দণ্ডিতের সাথে
সুকন্যা মিশ্র
শীর্ণ চেহারার লোকটিকে মাঝে মধ্যেই দেখতাম, বাইরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। আন্দাজ পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের লোকটির পরনের বেশবাস ছিল অতীব জীর্ণ। আমার গিন্নির নজরে এলে তাকে উঠোনে বসিয়ে কিছু খেতে দিত। এরপর তাকে উঠোন ঝাঁটানো বা মাটি কোপানো এজাতীয় কিছু কাজ দিতে হত। আমার বছর চারেকের কন্যার সঙ্গে তার বেশ ভাব ছিল। মেয়ের অবান্তর প্রশ্নের জবাবে লোকটি কিন্তু কখনও বিরক্ত হত না বরং মেয়েকে দেখলে ওর ম্রিয়মাণ চোখমুখ খুশী খুশী হয়ে উঠত।
অফিসের কাজ বাড়ি থেকে করার অনুমতি নিয়ে আমি, স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে ঘাটশিলায় এসে উঠেছি। উদ্দেশ্য ছিল, কিছুদিনের জন্য মেয়েকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে, খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া। আমার স্ত্রীর এক প্রবাসী বন্ধু আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
এখন হেমন্তের নরম আবহাওয়ায় রয়েছে শীতের আগমনবার্তা। আমরা কখনও কখনও তিনজনে মিলে গ্রামের ভেতরে হাঁটতে বেরোই। মেয়ে কখনও ছাগলছানাকে তাড়া করে, কখনও লাল মাটি মেখে খুদে খুদে দাঁত বের করে হাসতে থাকে, কখনও হাঁস-মুরগির ছানাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না করে আবার কখনও বা স্থানীয় বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলোয় মেতে ওঠে। বিকেল হলে মাঝে মাঝে আমরা সুবর্ণরেখা নদীর ধারেও যাই। মেয়ের উচ্ছ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, আমরা বুঝি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আপাতদৃষ্টিতে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ মনে হয়। আমরা, কোনোদিন হয়ত এদের মত সহজভাবে জীবন কাটাতে পারব না , তবুও ওদের এই নিশ্চিন্তের জীবনটাকে দূর থেকে দেখতে ভারী ভালো লাগে। ওদেরও হয়ত ওদের জীবনযাপন সম্পর্কে বহুবিধ অভিযোগ আছে। সেই, নদীর এপার আর ওপারের গল্পের মত। সন্ধ্যা নেমে এলে, বাড়ি ফেরার পথে ভাবি,ফ্ল্যাটবাড়ির সেই রোজের একঘেয়ে জীবনের চেনা ছকের বাইরে, মনে রাখার মত এক চিলতে ছোটবেলা তো আমরা মেয়েকে উপহার দিতে পারলাম।
সেই লোকটি এখন রোজ আসে। ওর নাম পাশা। ওকে দেখে, ও যে খুবই অভাবী এবং আমার মেয়ের টানেই আমাদের বাড়িতে আসে তা বোঝা যায়। যদিও নিজের সম্পর্কে কোনো কথা ও আজ পর্যন্ত বলেনি। মনে মনে ভাবি,বেচারা দু’বেলা দুমুঠো ভাত তো পাচ্ছে, মেয়েরও খেলার সঙ্গী হয়ে উঠেছে, অতএব আসতে দিতে আর বাধা কোথায়। পাশা, ছোটদের সঙ্গে যতটা স্বচ্ছন্দ, বড়দের সঙ্গে একেবারেই তা নয়। পাশার সহায়তায়, বাগানে কিছু সবজি আর ফুলের গাছ লাগিয়েছি। এখানে এসে মৌমাছির ফুলের মধু সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে, পিঁপড়ের শীতের সঞ্চয়ের জন্য ব্যস্ত পায়ে ঘোরাঘুরি করা, গাছ থেকে শুকনো পাতার বাতাস সাঁতরে হেলেদুলে মাটি ছোঁয়া, পাখির ডাক শুনে বাপ মেয়েতে মিলে তাকে পাতার আড়াল থেকে খুঁজে বের করা কিংবা প্রজাপতির পেছনে খিলখিল হাসিতে মেয়ের দৌড়োনো পর্যন্ত সবটুকুই ভীষণভাবে উপভোগ করি, কিচ্ছু বাদ দিইনা। বাগানের একটা চৌবাচ্চা থেকে গাছে জল দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়ে সকালে বাজার থেকে নিয়ে আসা জ্যান্ত মাছ ওখানে ছেড়ে দেয়। তারপর সেই মাছ ধরা নিয়ে, আমাদের বাপ মেয়েতে হুড়োহুড়ি চলে। আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে পাশার বিষণ্ন মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফোটে। বেলা দশটার পরে, আমি অফিসের কাজে ল্যাপটপে আর ওর মা ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশা তখন থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত মেয়ের বায়নাক্কা সামলায়। মেয়ে ওর সঙ্গে আনন্দে থাকে আর আমরাও স্বল্প দিনের পরিচিত পাশার কাছে মেয়েকে রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।
এভাবেই হেমন্তের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। সেদিন অনেকটা বেলা হলেও পাশা আসেনি তখনও। সূর্য যখন প্রায় মাথার ওপরে, তখন ও এল। মেয়ে গেছে স্নানে। আমি উঠোনের বাঁধানো আমগাছের তলায় তাকে বসতে বলে নিজেও বসলাম। তার সঙ্গে আলাদাভাবে পরিচয় না থাকার কারণে, পাশা একটু অস্বস্তি বোধ করে। কথায় কথায় তার বাড়ির ঠিকানা,পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে জানতে চাই। প্রশ্ন শুনে ও কেমন অস্থির হয়ে যায়। তারপর অনেকক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলে,-
“বাপে নাম রেখেছিল পশুপতি, সেই থেকে পাশা। নয় ভাইবোনের মধ্যে আমিই ছিলাম বড়। বাবার রোজগার তেমন ছিল না। অভাবী সংসারে মা যে কীভাবে আমাদের এতজনের খাওয়ার জোগাড় করত তা ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে। একটু বড় হলে, আমার উপর সংসারের দায়িত্ব পড়ে। উপার্জনের চেষ্টায় ধীরে ধীরে একটা দলের সঙ্গে নানারকম অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লাম। পয়সাপাতি ভালোই উপার্জন করতে লাগলাম। নেশা আর মেয়েমানুষে বেলাগামভাবে জীবন চলতে থাকল। এভাবেই কেটে গেল প্রায় বছর কুড়ি। একদিন পরিচয় হল ‘কান্দি’ নামে এক বিধবা মহিলার সঙ্গে। অনেক মেয়েলোকের সঙ্গে মিশেছি, কিন্তু ছোটখাটো চেহারার কান্দির মধ্যে কি ছিল জানি না, আমি কেমন যেন বাঁধা পড়ে গেলাম। ঘনঘন যাতায়াত শুরু হল। ওর কাছে যাওয়ার আরেকটা আকর্ষণ ছিল ওর বছর দশেকের মেয়ে। ছোট্ট বোবা মেয়েটি নির্বাক চাহনিতে এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল আমায়। কল্পনায়, ভবিষ্যতের আবছা আবছা স্বপ্নের আনাগোনা হত। ইচ্ছে হত, মা মেয়েকে নিয়ে এই এলোমেলো জীবনটায় একটু থিতু হই। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব মিলল না। একবার কী কারণে বাইরে যেতে হয়েছিল। কয়েকদিনের অদেখায় কান্দির জন্য মন বড় উতলা ছিল। ফিরে এসে, আকণ্ঠ মদ গিলে, গেলাম কান্দির ঘরে। দেখলাম ঘরের দরজার পাল্লাদুটো ভেজানো রয়েছে। লন্ঠনের আলো আঁধারিতে বিছানায় কান্দিকে একা শুয়ে থাকতে দেখে, ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু দেখলাম সে হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। আমার মধ্যের পুরুষ সিংহটা তখন জেগে উঠেছে, আমিও বাঁধন আলগা করলাম না বরং তার মুখ চেপে ধরলাম। তারপর হঠাৎই এক ধাক্কায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালাম। সেদিন বিছানায় ছিল কান্দির মেয়ে আর তার মা গিয়েছিল ঘরের কাছেই,নদীতে। মাতাল অবস্থায়, আমি তার মেয়েকে,কান্দি ভেবে ভুল করেছিলাম। জ্ঞান ফিরতে বুঝলাম রক্তে ভেজা গা, হাত-পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। ততক্ষণে নেশার ঘোর কেটেছে। আমাকে ঘিরে রয়েছে গ্রামবাসীর জোড়া জোড়া ঘৃণিত দৃষ্টি।”
কিছুক্ষণ থেমে সে বলে চলল, “গ্রামের লোক সেদিন আমাকে শুধু প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছিল। একমুহূর্তের মধ্যে, আমার জীবন ওলট পালট হয়ে গেল। বিগত কয়েক মাস ধরে দানা বাঁধতে চাওয়া স্বপ্নগুলো, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। নিজের পরিবার,ভালোবাসার জন কান্দি, সন্তানসম কান্দির মেয়ে, গ্রামের লোক সবাই বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। নিজের কৃত অপরাধের জন্য মরমে মরে গেলাম আমি। কিন্তু সেদিন আমি ক্ষমা চাওয়ার কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি। কারণ, সেদিন যদি অন্য কেউ কান্দির মেয়ের ওপরে ওই অত্যাচার করত,তাকে তো আমি প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতাম না।” আমি বললাম, “তারপর কী করলে?” পাশা বলল, “ওরা আমায় গ্রাম থেকে বের করে দিল। মনেপ্রাণে নিঃস্ব অবস্থায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দিন কাটতে লাগল আমার। কিন্তু ক্ষিদে বড় বালাই। টুকটাক কাজ করে, চেয়ে চিন্তে পেট চলতে লাগল। চেনা লোকজনের মুখোমুখি হলে সে কাজও আর থাকত না। এভাবেই কেটে গেছে সতেরো বছর। নদীর ধারে এক ছাউনি করে থাকি। সেদিনের সেই দুর্ঘটনা আজও নিদারুণ কষ্ট দেয় আমাকে। সেই ঘটনার আগের মুহূর্তে যদি ফিরতে পারতাম তাহলে সব পাল্টে দিতে পারতাম।”
“সে রাত্রে, এক মুহূর্তে একইসঙ্গে আমি এক মেয়ের, তার মায়ের, আমার আত্মীয় পরিজন সবার বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হয়েছিলাম। কিন্তু আমি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করিনি। বিশ্বাস করুন, আমি জেনে বুঝে মেয়েটার ওপর অত্যাচার করিনি। আমি লোকটা খারাপ হতে পারি,অনেক খারাপ কাজ করতে পারি, কিন্তু যাকে নিজের মেয়ের মত মেনে এসেছি, তার ওপর অত্যাচার করব এমন নরাধম নই। সেই রাত্রে কান্দি তার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যে চলে যায় কেউ আর কোনোদিন তার খোঁজ পায়নি। যাদের কাছে অপরাধ করেছিলাম, সেই মা ও মেয়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আর কোনো সুযোগই হয়নি। কয়েকবছর আগে ক্ষমা প্রার্থনার আর্জি জানিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। মুরুব্বীদের বললাম, যে মানুষ ওই কাজ ঘটিয়েছিল সে মরেছে আমি আজ অন্য মানুষ। কেউ আমার কোনো কথাই শুনতে চায়নি, সবাই মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। আমায় কেউ একবার বলুক,অমুক সাজা দেওয়া হবে। আমি এখনই তা মাথা পেতে নেব, কিন্তু প্রতিদিন সবার ঘৃণার পাঁকে আফসোস করতে করতে বেঁচে থাকতে আমি আর পারছি না। আমি একবার….একবার মানুষের মত বাঁচতে চাই। ”
এই পর্যন্ত বলে পাশা আর কথা বলতে পারল না। মানুষটা শিশুর মত কাঁদছে। না জানি এই সতেরো বছরে আরও কতবার ওকে, ওর কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হয়েছে। পাশার অপরাধের কি সত্যিই ক্ষমা নেই? সে তো তার কৃতকর্মের জন্য প্রতি মুহূর্তে মরে গিয়ে বেঁচে আছে। প্রতিটি ক্ষণ সবার ঘৃণার মধ্যে বেঁচে থাকা কি যথেষ্ট শাস্তি নয়? আমরা অপরাধের বিচার করি না,বিচার করি অপরাধীর। একসময় যে একটি অপরাধ করেছে, সে যদি তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়, কেন তার জীবনের মূল স্রোতে ফেরার অধিকার থাকবে না? সবাই ওকে এখনও চিনে রেখেছে অপরাধী হিসেবে। আমরা হয়ত অপরাধী চিহ্নিতকরণেই পৈশাচিক আনন্দ পাই। দণ্ডিতকে দণ্ড দিয়ে তাকে আজীবন অপরাধী হিসেবে দোষারোপ করেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায়। সুস্থ জীবনে ফিরে সেও তো আজ সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারত। তার অতৃপ্ত শূন্য হৃদয় নিস্ফল প্রয়াসে আজ মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ায় শুধু একটিমাত্র শব্দের প্রয়োগের অপেক্ষায়, ‘ক্ষমা’।
কিন্তু এ তো গেল যুক্তির কথা। এরপরে কি আমি আমার প্রাণাধিক প্রিয় মেয়েকে পাশার সঙ্গে, আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে নিশ্চিন্তে সময় কাটাতে দিতে পারব? কখনও কি সন্দেহের কালো মেঘ আমার মনে ছায়া ফেলবে না? পারব কি, ওর ইতিহাসকে সম্পুর্ন ভুলে গিয়ে ওকে যেমন দেখেছি সেভাবেই একজন মানুষের মর্যাদা দিতে? আমি মানি,ক্ষমা মহৎ ধর্ম। কিন্তু আমি কি ততখানি মহৎ হতে পারব,যেখান থেকে কৃতকর্মে অনুতপ্ত এক মানুষকে ‘বলাৎকারী’ তকমার বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র একজন ‘মানুষ’ হিসেবে ভাবতে পারা যাবে?
ভাবনায় ছেদ পড়ল। দেখলাম, স্নান সেরে, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলে আমার মেয়ে পাশাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এলো। দ্বিধাবিভক্ত আমার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ও পাশাকে দেরিতে আসার জন্য জবাবদিহি করতে লাগল। তারপর তার হাত ধরে, চৌবাচ্চার কাছে গিয়ে, মরা মাছ কেমন করে উল্টে জলে ভাসছিল, তা হাত পা মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল। আমি বসেছিলাম গাছের ছায়ার আলো আঁধারিতে আর দুপুরের ঝলমলে রোদে, ওদের দু’জনের মুখদুটি কী ভীষণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল! শিশুমনের নিষ্পাপভাবকে যদি আমরাও ধরে রাখতে পারতাম, হয়ত আমাদের জীবন এত জটিল হত না। ভাগ্যিস! আমার মেয়ে এখনও অতীতের ঘটনা দিয়ে মানুষকে বিচার করতে শেখেনি! আমাদের মধ্যে কে তবে আসল অপরাধী? পাশা? যে তার কৃত অপরাধে অনুতপ্ত, নাকি যারা ওকে অপরাধী হিসেবে দাগিয়ে রেখে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দিচ্ছে না, তারা?
তারিখঃ জুলাই ৬, ২০২১