আমার সুনয়না
সুধাংশু চক্রবর্তী
– করে এলুম অঙ্গীকার । হি হি হি । সুনয়না হাসতে হাসতে বলে ।
– কিসের অঙ্গীকার করে এলে ? শুনে চমকে উঠলাম ।
– চক্ষুদান করবো । আমার এই চোখ দুটো যাতে কারও চোখে আলো ফিরিয়ে দেয় আজ সেই ব্যবস্থাই করে এলাম ।
– কবে নেবে বলেছে কিছু ?
– মানে ? সুনয়না অবাক হয়ে শুধোয় ।
– আমি জানতে চাইছি, কবে চক্ষুদান মহাযজ্ঞে নিয়ে যেতে হবে তোমাকে ?
– তুমি নিয়ে যাবে কেন ? ওরাই সময়মতো এসে নিয়ে যাবে বললো ।
– দিনক্ষণ জানা থাকলে একটু শান্তি পেতাম গো ।
– আমি দান করবো চক্ষু, আর তুমি পাবে শান্তি ! কি বলতে চাইছো, একটু খুলে বলবে আমাকে ?
– নাহ্ মানে, আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হলো । অথচ আজও ভেবে মরি কার দিকে তাকিয়ে কথা বলছো তুমি । আমার দিকে ? নাকি… সেদিন দেখলে না ? অবশ্য হলফ করে বলতে পারবো না সত্যিই দেখেছো কিনা, শুধু অনুমান করছি, তোমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার জন্য যতবারই নিজের পজিশন বদলেছি, ততবারই মনে হচ্ছিলো আরও একটু সরে দাঁড়ালে হয়তো তোমার চোখে চোখ রেখে… সরতে সরতে এতোটাই সরে গেছিলাম যে, খেয়ালই করিনি কখন চলে গেছি বারান্দার কিনারায় । তারপর নিচে গড়িয়ে যেতে যেতে শুনেছিলাম তুমি শুধোলে, চলে গেলে নাকি ?
– ভেরি ইন্টারেস্টিং । তারপর কি হলো ?
– তারপর ? কপাল ফুলিয়ে, ওপরের পাটির দুটো দাঁত নড়িয়ে, পা ঘষটে ঘষটে বারান্দায় উঠে এসে দেখি, তোমার চোখদুটো তখনো দু’দিকে পা ছড়িয়ে বসে যেন আমাকেই খুঁজে চলেছে !
– কে বলেছে আমি অতটাই ট্যারা ? মা-বাবা বলেননি তোমাদের, আমি লক্ষ্মীট্যারা ? আমাদের পাকা দেখার সময় বাবা তো সেই কথাই বলেছেন তোমাদের ?
– না বলে উপায় কি ? দোকানী কি নিজের মাল গছানোর জন্য সত্যি কথা খদ্দেরকে বলে ?
– আহা, খদ্দের যদি যাচাই না করেই সেই বস্তু নিয়ে গিয়ে ঘরে তোলে, তাতে দোকানীর দোষ কোথায় ?
– তখন কি জানতাম, সেদিন অনেক কসরত করে চোখের মণিদুটোকে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছিলে ? যখন জানতে পারলাম, তখন যে পিছিয়ে যাবার কোনো উপায়ই ছিলো না আমার ।
– কখন জেনেছিলে তুমি ?
– শুভদৃষ্টির সময় ।
**
মাস খানে আগেকার কথা । সন্ধ্যের সময় । মন ছিলো টিভির পরদায় । সহসা সুনয়না এসে ঢুকলো বসার ঘরে । এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, হ্যাঁ গো, আমার ডান চোখ লাফাচ্ছে কেন ! কোনো অঘটন ঘটবে না তো ?
– অঘটন তো ঘটেই গেছে সুনয়না ।
– কীরকম ?
– এই যে তুমি ভয়ে কাঁপছো । এটাই কি অঘটন নয় ?
– এমন করে বলছো কেন ? আমি কি ভয় পাই না ? তোমাকেই খুব ভয় পাই । নইলে পকেট কাটার সুযোগ থাকলেও, হাত সুড়সুড় করলেও, তোমার পকেটে হাত দিতে সাহস পাই না কেন ?
– ভয় পাও ? আমাকে ? পকেট কাটো না ? তাই বুঝি বছর খানেক আগের এক রাত্রে, টাকায় ভরা কালো লেডিজ ব্যাগটা, বের করে এনে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে লুকোনো জায়গা থেকে ।
– মরণ ! সেকি তোমার ভয়ে ?
– এই যে বললে, আমাকে ভয় পাও !
– অমন কথা না বললে তোমার কি মান থাকতো ? কথাতেই আছে, প্রত্যেক স্ত্রীরই কর্তব্য নিজেদের স্বামীকে ভয় পাওয়া ।
– আচ্ছা ! সেদিন আমার ভয়েই কি, লুকোনো টাকাগুলো বের করে…
– না গো, তোমাকে ভয় পাই না, যত ভয় আমার সরকারকে নিয়ে । সরকার যদি নোটবন্দী ঘোষণা না করতো, তাহলে ওই টাকা কি চোখে দেখতে পেতে ? মোটেই না । খামোখা টাকাগুলো বাতিল হয়ে যাবে, সেই ভয়েই না তুলে দিয়েছিলাম তোমার হাতে ।
– বুঝেছি । এবার সত্যি কথাটা বলো দেখি আমাকে। ঠিক কাকে কাকে ভয় পাও বা ভয় পেতে তুমি ?
– মেয়েবেলায় বাবাকে, বিয়ের পর শাশুড়িকে । এখন আমার ছেলেকে ।
– ছেলেকে কেন ?
– ও যে আমারই স্বভাব পেয়েছে । যাকে বলে চোরের ওপর বাটপাড়ি । ছেলেটা যে সেই পথেই এগোচ্ছে ।
– মানে ?
– ছেলে যে সুযোগ পেলেই, আমার লাল, নীল, সাদা, কালো… সব ব্যাগই হাতড়ে মরে । ওর ভয়েই তো, হাত সাফাইয়ের টাকাগুলোকে, বিড়ালছানার মতো করে, দিনরাত এখানে সেখানে করে মরছি ।
– বলো কি ! ছেলেও তোমার পথে ! এবার যে আমারই ভয় পাবার পালা ! কাকে ছেড়ে কাকে ধরি, আমি যে সেই দশায় পড়েছি ।
– তুমিও কি ছেলেকে ভয় পাও ?
– শুধু ছেলে ? তার মাকে নয় কেন ? আজ থেকে ভয়ের ঘরে তালা দিলুম ।
– কিরকম শুনি ?
– মানিব্যাগে আর একটাও টাকা রাখবো না । আজ থেকে শুধু এ টি এম কার্ড । যদিও তাতে কিছু ভয় থেকেই যায় । সব টাকা একসাথে লোপাট হবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে । তবু ভালো, তিলে তিলে ভয়ে মরার চেয়ে, একবারে খতম হয়ে যাওয়াই ভালো ।
**
আজও সন্ধ্যের পর টিভি খুলে বসেছি । সহসা সুনয়না এসে ঢুকলো বসার ঘরে, এই শুনছো ?
টিভির পরদায় চোখে রেখে জবাব দিলাম, শুনছি । বলো ।
– বলছি কি… শুনছো তো আমার কথা ?
– আহা বলোই না, শুনছি ।
– শুনছো না ছাই । ওই তো তাকিয়ে আছো টিভির দিকে । শুনবে কি করে ?
– টিভি দেখতে দেখতে শোনা যায় না নাকি ?
– নাহ্, যায় না । আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন ?
– তাকাতে ভয় পাচ্ছি ।
– তাকাতে ভয় পাচ্ছো ! কেন ?
– ভাবতেও পারিনি, বিয়ের পর মেকআপ করে করে আরও সুন্দরী হবার চেষ্টায়, তোমার ওই শ্রীমুখের হাল এমন হবে । একে তো চোখের মণি দুটো দুদিকে পা ছড়িয়ে রয়েছে । তার ওপর মেকআপের গুণে…
– তারমানে !
– খুবই সোজা । মেকআপের গুণে আরও সুন্দরী হতে গিয়ে মুখটা কখন কয়লার মতো কালো হয়ে গেছে, তুমি নিজেও টের পাওনি ।
– আমার মুখ কয়লা হয়ে গেছে !
– হলে তো ভালোই হতো । দিন দিন রান্নার গ্যাসের যা দাম বাড়ছে…
– থামলে কেন ? বলো ?
– বলার কথা তো তোমার সুনয়না । তখন থেকে ‘শুনছো শুনছো’ করছো, অথচ বলছো না কিছুই ।
– আমি আজই বাপের বাড়ি চলে যাবো । আর থাকবো না তোমার সংসারে । সুনয়না রেগে গিয়ে বলে বসে।
– ওহো, এই কথা বলার জন্য এতো ধানাইপানাই করছিলে ? যাও তাহলে । ভাইয়ের সংসারে কলকে পাবে তো ?
– কে বলেছে কলকে পাবো না ? মা গতকালই ফোন করে বলেছেন, বাঁদরটাকে ছেড়ে চলে আয় আমাদের কাছে ।
– সেকি ? আজকাল বাঁদরের সঙ্গেও থাকতে শুরু করেছো ? অবশ্য তেমন হলে মোটেই আশ্চর্য হবো না । বাঁদর, হনুমান – এদের সঙ্গেই যে তোমার চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছি । শাশুড়িমা’র বুদ্ধির তারিফ না করে থাকতে পারছি না গো । একেবারে নির্ভুল অনুমান করেছেন তিনি । দিনরাত রূপচর্চার গুণে তোমাকে এখন ঠিক যেন একটা মুখপোড়া ইয়ের মতো দেখতে লাগছে ।
– ইয়ের মত মানে ? কার মতো ?
– দুটো অপশন দিচ্ছি । বাঁদর এবং হনুমান । নিজেই বুঝে নাও ।
– হনুমান !
– গিয়ে আয়নায় দেখে একবার মিলিয়ে নিও ।
সুনয়না রেগে গিয়ে গলা সপ্তমে তুলে বললো, কি বললে ? আমি হনুমানের মত দেখতে হয়ে গেছি ?
গম্ভীর গলায় জবাব দিলাম, উঁহু, শুধু হনুমান নয়, একেবারে মুখপোড়া হনুমান ।
তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২০