আপেল
ভবেশ দাস
অপালার কথা-
পুরো নাম ধরে স্কুলের দিদিমনিরা ছাড়া আমাকে কেউ ডাকে না। অপা বলেই ডাকে বাড়িতে। বন্ধুরা ডাকে অপু নামে। তা বলে ভাবতে যাবেন না যেন, আমি রায়বাবুর বিখ্যাত ‘অপুর সংসার’ সিনেমার নায়ক সৌমিত্র। অপুর ভাগ্য গড়েছিলেন পরিচালক। আমার ভাগ্যদেবতা যে কে তা বুঝতে পারি না নিজেও! আজকাল কথার বড্ড খেই হারিয়ে যায়। মামনি বলে, “উঠতি বয়স যে”। ও হ্যাঁ, আমাকে দেখে রঙ্গ করে, আপেল বলেও ডাকে বেশ কিছু আমোদ প্রিয় ছেলেরা। না, না, পাকা কাশ্মীরি আপেলের মতো গায়ের রং দুধে-আলতা মোটেও নয় আমার। ওই আর পাঁচটা সাধারণ বিবাহযোগ্য বাঙালি মেয়েদের, পাত্র চাই কলমে যা লেখা থাকে–উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। উচ্চতা, সেটাও গড়পরতা। চোখ, নাক,মুখ সবই সাধারণ মানের। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে, ভিড়ের মধ্যে যদি মিশে যাই আলাদা করে চোখে পড়ার মতো কিছুই নই আমি। তবে হ্যাঁ, একা বা বন্ধুদের সাথে যখন কোথাও যাই তখনই রসালাপ প্রিয় ছেলেদের মুখে শুনতে হয়, “আপেল তো এখন বাতাবিলেবু।” কিংবা “বাজারে আপেলের দর বেশি না বাতাবিলেবুর?” এই কথাগুলো প্রথম-প্রথম শুনে ভেতর-ভেতর রাগে ফেটে পড়তাম জানেন। সেভাবে প্রতিবাদ করতে ছোটথেকেই শিখিনি তো।কিন্তু গার্গী সঙ্গে থাকলে তেড়েফুঁড়ে উঠে,নিষ্পাপ মুখের কচি ঘাসের মতো দাড়ি গোঁফ গজানো ছেলেদের দিকে এগিয়ে যায়। আহা ওই মুখে কি গরল মানায়! তবুও ওরা বলে আনন্দ পায়।
গার্গী আমার প্রিয় বন্ধু। একটু ডাকাবুকো ধরনের মেয়ে। এই আপনারা যাদের ভালোবেসে, মর্দানি বা মেয়েছেলে বলে ডেকে থাকেন। দেখতে আমার থেকে অনেকটাই সুন্দর। তা বলে বিশ্বসুন্দরী ভাবার কারণ নেই। আলগা চটক আছে গার্গীর মুখে। আর যেটা আছে ওর মধ্যে, যার জন্য সবাই গার্গীকে সমঝে চলে, তা হল ওর বচন। কাটা কাটা বুলিতে ধান পড়লেই চ্যাপ্টা চিড়ের আকার ধারণ করে গার্গীর অপরপক্ষ। সবসময় হাসিখুশি থাকে গার্গী। আমাদের পাড়া শ্রী পল্লীতেই থাকে গার্গী।
আজকে প্রাইভেট টিউশন পড়ে আসছি আমি, একাই হরিসভার পাশ দিয়ে। গার্গী আসেনি আজ পড়তে। ওর কী একটা কাজ আছে। হরিসভা থেকে একটু এগোতেই তেমাথার মোড়ে জগদ্ধাত্রী-
পল্লীর কিছু বখাটে ছেলেদের মাঝ থেকে বিমল বন্ধুদের শুনিয়ে,গলা চড়িয়ে,আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, কীর্তনের সুর ছাপিয়ে,
” হ্যাঁ ব্বে…
পাতিনেবু আর ডাঁসা পিয়ারার থেকে আপেলই ভালো খেতে। তবে রসালো বাতাবিলেবু পেলে সব ওলা হয়ে যাবি শ্লা…”
কথাটা শুনেই আমার কান থেকে রক্ত ক্ষরণ হতে লাগল। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি চলে এলাম। মামনি রান্নাঘরে ছিল। দৌড়ে সেখানে গেলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে মামনিকে বিমলের কথাগুলো বললাম।
আমার কথাগুলো মামনি নির্বিকার চিত্তে শুনলো।
রান্নার কড়াতে গরম তেলের ওপর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিলো। ঝাঁঝে শুরু হল আমার চোখ,নাক, মুখের জ্বলুনি। কাশতে কাশতে আমি নিজের ঘরে চলে যাচ্ছি একফালি বারান্দা দিয়ে। সেই মুহূর্তে মামনি আমাদের পুরনো কাজের লোক ঝর্না মাসিকে বলল, ” বেগুন গাছি যদি লাউ ফলেনি নজর তো লাগবেই । ছোঁড়াদের আমি দোষ দেকিনে। যে বয়সের যা ধম্ম।” বিমলের কথা শুনে খারাপ লেগেছে আমার কিন্তু মামনির কথাগুলো বুকে ধানি-পটকার মতো ফাটলো।
সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকলাম। দরজায় খিল এঁটে ড্রেসিং-টেবিলের সামনে ছোট্ট টুলে বসলাম। অল্প কিছু কসমেটিক রাখা আছে এলোমেলো ভাবে। টেবিলের কিছু জায়গায় রংচটা সানমাইকার উঠে গেছে। ধুলি-ধূসরিত আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলাম। আজকাল নিজেকে দেখে চিনতে পারি না। আমার প্রতিবিম্বের সুখ-দুঃখের বিভিন্ন কোলাজ দর্পণে ভেসে ওঠে ভেংচি কাটে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। নামিয়ে নিই। আয়নার নীচে আমার মায়ের মলিন হয়ে আসা ছোট্ট ল্যামিনেশন করা ছবির দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলাম। মা ছবি থেকে হাসি হাসি মুখে আমায় অভয় দিচ্ছে। চোখের কোল হতে অসময়ের বর্ষা গড়িয়ে নামছে দুটি ধারায়।
বাঁধ ভাঙা প্লাবন আসার আগের মুহূর্ত।
ঠিক তখনই গার্গী দরজায় কড়া নাড়লো। সঙ্গে উচ্চস্বরে হাঁক-ডাক, ” অপু অপু ঢেঁপুরে….
আমায় তুই বাঁচারে।
জীবন আমার ইনহেলার হো গ্যায়া”
কোন রকমে নিজেকে সামলে দরজা খুলে দিলাম।
ঘরে ঢুকেই গার্গী ওর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ” ডিয়ার অপু তুই একমাত্র পারিস আমাকে বাঁচাতে। মাই মাদার ইন্ডিয়া ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে আমার পিন্ডি চটকাচ্ছে। মাম্মিগুলো কেন এমন হয় বলতো? নিজেদের জীবনে বসন্ত আসার আগেই উইন্টার এসে গিয়েছিল বলে!”
আমি গার্গীর দিকে তাকিয়ে আছি দুই ভ্রু’তে সেকেন্ড ব্যাকেটের ভাঁজ তুলে।
গার্গী বুঝতে পেরে দাঁত বার করে বলল, “সমরটাকে নিয়ে আর পারি না। রোমিও এখন ল্যাজে-গোবরে হয়ে গ্যাছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওকে দেওয়ালে ছুঁড়ে দিয়ে ঘুঁটে বানিয়ে শুকিয়ে নিই। তারপর ফার্নেসে ঢুকিয়ে হিট বার করি।”
কথাটা বলেই, আমার হাত ধরে ওর প্রিয় ব্যান্ডের গান গাইতে গাইতে ঘরের মধ্যে গোল-গোল ঘুরতে লাগল।
“ফাগুনেরও মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায়…”
************
আমার জীবন নামক ঘুড়িটা নীল আকাশের বেশি উঁচুতে উড়তে পারে না কখনই। লাটাইয়ের সুতো বিনা মাঞ্জায় পচে গেছে, কী জানি হয়তো বা গোটানো সুতোর মধ্যে খানিকটা কাটা রয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে থাকি। যদি লাটায়ের সুতো উপড়ে যাই বা লাট খেয়ে গোঁত্তা খাই। কি ভাবছেন আমি ঘুড়ি ওড়াই? ওটা গার্গীর পছন্দ। আমি সহকারী নামমাত্র। গার্গী যখনই আসে একরাশ টাটকা পুবালী বাতাস বয়ে এনে আমার সমস্ত কষ্ট উড়িয়ে নিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তারপরই ভাবতে বসি আমি ছোটবেলার কথা। বাবা-মা ও আমি, ছোট সংসারে সুখ যেন উপচে পড়ছে। বাবা কলকাতায় বড় অফিসে চাকরি করে। রবিবার ছুটির দিন আমাদের নিয়ে কখন মায়াপুর কখনও বিষ্ণুপুর গাড়ি করে বেড়াতে যাচ্ছে। রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে টুনটুনি পাখির গল্প বলছে বাবা। মোটা মোটা আঙুলগুলো আমার পেটে ছুঁয়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলছে, ” হাট্টি মা টিম টিম…” মা আমার, ভাত খাওয়াচ্ছে কাকের ছা, বকের ছা বলে আদর করে। তারপর কী যে হল আমাদের!
হঠাৎ করে মায়ের ভারী অসুখ হল। আমার বড় হবার আগেই মা চলে গেল আমাদের ছেড়ে। পরে জেনেছি মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিল। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিল।
তবুও….
বাবা দিল চাকরি ছেড়ে। অনেক টাকা দেনা হয়েছিল মায়ের চিকিৎসার জন্য। তাই ভি.আর.এস নিয়ে সেই টাকা মেটালো। যদিও চাকরি ছাড়ার কারণ হিসাবে আত্মীয়-স্বজনকে
বোঝালো, আমি ছোটমেয়ে মা ছাড়া একা একা কী করে থাকবো। আমায় কিন্তু ঝর্নামাসি খুব আগলে রাখতো। মায়ের কথা মনে পড়লেই কেমন একটা কষ্ট হয়। তবুও ঝর্নামাসির আদরে আমি বড় হতে লাগলাম। ঝর্নামাসি আমার মামার বাড়ি চাঁপাডাঙার মানুষ। বয়স হয়েছে কিন্তু খুব আঁটোসাঁটো চেহারা। আমার মা মাসি বলে ডাকতো। আমিও শুনে শুনে তাই ডাকি। দিদা বলিনা কখনও। আমাদের বাড়ির সকলেই ঝর্নামাসি বলে। যেন জগতমাসি। বাবা চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় মন দিয়েছে। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় কুমুদজেঠুর সঙ্গে। লরির ব্যবসা। নাম আমার নামেই রেখেছে, ‘অপালা ট্রান্সপোর্ট’ শুরুতে নাকি দুটো লরি ছিল আমাদের। এখন চারটে লরি হয়েছে। বাবা একটা করে লরি কিনেছে আর আমাকে গালটিপে আদর করে বলেছে, ” আমার পয়মন্ত মেয়ে। তোর জন্যই ব্যবসার আয় উন্নতি।” খালি বাবাকেই আর কাছে পাই না জানেন। সব সময় ব্যস্ত। এখানে দৌড়াচ্ছে ওখানে যাচ্ছে। বাড়িতে নানা ধরনের লোকজনের আসা যাওয়া লেগেই রয়েছে।
বাড়ির পেছন দিকের জমিতে মায়ের হাতে লাগানো গাছগুলো কেটে গো-ডাউন বানিয়েছে বাবা। একটা রাধাচূড়া গাছ ছিল। হলুদ ফুলে ছেয়ে থাকতো। ওটা যেদিন কাটলো সেদিন খুব কষ্ট হয়েছে আমার। বাবাকে বারণ করতে গিয়েও পারিনি। বাবার মধ্যে যেন একটা অন্য বাবাকে দেখতে পাচ্ছি। ঝর্নামাসি আমায় বলতো, ” জামাই খুব কাজের নোক,দ্যাখো দিকিনি। কেমন বড় মাপে কারবার ফেঁদিছে বল দিকিনি!”
হঠাৎ করে একদিন দেখি, বাবা মামনিকে নিয়ে বাড়ি এসেছে। মামনির গায়ে মেরুন বেনারসি শাড়ি। গলায় গোরের মালা। কপালে চন্দনের ফোঁটা। বাবা যদিও জামাপ্যান্ট পরেই আছে। কুমদ জেঠু আমায় বলল, ” অপা তোর লাইগা নতুন মা আনসে তর বাপে। তর একটা নতুন মামাবাড়ি হইসে বনগাঁয়ে।”
সে রাতে আমার কেমন যেন হচ্ছিল। কষ্টগুলো বুকের ওপরে উঠে এসে গলার কাছটা আটকে ছিল শুধু। মায়ের মুখটা আবছা ভেসে উঠছিল দু’চোখের পাতায়, বারে বারে। হঠাৎ করে রুনুর ডাকে আমার স্মৃতির সুতো ছিঁড়ে যায়।
“দিভাই দিভাই আমার স্কুলের আঁকাগুলো দেখিয়ে দিবিইইইইই।”
রুনু আমার ছোটবোন এইভাবেই এসে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে স্মৃতির মলিনতা ওপর চাঁদের হাসি ছুঁড়ে দেয়।রুনু সবে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। খুব পাকা পাকা কথা ওর। যত গল্প আমার সাথে। মামনিকে একটু ভয় পায়। রুনুরই কি বা বয়েস। আমি কলেজে পড়া মেয়ে হয়েও মামনিকে এখনও ভয়ে ভক্তি করি মা মনসার মতো।আঁকার খাতায় আঁকিবুকি কাটতে কাটতে রুনু স্বভাব সুলভ চপলতায় সুর করে বলে উঠলো, “জানিস দিভাইইইই, বাড়িটা না রং হয়ে নতুনননন হবে। তোর বিয়ে হবেএএএ তাড়াতাড়ি। মা সেদিন রাতের বেলা বাবাকে বলছিলওওও।”আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার বিয়ের তোড়জোর চলছে আমিই জানি না! জেনেই বা আমি কী করতে পারি! মামনির সিদ্ধান্তে এই সংসার চলে। বাবা নিজের ব্যবসা নিয়েই মত্ত থাকে। নিজের মতে আমি পোশাক পরতেই পারি না। মামনিই কিনে আনে আমার শরীরের থেকে দু’সাইজ বড় সালোয়ার কামিজ।সব সময় ঢলো ঢলো পোশাক পরে থাকি বলে, গার্গী মাঝে মাঝে কথা শোনায়, “তোকে পুরো টিপিক্যাল হিন্দুস্থানিদের মতো বহেনজী লাগে।” বুকে ওড়না ছাড়া বাড়ির বাইরে যাই না। মামনির কঠোর নির্দেশ। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। আসলে ভগবান আমাকে তৈরি করার সময় অতিরিক্ত যা মাটি বেঁচেছিল, পুরোটাই আমার বুকে ঠেসে দিয়েছে। তাই গার্গীকে যা মানায় আমার ক্ষেত্রে তা দৃষ্টিকটু লাগে।
সোদপুর শ্রীনিকেতন থেকে গার্গী পছন্দ করে কত নিত্য নতুন ড্রেস কিনে আনে। আমারও খুব সাধ হয়, গার্গীর মতো জিন্স ও টপ পরে হিলহিলে শরীর নিয়ে কলেজে যেতে। এই আগরপাড়া থেকে সোদপুরের দূরত্ব আর কতটাই? তবুও আমার কাছে এইটুকু দূরত্ব কত যোজন আলোকবর্ষ…
#########
গার্গীর কথা-
আমার পরিচয় তো পেয়েই গেছেন অপুর মুখে। নিজের মুখে আপন ঢাক পেটাতে হেব্বি শরম লাগে মাইরি। বিন্দাস জীবন। ঝিনচ্যাক কাটাই। বাড়িতে আমি বাপির আদুরে কাবলি বেড়াল। খালি মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীতে আমার গ্রেট দুশমন মাই মাদার ইন্ডিয়া। একদিন খাবার টেবিলে বাপীকে ফটাকসে জিগ্যেস করেছিলাম,
” মাই ডিয়ার পাপ্পা, অপুর মতোই কি আমার আরো একটা মা ছবির ফ্রেমে আটকে আছে?”
আমার রিমা লাগু সুলভ মা হঠাৎ করে অনামিকা সাহা হয়ে উঠে, জলের জগ ছুঁড়ে মেরেছিল। তবে একটা কথা বস। যখনই কোনো ছেলে আমায় ল্যাঙ মারে তখন কদিন ‘ল্যাব’ ডগির মতো আমার থোবড়া ভারী দেখে অনামিকা সাহা, সন্ধ্যারানি হয়ে যায়। আমার দিকে লাভ দিয়ে দেখে। চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজে হাতে করে খাইয়ে দেয় দোস্ত।
মাকে তখন গলা জড়িয়ে বলি, ” মাম্মি ও ম্মামি তু কব শাস বনেগি…”
মা মুচকি হেসে বলে, ” তুই কি কোনদিন সিরিয়াস হবি না গার্গী?”
ধ্যার আবার ভ্যাজাতে লাগে আমার সন্ধ্যারানি- রূপী মা।
আচ্ছা, এতক্ষণ আপনারা পড়ছেন সঙ্গে ফিচিক হাসছেন ও ভাবছেন, এত নায়িকার নাম কি করে জানলাম। আসলে আমাদের বাড়িটা হল সিনেমার বাড়ি। দাদু সেই কোনকালে ‘পদ্মা’ সিনেমা হল বানিয়েছিল। বাবা সেটাকে শপিংমল বানাবার চেষ্টায় রত। বাড়িতে কেবল লাইনে যত সিনেমার চ্যানেল আছে, শুড্ডা দাদু দিনরাত বসে বসে হেলেন থেকে রাখি সাওয়ন্ত সব সিনেমা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চোদ্দ ঘন্টা দেখে। আমি হলাম দাদুর কাছে শর্মীলা টেগোর।
বুড়োটা বুকে হাত ঠেকিয়ে আমায় বলে,
” তুমি কাছে তব যে দূরে
কত যে দূরে ওরে বঁধূয়া
পরান যায় জ্বলিয়া রে …”
দাদু ছোট থেকেই ঠাকুমাকে বড়বৌ আর আমাকে আদর করে ছোটবৌ বলে ডাকে।আমিও বুড়োর থুতুনি নেড়ে বলি, “ফেস কাটিং তো রাজেন্দ্র কুমার থেকে দিলীপ কুমার হয়ে গেছে। হেয়ার কালার যতই করো বুড়ো, জামা খুললেই, বুক থেকে চাউমিন ঝুলে পড়ে।”আমার মায়ের অভিযোগ, দাদু ও বাবা দু’জনেই আমার মাথা টাকে চিবিয়ে খেয়েছে। আচ্ছা বলুনতো, মেয়েদের মাথা কি মাছের মাথার থেকেও বেশি টেস্টি? যাক বলবো না বলবো করেও, মাই ফ্যামিলির হিস্ট্রি, জিওগ্রাফির মানচিত্র এঁকে দিলাম। এখন যাই অপুর বাড়ি। ওর সাদা-কালো সিনেমায় একটু রঙিন জল ছিটোতে। অপুর নাকি আজ পাকা দেখা। ওর মামনিটা পুরো জালি। মেয়েটাকে ঠিক মতো জীবনটা উপভোগ করতে দিল না। এখন সবে আমাদের কুড়ি। আমি বলি কুঁড়ি। পাপড়ি মেলবো মেলবো করছি। কত রকমের রঙীন প্রজাপতি উড়ে আসবে। আজকের দিনে এক্ষুণি কেউ বিয়ে করে লাইফটাকে মর্গে চালান করে। টাটার মোবাইল ফোন লঞ্চ করেছে। টাটা টু টাটা ফ্রি। আমি একটা নিয়েছি। 9 2 3 1 লাগিয়ে পরের ছ’টা যা হোক নং ডায়াল করি। যদি কোনো হিরো হিরালালকে ফোনে পেয়ে যাই। সারা রাত ভাট বকে কাটিয়ে দিই। ফুলটু মস্তি ভাই। অপুর বাড়ি ঢুকেই ওর ঘরে গেলাম। ঘরের ওয়েদার, ষাটের দশকের ঝিমধরা সিনেমা। আমার এভারগ্রীন ব্যান্ডেমাতরম গানটা গাইলাম চেয়ারে বসে, পা দুলিয়ে দুলিয়ে। ” বারান্দায় রোদ্দুর…..”
অপু একটা হলুদ তাঁতের শাড়ি পরেছে। হালকা সেজেছে। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। অপুকে যেন এখুনি বৌ-বৌ লাগছে আমার। অপুর কাছেই শুনেছি, এর আগেও তিন-চারটে বাড়ি থেকে মা-বাবার বাধ্য ছেলেরা মায়ের আঁচল ধরে ব্যা–ব্যা করতে করতে অপুর এক্সাম নিয়ে গিয়েছিল। ঘাড়ে পাউডার মাখা লক্কা পায়রার মতো ছেলেগুলো বাইরে এন্তার পাখি উড়িয়ে এসে এখানে বাধ্য সন্তানের মতো বসে থাকে ফিসিং ক্যাটের মতো। সেই কাউবয়দের সামনে তাদের মা- জেঠিমা গোত্রের টিপিক্যাল বঙ্গ নারীরা বলে, “একটু হেঁটে দেখাও মা। চলে দেখাও মা। চুল খুলে দেখাও তো।” ওরা মেয়ে দেখতে আসে না বাজার করতে? মেয়েরা যেন বাজারের রসালো ফল। ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে, টিপে–টাপে দেখবে। দাগি- পচা মাল কি না! আমায় যদি কখনও আসে দেখতে বাড়িতে,বসার চেয়ারে চুইং-গাম আর্দ্ধেক চিবিয়ে রেখে দেবো। চায়ের সাথে নুন ও লঙ্কা গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়ে মজা চাখাবো। আর ড্রেস পরবো, দীপিকার মতো হট। যদিও এসবের চান্স নেই আমার জীবনে। কারণ সমর ভাগলবা তো অমর আগলবা মাই লাইফে।
অপুকে নিয়ে নীচে বসার ঘরে গেলাম। একজন ভদ্রলোক ও দু’জন মাঝ বয়সী ভদ্রমহিলা বসে আছেন। ঝর্নাদিদা ওরফে মাসির থেকে জেনেছি ছেলে ও ছেলের মা অপুকে দেখে আগেই পছন্দ করে গেছেন। আজ ছেলের বাবা ও মা এসেছেন। মেয়েও দেখবেন এবং পাকা কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করবেন। এক নজরে অপুর হবু শ্বশুর–শাশুড়িকে দেখে মনে হল, যেন বাংলা সিনেমা থেকে উঠে আসা, কুচুটে, বিকাশ রায় ও গীতা দে’র জুটি। অপুকে ওদের সামনে বসিয়ে আমি কিচেনে এসে ঝর্নামাসির সাথে হাতে-হাতে জলখাবার গুছিয়ে দিচ্ছি। মাসি আপন মনে গজ গজ করতে করতে বলছে,
“একবরে ভাতারের মাগ
চিংড়িমাছের খোসা,
দোজবরে ভাতারের মাগ
নিত্যি করেন গোঁসা।
তেজবরে ভাতারের মাগ
সঙ্গে বসে খায়,
চারবরে ভাতারের মাগ
কাঁধে চড়ে যায়।”
আমি বুঝতে পারলাম নিশ্চয় অপুর মামনির সাথে ঠোকাঠুকি হয়েছে ঝর্নামাসির। তাই এই ভাবে বীজমন্ত্র ঝাড়ছে। মাসির সাথে কাকিমার একদম পটে না। তবুও এ বাড়িতে টিকে আছে মাসি, অপুর জন্য। কোলে পিঠে বড় করেছে। খুব মায়া অপুর পরে। ওই ঘরে, অপুর বাবা-মা ও কুমদজেঠু বসে ছেলের বাড়ির সাথে খেজুরি জুড়েছেন। চা-জলখাবার পৌঁছে দিতে গিয়ে ফিরে আসছি। তখন অপুর বাবা বলল, ” গার্গী, তুই নিয়ে যা অপাকে। এবারে আমরা কথা বলবো। অপার এখানকার কাজ মিটে গেছে।” দো-তলায় নিজের ঘরে না গিয়ে অপু ডাইনিং রুমের পাশের ঘরে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল। আমি কিছু বলবার আগেই আমাকে ইশারায় চুপ করতে বলল। তারপর জানলার ধারে দু’জনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানলায় পর্দা দেওয়া আছে বলে আমাদের কেউ চট করে খেয়াল করতে পারবে না ও ঘর থেকে। আমরা কিন্তু পর্দার ফাঁক থেকে ওঘরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছি।ছেলের মা হাতের আঙুল নাড়িয়ে কর্কশ কণ্ঠে অপুর বাবাকে বলছেন, ” বিয়াই–মশাই, আমার
খুড়শাশুড়ির কথায় আপনার মেয়েকে ঘরের বৌ করে নিতে ইচ্ছুক। মা-মরা অভাগী মেয়ে।
আমরা চেয়েছিলাম লক্ষ্মী প্রতিমার মতো ছেলের বৌ আনবো। শান্ত,শিষ্ট, শ্রীময়ী।জানিনা আপনার মেয়ের স্বভাব চরিত্র কেমন! তবে যদি, চঞ্চলা, চপলা, লাস্যময়ী হয় তবে আমার ঘরের ভাত বেশি দিন ওর কপালে নেই।এটা আমি আগেই বলে রাখছি।”
আমি অপুকে ঠেলা মেরে কানে কানে বললাম,
“তোর হবু শাশুড়ির কথা বলার স্টাইল তো পুরো বিরোধী নেত্রীর মতো! একে পার্লামেন্টে পাঠানো উচিত রে।”
অপু আমার হাতে চিমটি কেটে থামাতেই দেখি, অপুর মামনি ললিতা পাওয়ার থেকে সন্ধ্যা রায় হয়ে গেছে। গলায় আঁচলখানা টেনে, গদগদ কন্ঠে অপুর গুণের প্রশংসা করছেন। আমি তো শ্লা বিলা হয়ে গেছি। আমার ছোট্টবেলার বন্ধুর মধ্যে এত গুণ… আমিই জানতাম না। কাকিমার এই মাদার-টেরেসা রূপ কোন ভল্টে লুকিয়ে রেখেছিল! এসব শুনে ছেলের মা বললেন অপুর মাকে,
“আপনার কথা ঠিক বলেই ধরে নিচ্ছি।এবার আসল কথায় আসা যাক। এমনিতেই আমরা পণের পক্ষে নেই কিন্তু আপনার মেয়েকে গলা থেকে বুক সোনার হারে ঢেকে দিতে হবে। কথাটা কেন বললাম বুঝতেই পারছেন।”
কুমদজেঠু বলে উঠলেন, ” স্বর্ণ দিবে তো আমাগো মাইয়ারে। ওর মার যা স্বর্ণ আসে সব অপুই পরবা।”
ছেলের মা প্লেট থেকে নিয়ে একটা গোটা মিষ্টি মুখে পুরে দিল। আমি মনে মনে বলি, একটা পিঁপড়ে যদি হতাম না, তবে ওই মিষ্টির সাথে মিশে গিয়ে আপনার জিভের দফা আজ ফিনিশ করে দিতাম। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। অপুকে জোর করে টেনে ওর দোতলায় উঠে গেলাম। ঘরের সামনের ছাদে দুই বন্ধু দাঁড়ালাম। মাথার উপর খোলা আকাশ। সর পড়া দুধের বাটির মতো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের গায়ের কলঙ্কের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আজ।টিমটিমে তারাদের মাঝে আমরা দুই বন্ধু নক্ষত্র খুঁজতে লাগলাম….
########
অপালার দাম্পত্য-
আমার বিয়ে হয়ে গেল সমীরণের সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ জমকালো হয়েছে। সানাইয়ের থেকে বেশি বাজলো, ” পালকিতে বৌ চলে যায়…” যদিও স্করপিও করেই শ্বশুরবাড়ি এসেছি।তবে, গার্গী বলছিল বিয়ের দিন, “তোর ছবি বিশ্বাস ফাদার ধার করেও এত ফুটুনি কেন করছে জানিস? আমিই বলছি, তোর লাইট ব্রেনে এ সব ঢুকবে না। আসলে শ্রীপল্লীর লোককে দেখালো, তোকে কত্ত ভালো ঘরে বিয়ে দিচ্ছে। পাড়ার পি, এন,পিসিতে যেন কথা না ওঠে, মা মরা মেয়েকে বেড়াল পার করলো।” ফুলশয্যার পরের দিনই শাশুড়ি লকারের দোহাই দিয়ে সব গয়না নিজের হেফাজতে নিয়েছে। সব সময় পরে থাকার জন্য একটা ফিনফিনে সরু চেন ও একগাছা ব্রোঞ্জের উপর সোনা ধরানো চুড়ি বরাদ্দ হয়েছে আমার। কানে সরু সরু দুটো রিং। অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গিয়ে বুঝতে পারলাম মামনির মনোভাব। আমার মায়ের যা গহনা ছিল তাতে বিয়ে হতো না। বাবা একটা লরি বেচে দিয়েছিল বিয়ের গহনার জন্য।মামনি আমাকে শুনিয়ে ঝর্নামাসির কাছে গল্প করছিল, ” কী ডাহাবাঁজ শাউরিরে বাবা বিশ ভরি গয়না পইরে মেয়ে পাঠালাম নি। বিয়ের পর পেত্থমবার বাপের ঘরে এল, এর মাঝেই সব নিজের আঁচলে বেঁদেছে ক্যানে।”
সমীরণকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমার সাথে সেভাবে কথাও বলে না। এদের বাড়িটা আমাদের থেকেও বড়। কাজের লোক দু-তিন’জন আছে। এখানেও দো’তলার ঘরে আমার স্থান হয়েছে। বাড়ির পাশেই রাস্তার ওপর একটা বড় ছাতিম ফুলের গাছ। অগ্রহায়ণ মাসেও ছাতিম ফুলের গন্ধ আমার ঘরটাকে মাতিয়ে রাখে। যদিও সমীরণ উগ্র গন্ধ পছন্দ করে না। সমীরণ কি আদৌ আমাকে পছন্দ করে? কী জানি! শুধু রাতের বেলায় জৈবিক তাড়নায় আমার শরীরটা ঘাঁটে। মর্দন করে আমার ভারী বুক। আমি তাতেই খুশী। আমার শরীরের দৃষ্টিকটু অঙ্গ সমীরণের হাতের স্পর্শে সজীব হয়ে ওঠে। মুখের দিকে ভালো করে তাকায়ও না বোধহয়। এতে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
বৌ –ভাতের রাতে শেষ ব্যাচে সমীরণের কাছের বন্ধুরা খেয়ে উঠে গালে পান ঠেসে আমাদের ফুলশয্যার ঘরে এসেছিল। ব্যক্তিগত উপহার দিয়ে তাদের মধ্যে একজন মিচকে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ” তোর আর বালিশের দরকার নেই সমু।” অন্য সব বন্ধুরা উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিল। শুধু সমীরণের মুখেই সে রাতে নেমে এসেছিল অমানিশার কালো ছায়া….
**********
আমরা মেয়েরা কবে আর নিজের পছন্দ অপছন্দ ব্যক্ত করতে পেরেছি। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়াই হল আমার মতো বেশিরভাগ মেয়ের জীবন। তবুও গার্গীর মতো দু-চারজন যখন খাপছাড়া ভাবে জীবনকে উপভোগ করে তখন একদিকে রাগও হয়। আবার অপর দিকে গর্বও হয়। বেশ কিছুদিন হল আমাদের ওপরের ঘরে শুতে আসছে না সমীরণ। সব সময় বাড়িতে ফরমাশ খাটা কাজের মেয়ে টুম্পা রাতের বেলা আমাদের খাটের নীচের মেঝেতে শুতে আসে। টুম্পা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। যেন আমার প্রতি কত বিস্ময় ওর। কটাদিন যাবার পর শাশুড়ি আমাকে বলল,
” বৌমা তোমাদের খাটে ছারপোকা হয়েছে। রক্ত খেয়ে ছেলের আমার পিঠে দাগরা দাগরা দাগ করে দিয়েছে। তুমি ছারপোকা মারার ব্যবস্থা করো। তবেই সমু ও ঘরে যাবে।”
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! কই আমাকে তো একটাও কামড়ায় নি ছারপোকা। গার্গী একদিন ফোন করলো আমাকে। ও আমার বিয়েতে একটা নোকিয়ার মোবাইল সেট উপহার দিয়েছে। মাঝেমধ্যে গার্গীই ফোন করে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার এখনকার পরিস্থিতি সব জানলো। ছারপোকার কথা উঠতেই বলল,
“তোর মাদার-ইন-ল হল আস্ত খটমল। আমি তোর জায়গায় থাকলে, ওই মহিলার মুখে বেগন স্প্রে পুশ করে মুখ চেপে ধরতাম।”
আমি হাসবো না কাঁদবো গার্গীর কথা শুনে তাই বুঝতে বুঝতে ফোনের সিগন্যাল কেটে যায়।
***********
বিয়ের ছ’মাস পর আজ সন্ধেবেলা বাবা ও মামনি এসেছে আমার শ্বশুর বাড়িতে। টুম্পার মুখে শুনেছি বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছে আমার শাশুড়ি মা। বসার ঘরে এবাড়ি ও বাড়ির গুরুজনেরা বসে আছেন আবহাওয়া গরম করে। একপ্রস্থ বাক-বিতন্ডা হয়ে গেছে বুঝতেই পারছি। আমি চা-জলখাবার নিয়ে টুম্পার সাথে ঢুকলাম। আমাকে দেখেই শাশুড়ি স্বমহিমায় হাত, পা নেড়ে বলে উঠলেন, ” কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে। বিয়াই মশাই এই প্রণাম মন্ত্র বিদ্যার দেবীর ক্ষেত্রেই খাটে। অপালাকে নেকলেস ও হারেও মানাচ্ছে না। আমার সমু বৌমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে সংকোচ বোধ করে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার।”
আমি দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে আছি পর্দার কাপড়টা ধরে। আমার বাবার মাথাটা একটু ঝুঁকে ছিল। আমার যেন মনে হল এই কথাটা শোনার পর, বাবার মাথাটা বোধহয় দেহের থেকে আলাদা হয়ে গেল। তবুও বাবা মাথা নিচু করেই বলল, ” আপনি কী বিহিত চাইছেন বিয়ান?” শাশুড়ি গলার পর্দাটা আরো এক পর্দা টেনে বললেন, ” আমার ছেলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছে। কলকাতার অ্যাপোলোর বড় সার্জেন ডাঃ পাকরাশি। সেই ডাক্তার বলেছে রিডাকশন ম্যামোপ্লাস্টি বলে একটা মাইনর আপারেশন করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ আমার মামনি চুপ করে কথার ওজন মাপছিল। এবার গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে বলল, ” তা বিয়ান কি আমাদের তলব করলেন নি আবার ট্যাকার জন্যেই?”
আমার শ্বশুর নির্বিবাদী মানুষ হলেও শাশুড়ি চতুর মহিলা তা আমি ওঁর হাবভাবে বিয়ের আগেই টের পেয়েছি কিন্তু এতটা ধড়িবাজ অভিনেতা সেটা এই ছ’মাসেও বুঝতে পারি নি। সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়িমা আমার মামনিকে গলায় মধু ঢেলে বললেন, ” ওরা দুটিতে সুখে সংসার করবে।এটাই আমাদের কাম্য বিয়ান। টাকা দিয়ে কি সুখের বিচার হয়!”
আমার বাবা তদগদ কন্ঠে বলে উঠল,
“তা তো বটেই।” সেটা শুনে আমার মামনি বাবার দিকে আগুনে দৃষ্টি হেনে বলল,
“দ্যাহেন বিয়ান ছ’মাস হয়েছে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি নি। যা চেয়েছেন তার থেকে বেশিই দিয়েছি নি। আবার এখুনি যদি এইসব ধানাই-পানাই করে ট্যাকা নেবার মতলব করেন নি। তবে গুইড়ে বালি। সৎ হলেও নি অপার মা আম্মি। সেই অষ্টমঙ্গলায় মেয়ে এয়েচে শ্বশুরবাড়ি। তারপর থেকে একটি বারও পাঠান নি । আজকে অপাকে আমরা নিয়ে যাবো নি।
আপনি বাবা-জীইবনকে কদিন বাদ পাঠিয়ে দেবেন নি। কয়েকদিন শ্বশুরবাড়ির আদর যত্ন খ্যায়ে আপনার ছেলে-বৌমা আবার ফিরে আসবে নি।আমাদের বাড়িতে ছারপোকা তো দূর নি তার বংশও নেই।”
আমি মনে মনে ভাবি ছারপোকার ব্যাপারটা নিশ্চয় গার্গীর থেকেই শুনেছে মামনি। মামনি আমার দিকে তাকালো। ওই চোখের ভাষা আমি বুঝি। যবে থেকে মামনিকে দেখছি ওই ভাষাতেই মামনি আমার সাথে কথা বলে। বাকি যেটুকু কথা থাকে সবই ঝর্নামাসিকে উদ্দেশ্য করে আমাকে শোনায়। আমি দো-তলায় এসে নিজের ঘরে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নিলাম। জানলা দিয়ে ছাতিম ফুলের গাছটাকে দেখলাম। এখন তপ্ত গরমের দিন। গাছে ফুলের গন্ধ নেই। আমার মতো গাছটাকেও দীন মনে হলো। টুম্পা গুটিগুটি পায়ে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো।এই কদিনে ওর ওপর মায়া পড়ে গেছে আমার। শুনেছি, সুন্দর বনের কাছে নামখানা বলে কোনো জায়গা আছে সেখান থেকে টুম্পা এসেছে। ওর বাবা দিয়ে গেছে। ওদের নাকি ঘরবাড়ি সব নোনা জলে গ্রাস করেছে। অনেকগুলো ভাই বোন টুম্পারা। খাওয়ার কষ্ট। পরার কষ্ট। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এখানে খেতে পরতে পায়। দু’মাস অন্তর ওর বাবা কিছু করে টাকা নিয়ে যায়। টুম্পার বাবার মুখটা একবার দেখেছিলাম। আবছা হয়ে গিয়েছিল স্মৃতি থেকে। আমার বাবার মুখ দেখে আজ টুম্পার বাবার ছায়া দেখতে পেলাম। স্মৃতি বিদ্রোহী হল। টুম্পার হাতে দুশো টাকা দিলাম। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ও। আমাকে ঝপ করে প্রণাম ঠুকলো। ওর চিবুকে হাত দিয়ে হামি খেলাম। দু’জনেই চোখের জল লুকাচ্ছি পরস্পরের কাছে।
ঘরটা তাকিয়ে দেখলাম আরো একবার। নিচ থেকে মামনির গলা শুনতে পাচ্ছি। বাপীকে তাড়া লাগাচ্ছে। ধীরপায়ে নেমে এলাম। হাতের সুটকেস বাপী নিল। সুটকেস তো তেমন ভারী নয়। তবে বাপী কেন এইটুকু ওজনে ঝুঁকে পড়লো। আমার বাপীর ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা। ওর থেকেও বেশি ওজন সে তুলেছে একসময়। আমি আবার আগরপাড়ার বাড়িতে চলে এলাম।
আজ দু’মাস এখানে আছি। গার্গী মাঝে মধ্যেই আসে । ওর স্বভাব অনুযায়ী চটুল রসিকতা করে। সেদিন বলছিল, ” তোকে তো কী সব ময়ী-টয়ী বলে বৌ কথা কও সিরিয়ালের মৌরী ভেবে নিয়ে গেল। তা এখন কি মৌরী দাঁতের ফাঁকে আটকে গেছে? ডিসগ্যাস্টিং!” ও ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দেবে এবছর। আমিও দিতাম কিন্তু….আমার ফোন থেকে সমীরণকে দু’তিনবার মিসকল করেছিল গার্গী। একটু পরেই কলব্যাক করেছিল সমীরণ। ওর সাথেই হাসি-ঠাট্টা করেছে ফোনে।
আমার সাথে দায়সারা ভাবে যে টুকু কথা না বললেই নয় সেটুকু বলেছে। আমার জীবনে পুরনো রোজনামচা ফিরে এসেছে।
ছাদের ঘরে একাকিনী বন্দিত্ব আমি নিজেই মেনে নিয়েছি ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়ে। আজকাল নিচেও নামি না। মামনির শব্দভেদি বাণ বড্ড অবসন্নতা আনে। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে মায়ের ছবিটাকে দেখি আগের মতো। আর মনে মনে ভাবি, মায়ের মতো আমারও বুকটা যদি কর্কটরোগে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তবেই মুক্তি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে। দু’চোখের কোলে আষাঢ়ের বাদল মেঘ জড়ো হয়েছে। ভেঙে পড়ার লক্ষণ আছে। তবুও বৃষ্টি আসছে না। হুড়ুম-দুড়ুম করে গার্গী ঘরে ঢুকলো। আমাকে ওই অবস্থায় দেখেই বলতে লাগলো, ” এতো ম্যা ম্যা করে কাঁদবি না তো। তুই কি পাগলাঠাকুর না বামাক্ষ্যাপা? মাকে ডাকলেই যেন জগজ্জননী না হোক তোর নিরূপা রায় রূপী মা ফোকাস হবে! আয় দুই বন্ধু মিলে এই ওয়ার্ল্ডের জীবিত কৈকেয়ী রূপী মায়েদের গুষ্টি উদ্ধার করি।” এই মেয়েটা যে কী তা আমার ভাবনার অতীত। ঘরের দরজাটা ভেজানো থাকে। ও খিল দিয়ে এলো। তারপর হাত-পা ছড়িয়ে আমার খাটে শুয়ে একটা সিগারেট টানতে লাগলো। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, ” বিদ্রোহী নারীর প্রথম শর্ত আগুন ফুঁকে ধোঁয়া ছাড়ো। তুই তো টি.ভি দেখিস না। পরমায় অর্পনা সেনকে দেখলে বুঝতিস। তুমি ডিয়ার ছ-মাস স্বামীর আদর খেলে। আর আমার এখনকার বয়ফ্রেন্ড রোহিতাশ্ব বলছে,
সিগারেট একসাথে কাউন্টারে না খেলে দু’জনের বন্ডিং ঠিক জমবে না।” বেশ কিছুদিন হল আমার মুখে শব্দের যোগান একদম কমে গেছে। চুপ করে গার্গীকে দেখছি ও ভাবছি অতলান্ত সাগর। গার্গী একমিনিট চুপ করে থাকতে পারে না।
কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ আমার দিকে চোখ নাচিয়ে গান ধরলো, ” কান্দে শুধু মন কেন কান্দে রে…” গান শেষ করেই আমার হাত ধরে দরজার খিল খুলে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে এলো। শেষ দুপুরের তপ্ত রোদ আমাদের দু’জনের ওপর হামলে পড়লো।
বাড়ির ছাদের নীচ দিয়ে একজন দেহাতি মহিলা গলা ছেড়ে বলে চলছে,
“বর্তন লিবেহো….বওদি….এ দিদি….
পুরান কপড়ে কে বদলে ভারী বর্তন হোবে…
এক জোড়ি মে থালি অর দো জোড়ি মে গামলি…
আমি ভাবছি এদের জীবনেও স্বাধীনতা আছে।
আর আমার….
গার্গী আবার বকবকাচ্ছে,” এদিকের খবর কিছু জানো ডিয়ার?” আমি ঘাড় দুলিয়ে না বললাম। গার্গী ওর কপালের ওপর ঝুঁকে আসা কুঁচো অবাধ্য চুলগুলোয় আঙুল চালিয়ে ঠিক করলো। তারপর গলায় একরাশ বিরক্তি এনে বলল, ” তোর মামনি ও হাড়গিলে ওল্ড ম্যান কুমদ বুড়ো মিলে প্লান করেছে তোর আর সমীরণের মধ্যে ডাইর্ভোসের মামলা করবে। প্রয়োজনে 498 ও করতে পারে। তোর বিয়ের গোল্ডগুলো তোর ললিতা পাওয়ার রূপি শাশুড়ি আটকে রেখেছে। সেদিকেই ভুখা নজর।”
ভারাক্রান্ত মনখারাপটা কান্না হয়ে গলার কাছে আটকে গেল আমার।
***********
দিবাকরের ওপর আমি অভিযোগ করি খুব। আমার সুখের দিনের সময়টিতে আহ্নিক গতির স্বল্প বিলম্ব আনলে কি পৃথিবী রসাতলে যাবে? আসলে জীবনে আমার দুঃখের পাল্লা এত ভারী, তা ওজন করতে কয়লার দোকানে যেতে হয়। আর সুখ ওজনের মাপকাঠি স্বর্ণকারের পুঁতির মতো নিক্তি। কয়েক বছর পর আজ সুখের ঘড়ার যাদু উপচে পড়েছে মোর জীবনে। আজ সাধ দিয়েছে মামনি। মামনির এই রূপ আগে কোনদিন দেখিনি। খুব যত্ন করে নিজে হাতে আমার পছন্দের সব রান্না করেছে। পাবদা মাছটাতো লাজাবাব বানিয়েছে। ঝর্নামাসিকে বলতে শুনেছি, মামনি নাকি সবার কাছে বলেছে, আমার ছেলে হবে। কী যেন ছড়া কেটেছে, দাঁড়ান মনে করি। ও হ্যাঁ, ” মেয়ের মা বান্দরী, ছেলের মা সুন্দরী।” তা আমাকে দেখতে কবে আর রূপকথার রাজকন্যে ছিল! আজ শ্বশুরবাড়ি থেকেও শাশুড়ি এসেছিল। বিয়ের সব গয়না নিজের হাতেই পরিয়েছে। তার সাথে ঠাকুর শাশুড়ির আমলের পনেরো ভরির দামী চন্দ্রহার গলায় দিয়ে আর্শীবাদ করেছে। মুখে বলেছে, ” আমার ঘরের কুললক্ষ্মী তুমি, মা। বংশের প্রদীপ তোমার কোলে। কোনো অযত্ন যেন না হয়।” সমীরণ দিনের বেলার অনুষ্ঠানে আসেনি। স্বামীদের নাকি দেখতে নেই এই সব মেয়েলি লোকাচার। সে রাতে আসবে। গার্গী ছিল সারাদিন আমার সাথে। তবে অন্যদিনের তুলনায় একটু চুপচাপ। কি জানি আমার সুখ দেখে ওর আনন্দ হচ্ছে না হিংসে! মাঝেমধ্যে গার্গীকেও আমি বুঝতে পারি না। তবে গার্গীর স্বভাবতো পাহাড়ী আবহাওয়ার মতো। কখনও রোদ কখনও বৃষ্টি। এক্ষুণি রেগে ক্ষেপে যাবে। উল্টোপাল্টা বলবে।পরক্ষণেই মজা করে হাসতে থাকবে। পাগলী মেয়ে।
এখন রাত নটা। সমীরণ এসেছে। আমার ওপরের ঘরেই এসে বসেছে। গার্গীর সাথে ফোনে কথা হয়েছে সমীরণের। ও আসছে এখুনি। সমীরণ আমার শরীরের খবর নিচ্ছে। ঘরে নতুন সি.এল.এফের উজ্জ্বল আলো আমার স্থুল শরীরে লেপ্টে থাকা বিশালাকার স্তনে পড়ে ঠিকরে উঠছে। মনে মনে ভাবছি এতদিন পর জোড়াবুকের কদর। মা হবো আমি। নিজের সন্তানকে বুকের মাঝে আগলে রাখবো। মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে নিজের নারী জীবন সার্থক করবো। ভগবান আগে যা বলেছি সব মিথ্যে। ক্ষমা করে দিও। আমার মায়ের মতো যেন বুক কেটে বাদ না দিতে হয়।
গার্গী ঢুকলো ঘরে। এসেই সমীরণের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, ” ছারপোকার কামড় খেয়ে দিব্যি তো ঘুনপোকার মতো ছেয়ে গেলেন আমার ফ্রেন্ডের শরীরে।” সমীরণ মিটি মিটি হাসতে থাকলো গার্গীর কথা শুনে। সেই হাসি দেখে গার্গী গলার স্বরে তীব্র বিদ্রুপ এনে ঘাড় উঁচু করে বলল,” আচ্ছা সমীরণদা আপনি ও অপু অথবা আপনাদের মতো পাব্লিকরা সংসার সন্তান এগুলো কি শেষ বয়সের লাইফ ইন্স্যুরেন্স ভাবেন?” সমীরণ কথাটা বুঝতে পেরেও ঢোঁক গিলে গার্গীর কথার পাশ কাটিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ” ইডেনে আই.পি.এলের খেলা দেখতে যাবে। গতবছর শুরু হয়েছে। কাউন্টি ক্রিকেটের মতো।”
গার্গীর জবাব মুখে মুখে, ” গেম দেখতে যান,না চিয়ার লিডারের নাচ দেখতে সমীরণদা।”
সমীরণ ভাবতে পারেনি, একটা মেয়ে ওকে এইভাবে তাচ্ছিল্য করে পাল্টা দেবে।
তারপরই গার্গী আমার আলমারী থেকে শাশুড়ির দেওয়া চন্দ্রহারটা নিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরলো,
“তোরে চন্দ্রহার গড়াইয়া দিলে কে
ও চন্দ্রমুখী লো…
তোর লাইগা হইলাম দেশান্তরি।”
সমীরণ পালাবার পথ পায় না। আমার খুব মজা লাগছে।
***********
আমি এখানকার গ্রীন ভিউ নাসিংহোমে ভর্তি হয়েছি। আজ সকালেই আমার সিজার হবে। ওটি টেবিলে আমাকে তুলেছে। বাইরে এ বাড়ি ও বাড়ির সব লোক অপেক্ষা করছে। গার্গীকে বলেছিলাম আসতে, ও আসেনি। আমার স্পাইনাল কর্ডের নীচে ইনজেকশন দিল। একটু পরেই বুকের নীচ থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে গেল। আমি চোখ বুজে ঠাকুরকে স্মরণ করছি….
এখন কটা বাজে জানি না। বেডে শুয়ে আছি। শরীরের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি বোধ করছি। বাড়ির লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বাচ্চা বেডের পাশে ঘুমাচ্ছে। সবার কেন্দ্রবিন্দু আমরা মা ও ছেলে। এই সময় আমার ছেলে “ওঁয়া ওঁয়া” করে কেঁদে উঠল। খুব আস্তে কিন্তু তীক্ষ্ম কান্নার শব্দ। সমীরণ নার্সকে “সিস্টার সিস্টার” বলে তলব করলো। মামনি বলে উঠলো, “জামাই যেন ছেলে মানুষ হয়ে গেছে। বাচ্চা তো কাঁদবেই।” নার্সদিদি এলেন। সবাইকে বললেন, “আপনারা বাইরে যান। বেবি ব্রেস্ট মিল্ক খাবে।” সবাই চলে গেল কেবল মামনি থাকল। নার্সদিদি আমার কোলেতে আমার ছেলেকে দিয়েছে। আমি আধশোয়া অবস্থায় আছি স্তনপান করানোর জন্য। আমার ছেলে স্তনে মুখ দিয়েই মুখ বার করে নিচ্ছে। চুকচুক করে টানছে না! মুখ নামিয়ে “ওঁয়া ওঁয়া” করে কাঁদছে। ওর লালচে গোলাপী ছোট্ট ছোট্ট ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে।
আমার মামনি এ সব দেখতে-দেখতে নার্সদিদিকে অসহ্য হয়ে বলল, ” দেখি তো আমায় দিন একবার বাচ্চাকে।” নার্স দিদি বললেন, “আপনার বাড়ির কাপড় পরা। হাত-পাও ধোয়া নেই। ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে বেবির।” মামনি ধৈর্য হারিয়ে বললেন,” পরিষ্কার কাচা কাপড় পরে এসেছি। হাতে ডেটল জল দিন আমায়।” মামনির কথা মতো কাজ হল। মামনি আবার আমার ছেলেকে আমার বুকের কাছে এনে স্তনে মুখ ঠেকালো। আমার ছেলে স্তনে মুখ না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। মামনি হঠাৎ আমার স্তনের নিপিল টিপে দেখল, সেখান থেকে দুগ্ধ ক্ষরণ হচ্ছে না। মামনি, চিৎকার করে বলে উঠলো, ” অপা তোর বুকে দুধ আসেনি। আপেলে রস নেই রে..
তুই বড় হতভাগিনী….”
বিহ্বল হয়ে পড়লাম আমি। যেই বুক নিয়ে সারা জীবন যন্ত্রণা ছিল। আক্ষেপ মেটানোর উদগ্র বাসনা ছিল আমার, সেই ভারী বুক নিজের মাতৃত্বকে বঞ্চিত করে দিল…আমার দু’চোখের পাতা হয়ে পাহাড়ি ঝোরার মতো ক্ষীণ স্রোতে বারির ধারা। গাল বেয়ে কোলের মধ্যে থাকা ছেলের ঠোঁটে মুখে অশ্রুসিক্ত জল। সদ্যোজাত শিশু চোখ বুজে সেই ঠোঁট চাটতে লাগল….
তারিখঃ জানুয়ারি ১১, ২০২১