগে গিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন। খাঁচার দরজা খুলে দিতে টিয়াপাখিটা টুয়ার কাছে উড়ে এসে ওর মাথার কাছে বসে বার কয়েক ‘টুয়া-টুয়া’ বলে ডাকাডাকি করে আচমকা সবুজ ডানা দুটো মেলে দিয়ে উড়ে গেল দূর আকাশে। সেই বিকেলে মেয়েকে জোর করে গরম দুধ খাওয়াতে এসে মা দেখেন, মেয়ের নরম গরম শরীর ঠাণ্ডা কাঠ হয়ে গেছে! সেই দেখেই বুকফাটা হাহাকারে ভেঙে পড়েছিলেন টুয়ার মা, “ওরে, টুয়া রে-এ-এ-এ!” ডাক্তার এসে দেখেশুনে জানিয়ে দিলেন টুয়া নাকি শেষ দুপুরেই মারা গেছে।”

 

একটু থেমে দম নিয়ে বিষণ্ণ গলায় প্রভাত বলে– “টুয়ার মা পরদিনই খাঁচাটাকে উঠোনের এক ধারে ফেলে দিয়েছেন। সেই থেকে পাখিশূন্য খাঁচাটা যেন নীরবে তাকিয়ে থাকে টুয়াহীন ঘরটার দিকে। আমার গল্পটাও এখানেই শেষ হয়েছে প্রবীর। গল্পটা ছেপেছে একটা ছোট্ট পত্রিকার পুজো সংখ্যায়। আজ ওই বইটা নিয়ে গিয়ে একবার পড়ে দেখিস তুই। গল্পের নাম দিয়েছি, ‘শূন্য খাঁচাটা’।”

 

প্রভাত চক্কোত্তির লেখা গল্পটা শুনতে শুনতে প্রবীরের মন খারাপ হয়ে গেল। তাই মৃদু গলায় বলে– “আজ বিকেলের মধ্যে এমনই একটা গল্প লিখে দিবি আমাকে? আগামীকাল সকালের ডাকেই না হয় পাঠিয়ে দেবো প্রতিযোগিতার জন্য।” প্রভাত আচমকা গম্ভীর হয়ে গিয়ে থমথমে গলায় বলে– “নাহ্‌! এই প্রতিযোগিতার জন্য লিখবো না কোনো গল্প।”

 

শুনে প্রবীর বেশ অবাকই হয়- “কেন লিখবি না? আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, এই গল্প প্রতিযোগিতা তুই জিতবি। খামোখা স্বর্ণপদক ও শংসাপত্র হাতছাড়া করতে যাবি কেন?”

 

প্রভাত চক্কোত্তি জবাবে বলে– “টোপ প্রবীর, টোপ। ও দুটো আসলে লোভনীয় টোপ। খাঁচার দরজা খুলে রেখেছে। যতগুলো পাখি খাঁচার ভিতরে ঢুকবে ততগুলোই যে দানাপানি পাবে তা যে নয় সে কথা ওরা আগেই ঘোষণা করে দিয়েছে। যে পাখিটা ইতিমধ্যেই ওদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ওরা তাকেই… বাকিগুলো বেচারা বোকার দল জানতেও পারবে না। পাখিরাও বোকা বনতে বনতে একদিন সাবধান হয়ে যাবে। এরপর পোড় খাওয়া পাখিরা কখনোই কোনো খাঁচার ভিতরে আর ঢুকতে যাবে না টোপের লোভে। হাহাহা…”

তারিখঃ এপ্রিল ২৫, ২০২৪

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse