আঠারো ভাটির দেশে

ভাগীরথীর মিঠেজলের ফিসফিস আর সাগরের লোনাজলের উথালিপাথালি কানাকানি মিলেমিশে যখন জীবনের গান গায়-বড় তীব্র সে সুর।বড় উদ্দাম সে আহ্বান।প্রতিমুহূর্তে প্রাণের ইশারা গহনে ছুটে যাবার।

তাই তো যখন সুযোগ এল এড়াতে পারিনি সে ডাক।হোক না কিছুক্ষণের।গরাণের মধু’র আদরের সে ছোঁয়া,গরাণ ফুলের মাতাল করা সুবাস ,গর্জনের গ্ল্যামার।এড়িয়ে যেতে পারিনি, চাঁদের শুশ্রূষায় অরণ্যের জন্মপ্রক্রিয়ার চিরায়ত মোহন-রূপ প্রত্যক্ষের চাক্ষুষ আহ্বান ।

অনুরোধ উপরোধকে পাশে রেখে বেরিয়েই পড়লাম ‘ফকির বাউলে’র খোঁজে।হেতাল নড়ি হাতে কলিমের পৌরুষের দুর্জয় হুঙ্কার- বাঘে ডরায় যারে।সমুদ্রমুখী সে ভাটির দেশ।

 

গদখালি লঞ্চঘাট থেকে বিদ্যাধরীর পূর্ণ জোয়ারে ভেসে পড়ল লঞ্চ।জোয়ারের ছন্দিল মাদকতায় মিশিয়ে নিয়েছে নিজের গমক-ঊষসী(লঞ্চ), আর উজানের মূর্ছনায় আমরা কুড়িজন মনুষ্য জীব আচ্ছন্ন,চকিত-বিহ্বল।এই সেই বিদ্যাধরী,অতীতে-দু’হাজারেরও অধিক বছর পূর্বে গঙ্গারিডির মতো সমৃদ্ধ নগর বিরাজ করত।পলিস্তরের পরতে পরতে তার সমৃদ্ধ ইতিহাস আজও খোঁজ নিলে হয়তো পাওয়া যায়।

 

চলেছি গোসাবা,জয়নগরকে পাশে রেখে। কখনো দুদিকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসা কখনো বা নিরাপদ দূরত্বে পুরু ও শক্ত পাতা বিশিষ্ট ঝুপসি ম্যানগ্রোভকে পাশে রেখে অব্যাহত আমাদের যাত্রা।দুর্ভেদ্য সে জগৎ।অন্য কোনো বনাঞ্চলের সাথে যার কোনো মিল নেই। না আছে আকাশছোঁয়া গুল্মশোভিত গাছ,না আছে রঙের বাহার।কেবল সবুজের ঔদ্ধত্য।কতরকম যে সবুজের শেড!

কাদামাটি আর বাদাবনের সেই ভাটির দেশ-যার তীব্র  সম্মোহন মানুষকে বারবার কাছে টেনে নেয়। দুর্মর সে আকর্ষণ।সমুদ্র এবং বাংলার সমতল ভূমির মধ্যে যোগ সাধন করেছে এক বিশাল দ্বীপপুঞ্জ ।প্রায় তিন’শ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই দ্বীপেরা-পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মেঘনার তীর পর্যন্ত।

ছোট ছোট নদী,পাশ খাল,সূতি খাল পাশে রেখে আপন খেয়ালে চলেছে ঊষসী।আশ্চর্য প্রকৃতিক বিন্যাস-সুন্দরবনের ছোট খালও কয়েক কদম এগোবে না,বাঁক না নিয়ে।এখানে প্রকৃতি সবেতেই যেন ব্যস্ত-সমস্ত।বড়ো গতি তার।যেমন বাতাস হু হু হুঙ্কারে ছোটে নদীও সেই টানে ছন্দ মিলিয়ে জোয়ার- ভাঁটায় ছুটে চলেছে।

বিদ্যাধরীর উজানে আমরা চলেছি।কখনো মাঝনদী বেয়ে,কখনো বা উপকূল ঘেঁষে।নিতাইদা,আবাদের সেই আশ্চর্য মানুষ।যার তত্ত্বাবধানে আমাদের এই কয়েকঘন্টার ঐশ্বর্য-সুখ।নোনাজলের যুদ্ধ যার মনকে এতটুকু বিবর্ণ হতে দেয়নি। আশ্চর্য এই উপকূলবাসীরা,বাদা-আবাদের ঝঞ্ঝা- ঝাপটে,সুখে-দুঃখে,ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকে পরস্পরে।সুন্দরবনের শৌর্য,বীর্য,মাধুর্য নিয়ে এক ভিন্ন এবং অভিনব সমাজের বাসিন্দা এরা।পলিমাটি আর সবুজের প্রতিচ্ছায়ায় প্রতিপালিত-আমাদের দৈনন্দিনতার নিত্য সহায়ক লতা,প্রতিমা,অলকা এই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে তাদের পরিচয় বহন করে চলেছে নির্লোভ সেবা দিয়ে।মনে হয় এই মানুষগুলো ও সুন্দরবনের সমাজকে না জানলে অঙ্গহানি হবে সে জানার।

তবে যন্ত্রণা হয় যখন দেখতে পাই জঙ্গলেরও সামান্য বিরতিতে স্বার্থগন্ধী লাল,নীল,হলুদ,সবুজ দলীয় পতাকা-দক্ষিণরায়ের লাল-সাদা পতাকার শৌর্য ও ঔদ্ধত্যের পাশে।খেদ হয়, এই ধনের আগারে ন্যূনতম  যাপনের তাগিদে জীবন হাতে করে  ভূমিপুত্রদের প্রবেশ যখন মৃত্যুর হাতছানি হয়ে ওঠে।সুখী হতাম- আগারকে আগল দেবার কাছে দুর্জয়-দুর্বার নিরাপত্তা রক্ষী “রাজকীয় বাঙালী” মেনে নিত এই অসহায় মানুষগুলোর অনধিকার প্রবেশ।

জলের বুকে আলপনা এঁকে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ।আর জলের ক্যানভাসে আমরা কজন এঁকে চলেছি নিজের নিজের মতো করে সবুজ আর তার আলো-অন্ধকারের ছবি।শৈশব থেকে একটু একটু করে কত স্বপ্ন কত শিরশিরে রোমাঞ্চ জমিয়ে রেখেছি এই বনের নামে।সে দেশে জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ,আর আছে বাঘ-কুমিরের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা সব হারানো কিছু মানুষ। আর এক অলিখিত বন্ধনে আবদ্ধ বাদাবনের সমাজ ও সংস্কৃতি।

সরে সরে যাচ্ছে বিদ্যাধরী,হাতানিয়া,দোয়ানিয়া,মাতলা…আর

নিতাইদার সাথেও একটু একটু করে পরিচয় এগোচ্ছে।বাবা ছিলেন বাউলে বা বাওয়ালি ,চাঁদরাম।বাউলের কোনো আনুষ্ঠানিক বা প্রথাগত ভিত্তি নেই।কঠিন বাদা-বন তাকে বাস্তব শেখায়,জীবন যুদ্ধ শেখায়।একবার যে বাউলে বলে প্রতিষ্ঠিত হবে,তার আর রেহাই নেই এ দায় থেকে।বাউলেও চায় না মুক্ত হতে।তার রক্তে,শিকড়ে চারিয়ে গেছে বাদার লোনা-যুদ্ধ, অহঙ্কার।আর বাঘের মতো শক্তিশালী জীবকে বশে আনার মাঝে এক মাদকতা আছে। যে মাদকতার পথে শক্তিমত্তার সর্বনাশ আসতে পারে,নিতাইদার কথায়।বাবার কথা বলতে বলতে হারিয়ে যান শৈশবের মাঝে, “বাবার সাথে মীন ধরতে গিয়েছি কুলতলি-নেতাধোপানী ঘাটের ওপার।হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় জল-জঙ্গল কাঁপিয়ে দেওয়া ভয়ঙ্কর গর্জনে।আমি,বড়দাদা,চিত্তকাকা পলিথিন ঢাকা গলুইতে আর বাবা হাল ধরে আছে ডিঙির শেষে।

স্থির দৃষ্টি বাউলে বাবা বাঘের চোখে চোখ রেখে বেপরোয়া হুঙ্কারে কাঁপিয়ে দেয় বাদাবন।ভয়ঙ্কর সে গর্জন,বেপরোয়া সে হুঙ্কার।সে হুঙ্কারে প্রচ্ছন্ন  থাকে আমাদের বাইরে না বেরোনোর ইশারাও।” বাঘকে স্তব্ধ করতে বাউলের চোখও এই হিংস্র জন্তুর আচরণ ‘অনুকরণে সিদ্ধ’। “এখনো বাউলে আছেন?”– আনমনা চোখে-মুখে কোনো সদুত্তর পাইনি।খানিকটা এড়িয়ে গেলেন।আমিও সঠিক জানিনা,সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা।আসলে আতঙ্ক, বিরক্ত, রাগ সব নিয়েও এটাই সত্য-এই রাজ্যটাতো ওদেরই।আমাদের অনধিকার প্রবেশ এবং রাজ্যপাটে হস্তক্ষেপে শান্তি  স্বাধীনতায় বিশ্বাসী দুর্জয় প্রজারা সুযোগ পেলে ক্ষেপে তো উঠবেই।

খেয়ালের আধিক্যে জঙ্গল দেখতে যাওয়া এই শহুরে মানুষগুলোকে গানে,গল্পে, খুশি রাখার কী আপ্রাণ প্রয়াস-ওই নিরন্ন কিছু মানুষের।আঠারো ভাটির দেশের জীবন,প্রকৃতি,ইতিহাস আর লোকপুরাণ জীবন্ত চেহারায় ধরা দিল নিতাইদা এবং বশির মাঝির মধুর কণ্ঠে।

 

একটার পর একটা ছোট-বড়ো দ্বীপ পার হয়ে লঞ্চ চলেছে।কাছে-দূরে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট লঞ্চ।কত রঙে সেজেছে,রহস্য-গহীন সবুজের সাথে পাল্লা দিয়ে।নদী থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে ঘন জঙ্গলে ভরা দ্বীপের মধ্যে ঢুকে গেছে কোনও কোনো খাল।দৃষ্টি চলে না সে জঙ্গলে।যদিও বা ভুল করে আলো পথ হারায়-জমাট বাঁধা ঘন সবুজ-ধুলোর রেখায়।সে বুঝি পথ হারালো। কোনো দ্বীপের লাল-সাদা নিশান বুঝিয়ে দেয় তার মৃত্যু ফাঁদ।দক্ষিণরায়ের খাস তালুক, সাধারণের প্রবেশ নিষেধ । আর ঠিক ওখানেই মীন ধরার এক ডিঙি নৌকা অজান্তে কাঁপন ধরিয়ে দেয় মনে।কোথাও বা শুকনো ম্যানগ্রোভ আর ছোট বড় বৃক্ষ, লতা ও গুল্মের জড়াজড়ি।কত যে জানা-অজানা পাখি! সর্বত্রই জীবনের স্পন্দন।কিন্তু বড় নিঃশব্দ স্পন্দন।’নির্জীবের নিরবতা আমাদের বাঙ্ময় হয়ে উঠবার আবেগ আনে,আর সুন্দরবনের সজীবের নীরবতা মানুষকে কোরে তোলে নির্বাক’।

 

বিকেল চারটের একটু আগে আমরা এই প্রথম পা রাখলাম দক্ষিণরায়ের সাম্রাজ্যে।আম্ফান-ধ্বস্ত ঘাট,সিঁড়ি এবং পাঁকে পা ডুবিয়ে পাড়ে উঠলাম আমরা কজন।অনধিকার প্রবেশের শাস্তির চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল তীব্র হুঙ্কারে দক্ষিণরায়।আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছে অজানা আশঙ্কায়।সাথে আসা দুজন মাল্লার অভয়-বাচন খানিকটা স্বস্তি দিল।ওটা রেসকিউ সেন্টার।কাল একজন যুবককে ধরে আনা হয়েছে।সে বারবার অতি কৌতূহলে গ্রামের মধ্যে চলে যাচ্ছে।তাই শাস্তি স্বরূপ পরিখা ও খাঁচা-বন্দী।আর অসুস্থ এক বাঘিনী।যদিও তার পরাক্রম দেখলে বারবার কেঁপে উঠেছি।অসুস্থ বলে একবারও মনে হয়নি।

 

আশ্চর্য হয়েছি বারবার,উপর্যুপরি বুলবুল,আম্ফান বিধ্বস্ত মানুষগুলোর নিরলস চেষ্টায় রাস্তাঘাট, নদীর পাড়,মাটির উঁচু উঁচু বাঁধ-দ্বীপ জীবনের নিরাপত্তায় যার প্রধান ভূমিকা তৈরি হয়েছে দরিদ্র মানুষগুলোর আত্মিক ও নিরলস চেষ্টায়।প্রতিটা জমির চারদিকে ঘেরা হয়েছে বেড়া দিয়ে। কতটা সরকারি বদান্যতায় তা আমি জানিনা।যেটুকু জেনেছি স্থানীয় মানুষের সাথে আলাপচারিতায়।চোখের সামনে যা দেখছি সেই প্রচেষ্টার  সাথে বাধ্যবাধকতার কিছু মূলগত ফারাক আছে।কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর ভাবনা কেবলমাত্র নয়।যারা এখানে বসত করছে এ ইচ্ছা, এ স্বপ্ন তাদের নিজেদের আর সেই স্বপ্নকেই বাস্তব করে তুলতে তাদের নিরলস চেষ্টা। আশ্চর্য হতে হয় শৃঙ্খলা ও পরিশ্রম দেখে।দুর্গম শ্বাপদসঙ্কুল বন।যেখানে জীবনধারণের জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই জারি থাকে-বাঘের গর্জন,কুমীরের ভয়াল দাঁত,সাপের হিংস্র ফনার ঔদ্ধত্য, হরিণের আর্তনাদ আর নিঃস্ব মানুষের যন্ত্রণাময় কান্নায়।

 

ত্রিস্তর বিশিষ্ট নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মাঝখান দিয়ে আমাদের চলা-এই প্রথম দেখতে পেলাম সুন্দরবনের অহঙ্কার-ছোট বড়ো বর্শার ফলার মতো শক্ত শক্ত শ্বাসমূল বা শূলো।কোথাও কম ,কোথাও বেশি।শুনলাম, কোথাও এই শ্বাসমূল এত বড়ো হয় যে এর আড়ালে বাঘ নিজেকে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে।জীবন যুদ্ধের প্রাকৃতিক নিয়মে হয়তো বা বাঘের পিঠের ঐ কালো ডোরা ডোরা দাগ , যা কখনো শ্বাসমূলের সাথে একাকার হয়ে যায়।না হলে রয়্যাল বেঙ্গলের রয়্যাল যাপন আর জীবিকার সংগ্রাম হয়তো সম্ভব হতো না।

 

চোখ দুটোর খোঁজ ছিল সেই ছোট্ট চেহারার দুর্জয় মানুষটির।রক্তে যার সুন্দরবন আর ‘লোনা-পানীর জোয়ার’। “আজও হয়তো  ঘুরে বেড়ায় মাথায় গামছা ছড়িয়ে, হাতে বে-পাশী বন্দুক ঝুলিয়ে, স্থির সন্ধানী ও অপলক দৃষ্টিতে-সুন্দর বনের রন্ধ্রে,ব্যাঘ্রের ‘আঁটি’ ও ঘাটির সন্ধানে”–‘সুন্দরবনে আর্জান সর্দার’।

ঝড়খালির বাদিক ঘিরে উঁচু বাঁধ।বাঁধের একটু নিচে ভেড়ি আর এখানেই ছিল ঘেরের ক্রস।যেন মিঠে মাটির দেশের আল।তার পাশে পাশে সবুজ ক্ষেত আর চাষের জন্য  সঞ্চয় করা বৃষ্টির মিঠে জল।ভয় ধরা প্লাবন-মিঠে জল , নোনাজলকে একাকার করে দেয়।পুড়িয়ে দেয় বছরভর খাদ্যের আশা।আবাদের বেশিরভাগ বাড়ি ভেড়ির কোলে নদী ঘেষা।বনের তরাসের মতো কাঁকড়ার তরাসও একসাথে বেঁধে রাখে এই মানুষগুলোকে।মাটির বাঁধে গুপ্ত ঘাতকের মতো নিঃশব্দে সংসার পেতে সুড়ঙ্গ তৈরি করে।জলের সামান্য চাপে ভেড়ির ঘোঘা বা সুড়ঙ্গ দিয়ে নোনা জল চুঁইয়ে এসে ফসলের ফলন কমিয়ে দেয়।

 

ঝড়খালির সবুজ অহঙ্কারে দেখতে দেখতে চলেছি,গেয়ো,গরান,হেঁতাল (খুব কম)আর কত যে অজানা গাছ।সুবল মাঝির কাছে হেঁতাল নুড়ি চাইলাম,বন্ধুকে কথা দিয়েছি যে।কিন্তু সব গাছই ওই দুর্ভেদ্য ব্যারিকেডের বাইরে।অগত্যা- কাঁটা ও পাতা ছাটা হেঁতাল নড়ি এক বাউলের জিয়ন কাঠি, চাইল না শহুরে স্মৃতির ভার বাড়াতে।

আমাদের ফেরার সময় হয়ে এল।মন ভর্তি করে নিয়ে চললাম দক্ষিণরায়ের রাজ্যপাটের কাদামাটির সুবাস।

মউলে,মাঝি ও জেলেদের নৌকাগুলো মাঝে মাঝে  দূরে জঙ্গলের কাছে দেখা যাচ্ছে।দুটো ছোট নৌকা সুতি খালের গহীনে একঝলক দেখা দিয়েই আড়াল করে নিল নিজেকে।অবচেতনে প্রার্থনা জানাল মন।দক্ষিণরায় এবং বনবিবির পুজো দিয়ে তো ওরাও বাড়ির বার হয়।কোচর ভর্তি পটকা আর মুখোশের সম্বলে।কিন্তু মানুষের গলার স্বর আর আছাড়ি পটকার শব্দ সুন্দরবনের বাঘকে দূরে না পাঠিয়ে আরো কাছে টানে-মৃত্যুর কাছে।

 

বেলাশেষের স্তিমিত আলোয় জলের ছায়ায় সবুজ কলকা পাড়ে লাল-কমলা ডুরে আজ অস্তরাগের প্রসাধনীতে ঢেউ তুলেছে প্রাণে।

বদলে গেছে চারপাশ।প্রকৃতির নিপুণ তুলির আঁচড়ে।আবছা আঁধারে ঢাকা দ্বীপগুলো এক একটা সবুজ স্বপ্নলোক।জ্যোৎস্না ধোঁয়া আলোয় গোটা নদীর বিস্তার জুড়ে রুপোলি পাত।ছুঁয়ে যায়  শহুরে মনের হাজারো প্রশ্ন, আবাদের আলো অন্ধকারে।

 

হঠাৎ নিতাইদার চাঞ্চল্য এবং নদী জুড়ে তীব্র সার্চলাইটের বলয় খবর দেয় বেশ কয়েকদিন ধরে মানুষের (গোসাবার)সঙ্গ পেতে উৎসুক বাঘিনী আমাদের একশো মিটার দূরে।বনদপ্তর এবং জল সম্পদ রক্ষকের সন্ধানী চোখ আর তর্জন গর্জন ফুৎকারে নস্যাৎ করে সে তার অভীপ্সা বজায় রেখেছে।সকলের অনুরোধ সত্ত্বেও কেবিনের নিরাপত্তায় আটকে থেকে এই সুযোগ হারাতে চাইনি।কিন্তু দেখা হল না…

 

সারাদিনের সঞ্চয়ে কুড়িয়ে নিয়েছি অনেক অনেক মণিমুক্তো।ছুঁয়ে দিতে চেয়েছি সরল,সবল ও প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা মানুষগুলোর সহজ মনের তরঙ্গগুলো।আর ঐ ঘন দুর্ভেদ্যর অব্যক্ত ইশারা।

আমার কানে যেন ভেসে আসছে ডিঙির কোণে কোণে, গলুইতে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিয়ে ‘বেদে বাউলে’র যাত্রামন্ত্রের সেই বয়ান,দিগ্বিদিক তোলপাড় করা সেই আর্ত মূর্ছনা, আশ্বাসবাণী–

 

“বদরের পায়ে দিয়ে ফুল।

বেড়ে ওঠো নদীর কূল ।।

মুখে বলো হরি হরি।

গুরু আছে কাণ্ডারি।।

লাও ভাই বদরের নাম।

গাজী আছে লেখাপান।।

দরিয়ায় পাঁচ পীর।

গাজী বদর বদর।”

তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse