মরণের পরে
দেবব্রত সরকার
– “ছোঁবেন না। এইভাবে কেউ বডি ছোঁয়। মাকে তো মেরেছেন। এবার নিজেও মরবেন নাকি? কার না কার থেকে পারমিশন নিয়ে আসবেন আর আমাদের যত জ্বালা বডি দেখাও, মুখাগ্নি করাও, অস্থি দাও। এসব এখন হয় নাকি! ভিড় বাড়াবেন না গেটের বাইরে যান আমাদের কাজ করতে দিন”। – খুব বিশ্রী ভাবে তীব্র আওয়াজে খেঁকিয়ে উঠল লোকটা।
সামনেই কংক্রিটের চাতালে শোয়ানো নীল রঙের প্লাস্টিকে মোড়া মাধবীর দেহ। পা দুটো লাল প্লাস্টিকের দড়িতে টাইট করে বাঁধা। সাথে বাঁধা সুতোতে একটি কাগজ ঝুলছে। জলে ভিজে চপচপ করছে কি লেখা আছে বোঝা যাচ্ছে না। প্লাস্টিকের প্যাকেটের বাইরেটা দেখে বোঝার উপায় নেই ঠিক কত ঘণ্টা আগে প্যাকেট বন্দী করা হয়েছে মাধবীকে। দেহ মর্গে রাখা ছিল বোধহয়; সেখান থেকেই সোজা শ্মশানে। মুখের কাছে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ছোট আবরণ। বাইরে থেকে প্রিয় জনের মুখ শেষ বারের মতো দেখার শেষ উপায়। ভ্যাপসা গরমে প্লাস্টিকের ভিতরে মৃতদেহের শরীরের ঘাম জলে ঝাপসা হয়ে আছে মুখের কাছের স্বচ্ছ জায়গাটার ভিতরটায়। বাইরে থেকে কোনও ভাবেই মুখ দেখবার উপায় নেই। ঋক ঝুঁকে হাত দিয়ে ঘষে শেষ বারের মতো মায়ের মুখটা একবার দেখতে চেয়েছিল। আর তাতেই এত কথা শুনিয়ে দিল লোকটা।
সন্ধ্যে বেলা টিভির পর্দায় প্রধানমন্ত্রীর একটা ছোট্ট ঘোষণা। রাত থেকেই বদলে গেল সারা দেশের আইন। সেই ঘোষণাকে মান্যতা দিতে দিকে দিকে পাল্লা দিয়ে পুলিশ তো নয় যেন সরকারের পোষা ঠ্যাঙারে বাহিনীর প্রবল পরাক্রম। মনে হচ্ছে একদল ক্ষ্যাপা ষাঁড় কেউ রাস্তায় ছেড়ে রেখেছে পুরো দেশটাকে গৃহবন্দী করতে।
কার কি পরিস্থিতি! কেউ মরে আছে কি বেঁচে আছে দেখার কোনও দায়িত্বই যেন আজ রাষ্ট্রের নেই। প্রতিটি মানুষের মনে চেপে বসেছে একটা অজানা ভয়। প্রথম দফায় দেশ জুড়ে একুশ দিনের লক ডাউন। সৌজন্য করোনা নামক অতিমারি।
মাধবীর হার্টের সমস্যা। বিক্রম মারা যাওয়ার পর থেকেই। ডাক্তার নিদান দিয়েছিল বাইপাসের। ভর্তি করাতেই হল। শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। বড় ছেলে, মেয়ে কেউই আসতে পারেনি। দিন দিন করোনার থেকে আতঙ্ক বাড়ছে। মাধবীই বলেছিল আসার দরকার নেই।
দিন কয়েক আগে অপারেশনটা ভালোভাবেই হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছিল দিন দুয়েকের মধ্যে ছুটি হয়ে যাবে।
সব তছনছ করে দিল লকডাউন।
পুলিশ এসে মুহূর্তেই সিল করে দিল পুরো হাসপাতাল। স্বাস্থ্য দপ্তরের গাড়ি এসে একঘণ্টায় খালি করে দিল হাসপাতালটা। এখানকার রোগীদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হল তার খবর এই হাসপাতালের কাছেও নেই। হাসপাতালের কোনও ডাক্তারের নাকি করোনা ধরা পড়েছিল।
লকডাউনের দিন থেকেই পাগলের মতো মাকে খুঁজছে ঋক। আজ আটদিন। মায়ের ফোনও সুইচড অফ। যে সন্ধ্যায় লকডাউন ঘোষণা হল সেইদিন বিকেলে শেষ বারের মতো হাসপাতালে মাকে দেখেছিল ঋক। চলে আসার সময় মাধবী বলেছিল – “কাল একটু তাড়াতাড়ি আসিস, সাথে একটা চার্জার নিয়ে আসিস। আমারটা কাজ করছে না। এখনও যা চার্জ আছে আজ রাতটা চলে যাবে”।
এখন হাসপাতালের কাছে গেলেও কেউ ভিতরে ঢুকতে দেয়না। বাইরে পুলিশ পাহারা। ফোন করলে জবাব পাওয়া যায়না। ফোন তুললেও সেই একই উত্তর – “এখানে সব বন্ধ আপনারা স্বাস্থ্য দপ্তরে যোগাযোগ করুন। বার বার ফোন করে বিরক্ত করছেন কেন?
কিন্তু কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে? কোন নম্বরে? এমন অনেক প্রশ্ন ফোনের অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছায় না। তার আগেই কেটে যায় লাইনটা।
বাবা মারা যাওয়ার পর মাই ঋকের একমাত্র সম্বল। দাদা এখন বিদেশে। দিদিরও বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বরোদায়। বাড়িতে মানুষ বলতে দুই জন। মাধবী আর ঋক।
আজ সকালে ঘুমের ঘোরে গ্যাঁক গ্যাঁক করে বেজে উঠেছিল ফোন। ঠিক করে হ্যালো বলার আগেই। ওপার থেকে মোবাইলে ভেসে এসেছিল আওয়াজ – “মাধবী দত্ত আপনার কে হন?”।
মায়ের খবর পাওয়া যেতে পারে এই ভেবে নিজের মনে মনেই মুহূর্তের জন্য আনন্দে শিউরে উঠেছিল ঋক, – “আমার মা? মা এখন কোথায়? আপনারা আমার মায়ের খবর জানেন?
– ওনার করোনা হয়েছিল আজ ভোরে মারা গেছেন।
মুহূর্তে শূন্য হয়ে গিয়েছিল চারপাশটা। ফোনের ওপারের কোনও কথাই কানে যাচ্ছিল না ঋকের। সে ভাবতেই পারছিল না মা নেই। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল – “বোধহয় কিছু ভুল হচ্ছে, ওনার বাইপাস হয়েছিল”।
ফোনের ওপারে যিনি ছিলেন তিনি ঋকের কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করলেন না। নিজেই বলে গেলেন – “করোনায় মৃতের ডেড বডি এখন বাড়ির লোকদের দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের দায়িত্বে শ্মশানেই পুড়িয়ে দেওয়া হবে। কোন শ্মশান জেনে যাবেন”।
তারপর সারাদিন কিভাবে কেটেছে একমাত্র ঋকই জানে। চারিদিকে সব কিছু বন্ধ। দাদা বা দিদি কারো আসার উপায় নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।
মা করোনায় মারা গিয়েছে সংবাদ শোনার পর ঋক নিজের চোখে দেখল সকাল থেকে কিভাবে বদলে গেল চারপাশের চেনা পৃথিবীটা। পাশের ফ্ল্যাটের তয়ন দের সাথে মায়ের খুব ভাব ছিল। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তয়নের বাবা এমন ভাবে তাকালেন মনে হল যেন তার করোনা হয়েছে এখুনি মারা যাবেন।
মাধবী দত্ত করোনাতে মারা গেছে খবরটা সময় নিল না সারা হাউজিং হতে। সোসাইটি থেকে দলবেঁধে এসে জানিয়ে গেল ডেড বডি নিয়ে যেন এখানে না আসা হয় – “আপনার মায়ের করোনা হয়েছে জানান নি? বুঝতেই পারছেন। আমাদেরকে সকলকে নিয়ে থাকতে হয়। এখানকার মেম্বাররা কেউ সেটা পছন্দ করছেন না”।
কে কে পছন্দ করছেন না সেটার কোনও উত্তর নেই।
ঋক দের ফ্ল্যাটের বাইরে ছোট্ট জটলা অধিকাংশেরই মুখে মাস্ক নেই। তার ভিতর থেকেই আওয়াজ ভেসে এলো – “দেখুন এরও করোনা হয়েছে কিনা? ঘর থেকে বেরতে দেবেন না। পুলিশে খবর দিন। নাহলে সবাই করোনায় মারা যাবে”।
ঋককে প্রায় হাতে পায়ে ধরতে বাকি রাখতে হল –“আপনারা সবই জানেন গত আটদিন ধরে আমার মা কোথায় সেটাই জানিনা”।
– আপনি জানতেন। আমাদের মিথ্যে বলেছেন। প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে মায়ের সাথেই দেখা করতে যেতেন?
– বাঃ, মাকে খুঁজতে যাব না?
আবার আওয়াজ ভেসে এলো – “সেদিন মোড়ের মাথায় দেখলাম মালটাকে পুলিশ লাঠি দিয়ে মারছে; বেশ করেছে”।
একটা হোমরা চোমড়া গোছের লোক বোধহয় সেক্রেটারি হবে জানাল – “দেখুন যা হওয়ার হয়ে গেছে আপনি আর বাইরে বেরবেন না। নিজে বাঁচলে বাবার নাম।
আবার আওয়াজ ভেসে এলো – “ঘরের সামনে একটা সিকিউরিটি বসিয়ে দিন যাতে মালটা না বেরতে পারে”।
– ঠিক ভাবে কথা বলুন। আমার মা মারা গেছে আমি দেখতেও যাব না?
এবার শাসানি – “মরতে যাচ্ছেন যান। এবার বেরলে কিন্তু এখানে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না”।
কথায় কথা বাড়ত। এইসময়ে এইসব কথা কানে নেওয়ার সময় বা ধৈর্য কোনটাই এখন ঋকের নেই।
তাকে যেতেই হবে। মায়ের কাজ বলে কথা। যা হবে ফিরে দেখা যাবে। ঘন ঘন ফোন কল আসছে। বোধহয় সকলেই জেনে গেছে মা নেই। প্রায় সবকটাই আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের ফোন। সকলেরই একই জিজ্ঞাসা কিভাবে খবর পেলি? এখন কি করবি? যাই করিস সাবধানে করিস ঋক। ওখানে কিন্তু তোর দেখার কেউ নেই।
দাদার সাথে অনেক বার ফোনে কথা হল দাদাই জানালো – “তুই সোজা কালেক্টর অফিসে গিয়ে ডি এমের সাথে দেখা কর। যদি কিছু ব্যবস্থা হয়”।
তাতেই অনেক কাজ হল। অনেক দৌড় ঝাঁপটার পর ডি এম অফিস থেকে পারমিশন করে নেওয়া গেছে মায়ের শেষকৃত্যে একমাত্র সেই শ্মশানে উপস্থিত থাকতে পারবে। কমপ্লিট পিপিই পরে যেতে হবে। আরও অনেক কিছু নিয়ম লিখে দিয়েছে সেখানে।
শ্মশানে পৌঁছে আরেক কাণ্ড। প্রথমে গেট দিয়ে ঢুকতেই দিচ্ছিল না পুলিশে। ডি এমের চিঠি দেখিয়ে তবে কাজ হল। ভিতের মাস্ক পরে কয়েকজন মেশিনের মতো কাজ করে চলেছে। জিজ্ঞাসা করতে একটা পিপিই লোক লিস্ট দেখে জানালো – মাধবী দত্ত। ৬৩২। এখন এসে পৌঁছায়নি”।
ঋক জানতে চাইল – “কখন পৌঁছাবে”?
– “এখন ৪৭৮ নম্বর চুল্লিতে উঠেছে। একটা চুল্লি আবার খারাপ। চারটে জ্বলছে। দিন তিনেকের আগে নম্বর আসবে বলে মনে হয়না”।
চমকে উঠল ঋক। তাহলে টিভির খবরে করোনার মৃতের সংখ্যা নেই বললেই চলে! সেটা কি?
আবার ডি এম অফিসে অনুরোধ করতে হল। কেন জানি তারা সদয় হলেন। সেখান থেকে ফোন আসতে নড়েচড়ে বসল সব। না হলে কি যে হতো আজ?
বিকেলে যে লোকটা মায়ের মৃতদেহ ছোঁয়ার জন্য ঋকের ওপর খেঁকিয়ে উঠেছিল সেই এখন স্যার স্যার করে কথা বলছে; জানালো – “কাকিমাকে দাহ করা হয়ে গেছে”।
ঋক শ্মশানের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সারা শরীর পি পি ই তে ঢাকা। মুখে মাস্ক। শুধু চোখ টুকু দেখা যাচ্ছে। সকাল থেকে একফোঁটা জল পর্যন্ত পেটে যায়নি। এতো ফোন আসছে সব ফোনের উত্তর দিতেও ইচ্ছে করছে না। একটা সিগারেট খেলে ভালো হতো। উপায় নেই। লড়তে গেলে এখন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
মাধবীর দেহ এক মুহূর্তের জন্য প্লাস্টিকের বাইরে থেকে দেখার পর ঋকের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। মুখাগ্নি পর্যন্ত করতে পারেনি সে। এখন নিয়ম নেই। লোকটার সাথে বিন্দু মাত্র কথা বলার ইচ্ছে নেই ঋকের, তবুও জিজ্ঞেস করল – “আপনারা অস্থি দেবেন না”?
– “স্যার নিয়ম নেই”। তারপর চাপা গলায় জানালো – “আপনার হেব্বি লিঙ্ক। আপনি সাহস দিলে পেয়ে যাবেন”।
অন্ধকারে পিপিই-র বাইরে চক চক করে উঠল লোকটার চোখটা। ঋক এই চোখের ভাষা চেনে জিজ্ঞাসা করল – “কত”?
– “স্যার রেট তো অনেক। অনেককে ভাগ দিতে হচ্ছে। আপনি একটু বুঝে সুজে দেবেন। যা রোগ হল আমরাও কয়দিন বাঁচব কে জানে। বাড়িতে আমি ছাড়া ইনকামের কেউ নেই। বুঝতেই পারছেন। কাকিমার ভাগ্য খুব ভাল আপনার মত ছেলে পেয়েছেন বলে দিনের দিন কাজ শেষ হল। এখন কেউ কেউ পাঁচ ছয় দিনেও চুল্লির লাইন পাচ্ছে না”।
লোকটার সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগছে ঋকের। আবার ফোন বাজছে। অস্থির কৌটোটা হাতে নিয়ে পকেট থেকে একটা গোলাপি রঙের নোট বের করে লোকটার হাতে গুঁজে দিল ঋক।
জীবিত অবস্থায় যার সাথে শেষ কথা বলা হল না। নিয়মের ফেরে যার মুখটাও শেষ দেখা গেল না। শ্মশানে পৌঁছেও যার মুখাগ্নি করা গেলনা। শুধু সান্ত্বনা বলতে কৌটো ভর্তি একমুঠো ছাই! এরই নাম কি নিয়মের ফের! এরই নাম কি অতিমারি! এরই নাম কি লকডাউন!
ঋকের মাথা কাজ করছে না। আনমনা হয়ে পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে ঋক। রাত্রে কোথায় ফিরবে তাও জানা নেই। পকেটে মোবাইল বাজছে অনেকক্ষণ। হয়তো দাদা বা দিদি ফোন করেছে মায়ের শেষ খবর টুকু জানতে। সামনে এখন অনেক কাজ। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন ঋকের। সারাদিন নিজেকে অনেক সামলে রেখেছিল সে এখন চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে।
বার বার ফোনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিপিই ভেতর থেকে ফোনটা অনেক কষ্টে বের করে হাতে নিয়েই চমকে উঠল ঋক, ওপার থেকে ভেসে এলো প্রায় কান্নার আওয়াজ – “ঋক, ফোন ধরছিস না কেন। আজ আমার হসপিটাল থেকে ছুটি হয়ে গেছে নিতে আসবি নে”?
সমাপ্ত
তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২০