তারে কুড়াই ধনেশ আকাশে

একটি যাদুঘর কিংবা দোকানে দাঁড়িয়ে আছি ভাবতে নিলেই বৃদ্ধের লাঠির মতোন ঠুকঠুক করে একটা বেমানান খটকা। ভাঙচুর, নিয়তি, ক্রমাগত ইতিহাস রহস্য নিয়ে ও যেন সমুদ্রের অতলে, যেমন পড়ে থাকে ভাঙা জাহাজ। দরজার ডান পাশে চালকুমড়োর মাপে ঝুলছে সাইন- নিতে চাহিয়া লজ্জা দেবেন না। তবু সবার লজ্জা দিতে ইচ্ছে হয়। সাংবাদিকদের দেয়া সাক্ষাৎকারে তাই বলছিল দর্শনার্থীরা। কারণ আপনি হয়তো এমন কিছুর মুখোমুখি হবেন, যা যে কোন কিছুর মূল্যে নিতে চাইবেন।

আগলে রাখছে এমন কোন সতর্ক মানুষ চোখে পড়ে না ভেতরে। ‘ফুরিয়ে যাব’ ভাবনা দিয়ে ঝুলে আছে কুয়াশা ছড়ানো অসুস্থ আলো। আলো আপনাকে দেখতে সাহায্য করে আর অন্ধকার আপনাকে বুঝতে। অন্ধকারে একেক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিজস্বতা পায়। এই যেমন ছোটবেলায় পাশের হোটেলের আলোতে আমাদের বেঁটে জানালায় বাতাস-ডাল-পাতারা যে আবছায়া তৈরি করতো আমি পুতুল নাচ ভেবে মুগ্ধ ‌হতাম। আমার ছোট বোন পেত ভীষণ ‌ভয়। ওর ধারণা ছিল সন্ধ্যে নামলে ওখানে একটা গরিলা দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতি রাতে পর্দার উপর আরো পাঁচটা ওড়না দিয়ে জানালার ভয়কে ঢেকে না দিলে ঘুম হতো না ওর। আর, আমাদের বাড়িতে কাজ করতো বিনু, বিশ্বাস করতো ছায়াটা শিব, শিবের গলায় সাপ নড়ে।

ভেতরের দেয়ালেও এখানে ওখানে দিক- নির্দেশ ঝুলিয়ে রাখা। যেন ধরে নিয়েছে আগন্তুকরা পড়তে জানবে। নাহ, শোনার ব্যবস্থাও আছে। চাপ দিতেই যে কণ্ঠ  আসে, ছেলে না মেয়ে ঠিক আলাদা করা যায় না। মনে হবে একটা বেহালা কথা বলছে। সুর আছে, স্বর আছে, যন্ত্র আছে। খানিকটা এগোতেই একটা সমুদ্র রঙের বাকসো। উপরে চিলের ডানায় লেখা- নিঃশ্বাস রাখুন। বাকসের ফোকরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস অথবা দীর্ঘশ্বাস রেখে মনে হয় ছুটে এসেছে মুর্হুমুর্হু সমুদ্র। একবার নক্ষত্র হয়ে ভেসে, ডুবে যাই আরেকবার। বুকে জলহাওয়া যায় আসে- আছি, নেই, আছি, নেই… নিঃশ্বাসেরা যেন অবিকল ঢেউ। শরীরে মিহি সমুদ্র কিংবা অবিরত সাঁতার আজকের মতো উপলব্ধি  করিনি আগে কোনদিন। অথচ সেই কবে ক্লাসঘরে জেনেছি মানুষের শরীরে ৬০ শতাংশই জল, ফুসফুসে ৮৩ শতাংশ জল নিয়ে আমরা বাঁচি। দাদু বলতেন- ‘ঈশ্বর সমুদ্রের আদলে মানুষ গড়েছেন, অহোরাত্র সমুদ্র দেখি, সমুদ্র না দেখার আফসোস থাকতে নেই।’

আরেকটু হেঁটে নিলে চোখে পড়ে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা- হারানো বয়াম। তবে বয়াম নয়, ফ্রেমে বাঁধানো সংরক্ষণ করা মৃত প্রজাপতি। আমার ভাবনায় তখন শীতের মৌসুমে তিন হাজার মাইল পেরিয়ে কানাডা থেকে মেক্সিকোতে পাড়ি জমানো হাজার হাজার উড়ন্ত প্রজাপতি। তাই নিশ্চুপ প্রজাপতির পেছনে নিষ্ঠুর হত্যা আন্দাজ করে ফ্রেমগুলোকে আমার বীভৎস লাগে। হয়তো এ শহরে প্রজাপতি হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা নেই কিংবা ওদের মরে যাওয়ারই ছিল। সেদিন বাসে কেউ বলছিল প্রতি বছর পঁচিশ মিলিয়ন প্রজাপতি মারা যায় আর এর প্রধান কারণের একটি রাস্তায় যানবাহন।

একটা গুমোট পরিবেশ এড়াতে ডান দিকে ফিরি। সেখানে টেবিলে রাখা কুমিরের কংকাল, খুলিতে বাহারী রত্নপাথর- এ্যামিথেষ্ট, পোখরাজ, ভালোবাসার পাথর টোপাজ, চন্দ্রকান্তমনি, রোজ কোয়ার্টজ, টাইগার্স আই… যেন ঠিক ফিরে পাওয়া হারানো বয়াম যেখানে পাথর আমার বোন। আমার ছোট বোন বড়ো পাথর ভালোবাসতো। প্রথম স্মৃতির কথা যদি বলি- সে ওর পথের থেকে পাথর কুড়ানোর দৃশ্য। এত কিছু থাকতে কটা কালো পাথরের জন্য মায়া দেখে আত্মীয়রা হাসাহাসি করতো।‌ কিন্তু আমরা জানতাম পাথর ছিল ওর বন্ধু, ওর গভীর ভালোবাসা। তাই ওর স্মরণে কফিনে আমরা পাথর রেখেছিলাম, আমি দিয়েছিলাম সিংহলী গোমেদ।‌ আমার পেছনে অন্য কোন আগন্তুক অপেক্ষায় নেই অথবা থাকলেও হয়তো কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে আছে। আমারও তাই তাড়াহুড়ো নেই, নেই অস্বস্তি। প্রতিটা পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিংবা ও নেই ভাবতে ভাবতে যখন ক্লান্তি আসে, আমি এগুই।

কুয়াশা তখন আরো গাঢ় হয়। কুয়াশার গর্ভে বিলীন হতে হতে খুঁজে পাই পাশাপাশি দুটো দরজা- শালিক আর ধনেশ রঙের। মাঝে কুমড়ো পাতায় লেখা ‘যে পালক খসে গেছে ভালোমন্দে, তারে কুড়াই ধনেশ আকাশে’। ধনেশ শব্দতে তাৎক্ষণিক আগ্রহ ছুটে ধনেশ দরজার দিকে। আর তখনই বুঝি আমাকে বেছে নিতে হবে যে কোন একটি দরজা। ধনেশ ছুঁয়ে গেলে, এই জীবনে শালিক দরজা দেখা হবে না কোনদিন।‌ সিদ্ধান্তের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় কোন জটিলতা নেই। জটিলতা এই অনিশ্চয়তায়, একটা অচেনা সম্ভাবনায় শেষ মাটি চাপিয়ে দেয়ায়। দাদু বলতেন ‘ভগবান একটা সাদা পৃষ্ঠা দিয়েছেন- কেউ তাতে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, অংক শেখে, কেউ বানায় সারস পাখি, আবার কেউ ছিঁড়ে ফেলে কী অনায়াসে…” আমি সাদা পৃষ্ঠায় শালিক ছাড়া ধনেশ কিংবা ধনেশহীন শালিক মেলে দিতে পারি না। আত্মবিশ্বাস আমার জোরালো ছিল না কখনোই।

হতে পারে একটা দরজা পেরুলে তারার মতোন ফুটে থাকবে ভালোরা। আর প্রতিবেশী দরজায় জীবনের সবথেকে খারাপ কিংবা খুচরো সব অপরাধ। হয়তো আমাকে ঘিরে থাকবে এক জাহাজ বেড়াল। বিড়াল আমার অসহ্য ভয়ের। ছোটবেলায় দেখেছি দাদুর জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে পাড়ার মেয়ে বিড়ালদের মা হতে। শীতকালে আমার লেপের নিচে, আমার শরীরের ওমে সেই মায়েরা ছানাপোনা নিয়ে আসতো ঘুমোতে আর আমি আআআ চিৎকার করে লাফ দিয়ে নেমে সোজা ছুটতাম রাস্তায়। বেনু তখন‌ বিড়ালদের ধরে, আলতো লাথি দিতে দিতে বাইরে নিয়ে যেত। একবার ফেলে আসা একটা বিড়ালছানা আমার ঘরের জানালার নিচে চলে আসে রাতে। একঘেয়ে বৃষ্টির মতো সারারাত তার করুণ মিঞাও ডাক! ঠাণ্ডায়, ক্ষিধেয়, ভয়ে প্রায় অন্ধ ছানাটা সকালে চিৎপটাং হয়ে মরে পড়ে ছিল। এত নরম হয় মৃত বেড়াল! এখনও মাঝেসাঝে দুঃস্বপ্ন ‌দেখি আমার গায়ে ছুটে আসছে হাজার হাজার ‌দলা পাকানো মরা বেড়াল, চারদিকে মিঞাও মিঞাও। উহ! তেষ্টায় আমার সমস্ত জল শুকিয়ে আসে।

অন্য দরজায়‌ হয়তো তখন কুলকুল করে বয়ে আসবে বেনোজল। আমি ডুবে যাব, যেমন ডুবে যায় বাড়িঘর।‌ আমার সমস্ত জানালা ‌দিয়ে ঢুকে ‌পড়বে ঝকঝকে কৈ, বেহুলা ইলিশ। ছোটবেলায় দাদু গল্প শুনাতেন- রুপোলি এক রাজ্য ছিল এককালে, সবকিছু রুপোতে গড়া।‌ প্রজাদের কাছে ওদের রাজকুমারী রূপকথা ছিল বড়ো প্রিয়। একবার সমুদ্র থেকে উঠে আসা রাক্ষস ধ্বংস করে দেয় রুপোলি রাজ্য। শেষে রাজাকে যেই মুখে দেবে, রাজা অন্তঃসত্ত্বা রাজকুমারীকে বলেন জলের দিকে যেতে। রাক্ষস ভেবেছিল একে তো মেয়ে, তার উপর গর্ভবতী, আর কতোইবা দূরে যেতে পারে। সমুদ্রে নামতেই জলের দেবতার বরে রাজকুমারী রূপকথা হয়ে গেল রুপোলি মাছ। পেছনে ছুটছে দুর্ধর্ষ রাক্ষস। বারো হাজার মাইল ভাসতে ভাসতে রাজকুমারী অবশেষে সমুদ্র‌ ছেড়ে নেমে আসে নদীর ‌জলে। নেমে আসে রাক্ষসও আর তখনই তার মনে পড়ে নদীর ‌জলে ও বাঁচতে পারে‌ না, তার চাই নোনতা নিঃশ্বাস। ক্রুদ্ধ-ভীত রাক্ষস ছুঁড়ে দেয় হাঙরের দাঁতে তৈরি অব্যর্থ তীর। রাজকুমারীর রুপোলি শরীর ভেঙে ছড়িয়ে গেল সারে সারে ডিম, কতো যে ছলকে উঠে হয়ে গেল রাতের নক্ষত্র, আরও কোথায় কোথায় যে ছড়িয়ে গেল রূপকথার শরীর। এভাবেই রাজকুমারী মৃত্যু দিয়ে রক্ষা করে রুপোলি বংশধর। আজও ইলিশেরা রাজকুমারী রূপকথার স্মরণে বেহুলা হয়, শত মাইল পেরিয়ে নদীতে যায় ডিম দিতে, আজও নক্ষত্রেরা ছটফট করে, আর কোথায় কোথায় যে আমরা খুঁজে পাই রূপকথাকে…

আমার সামনে এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে শালিক আর ধনেশ দরজা। সামনে এগিয়ে যাওয়ার অস্থিরতা তবু নিজেকে চাবি বানাতে পারি না আমি। দু-এক জনের রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনেছিলাম, হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো অর্ন্তধান। এখানেই কি তবে…এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে এই ভ্রমণ? ঐ তো একটু দূর থেকে আসছে ফুলের ঘ্রাণ, অথচ দরজাকে অবহেলা করে নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারি না। হঠাৎ বন্ধ দরজা থেকে উড়ে আসে শালিক, উড়ে আসে ধনেশ- যেন শালিকের বন, ধনেশের বন। আমাকে ঠুকরে ঠুকরে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে চায়- বেছে নাও, বেছে নাও। নিজেকে বাঁচাতে যে কোন একটা দরজার দিকে দৌড়োনোই বুদ্ধিমানের কাজ। হয়তো যে কোন দরজা খুললেই শুনব- “তারপর ঈশ্বর বললেন, আলো ফুটুক!” আমি সেই আলো ফোঁটা দেখতে চাই। আমি বাড়ি ফিরতে চাই। চড়ুুই রোদে হেলান দিয়ে লিখে ফেলতে চাই নতুন কবিতার চতুর্থতম লাইন‌টা- নিজেকে কুড়িয়ে নিয়ে করেছি রুমাল। নাকি আমি সারাজীবন চেয়েছি পত্রিকার ছয় নম্বর পৃষ্ঠায় একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি হতে!

দুটো শালিক এবার ঠুকরে নেয় আমার গলার ডান পাশ, বাঁ পাশটা ধনেশেরা। বুঝিবা ওদের কাছে আমি একটি হৃষ্টপুষ্ট ফসলের গাছ। হঠাৎ অন্যরকম একটি দরজা আবিষ্কার করি, আসলে সামনের দেয়াল আয়নায় দরজাটা ফুটে ওঠে। এতক্ষণ কুয়াশায় ঢাকা ছিল‌, ওখানে জমে ওঠেছে দৃশ্য- নিজের কাটা মাথা হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছিন্নমস্তা। আহ, কণ্ঠনালী থেকে গড়িয়ে নামছে তিনটে লাল ধানের ধারা। একপাশে পান করে শালিকেরা, অন্যপাশে ধনেশ পাখিরা। এবার মুখ হাঁ করে আলো-অন্ধকারের মৈথুনে দাঁড়ানো আগন্তুক কিংবা হারানো বিজ্ঞপ্তি হতে চাওয়া তৃতীয় দরজাটা।

তারিখঃ জানুয়ারি ১০, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse